গানে গানে শ্রীরামকৃষ্ণ
“পড়িয়ে ভবসাগরে ডুবে মা তনুর তরী।
মায়া-ঝড় মোহ-তুফান ক্রমে বাড়ে গো শঙ্করী।।
একে মন-মাঝি আনাড়ি, তাহে ছজন গোঁয়ার দাঁড়ি,
কুবাতাসে দিয়ে পাড়ি, হাবুডুবু খেয়ে মরি।
ভেঙে গেল ভক্তির হাল; ছিঁড়ে পড়ল শ্রদ্ধার পাল,
তরী হলো বানচাল, উপায় কি করি;-
উপায় না দেখি আর, অকিঞ্চন ভেবে সার;
তরঙ্গে দিয়ে সাঁতার, শ্রীদুর্গানামের ভেলা ধরি।।” দেওয়ান রঘুনাথ রায় (সিন্ধু ভৈরবী, আড়াঠেকা)
ভয়ঙ্কর রকমের একটা উদ্বেগের নাম—ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। সংসারী জীব তোমরা, তোমাদের কী হবে! আমি তো আমার কথা ভাবতে আসিনি—নিজের সাধনা, নিজের মোক্ষ! আমি এসেছি তোমাদের জন্য। কি দেখছি জান? “জীব যেন ডাল। জাঁতার ভিতর পড়েছে, পিষে যাবে। তবে যে-কটি ডাল খুঁটি ধরে থাকে, তারা পিষে যায় না। তাই খুঁটি অর্থাৎ ঈশ্বরের শরণাগত হতে হয়। তাঁকে ডাক, তাঁর নাম কর, তবে মুক্তি। তা নাহলে কালরূপ জাঁতায় পিষে যাবে।”
“এমনি মহামায়ার মায়া রেখেছে কি কুহক করে।
ব্ৰহ্মা বিষ্ণু অচৈতন্য জীবে কি জানিতে পারে।।
বিল করে ঘুনি পাতে মীন প্রবেশ করে তাতে।
গতায়াতের পথ আছে তবু মীন পালাতে নারে।।
গুটিপোকায় গুটি করে পালালেও পালাতে পারে।
মহামায়ায় বদ্ধ গুটি, আপনার নালে আপনি মরে।।” কুমার নরচন্দ্র (কালেংড়া, একতাল)
মায়া কি? মায়া হলো কামিনী-কাঞ্চন। ভোগ, আরো ভোগ, শেষে দুর্ভোগ। তাহলে কি হবে? সবাইকে সন্ন্যাসী হতে হবে? সংসারবিমুখ হতে হবে? না সংসার ত্যাগ করলেই কি মায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়! মনটাই তো সব। মনে ত্যাগ করতে হবে।
“আয় মন, বেড়াতে যাবি।
কালী-কল্পতরুমূলে রে (মন) চারি ফল কুড়ায়ে পাবি।
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।
ওরে বিবেক নামে তার বেটা, তত্ত্ব-কথা তায় সুধাবি।।
শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্য ঘরে কবে শুবি।
যখন দুই সতীনে পিরিত হবে, তখন শ্যামা মাকে পাবি।।
অহঙ্কার অবিদ্যা তোর, পিতামাতায় তাড়িয়ে দিবি।
যদি মোহগর্তে টেনে লয়, ধৈর্যখোঁটা ধরে রবি।।
ধর্মাধর্ম দুটো অজা, তুচ্ছ খোঁটায় বেঁধে থুবি।
যদি না মানে নিষেধ, তবে জ্ঞানখড়ো বলি দিবি।।
প্রথম ভার্যার সন্তানেরে দূর হতে বুঝাইবি।
যদি না মানে প্রবোধ, জ্ঞান-সিন্ধু মাঝে ডুবাইবি।।
প্রসাদ বলে, এমন হলে কালের কাছে জবাব দিবি।
তবে বাপু বাছা বাপের ঠাকুর, মনের মতো মন হবি।।” রামপ্রসাদ সেন (প্রসাদী, একতাল)
সত্য বলছি, তোমরা সংসার করছ এতে দোষ নাই। তবে ঈশ্বরের দিকে মন রাখতে হবে। তা নাহলে হবে না। এক হাতে কর্ম কর, আরেক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাক। কর্ম শেষ হলে দুইহাতে ঈশ্বরকে ধরবে। মন নিয়ে কথা। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত। মন যে-রঙে ছোপাবে সেই রঙে ছুপবে। যেমন ধোপাঘরের কাপড়। লালে ছোপাও লাল, নীলে ছোপাও নীল, সবুজ রঙে ছোপাও সবুজ। বিবেক-বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়। সংসার-সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক-বৈরাগ্য-হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বরই সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য; দুদিনের জন্য। এইটি বোধ আর ঈশ্বরে অনুরাগ। তাঁর ওপর টান-ভালবাসা। গোপীদের কৃষ্ণের ওপরে যেরূপ টান ছিল। একটা গান শোন—
“বংশী বাজিল ঐ বিপিনে।
(আমার তো না গেলে নয়) (শ্যাম পথে দাঁড়ায়ে আছে)
তোরা যাবি কিনা যাবি বল গো।।
তোদের শ্যাম কথার কথা।
আমার শ্যাম অন্তরের ব্যথা (সই)।।
তোদের বাজে বাঁশী কানের কাছে।
বাঁশী আমার বাজে হৃদয়মাঝে।।
শ্যামের বাঁশি বাজে, বেরাও রাই।
তোমা বিনা কুঞ্জের শোভা নাই।।” অজ্ঞাত (কীর্তন, একতাল)
মূলকথাটি কি বল তো! মূলকথা ঈশ্বরে রাগানুগা ভক্তি। আর বিবেক- বৈরাগ্য। গুরুর কি প্রয়োজন! সচ্চিদানন্দই গুরু। ফিলজফিতে কি আছে! কেবল হিসাব-কিতাব। কেবল বিচার। যদি রাগভক্তি হয়, অনুরাগের সহিত ভক্তি, তাহলে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। রাগভক্তি, শুদ্ধাভক্তি, অহেতুকী ভক্তি। যেমন প্রহ্লাদের।
“আমি মুক্তি দিতে কাতর নই
শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই।
আমার ভক্তি যেবা পায় তারে কেবা পায়,
সে যে সেবা পায় হয়ে ত্রিলোকজয়ী।।
শুন চন্দ্রাবলী ভক্তির কথা কই,
মুক্তি মিলে কভু, ভক্তি মিলে কই।
ভক্তির কারণে পাতাল ভবনে,
বলির দ্বারে আমি দ্বারী হয়ে রই।।
শুদ্ধাভক্তি এক আছে বৃন্দাবনে,
গোপ-গোপী বিনে অন্যে নাহি জানে।
ভক্তির কারণে নন্দের ভবনে,
পিতাজ্ঞানে নন্দের বাধা মাথায় বই।” অজ্ঞাত (মনোহর সাহী, ঝাঁপতাল) )
কথাটা কি জান? কে চায়? মাগ-ছেলের জন্যে লোকে একঘটি কাঁদে, টাকার জন্যে লোকে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, কিন্তু ঈশ্বরের জন্যে কে কাঁদছে! খুব ব্যাকুল হয়ে কাঁদলে তাঁকে দেখা যায়।
“ডাক দেখি মন ডাকার মতো কেমন শ্যামা থাকতে পারে।
কেমন শ্যামা থাকতে পারে, কেমন কালী থাকতে পারে।।
মন যদি একান্ত হও, জবা বিশ্বদল লও,
ভক্তি-চন্দন মিশাইয়ে (মোর) পদে পুষ্পাঞ্জলি দাও।।”
তাই নাম কর। সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা কর যাতে ঈশ্বরেতে অনুরাগ হয়। আর যেসব জিনিস দুদিনের জন্য—যেমন টাকা, মান, দেহের সুখ—তাদের ওপর যাতে ভালবাসা কমে যায়, প্রার্থনা কর। বলো—
“মজল আমার মনভ্রমরা, শ্যামাপদ নীলকমলে,
(শ্যামাপদ নীলকমলে, কালীপদ নীলকমলে)
যত বিষয়মধু তুচ্ছ হলো কামাদি কুসুম সকলে।
চরণ কালো ভ্রমর কালো, কালোয় কালো মিশে গেল,
পঞ্চতত্ত্ব প্রধান মত্ত, রঙ্গ দেখে ভঙ্গ দিলে।
কমলাকান্তেরই মনে আশাপূর্ণ এতদিনে,
তায় সুখ-দুঃখ সমান হলো আনন্দ-সাগর উথলে।” কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (সিন্ধু, গোস্তা )
সংসারে কাম, ক্রোধ—এইসবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, নানা বাসনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, আসক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ কেল্লা থেকে হলেই সুবিধা। গৃহ থেকে যুদ্ধই ভাল, খাওয়া মেলে, ধর্মপত্নী অনেক রকম সাহায্য করে। কলিতে অন্নগত প্রাণ—অন্নের জন্যে সাত জায়গায় ঘোরার চেয়ে এক জায়গাই ভাল। গৃহে কেল্লার ভিতর থেকে যেন যুদ্ধ করা।
আসল কথা হলো—বাসনার ক্ষয়। মনে বাসনা থাকলে সংসারেই থাকি অথবা অরণ্যেই থাকি, মুক্তি অসম্ভব। তপস্যা তো ঐ বাসনার ক্ষয়ের জন্য। সে তো শুধু সাধু-সন্ন্যাসীরা করবে। সংসারী কি করবে? ঠাকুর বললেন, মায়ের নাম কর। হরিনাম কর। নামেই সব ক্ষয় হবে। গানে আছে :
“মনে বাসনা থাকিতে কি হবে বল না জপিলে তুলসীমালা।
চিতে কামনা থাকিলে নাকে তিলক কাটিলে ভোলে কি চিকনকালা।।
যোগের নিধি মিলত যদি পরিলে কৌপীন ঝোলা।
তবে ত্যজে স্বর্ণকাশী হইয়ে সন্ন্যাসী শ্মশানে যেত না ভোলা।।
তাই বলি ওরে পামর মন সদা হওরে হরিবোলা।
ভবে স্বার্থ পরিহরি মুখে বল হরি চেয়ে দেখ গেল বেলা।।
ভক্তের তরে হরি রাখালিয়া সনে বনেতে করিতেন খেলা।
সে যে ভক্তিডোরে বাঁধা বহিতেন নন্দের বাধা, নন্দালয়ে নন্দলালা।।” (বাউল, একতাল)
আহা! আমাদের ভক্তিতে বাঁধা ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ-
“ওহে রাজরাজেশ্বর, দেখা দাও!
করুণাভিখারি আমি, করুণা কটাক্ষে চাও।।
চরণে উৎসর্গ দান করিতেছি এই প্রাণ,
সংসার-অনলকুণ্ডে ঝলসি গিয়াছে তাও।
কলুষ-কলঙ্কে তাহে আবরিত এ-হৃদয়;
মোহে মুগ্ধ মৃতপ্রায়, হয়ে আছি দয়াময়,
মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রে শোধন করিয়ে লও।।” স্বর্ণকুমারী ঘোষাল (পরজ, আড়াঠেকা)