গণৎকার তারিণীখুড়ো

গণকার তারিণীখুড়ো

তারিণীখুড়োর এক ভাইপো এক চা কোম্পানিতে ভালো কাজ করে, সে খুড়োকে এক টিন স্পেশাল কোয়ালিটির চা দিয়েছে। খুড়ো টিনটা আমার হাতে চালান দিয়ে বললেন, ‘এটা খোলাবার ব্যবস্থা কর; আজ তোদের চা না খেয়ে এইটে খাবো।’

বৈশাখ মাসের এক রবিবারের সন্ধ্যে। দুপুরের দিকে কালবৈশাখী হয়ে গেছে, এখন সব শান্ত। আমাদের ঘরে খুড়োর শ্রোতারা সব জমায়েত হয়েছে, তার মধ্যে অবিশ্যি ন্যাপলাও আছে। ন্যাপলা বলল, ‘ভূতের গল্প অনেক হয়েছে খুড়ো; আজ একটা অন্য কিছু হোক। আপনি একবার বলেছিলেন আপনি কিছুদিন গণৎকারী করেছিলেন তখন একটা আশ্চর্য ঘটনা হয়। সে গল্প কিন্তু আজ অবধি শোনা হয়নি।’

‘ও, সে গল্প বলিনি বুঝি?’

আমরা সবাই একসঙ্গে না বললাম।

খুড়ো বললেন, ‘আগে ওই নতুন চা-টায় একটা চুমুক দিয়ে নিই। কাপে ঠোঁট ঠেকাতে না পারলে গল্প খোলে না।’

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চা এসে গেল, ভুরভুরে সুগন্ধ, খুড়ো ওই গরম চাতেই একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ‘বাঃ, খাসা চা।’ তারপর একটা এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে গল্প আরম্ভ করলেন।

ঘটনাটা ঘটে নাগপুরে। আমি বোম্বাই গেস্‌লাম যদি ফিল্মে কিছু কাজ পাওয়া যায়। তার মানে মনে করিস না যে আমার ফিল্মে অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল। তা নয় মোটেই। আমি প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজটা ভালো জানতাম; টালিগঞ্জে দুটো ছবিতে ওই কাজ করেছি, তাই সেই দিকেই চেষ্টা করছিলাম। একটা ছবিতে কাজ জুটেও গেল।

আমি থাকি ভিলে পার্লেতে একটা দোতলা বাড়ির একতলায় একটা ছোট ফ্ল্যাটে। পুরো দোতলাটা নিয়ে থাকেন বম্বের এক বিখ্যাত জ্যোতিষী মুকুন্দ পটবর্ধন। দিশি মতে হাত দেখিয়ে হিসেবে তার খুব নাম ডাক। আমার প্রতিবেশী, তাই আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। কেন জানিনা, ভদ্রলোকের আমাকে খুব ভালো লেগে গেল। বললেন, ‘তোমাকে আমি পামিস্ট্রি শিখিয়ে দেব।’

যে কথা সেই কাজ। কাজের পর রাত্তিরে ভদ্রলোকের ঘরে বসে হস্তরেখা গণনা শিখতে আরম্ভ করলাম। অদ্ভুত সাবজেক্ট। নেশা ধরে গেল। দু মাসের মধ্যে দেখি আমিও বেশ হাত দেখতে পারছি। স্টুডিওর কয়েকজনের হাত দেখে অতীত ভবিষ্যৎ বলে দিলাম, এক প্রোডিউসারের ছবি হিট হবে সেটা বলে দিলাম, আর ফলেও গেল।

শেষটায় একটা সময় এল যখন মনে হল আমি নিজেই এ কাজ করে রোজগার করতে পারি। এক কাজে বেশি দিন টিকতে পারি না সেটা ত তোদের বলেইছি, তাই ফিল্মের লাইন ছেড়ে পামিস্ট্রি ধরলাম। কিন্তু বম্বেতে নয়। বম্বেতে এ কাজে পটবর্ধন একচ্ছত্র অধিপতি। আমাকে অন্য জায়গা দেখতে হবে। চলে গেলুম নাগপুর। পাচপাগুলি অঞ্চলে রাস্তার ওপর একটা ঘর নিয়ে দরজার পাশে নোটিশ লটকে দিলুম—‘এখানে সুলভে হস্তরেখা দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করা হয়। বেঙ্গলের বিখ্যাত গণৎকার’ ইত্যাদি।

দেখতে দেখতে পসার জমে উঠল। এরকম র‍্যাপিড সাক্সেস হবে তা আশা করিনি। এক বছরের মধ্যে একটা বড় ফ্ল্যাটে উঠে যেতে হল, একটা বি. এ. পাশ ছোক্‌রা সেক্রেটারি রাখতে হল। সারা ভারতবর্ষ থেকে হাতের ছাপ আসে, সেই ছাপ দেখে আমি ইংরাজিতে গণনা করি, সেক্রেটারি সেগুলো টাইপ করে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়। বেশির ভাগ মক্কেলই হচ্ছে ব্যবসাদার, আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগই মারোয়াড়ি। মাসে রোজগার তখন আমার প্রায় তিন হাজার টাকা, আর আমার বয়স তখন বত্রিশ তা হলে কদ্দিন আগের কথা বুঝতেই পারছিস।

এর মধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক এলেন, ফর্সা একহারা চেহারা, চোখে চশমা, পরণে বিলিতি পোষাক। বয়স আন্দাজ বছর ত্রিশেক। তিনি তাঁর হাতটা দেখিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই। আমি একটা নতুন চাকরিতে জয়েন করছি। সে কাজটা ঠিক হচ্ছে না ভুল হচ্ছে?’

আমি হাতের রেখা দেখে বললাম, ‘যা করতে যাচ্ছ করো। তোমার নতুন চাকরিতে উন্নতি হবে।’

‘ভেরি গুড’, বললেন ভদ্রলোক। ‘এবার আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।’

আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম যে ভদ্রলোকের কাঁধে একটা নকসাদার কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। ভদ্রলোক তার মধ্যে থেকে একটা বেশ বড় খাম বার করে তার ভিতর থেকে এক শিট কাগজ টেনে বার করলেন। কাগজটা পুরোনো তা দেখলেই বোঝা যায়। সেই কাগজে রয়েছে কালো কালিতে একটা রেখা সমেত হাতের ছাপ। ভদ্রলোক সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাগজের উপর দিকে ডান কোনায় একটা তারিখ লেখা রয়েছে সেটা পনেরো বছর আগের।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কার হাতের ছাপ?’

‘আমার বাবার’, বললেন ভদ্রলোক। একটা পুরনো বাক্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে পড়ল। মনে হয় এটা উনি নিয়েছিলেন বম্বের গণৎকার পটবর্ধনকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।’

‘আমাকে কি এখন এই হস্তরেখা দেখে গণনা করতে হবে?’

‘হ্যাঁ। বিশেষ কয়েকটা তথ্য।’

‘আপনার বাবার বয়স তখন কত ছিল?’

‘পঞ্চাশ।’

আমি হাতের রেখা বিচার করে একটা অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করলাম। ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়েছে ওই পঞ্চাশ বছর বয়সেই। সেটা আমি বললাম আমার মক্কেলকে।

‘স্বাভাবিক মৃত্যু কি?’ জিজ্ঞেস করলেন মক্কেল।

আমি আবার ভালো করে দেখলাম ছাপটা! তারপর বললাম, ‘রেখা স্পষ্ট বলছে অপঘাত মৃত্যু, স্বাভাবিক নয়।’

‘এ বিষয় আপনি নিশ্চিত?’

‘অ্যাবসোলিউটলি’, আমি জোর দিয়ে বললাম।

‘তাহলে আপনাকে ঘটনাটা একটু খুলে বলি’, বললেন ভদ্রলোক। ‘আমার বাবার নাম ছিল প্রকাশচন্দ্র মাথুর। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মা আমাকে জন্ম দিতে মারা যান; আমি মানুষ হই এক বিধবা পিসির কাছে। আমার নাম সুরেশ মাথুর। বাবা ব্যবসাদার ছিলেন। বাবার একজন অংশীদার ছিল, নাম গজানন আপ্টে। আজ থেকে পনেরো বছর আগে—তখন আমার বয়স সতের—বাবা একটা বিশেষ কারণে খুব কষ্ট পান। বাবাকে এত বিচলিত হতে আমি কখনও দেখিনি। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতে বাবা বলেন, ‘যাকে আপনার জন বলে মনে করা যায়, সে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে যত কষ্ট পেতে হয় তেমন আর কিছুতে হয় না।’ আমার স্বভাবতই বাবার বিজনেস পার্টনারের কথা মনে হয়; কিন্তু বাবা এই নিয়ে আর কিছু বলতে চান না। এর কিছুদিন পরেই একদিন বিকেলে আপিসে বাবাকে চেয়ারে বসা অবস্থায় তাঁর টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তখনই ডাক্তার ডাকা হয়। ততক্ষণে বাবা মারা গেছেন। ডাক্তার বলেন হার্ট অ্যাট্যাক। আমার ইচ্ছা ছিল পুলিশ ডাকার, কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। বাবা তাঁর অংশীদারের কীর্তি ধরে ফেলেছেন, তাই তাঁকে মেরে তাঁর মুখ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমার তখন মাত্র সতেরো বছর বয়স—আমার কথা কে শুনবে? আজ আপনার গণনায় জানতে পারছি যে আমার ধারণাই ঠিক ছিল, বাবাকে খুনই করা হয়েছিল।’

আমি বললাম, ‘যাই হোক, যা হবার হয়ে গেছে। এতদিন আগের খুনের ব্যাপারে আজকে ত আর তুমি কিছু করতে পারবে না।’

সুরেশ মাথুর ধন্যবাদ দিয়ে আমার পারিশ্রমিক চুকিয়ে দিয়ে চলে গেল।

এই ঘটনার প্রায় ছমাস পরে একদিন হঠাৎ আমার কাছে এক মক্কেল এসে হাজির, বছর ষাট্‌-বাষট্টি বয়স, ঘি খাওয়া চেহারা, বললেন তিনি একজন ব্যবসাদার, একটা নতুন ব্যবসায়ে টাকা ঢালতে যাচ্ছেন, তার ফলাফল কী হবে সেটা জানতে চান। সামনে তাঁর কোনও আর্থিক বিপর্যয় আছে কি?

আমি জিজ্ঞেস করতে বললেন তাঁর নাম গজানন আপ্টে। আমি ত শুনে অবাক।

যাই হোক, মক্কেল যখন, তখন তাঁকে অ্যাটেন্ড করতেই হবে। আমি তাঁকে আমার ফরাসে বসালাম। তারপর আমার একটা প্রশ্ন ছিল সেটা করলাম।

‘আপনার বয়স কত?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘ছেষট্টি।’

আমি হাতের রেখার দিকে মন দিলাম। দেখি যে নতুন ব্যবসা ফাঁদার কোনও প্রশ্ন আসছে না। এই বছরই ভদ্রলোকের মৃত্যু এবং সেটা অপঘাত মৃত্যু। সে কথা তো আর তাঁকে বলতে পারি না; বললাম, ‘তোমার নতুন ব্যবসায়ে টাকা ঢেলে কোনও সুফল হবে না; তুমি যা করছ তাই করো।’

‘তুমি ঠিক বলছ? ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন। ‘আমি কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে এই পন্থা স্থির করেছি।’

আমি ভদ্রলোককে আবার বারণ করলাম। তাঁর হাতের তেলো আমার সামনে খোলা, আমি তখনও মনে মনে গণনা করে চলেছি। হঠাৎ একটা ব্যাপার দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ভদ্রলোকের হাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনি পনেরো বছর আগে একটা খুন করেছেন। সাংঘাতিক ফাঁড়া, কিন্তু সে ফাঁড়া তিনি কাটিয়ে উঠেছেন সে কথাও হাতে রয়েছে।

আমি অবশ্যি এ বিষয় আর কিছু বললাম না। ভদ্রলোক আমাকে টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি আবার বলে দিলাম যে নতুন ব্যবসায় টাকা ঢেলে কোনও ভালো ফল হবে না।

এর সাতদিন পরে সুরেশ মাথুর আবার এসে হাজির। আমি বললাম, ‘কী ব্যাপার?’

মাথুরকে বিশেষভাবে উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছিল। সে বলল যে এর মধ্যে নাকি গজানন আপ্টের আপিসে গিয়েছিল। আপ্টে ছিলেন না কিন্তু তাঁর সেক্রেটারি ছিল। সেটা জেনে শুনেই নাকি মাথুর গিয়েছিল। সেক্রেটারি নাকি বিশ বছর ধরে ওই আপিসে চাকরি করছে। তার সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল মাথুরের। মাথুর তাকে তার বাপের মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করে। সেক্রেটারি বলে তার ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে। সে প্রকাশ মাথুরের বিশেষ অনুরক্ত ছিল। সে বলে বিকেলে কফি খাবার পরই নাকি প্রকাশ মাথুর মারা যান। সেক্রেটারি সন্দেহ করেছিল যে কফিতে বিষ মেশানো হয়েছে, কিন্তু ডাক্তারের মুখের উপর সে কোনও কথা বলতে পারেনি।

‘তা হলে এখন তোমার কী মতলব?’ আমি সুরেশ মাথুরকে জিজ্ঞেস করলাম।

সুরেশ চাপা স্বরে বলল, ‘আমি বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।’

‘সে কী? কী করে?’

‘যে করে হোক।’

আমি যে ইতিমধ্যে গজানন আপ্টের হাত দেখেছি আর জেনেছি যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, সে বিষয় আর কিছু বললাম না। সুরেশ মাথুর প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে আমার আপিস থেকে বেরিয়ে গেল।

এর তিন দিন পরে খবরটা খবরের কাগজে বেরোল। গজানন আপ্টে খুন হয়েছেন। তিনি ইটওয়ারি রোডে থাকতেন, রোজ সন্ধ্যায় আপিসের পর জুমা তালাও-এর পাশে হাঁটতে যেতেন। সেই হাঁটা অবস্থায় পিছন থেকে কেউ এসে তাঁকে কোনও ভারী অস্ত্র দিয়ে মাথায় মেরে খুন করেছে। পুলিশ আততায়ীর অনুসন্ধান করছে।

কিন্তু আমি তো সুরেশ মাথুরের হাত দেখেছি। আমি জানি তার এখন একটা ফাঁড়া আছে, কিন্তু এ ফাঁড়া সে কাটিয়ে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত হলও তাই। পুলিশ খুনিকে ধরতে পারল না, এবং গজানন আপ্টের খুন ‘আনসল্‌ভ্‌ড্‌ ক্রাইম্‌স্’-এর পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হল।

সুরেশ মাথুর যে শুধু পারই পেল তা নয়। আমি জানি যে বিরাশি বছরের আগে তার মৃত্যু নেই, এবং সে মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু।

অন্তত তার হাতের রেখা তাই বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

গণৎকার তারিণীখুড়ো
অনুবাদ
2 of 2

গণৎকার তারিণীখুড়ো

গণৎকার তারিণীখুড়ো

তারিণীখুড়োর এক ভাইপো এক চা কোম্পানিতে ভাল কাজ করে, সে খুড়োকে এক টিন স্পেশাল কোয়ালিটির চা দিয়েছে। খুড়ো টিনটা আমার হাতে চালান দিয়ে বললেন, এটা খোলাবার ব্যবস্থা কর; আজ তোদের চা না খেয়ে এইটে খাব।

বৈশাখ মাসের এক রবিবারের সন্ধে। দুপুরের দিকে কালবৈশাখী হয়ে গেছে, এখন সব শান্ত। আমাদের ঘরে খুড়োর শ্রোতারা সব জমায়েত হয়েছে, তার মধ্যে অবিশ্যি ন্যাপলাও আছে। ন্যাপলা বলল, ভূতের গল্প অনেক হয়েছে খুড়ো; আজ একটা অন্য কিছু হোক। আপনি একবার বলেছিলেন আপনি কিছুদিন গণকারী করেছিলেন, তখন একটা আশ্চর্য ঘটনা হয়। সে গল্প কিন্তু আজ অবধি শোনা হয়নি।

ও, সে গল্প বলিনি বুঝি?

আমরা সবাই একসঙ্গে না বললাম।

খুড়ো বললেন, আগে ওই নতুন চা-টায় একটা চুমুক দিয়ে নিই। কাপে ঠোঁট ঠেকাতে না পারলে গল্প খোলে না।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চা এসে গেল, ভুরভুরে সুগন্ধ, খুড়ো ওই গরম চাতেই একটা চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ, খাসা চা। তারপর একটা এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে গল্প আরম্ভ করলেন।

.

ঘটনাটা ঘটে নাগপুরে। আমি বোম্বাই গেলাম যদি ফিল্মে কিছু কাজ পাওয়া যায়। তার মানে মনে করিস না যে আমার ফিল্মে অভিনয় করার ইচ্ছে ছিল। তা নয় মোটেই। আমি প্রোডাকশন ম্যানেজারের কাজটা ভাল জানতাম; টালিগঞ্জে দুটো ছবিতে ওই কাজ করেছি, তাই সেইদিকেই চেষ্টা করছিলাম। একটা ছবিতে কাজ জুটেও গেল।

আমি থাকি ভিলে পার্লেতে একটা দোতলা বাড়ির একতলায় একটা ছোট ফ্ল্যাটে। পুরো দোতলাটা নিয়ে থাকেন বম্বের এক বিখ্যাত জ্যোতিষী মুকুন্দ পটবর্ধন। দিশি মতে হাত দেখিয়ে হিসেবে তার খুব নামডাক। আমার প্রতিবেশী, তাই আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। কেন জানি না, ভদ্রলোকের আমাকে খুব ভাল লেগে গেল। বললেন, তোমাকে আমি পামিস্ট্রি শিখিয়ে দেব।

যে কথা সেই কাজ। কাজের পর রাত্তিরে ভদ্রলোকের ঘরে বসে হস্তরেখা গণনা শিখতে আরম্ভ করলাম। অদ্ভুত সাবজেক্ট। নেশা ধরে গেল। দুমাসের মধ্যে দেখি আমিও বেশ হাত দেখতে পারছি। স্টুডিওর কয়েকজনের হাত দেখে অতীত ভবিষ্যৎ বলে দিলাম, এক প্রোডিউসারের ছবি হিট হবে সেটা বলে দিলাম, আর ফলেও গেল।

শেষটায় একটা সময় এল যখন মনে হল আমি নিজেই এ কাজ করে রোজগার করতে পারি। এক কাজে বেশিদিন টিকতে পারি না সেটা তো তোদের বলেইছি, তাই ফিল্মের লাইন ছেড়ে পামিস্ট্রি ধরলাম। কিন্তু বম্বেতে নয়। বম্বেতে এ কাজে পটবর্ধন একচ্ছত্র অধিপতি। আমাকে অন্য জায়গা দেখতে হবে। চলে গেলুম নাগপুর। পাচপাগুলি অঞ্চলে রাস্তার উপর একটা ঘর নিয়ে দরজার পাশে নোটিশ লটকে দিলুম–এখানে সুলভে হস্তরেখা দেখে ভবিষ্যৎ গণনা করা হয়। বেঙ্গলের বিখ্যাত গণৎকার ইত্যাদি।

দেখতে দেখতে পসার জমে উঠল। এরকম র‍্যাপিড সাকসেস হবে তা আশা করিনি। এক বছরের মধ্যে একটা বড় ফ্ল্যাটে উঠে যেতে হল, একটা বি.এ. পাশ ছোঁকরা সেক্রেটারি রাখতে হল। সারা ভারতবর্ষ থেকে হাতের ছাপ আসে, সেই ছাপ দেখে আমি ইংরিজিতে গণনা করি, সেক্রেটারি সেগুলো টাইপ করে যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়। বেশিরভাগ মক্কেলই হচ্ছে ব্যবসাদার, আর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মাড়োয়ারি। মাসে রোজগার তখন আমার প্রায় তিন হাজার টাকা, আর আমার বয়স তখন বত্রিশ। তা হলে কদ্দিন আগের কথা বুঝতেই পারছিস।

এর মধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক এলেন, ফর্সা একহারা চেহারা, চোখে চশমা, পরনে বিলিতি পোশাক। বয়স আন্দাজ ত্রিশেক। তিনি তাঁর হাতটা দেখিয়ে বললেন, আমি শুধু একটা জিনিস জানতে চাই। আমি একটা নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি। সে কাজটা ঠিক হচ্ছে না ভুল হচ্ছে?

আমি হাতের রেখা দেখে বললাম, যা করতে যাচ্ছ করো। তোমার নতুন চাকরিতে উন্নতি হবে।

ভেরি গুড, বললেন ভদ্রলোক। এবার আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।

আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম যে ভদ্রলোকের কাঁধে একটা নকশাদার কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। ভদ্রলোক তার মধ্যে থেকে একটা বেশ বড় খাম বার করে তার ভিতর থেকে এক শিট কাগজ টেনে বার করলেন। কাগজটা পুরনো, তা দেখলেই বোঝা যায়। সেই কাগজে রয়েছে কালো কালিতে একটা রেখা সমেত হাতের ছাপ। ভদ্রলোক সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। কাগজের উপর দিকে ডান কোনায় একটা তারিখ লেখা রয়েছে সেটা পনেরো বছর আগে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার হাতের ছাপ?

আমার বাবার,বললেন ভদ্রলোক। একটা পুরনো বাক্স ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে পড়ল। মনে হয় এটা উনি দিয়েছিলেন বম্বের গণৎকার পটবর্ধনকে পাঠানোর জন্য। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।

আমাকে কি এখন এই হস্তরেখা দেখে গণনা করতে হবে?

হ্যাঁ। বিশেষ কয়েকটা তথ্য।

আপনার বাবার বয়স তখন কত ছিল?

পঞ্চাশ।

আমি হাতের রেখা বিচার করে একটা অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করলাম। ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়েছে ওই পঞ্চাশ বছর বয়সেই। সেটা আমি বললাম আমার মক্কেলকে।

স্বাভাবিক মৃত্যু কি? জিজ্ঞেস করলেন মক্কেল।

আমি আবার ভাল করে দেখলাম ছাপটা। তারপর বললাম, রেখা স্পষ্ট বলছে অপঘাত মৃত্যু, স্বাভাবিক নয়।

এ বিষয় আপনি নিশ্চিত?

অ্যাবসোলিউটলি, আমি জোর দিয়ে বললাম।

তা হলে আপনাকে ঘটনাটা একটু খুলে বলি, বললেন ভদ্রলোক। আমার বাবার নাম ছিল প্রকাশচন্দ্র মাথুর। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার মা আমাকে জন্ম দিতে মারা যান; আমি মানুষ হই এক বিধবা পিসির কাছে। আমার নাম সুরেশ মাথুর। বাবা ব্যবসাদার ছিলেন। বাবার একজন অংশীদার ছিল, নাম গজানন আপ্টে। আজ থেকে পনেরো বছর আগে–তখন আমার বয়স সতেরো বাবা একটা বিশেষ কারণে খুব কষ্ট পান। বাবাকে এত বিচলিত হতে আমি কখনও দেখিনি। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতে বাবা বলেন, যাকে আপনার জন বলে মনে করা যায়, সে যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে যত কষ্ট পেতে হয় তেমন আর কিছুতে হয় না। আমার স্বভাবতই বাবার বিজনেস পার্টনারের কথা মনে হয়; কিন্তু বাবা এই নিয়ে আর কিছু বলতে চান না। এর কিছুদিন পরেই একদিন বিকেলে আপিসে বাবাকে চেয়ারে বসা অবস্থায় তাঁর টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তখনই ডাক্তার ডাকা হয়। ততক্ষণে বাবা মারা গেছেন। ডাক্তার বলেন হার্ট অ্যাটাক। আমার ইচ্ছা ছিল পুলিশ ডাকার, কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। বাবা তাঁর অংশীদারের কীর্তি ধরে ফেলেছেন, তাই তাঁকে মেরে তাঁর মুখ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমার তখন মাত্র সতেরো বছর বয়স–আমার কথা কে শুনবে? আজ আপনার গণনায় জানতে পারছি যে, আমার ধারণাই ঠিক ছিল, বাবাকে খুনই করা হয়েছিল।

আমি বললাম, যাই হোক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এতদিন আগের খুনের ব্যাপারে আজকে তো আর তুমি কিছু করতে পারবে না।

সুরেশ মাথুর ধন্যবাদ দিয়ে আমার পারিশ্রমিক চুকিয়ে দিয়ে চলে গেল।

এই ঘটনার প্রায় ছমাস পরে একদিন হঠাৎ আমার কাছে এক মক্কেল এসে হাজির, বছর ষাটবাষট্টি বয়স, ঘি খাওয়া চেহারা, বললেন তিনি একজন ব্যবসাদার, একটা নতুন ব্যবসায়ে টাকা ঢালতে যাচ্ছেন, তার ফলাফল কী হবে সেটা জানতে চান। সামনে তাঁর কোনও আর্থিক বিপর্যয় আছে কি?

আমি জিজ্ঞেস করতে বললেন তাঁর নাম গজানন আপ্টে। আমি তো শুনে অবাক!

যাই হোক, মক্কেল যখন, তখন তাঁকে অ্যাটেন্ড করতেই হবে। আমি তাঁকে আমার ফরাসে বসালাম। তারপর আমার একটা প্রশ্ন ছিল সেটা করলাম।

আপনার বয়স কত?

ভদ্রলোক বললেন, ছেষট্টি।

আমি হাতের রেখার দিকে মন দিলাম। দেখি যে নতুন ব্যবসা ফাঁদার কোনও প্রশ্ন আসছে না। এই বছরই ভদ্রলোকের মৃত্যু এবং সেটা অপঘাত মৃত্যু। সেকথা তো আর তাঁকে বলতে পারি না; বললাম, তোমার নতুন ব্যবসায়ে টাকা ঢেলে কোনও সুফল হবে না; তুমি যা করছ তাই করো।

তুমি ঠিক বলছ? ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন। আমি কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তে এই পন্থা স্থির করেছি।

আমি ভদ্রলোককে আবার বারণ করলাম। তাঁর হাতের তেলো আমার সামনে খোলা, আমি তখনও মনে মনে গণনা করে চলেছি। হঠাৎ একটা ব্যাপার দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ভদ্রলোকের হাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনি পনেরো বছর আগে একটা খুন করেছেন। সাংঘাতিক ফাঁড়া, কিন্তু সে ফাঁড়া তিনি কাটিয়ে উঠেছেন, সেকথাও হাতে রয়েছে।

আমি অবিশ্যি এ বিষয়ে আর কিছু বললাম না। ভদ্রলোক আমাকে টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি আবার বলে দিলাম যে, নতুন ব্যবসায়ে টাকা ঢেলে কোনও ভাল ফল হবে না।

এর সাতদিন পরে সুরেশ মাথুর আবার এসে হাজির। আমি বললাম, কী ব্যাপার?

মাথুরকে বিশেষভাবে উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছিল। সে বলল যে, এর মধ্যে নাকি গজানন আপ্টের আপিসে গিয়েছিল। আপ্টে ছিলেন না কিন্তু তাঁর সেক্রেটারি ছিল। সেটা জেনে-শুনেই নাকি মাথুর গিয়েছিল। সেক্রেটারি নাকি বিশ বছর ধরে ওই আপিসে চাকরি করছে। তার সঙ্গে কথা বলার দরকার ছিল মাথুরের। মাথুর তাকে তার বাপের মৃত্যুর কথা জিজ্ঞেস করে। সেক্রেটারি বলে, তার ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে। সে প্রকাশ মাথুরের বিশেষ অনুরক্ত ছিল। সে বলে বিকেলে কফি খাওয়ার পরই নাকি প্রকাশ মাথুর মারা যান। সেক্রেটারি সন্দেহ করেছিল যে, কফিতে বিষ মেশানো হয়েছে, কিন্তু ডাক্তারের মুখের উপর সে কোনও কথা বলতে পারেনি।

তা হলে এখন তোমার কী মতলব? আমি সুরেশ মাথুরকে জিজ্ঞেস করলাম।

সুরেশ চাপা স্বরে বলল, আমি বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।

সে কী? কী করে?

যে করে হোক।

আমি যে ইতিমধ্যে গজানন আপ্টের হাত দেখেছি আর জেনেছি যে তাঁর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, সে বিষয়ে আর কিছু বললম না। সুরেশ মাথুর প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে আমার আপিস থেকে বেরিয়ে গেল।

এর তিনদিন পরে খবরটা খবরের কাগজে বেরোল। গজানন আপ্টে খুন হয়েছেন। তিনি ইটওয়ারি রোডে থাকতেন। রোজ সন্ধ্যায় আপিসের পর জুমা তালাও-এর পাশে হাঁটতে যেতেন। সেই হাঁটা অবস্থায় পিছন থেকে কেউ এসে তাঁকে কোনও ভারী অস্ত্র দিয়ে মাথায় মেরে খুন করেছে। পুলিশ আততায়ীর অনুসন্ধান করছে।

কিন্তু আমি তো সুরেশ মাথুরের হাত দেখেছি। আমি জানি তার এখন একটা ফাঁড়া আছে, কিন্তু এ ফাঁড়া সে কাটিয়ে উঠবে।

শেষ পর্যন্ত হলও তাই। পুলিশ খুনিকে ধরতে পারল না, এবং গজানন আপ্টের খুন আনসম্ভড ক্রাই-এর পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হল।

সুরেশ মাথুর যে শুধু পারই পেল তা নয়। আমি জানি যে বিরাশি বছরের আগে তার মৃত্যু নেই, এবং সে মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু অন্তত তার হাতের রেখা তাই বলে।

সন্দেশ, আষাঢ় ১৩৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *