গল্প গড়ে, গল্প ভাঙে
কোন ছোটোগল্প যে কী করে মাথাতে আসে তা বলা যায় না। তবে বড়ো উপন্যাসের কথা আলাদা। তার আরম্ভ ও শেষ অনেক সময় আগে থেকে ঘোরে-ফেরে। আবার অনেক ধারাবাহিক লেখা আরম্ভ করার পর লিখতে লিখতেই ভাবতে হয়। তা ছাড়া এক একজনের লেখার পদ্ধতি এক একরকম। অনেকে যেমন অগ্রজ ও মহৎ মিতলেখক সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী সারাবছর ধরে অগণ্য কাপ চা খান, কিছু পান এবং অনেক সিগারেট খেতে খেতে উপন্যাসটি নিয়ে ভাবেন। বছরে উনি মাত্র একটিই উপন্যাস লিখতেন। সারাবছরই উপন্যাসটির নায়ক-নায়িকার সঙ্গে কল্পনাতে ঘর করতেন এবং যখন উপন্যাসটি লেখা আরম্ভ করতেন তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে, তখন আর একটি শব্দও কাটতেন না।
আমার লেখাতে খুবই কাটাকুটি হয়। তা ছাড়া আমার হাতের লেখাও জঘন্য। শ্রদ্ধেয় প্রেমেন্দ্র মিত্রকে (তাঁকে প্রেমেন মামা বলতাম আমি। কারণ উনি আমার বড়োমামা অন্ত্যমিল দেওয়া কবিতা লেখা কবি সুনির্মল বসুর বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। আজকাল তো অন্ত্যমিল দিয়ে যাঁরা লেখেন তাঁদের গদ্যকবিতা লিখিয়ে কবিরা ‘কবি’ বলে মানেন না।) জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার লেখাতে ভীষণ কাটাকুটি হয়। কী করা যায়? উনি হেসে বলেছিলেন, কাটাকুটি সকলেরই হয়। কেউ মনে মনে কাটেন, কেউ লিখে কাটেন। তা ছাড়া আমরা তোমাদের মতো বেশি লিখি না। অত লিখলে মনে কাটাকুটি করার সময় কোথায় পাবে?
এখন বুঝি, প্রেমেন মামার কথাতে ভারও ছিল যেমন, তেমন ধারও ছিল। কিন্তু আমরা যে দায়ে পড়ে এত বেশি লিখি, তা কি ওঁরা জানতেন? এখন লেখালিখিও এক ধরনের Rat Race. Either run or drop out. There is no inbetween way.
যাকগে, অন্য কথাতে ফিরে যাই। গল্পের প্লট তো একজন লোকের মাথাতে প্রতিমুহূর্তেই আসে আবার হারিয়ে যায়। মাঝরাতে মাথাতে ভোমরার মতো শব্দ করে ভনভনিয়ে বেড়াতে থাকে। আবার সকালে ঘুম ভাঙতেই তা আর মনেই পড়ে না। গোটা কাঠামোটা থাকে, গল্পের যা-প্রাণভোমরা। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশ’-এ আমার একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। ‘শান্তিনিকেতনের একজনের ছবি’। চোখ-মুখ-কান চিবুক একই আছে কিন্তু ঠোঁটের কোণের ভাবটি কবে যেন চুরি হয়ে গেছে।
এইরকমই, কত ভালো ভালো গল্প যে নিয়ত মাথার মধ্যেই ভ্রূণেরই মতো উন্মেষ হচ্ছে এবং সকালে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবরশন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে।
মহারাষ্ট্রের লাগজিরা অভয়ারণ্য খুব বিখ্যাত, বিশেষ করে প্রজাপতির জন্য। সারাপৃথিবী থেকে নানা প্রজাপতিবিশারদরা দল বেঁধে আসেন এই অভয়ারণ্যে এ কারণেই। অবশ্য বড়ো বাঘ, লেপার্ড, শুয়োর, নীলগাই ও আরও নানা জানোয়ার দেখতে এবং তাদের ছবি তুলতেও আসেন। এই অভয়ারণ্যের প্রধান বাংলোর সঙ্গে ক্যান্টিন নেই। খাবার এনে সেখানে গরম করে নেওয়া যায়। ক্যান্টিনটি বেশ দূরে। বড়ো ক্যান্টিন, সবরকম নিরামিষাশী খাবারও পাওয়া যায় সেখানে। সেই ক্যান্টিনের সামনে একটি সদ্য যুবক পুরুষ নীলগাই ঘুরে বেড়ায়। সে স্বাধীন, একা, বধ্য নয়। এই ক্যান্টিনের ছেলেরা তাকে মা-হারা পরিত্যক্ত অবস্থাতে এই জঙ্গলে খুঁজে পায়। পাহাড়ের দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরের কাছ থেকে। তার মাকে দেখা যায়নি এবং সে তার সন্তানকে দাবিও করেনি। অনেক আধুনিকা মায়েরই মতো সন্তানকে ত্যাগ করে যেতে তার কিছুমাত্র কষ্ট হয়নি। সেই নীলগাইটির নাম ছিল রাজা। তাকে দেখামাত্র তাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। এখনও লিখে উঠতে পারিনি। তবে ওই লাগজিরা অভয়ারণ্যর পটভূমিকাতে দুজন জার্মান Lepidopteriss-দের নিয়ে একটি ঋজুদা কাহিনি ‘প্রকৃতি ও প্রজাপতি’ লিখেছি। তাতে অবশ্য রাজার কথা আছে।
এমনি করেই—গল্প গড়ে উঠে, ভেঙে যায় মাথার ভেতরে। জীবনেরই অনেক গল্পের মতো।