1 of 3

গন্ধ

গন্ধ

চলন্ত ট্রাম থেকে নেমে ছুটতে-ছুটতে সাধনদা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। বেশ ব্যস্তভাবে বললেন, সুনীল, তুই আমার কাছ থেকে দশটা টাকা পাবি, মনে ছিল না। আজ তোকে শোধ দেব।

সাধনদার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালুম। আমি যে সাধনদাকে চিনতুম, সেই সাধনদা ইনি নন। সাধনদার মুখে দু-তিন দিনের খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, প্যান্টের ওপরে ঝুলছে শার্ট, পায়ে রবারের চটি। আমার চেনা সাধনদা ছিলেন পাক্কা সাহেব, এমনকি অশৌচের সময়ও তাঁর এইরকম পোশাক কল্পনা করতে পারতুম না। সাধনদার সঙ্গে আমার দশ টাকা ফেরত দেওয়ার সম্পর্ক নয়। সাধনদা ট্রাম-যাত্রীও ছিলেন না কখনও।

ভুরু কুঁচকে বললুম, কী ব্যাপার?

সাধনদা পকেট থেকে পার্সটা বার করে টাকা খুঁজছে। পার্সে পঞ্চাশ টাকা, একশো টাকার নোট বেশ কয়েকটা, কিন্তু দশ টাকার নোট নেই।

সাধনদা বললেন, কারুর কাছে আর ধার করতে চাই না, বুঝলি? মনে করে-করে সবাইকে পুরোনো ধার শোধ দিয়ে বেড়াচ্ছি। একটা জিনিস লক্ষ্য করলুম, বুঝলি, আমরা কেউ পুরোপুরি নিজের রোজগারে বাঁচি না। একেক রকম ধার থেকেই যায়।

তুমি আমাকে দশ টাকা ফেরত দিচ্ছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? সেরকম হিসেব করলে তোমার কাছেও তো আমার ধার হবে অন্তত কয়েক হাজার টাকা!

—তুই আমার কাছ থেকে কোনওদিন ক্যাশ টাকা নিয়েছিস? নিস নি তো! ক্যাশ টাকাকেই ধার বলে। বাকিটা হচ্ছে আদর যত্ন, যার বিনিময়ে দিতে হয় কৃতজ্ঞতা কিংবা ভালোবাসা। তোর কাছে পঞ্চাশ টাকার চেঞ্জ আছে?

সাধনদার গাড়িতে একবার ডায়মন্ডহারবার যাচ্ছিলুম, মাসছয়েক আগের কথা। পেট্রল পাম্পে তেল নেওয়ার সময় কী একটা খুচরোর গোলমালে আমি দশটা টাকা দিয়েছিলুম। একে ধার দেওয়া বলে?

—তোমার কী হয়েছে আগে বলো তো?

—আমার দিন শেষ হয়ে এসেছ রে, আমাকে এবার যেতে হবে। টাকাটা তোকে কী করে দিই? চল, কোনও দোকান থেকে ভাঙাই!

কিছুদিন সাধনদার সঙ্গে দেখা হয়নি। একটা উড়ো খবর শুনেছিলুম যে সাধনদা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। মাথারও নাকি একটু গোলমাল হয়েছে। কিংবা, কারু-কারুর সন্দেহ, উনি ক্যানসারে

ভুগছেন!

ফুটপাতের দোকান থেকে দু-টাকার একটা কলম কিনে সাধনদা টাকাটা ভাঙালেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, ওই কলমটার সাধনদার কোনও দরকার নেই। বিজ্ঞাপন কোম্পানির বেশ বড় কর্তা ছিলেন। ওঁর বাড়িতে কলম-পেন্সিলের ছড়াছড়ি।

দশটা টাকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, জীবনটা বেশ ভালোই কাটল রে!

—তোমার কী হয়েছে, তা কিন্তু বললে না এখনও।

—আমার ক্যানসার হয়নি। সবরকম টেস্ট করিয়েছি। তোকে কী রত্না বলেছে যে আমার মাথা খারাপ হয়েছে?

–বউদির সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।

—মাথা খারাপ হলেও হতে পারে, বুঝলি? সেটা তো আমি নিজে বুঝতে পারব না। তবে, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে, এটা ঠিক। মৃত্যু আমায় তাড়া করছে।

—এটা কী করে বুঝলে?

—একটা গন্ধ পাই। প্রথম দিন সেই গন্ধটা পেয়ে ঘুম পেয়ে যায়। কীরকম গন্ধ জানিস; চেতলা ব্রিজের ওপর দিয়ে পাস করার সময় ওই গন্ধটা পাওয়া যায়। মানুষ পোড়া গন্ধ, কেওড়াতলা। শ্মশান থেকে আসে। ঘুম ভাঙার পর সারা বাড়ি খুঁজে দেখলুম, কোথাও কিছু নেই, অথচ গন্ধটা পাচ্ছি। বুঝলুম, এটা একটা ওয়ার্নিং। এখন গন্ধটা যখন-তখন পাই। ঘনঘন পাই।

—সাধনদা, তুমি কী যা-তা বলছ।

—জানি, বলবি তো, এটা আমার মনের ভুল? কিংবা বাতিক? সবাই শুনে তাই ভাবে। তুই কি আমার গা থেকে সেরকম কোনও গন্ধ পাচ্ছিস?

—না।

–রত্নাও পায় না। কিন্তু অন্য কেউ-কেউ পায়। হিপনোটিজমের মতন মৃত্যুরও মিডিয়াম আছে। অন্য কে-কে গন্ধ পেয়েছে শুনবি? গত শনিবার আমি বেশ্যাবাড়িতে গিয়েছিলুম। চমকে যাওয়ার কিছু নেই, মজা মারতে যাইনি, গিয়েছিলুম পরীক্ষা করতে। ওদের কাছে এমন কিছু কথা বলা যায়, যা অন্য আর কোনও মেয়েকে বলা যায় না। ওরা যেমন সহজে জামাকাপড় খোলে, সেইরকম ভাবে মনটাকেও খুলতে পারে। বাহান্ন টাকা দিয়ে একটা মেয়ে এক ঘণ্টার জন্য ভাড়া করলুম। তাকে কিছু বলিনি, অন্য লোকে যেমন যায়, সেইভাবেই গেছি। জামাকাপড় খুললুম, মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব সরলভাবে বলল, হ্যাঁ গো, তোমার গায়ে কীসের গন্ধ? আমি খুব নিরীহভাবে বললুম, গন্ধ? সে কী। রোজ বিলিতি সাবান দিয়ে চান করি। কীসের গন্ধ বলো তো! মেয়েটি তবু বলল, হ্যাঁ গো, কীরকম পোড়া-পোড়া গন্ধ! তুমি গঙ্গায় ভালো করে চান করো, সব ঠিক হয়ে যাবে! তবেই দ্যাখ মেয়েটিকে তো কেউ শিখিয়ে দেয়নি! মিছিমিছি সে আমার মনে আঘাত দিতে চাইবে কেন বল? একবালপুরে একটা বাচ্চা ছেলেও ঠিক ওই কথা বলেছিল! ওরা মিডিয়াম। ওরা ঠিক টের পায়।

—সাধনদা, তুমি সত্যি করে বলো তো, তুমি এর মধ্যে কোনও জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলে?

—পাগল হয়েছিস তুই? আমি যাব জ্যোতিষীর কাছে? ওসব আমি বিশ্বাস করি না। আমি পারতপক্ষে ডাক্তারদের কাছেও যাই না। কিন্তু আমি গন্ধ পেয়েছি।

মৃত্যু বিষয়ক আলোচনা আমার পছন্দ হয় না। মৃত্যু সম্পর্কে আমার ধারণা, অনেকটা রণক্ষেত্রে সৈনিকের মতন। কোথা থেকে কামানের গোলা আসবে, ব্যস, শেষ হয়ে যাব। আগে থেকে এত ভাববার কী আছে!

সাধনদাকে বললুম, তুমি চলন্ত ট্রাম থেকে অমন ঝুঁকি নিয়ে নামলে কেন? তুমি কি ইচ্ছে করে মরতে চাও!

সাধনদা হেসে ফেলে বলল, না রে, অত সহজে কী হয়? মরতে কেউ চায় না। আমিই বা চাইব। কেন? তবে সময় এসে গেলে তৈরি থাকাই উচিত নয়? মৃত্যুকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। এখন কথা হচ্ছে, মৃত্যু কোথায় এসে আমায় ধরবে? এই অনিশ্চয়তাটাই বড় সাংঘাতিক। ঐতিহাসিক প্লিনি একটা ঘটনা লিখে গিয়েছিলেন জানিস তো? প্লিনি লিখেছেন একজন কবির কথা। সেই কবি দৈববাণী শুনেছিল যে কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ তার মৃত্যু হবে। ওপর থেকে একটা কিছু ভারি জিনিস তার মাথায় পড়বে। বাঁচবার জন্য সেই কবি বাড়ি-ঘর। ছেড়ে চলে গেল। এমনকী কোনও জঙ্গলেও গেল না, যদি গাছের ওপর থেকে কিছু পড়ে। কবি এক ফাঁকা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। তবু মরতে হল তাকে। কী করে জানিস, ওপর থেকে একটা প্রকাণ্ড কচ্ছপ এসে পড়ল সেই কবির মাথার ওপরে।

—আকাশ থেকে কচ্ছপ? এ যে গাঁজাখুরি গল্প, সাধনদা!

মোটেই গাঁজাখুরি গল্প নয়। মিডল ইস্টে এখনও অনেক বড়-বড় শকুন আছে। সেই শকুনগুলো এক-একটা কচ্ছপকে ছোঁ মেরে ওপরে তুলে নিয়ে যায়। কচ্ছপের শক্ত খোলা ভেঙে তো তাকে। মারতে পারে না। তাই ওপর থেকে কোনও পাথরের ওপরে আছড়ে-আছড়ে ফেলে। সেই রকমই কোনও কচ্ছপ খসে পড়েছিল কবির মাথায়। তবেই বুঝলি? মৃত্যুর ভয়ে ঘর ছেড়ে পালাতে নেই। চলি রে। এখনও অনেকের কাছে ধার শোধ করতে যেতে হবে।

এরপর অনেকক্ষণ সাধনদার কথা ভাবলুম।

চেনাশুনো মানুষের পরিমণ্ডল থেকে এক-একটা মানুষ হঠাৎ অন্য রকম হয়ে যায়। সাধনদা ছিলেন সবদিক থেকেই একজন সুসংহত মানুষ। বুদ্ধিমান, দায়িত্ববান, জীবনের তথাকথিত উন্নতির সিঁড়ি ধরে বেশ ধাপে-ধাপে উঠে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কেন সব গোলমাল হয়ে গেল? গুরুতর অসুস্থও হননি, মাথার গোলমাল যদি হয়েও থাকে, তাও অতি সূক্ষ্ম, ওই মৃত্যু ব্যাপারটা ছাড়া আর সব বিষয়েই তো স্বাভাবিক।

সচরাচর মানুষ এইরকম পরিস্থিতি এড়িয়েই চলতে চায়। কিন্তু সাধনদা রত্নাদির কাছে আমার অনেক ঋণ। দুদিন বাদে গেলুম ওঁদের যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে।

বাড়ির ভেতরটা অদ্ভুত শান্ত। সাধনদার দুই ছেলেই দার্জিলিং-এ পড়ে। যতবার এ-বাড়িতে এসেছি, দেখেছি অনেক রকম মানুষের ভিড়। আজ কেউ নেই। বসবার ঘরটা খালি-খালি। ওঁদের কাজের ছেলেটি আমায় দরজা খুলে দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

একটু এদিক-সেদিক উঁকি মেরে দেখলুম, শোওয়ার ঘরের দরজার সামনে মেঝেতে উপুড় হয়ে বসে আছেন রত্না বউদি। পাশে অনেক ফটোগ্রাফ ছড়ানো। আর দুটি অ্যালবাম। রত্না বউদি ছবিগুলো বেছে অ্যালবামে সাজাচ্ছেন।

অতি সাধারণ দৃশ্য, তবু যেন আমার বুক কেঁপে উঠল। কী আছে এর মধ্যে? রত্না বউদি একবারও মুখ তুলে দেখলেন না।

সাধনদার নিজস্ব ঘরটি বারান্দার পাশে। ওটা ওঁর স্টাডি রুম, বইপত্র প্রচুর।

সেই ঘরের কাছে এসে দেখলুম, দেওয়ালে কোনও বুক সেলফ নেই। ঘরে একটাও বই নেই। একটা রঙিন টিন আর ব্রাশ নিয়ে সাধনদা এক মনে সাদা রং করে যাচ্ছেন। এই দৃশ্যটাও কেমন যেন বুক কাঁপার মতন। এসব কী চলছে এ-বাড়িতে।

দু-তিন মিনিট দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলুম। তবু সাধনদা দেখতে পেলেন না আমাকে।

আমি ভিতরে এসে সাধনদার একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলুম, এ কী হচ্ছে সাধনদা?

সাধনদা মুখ তুলে খুব শান্তভাবে তাকালেন আমার দিকে। যেন আমাকে চেনেনই না। মাত্র দু মাস আগেও সাধনদা আমায় দেখলেই উল্লসিত হয়ে উঠতেন। মানুষ এরকম বদলে যায় কেন?

আমি আবার ডাকলুম, সাধনদা।

সাধনদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই বললেন, সাদা রং তোর ভালো লাগে না? একটু-একটু নীলচে আভা? আগে আমার ঘরের রং ছিল নীল। ওটা জীবনের রং। বেঁচে থাকার রং। মৃত্যুর আগে ঘরটা সাদা করে যেতে হয়।

এত স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুর কথাটা উচ্চারণ করলেন সাধনদা, যেন এর কোনও প্রতিবাদই চলে না। যেন মৃত্যু দাঁড়িয়ে আছে ঠিক সাধনদার পাশে। আমি একটুখানি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, সাধনদা একমনে কাজ করে যেতে লাগলেন।

—আমি তোমাকে সাহায্য করব?

—না, তোর এখনও সময় হয়নি। নতুন রঙের গন্ধ তোর কেমন লাগে।

—সবারই তো ভালো লাগে।

—আমার আরও বেশি ভালো লাগছে। এই গন্ধে সেই পোড়া গন্ধটা ঢেকে যায়। দেওয়ালটা কেন রংকরছি জানিস তো? আমার পরবর্তী মানুষের জন্য। আমি সাদা করে দিচ্ছি, তারা এসে আবার যে-কোনও রং করবে। স্লেট মুছে দেওয়ার মতন।

কোনওদিন আমি সাধনদার মুখ থেকে এরকম শুনিনি। তিনি ছিলেন আমুদে আর প্র্যাকটিক্যাল ধরনের মানুষ। মৃত্যুর সান্নিধ্য তাকে এত জ্ঞানী করে তুলেছে?

সাধনদা বললেন, দেওয়ালগুলো রং করতে বেশি ঝামেলা নেই। একটা-একটা করে ঘষে। ফেলেছি। তারপর ব্রাশ বুলোচ্ছি। কিন্তু ওই যে ছাদ। ওইটা ঘষা, তারপর রং করাই শক্ত হবে। এটা শেষ করে যেতে পারব? বলত, শেষ করে যেতে পারব? ততটা সময় পাব? সবাই পায় না!

আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসলেন সাধনদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *