গণ্ডগোল

গণ্ডগোল

রামী কেমন মেয়ে তাও কুমুদ জানে না। অথচ রামী একরকম তার বিয়ে করা বউ। খবর যা পাচ্ছে কুমুদ তা মোটেই ভালো নয়। রামীর নাকি বিয়ে! গণ্ডগোল মানেই হল কুমুদ। তার গোটা জীবনটাই নানা গণ্ডগোল, গুবলেট আর কেলোর একটা যোগফল। বাপের দুটো বউ আর তেরোটা ছেলেমেয়ে। তার ওপর বাপটা রগচটা, দুই মায়ের উত্তম কুস্তম ঝগড়া। সব মিলিয়ে নরক গুলজার। তেরোটা ছেলেমেয়ে যে যার মতো ষণ্ডাগুণ্ডা বাঁদর গরু তৈরি হচ্ছে। কুমুদ ছিল তার মধ্যে আরও সরেস। মাস্টাররা মারত, বাপ পেটাত, মা ঠ্যাঙাত, দাদা দিদিরাও উত্তম মধ্যম। দিতে কসুর করত না। যাত্রা দলে নাম লেখাতে গিয়েছিল বলে অবশেষে ঠিক চৌদ্দ বছর বয়সে কুমুদকে তার বাপ জুতো পেটা করে বাড়ির বার করল।

ভেবে দেখল কাজটা ঠিকই হয়েছিল। বাপের তেমন দোষ দেওয়া যায় না। চৌদ্দ বছর বয়সে। আরও অনেক গুণ দেখা দিয়েছিল তার। বিড়ি খাওয়া, গাঁজা টানা, হাঁড়িয়া পচাইও বেশ চলে যেত। নষ্ট হওয়ার পথে চৌদ্দ বছর বয়সটা খুবই কাঁচা ছিল। তা ছাড়া ভেবে দেখলে তেরোটা ছেলেমেয়ের মধ্যে এক-আধটা কমে গেলে বাপের তেমন ক্ষতিও ছিল না, কে কার কড়ি ধারে।

কুমুদ জুতো পেটা হয়ে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল তখন চারিদিকে উদোম উধাও পৃথিবী। যেদিকে খুশি যাও, যা খুশি করো, কিছু বলার নেই কারও।

চৌদ্দ বছর বয়সে সে এক ভারী মজার ব্যাপার। প্রথম রাতটা জল খেয়ে গাছতলায় কাটিয়ে দিল কুমুদ। বেশ লাগল। একটু খিদে পায়, এই যা মুশকিল। কুমুদ চার-পাঁচ গাঁ তফাতে গিয়ে এক বাড়িতে চাকরের কাজ নিল। ঠিক তিন দিন বাদে ফাঁক বুঝে গিন্নিমার সোনার বালাটা হাতিয়ে কেটে পড়ল।

মতি স্যাকরা খুব ঠকিয়েছিল। মাত্র দেড়শো টাকা তাও মেলা ঝোলাঝুলির পর দিয়েছিল।

ধড়িবাজ লোক, বালাটা হাতে নিয়ে তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বলল , ‘এ তো চুরির মাল বাপু, ধরা পড়লে তোমারও হেনস্থা আমারও হেনস্থা।’

দেড়শো টাকায় কয়েকটা দিন একেবারে রাজার হালে কেটে গেল কুমুদের। তারপর সে আরও তফাত হতে লাগল। দশ-বিশ গাঁ আর দুটো গঞ্জ ছেড়ে ফুলপুরে বাসা গাড়ল। তুচ্ছ কাজ, একটা পুরোনো কালীমন্দির, ঝাঁট-পাট দেওয়া আর ধোয়া মোছার কাজ। মাইনে পাঁচ টাকা আর দু-বেলা খাওয়া।

এ কাজটা কুমুদের বেশ ভালোই লাগত। খবরদারি কারার লোক নেই, ছড়িদার নেই, খাটুনিও কিছু নয়। একদিন কালীমন্দিরে দুপুরবেলা এক ঝুল্লুস বাবাজি এসে হাজির। জটাজুট, দাড়ি আর ময়লা রক্তাম্বর। আর গায়ে যে বোঁটকা গন্ধ। বাবাজি নানারকম হু-হুঙ্কার ছেড়ে আর অং–বং চিৎকার করে আসার জমাতে চেষ্টা করল। সুবিধে হল না। তারপর কুমুদকে ধরে পড়ল, ‘দুটো টাকা দে সাপ ধরা শিখিয়ে দেব।’

দুটো টাকার তখন মেলা দাম। কুমুদ রাজি হল না। হতাশ হয়ে বাবাজি তখন নাট মণ্ডপে। শুয়ে ভোঁস-ভাঁস করে ঘুমোতে লাগল।

এমনই কপাল, ঠিক সেই সময়েই একটা গোখরো সাপ বেরোল মন্দিরের দক্ষিণ কোণে। সাপ! সাপ!

বাবাজি চেঁচামেচিতে উঠে পড়ল। তারপর এলেম দেখাল বটে।

সাপটা সবে নাট মন্দিরে নীচের ধাপে কিলবিল করে ঘাস জঙ্গলে পালাবার ফিকির খুঁজছিল, বাবাজি গিয়ে খপ করে লেজে ধরে সেটাকে তুলে ফেলল। অন্তত আড়াই হাতের পাকা গোখরো।

বাবাজি সাপটাকে হাতে ঝুলিয়ে পাকা চোখে সর্বাঙ্গ দেখে নিয়ে বলল , ‘গাভীন আছে। পেট ভরা ডিম।’

চিমটে দিয়ে দুটো বিষদাঁত উপড়ে সাপটাকে ফের ঘাস জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে কুমুদের দিকে চেয়ে বলল , ‘সবক’টা ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বেরোবে তখন গরমের সময় ঘাসে পা দিতে পারবি না, ঠুকে দেবে।’

সাপের ভয় কুমুদের তেমন নেই। জন্মাবধি সাপখোপ নিয়েই বসবাস। তবে বাবাজি বেশ খপ করে সাপটাকে ধরে ফেলল তাতে সে বুঝল, বাবাজি এলেমদার লোক।

দুটো টাকা কবুল করে সে বাবাজির কাছে সাপ ধরা শিখিল দু-দিন ধরে। অবশ্য দু-টাকায় হল না। গাঁজার পয়সা, ভাতের ভাগও দিতে হল।

অভাবে পড়লে কুমুদ সাপ ধরে বেচে দিয়ে আসত গঞ্জে। বিষ আর চামড়া দুইয়েই কিছু দাম আছে। তবে তেমন কিছু নয়।

বুড়ো পুরুতের মেয়ে পুতুলকে কু-প্রস্তাব দিয়েছিল বলে যে কী ঠ্যাঙানটাই না ঠ্যাঙাল গাঁয়ের মোড়ল মাতব্বররা। হেনস্তার আর শেষ ছিল না। ভেবে দেখলে কুমুদ কাজটা খারাপই করেছিল। পুতুল বড় ভালো মেয়ে।

ঠ্যাঙানিটা খেয়েছিল বিকেল বেলায়। মেরে গাঁয়ের বাইরে একটা গাছতলায় টেনে ফেলে দিয়েছিল তাকে। জ্ঞান যখন ফিরল তখন অনেক রাত। গায়ে গতরে সাংঘাতিক ব্যথা। চোখেও ভালো দেখছে না। কিছুক্ষণ জিরিয়ে কুমুদ ফের গাঁয়ে ঢুকল। সোজা কালীমন্দিরে গিয়ে কালীর নথ আর দু-চারটে বাসন নিয়ে চম্পট দিল। নথটা সোনার, জানা ছিল কুমুদের।

এর পরের ঠেকটা বেশ ভালোই জুটে গেল কুমুদের। মানুষের মেলায় একটা চপের দোকানে সে তখন জোগানির কাজ করে। সেদ্ধ আলু মাখে, নেড়ো বিস্কুট গুঁড়ো করে উনুনে হাওয়া দেয়, খদ্দেরকে চপ কাটলেট পরিবেশন করে, পাতা ফেলে। মেলায়-মেলায় ঘুরতে হয়। দোকানের মালিক তোক তেমন সুবিধের নয়, একটু খেকি গোছের। নানুরের মেলায় এক খদ্দেরের নতুন শালে চা চলকে পড়ায় মালিক উঠে এসে দু-তিনটে থাপ্পড় কষালে। কিন্তু শালওয়ালা লোক ভালো। প্রথমে গালাগাল করলেও মারধর দেখে সে-ই এসে মেটাল। কুমুদের খুব দুঃখ হয়েছিল সেদিন। মালিক চড় থাপ্পড় দিয়েও ক্ষান্ত থাকেনি, জবাবও দিয়েছিল। মালিকের সন্দেহ ফাঁক পেলেই কুমুদ পয়সা সরায়। ক’দিন ধরেই তাড়াব তাড়াব করছিল। তা মালিকের দোষ নেই। পয়সা কুমুদ সাত বটে।

দোকান থেকে বেরিয়ে ফ্যাফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কুমুদ। হঠাৎ সেই শালওয়ালার সঙ্গে দেখা।

‘এই যে খোকা–তোমাকে কি লোকটা তাড়িয়ে দিল?’

‘হ্যাঁ। আপনার জন্যেই তো, চায়ের দাগ দুধ দিলেই উঠে যায়। ঝুটমুট আমার চাকরিটা খেলেন।’ শালওয়ালা ভারী অপ্রস্তুত। বলল , ‘তা বটে, তাহলে আর কী করা। চলো, আমার সঙ্গে, মানুষকে নিরাশ্রয় দেখলে আমার ভারী কষ্ট হয়।’

তা সেই শালওয়ালার বাড়িতে কয়েদিন তোফা কাটল কুমুদের। আসলে শালওয়ালার তিনকুলে কেউ নেই। হরিগঞ্জ গাঁয়ে বেশ বড় বাড়ি। অবস্থাও ভালো। লোকটা ইস্কুলে মাস্টারি করে। আর নানা বায়ু আর বাতিকে ভোগে। ঘন–ঘন হোমিওপ্যাথি ওষুধ খায়। কোথায় পয়সা রাখে তা বেবাক ভুলে যায়। দুটো চাকর আর-এক জন রান্নার লোক যে কেন লাগে কে জানে!

সে বাড়িতে থেকে বেশ দু-পয়সা আয় হতে লাগল কুমুদের। খ্যাঁটের বন্দোবস্তও বেশ ভালো। আর দুটো চাকর, রান্নার লোক আর কুমুদ চারজনই হাত লাগাত। বেশ জমে গিয়েছিল চারজনে।

শালওয়ালার নাম ছিল গিরিনবাবু। তা গিরিনবাবু একদিন তাকে ডেকে চুপিচুপি বলল , ‘শোন কুমুদ, আমি ঠিক করেছি তোমাকে পুষ্যি নেব। উইল করে আমার বিষয় সম্পত্তি সব তোমাকেই দিয়ে যাব। এক জ্যোতিষী বলেছে আমার আয়ু আর বেশিদিন নয়।’

কুমুদের কাছে এ প্রস্তাব স্বপ্নের মতো। সে তক্ষুনি রাজি হয়ে গেল।

তবে পুষ্যি নেওয়াটা মুখে মুখেই হল। কাগজপত্র কিছু লেখা থাকল না। গিরিনবাবু মাথাপাগল লোক, তাঁর খেয়ালও কম।

কুমুদকে যে গিরিনবাবু পুষ্যি নিয়েছেন একথাটা কিন্তু তাঁর দুই চাকর ভজা আর কানু বিশ্বাস করল না। ঠাকুর নন্দলালও গায়ে মাখল না। অথচ এদের ওপরে খবরদারি করতে না পারলে তার পুষ্যি হয়েই লাভটা কী? তবে গিরিনবাবুকে সে প্রকাশ্যে বেশ খোলা গলায় ‘বাবা’ বলে ডাকতে শুরু করে দিল।

গিরিনবাবুর হঠাৎ একদিন খেয়াল হল কুমুদের বিয়ে দেওয়া দরকার। ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পাত্রী খুঁজতে লোক লাগিয়ে দিলেন। গাঁয়ে গঞ্জে পাত্রীর অভাব নেই। মেয়ের বাপেরা মুখিয়ে বসে আছে। নবীগঞ্জের পরেশ পালের মেয়ে রামীকে পছন্দ করে এলেন গিরিনবাবু। তারপর বেশ বাজনা-টাজনা বাজিয়ে ফস করে বিয়েও হয়ে গেল। রামী তখন নিতান্তই বালিকা। ন-দশ বছর বয়েস। কথা ছিল বিয়ের পর বউ বাপের বাড়িতেই দু-চার বছর থাকবে।

কিন্তু গোলমাল বাধল অন্য জায়গায়। বিয়ের পর পরেশ পালের জ্ঞানের চোখ খুলল। তার কাছে যে কুমুদ সজাত হলেও গিরিনবাবুর ছেলে নয়, পুষ্যি। তার ওপর কুমুদের নানা কীর্তি কাহিনীও ততক্ষণে চাউর হয়ে গেছে। পরেশ পাল এসে একদিন খুব হাত-পা নেড়ে গিরিনবাবুকে পাঁচ কথা শুনিয়ে গেল।

গিরিনবাবু সেই অপমানের পর শয্যা নিলেন। এবং তিনদিন বাদে একদিন সকালে দেখা গেল, ঘুমের মধ্যে গিরিনবাবু ইহলোক ছেড়েছেন। তার তিনদিনের মধ্যে কোথা থেকে পিল পিল করে গিরিনবাবুর একগাদা ভাইপো ভাইঝির আগমন ঘটল। তারা এসেই বাড়িটাড়ি দখল করে ফেলল, আর ঘাড় ধরে কাজের লোকেদের তাড়াতে লাগল।

কুমুদ বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে, সে আজ্ঞে কাজের লোক নয়। হু-হু বাবা, সে হল পুষ্যি পুত্তর।

একথায় তারা এমন হেসে উঠল যে, কহতব্য নয়।

কুমুদ তবু গাঁইগুই করছিল। তখন গিরিনবাবুর ভাইপোরা ধরে খুব আড়ং ধোলাই দিল। তাকে। তারপর জুতো পেটা করে তাড়াল। অবশ্য শুধু হাতে বিদায় নেওয়ার পাত্র কুমুদ নয়। দুশো টাকা আগেই সরিয়েছিল, যাওয়ার সময় দু-চারখানা বাসন, একখানা অ্যালার্ম ঘড়ি, তিনজোড়া জুতো সরিয়ে নিল।

কখনও-কখনও আমও যায় ছালাও যায়। গিরিনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে নবাবগঞ্জের শ্বশুর বাড়িতেও একবার গিয়েছিল। পরেশ পাল তাকে বারবাড়ি থেকেই কুকুরের মতো খেদিয়ে দেয়। স্পষ্টই বলে দেয় যে মেয়ে তার কুমারীই আছে। আবার বিয়ে দেব। কুমুদকে সে জামাই হিসেবে মানে না। কুমুদ মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিয়ে বলল , ‘মানা উচিতও নয়।’

সুখের পর দুঃখটা বেশ গায়ে লাগে। কুমুদেরও লাগল। গিরিনবাবুর বাড়িতে তোফা কয়েকদিন কাটানোর পর ফের খিদের কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না।

কিন্তু গিরিনবাবুর মতো আর-এক জন মাথাপাগলা লোক না পাওয়া গেলে এসব সমস্যার সুসারও হয় না। কুমুদের ফেরেববাজি করে দিন কাটতে লাগল।

নোনাপুকুরের শ্মশানে একদল সন্ন্যাসী ডেরা গেড়ে ছিল। তারা সব হিমালয়ে থাকে। গঙ্গাসাগরে এসেছিল ফিরে যাচ্ছে। তাদের কাছে জরিবুটি কিছু পাওয়া যায় কি না এই আশায় কুমুদ গিয়ে তাদে সঙ্গে ভিড়ল, গাঁজা সেজে দেওয়া, পা দাবানা সবই করল। কিন্তু বুঝল না সাধুগুলো কোন গোছের। কিছু ভাঙতে চায় না।

দু-দিন বাদে সাধুগুলো ডেরা গুটাল। আশায়-আশায় তাদের সঙ্গ নিল কুমুদ। গায়ে ছাইটাই মেখে নিল। জটা হয়নি তবে যথাসাধ্য ধুলোটুলো ঘসে মাথাটারও একটা ব্যবস্থাও করে ফেলল। কমণ্ডল, শূল, আর কৌপীনও ধারণ করে নিল। সাধু সাজলেও এদেশে কিছু রোজগার বাঁধা। তাকে তাড়াল না সাধুরা।

হাঁটতে-হাঁটতে দুটো জায়গায় রাত কাটিয়ে পরদিন দুপুর নাগাদ যে গাঁয়ে পৌঁছল সেটা কপালক্রমে নবীগঞ্জ। কুমুদের শ্বশুর বাড়ি। শ্মশানে সাধুরা ধুনি জ্বালিয়ে চায়ের জল চাপাল, কুমুদের ওপর হুকুম হল দুধ জোগাড় করে আনতে।

মনটা ভালো ছিল না কুমুদের। সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যেতে হচ্ছে, নিজের বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে, পাতানো বাপ পটল তুলেছে, শ্বশুর বাপ মুখ দেখতেও নারাজ। ভরসা শুধু সাধুবাবা সকল। তারাও বেশি ভরসা দিচ্ছে না। বুড়ো সাধু বিবেচক, অনেকবার তাকে বলেছে পাহাড়ের শীতে বাঙালিদের আমাশা হয়। সে আমাশা ওষুধে সারে না। আর সেখানে শীতও সাংঘাতিক, ডাল সেদ্ধ হয় না, কাঠ জোগাড় করতে দম বেরিয়ে যায়। শুনে ভয় খাচ্ছে কুমুদ। একটা লোটা নিয়ে দুধ জোগাড় করতে বেরিয়ে শ্বশুর বাড়ির গাঁ–খানা ভালো করে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছিল সে।

রামীকে তার ভালো মনে নেই। দেখনা-দেখনা করে বছর চারেক কেটে গেছে শুভদৃষ্টির পর। হ্যাজাকের আলোয় কচি মুখখানা দেখেছিল সেটা ভুলেই গেছে। এতোদিনে তার ডাগরটি হওয়ার কথা। বিয়েও হয়ে গেছে বোধহয় এত দিনে।

এধার-ওধার ঘুরল সে। চট করে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে তেমন সাহস হল না। সাধু। দেখে সবাই তাকাচ্ছে, দু-একজন পেন্নামও করে ফেলল। গয়লা গাড়িতে পো টাক দুধ ভিক্ষেও পেয়ে গেল সে। ফেরার আগে শ্বশুর বাড়িটা একটু দেখে যেতে ইচ্ছে করছিল বড্ড। শেষ দেখা।

ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়। লেংটি পরে শ্বশুর বাড়ি যেতে একটু লজ্জা ভাব ছিল তার। হিমালয়ের কথা ভেবে সেটা ঝেড়ে ফেলল। সে যখন সাধুই হয়ে যাচ্ছে আর আমাশাতে মৃত্যু যখন লেখাই আছে কপালে, তখন আর ভয়টা কীসের?

শ্বশুর বাড়ির ঝুমকো লতায় ছাওয়া ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে সে একটানা পেল্লায় হাঁক ছাড়ল, ‘জয় শিব শস্তো।’

কাজ হল। একটা ঝি গোছের বয়স্কা মহিলা বেরিয়ে এসে ‘ওম্মা গো’ বলে চেঁচিয়ে ভিতর বাড়িতে পালিয়ে গেল।

তারপর বেরিয়ে এল পরেশ পাল নিজে। বুকটা একটু কেঁপে উঠল কুমুদের।

‘এখানে সুবিধে হবে না বাবাজি, সরে পড়ো।’ কুমুদ কটমট করে তাকিয়ে বলল , ‘পাপী, পাপী!’ পরেশ পাল একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে মিইয়ে গেল। বলল , ‘বাড়িতে অসুখ আছে বাবাজি, অসুখ থাকলে ভিক্ষে দিতে নেই।’

কুমুদ কিছুদিন যাত্রা করেছিল। রাবণ রাজার হাসিটা এবার হাসল সে। হাঃহাঃহাঃ।

তারপর বলল , ‘মরবি-মরবি ঝাড়ে বংশে মরবি।’ এই বলে পিছু ফিরতেই পিছনে একটা নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনতে পেল সে, দাঁড়াও বাবাজি, যেও না।’

কুমুদ ফিরে দেখল তার শাশুড়ি! বেশ টসকালো চেহারা। হাতজোড় করে বলল , ‘বাড়িতে অশান্তি বাবা। আমার পনেরো বছরের মেয়েটা সদ্য বিধবা হয়ে শয্যা নিয়েছে।’

কুমুদ এমন হাঁ হয়ে গেল যে বলার নয়। বিধবা মানে? সে জলজ্যান্ত বেঁচে থাকতে রামী বিধবা হোল কোন সুবাদে?

সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল , ‘বটে! তা কী করে টের পেলি যে তোর মেয়ে বিধবা?’

‘জামাইয়ের দুই বন্ধু ছিল ভকু আর কালু। তারাই কাল বলে গেল কিনা, জামাই নাকি মরেছে।’

‘ডাক দেখি তোর মেয়েকে। এরকম তো হওয়ার কথা নয়?’

‘ডেকে আনাই বাবা। বসো।’

শাশুড়ি গিয়ে রামীকে ধরে-ধরে নিয়ে এল। রামীর পরনে ধুতি, মুখখানা নামানো, চোখের কোলে অনেক কান্নার চিহ্ন।

ভারী খুশি হয়ে পড়ল কুমুদ। আনন্দে ঠ্যাং নাচাতে লাগল সে। পরেশ পাল তাকে স্বীকার না করলে কী হবে। তার মরার খবরে মেয়ে তো বিধবা হল? তবে? হেঃ-হেঃ তাহলে এখনও তার দাম আছে। সবাই তাকে ঝেড়ে ফেলে দেয়নি।

আর রামীকে দেখেও ভারী খুশি লাগছিল তার। তেমন রূপসি কিছু নয় বটে, তবে বয়সের টানে চেহারাখানা দিব্যি হয়েছে। ছিপছিপে আঁটো গড়ন। মুখখানা ভারী মিষ্টি।

পরেশ পাল অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দেখছিল, লক্ষ্য করেনি কুমুদ। হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। বলল , ‘কল্যাণ হোক, আমি চলি।’

পরেশ যদি চিনতে পারে তাহলে হয়তো ব্যাপারটা কেঁচে যাবে। এরকমই থাক। সে বরং হিমালয়ে গিয়ে সত্যি মরাই মরবে। এটুকু তো জানা গেল যে, তার অভাবে দুনিয়ায় অন্তত একজনও বিধবা হয়ে কান্নাকাটি করেছে।

কুমুদ একটু জোরেই হাঁটা দিয়েছিল। কিন্তু মাধবী লতার ফটক পেরিয়ে আমবাগানে পড়তেই পরেশ পাশ ধরে ফেলল তাকে।

‘এই যে বাজাজি।’

কুমুদ সভয়ে বলল , ‘কাকে বলছিস?’

‘তোমাকেই হে। চিনতে পেরেছি।’

‘চিনে আর লাভ নেই। আমি সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাচ্ছি।’

পরেশ খপ করে হাতখানা চেপে ধরে বলল , ‘ঘাট হয়েছে বাপু। ফিরে চল।’

কুমুদ চোখ পাকিয়ে বলল , ‘কোথায় ফিরে যাব আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে?’

পরেশ একটু থতমত খেয়ে বলল , ‘ইয়ে এখন না হয় আমার বাড়িতেই চলো। পরে না হয়—‘

‘পরে তো হিমালয়। না গো পরেশবাবু, সুবিধে হবে না-মেয়েকে তোমার বিধবা বলেই ধরে নাও।’

‘পায়ে ধরছি বাপু। আমি তোমার গুরুজন, তবু ধরছি।’

‘ব্যবস্থাটা কী হবে?’

‘ঘরজামাই রাখব।’

‘বটে! শেষে ঘরজামাইকে চাকর মুনিষের অধম করে খাটাবে না তো। গরু চরানো, গোয়াল পরিষ্কার করা, খড় কাটা, মাঠের কাজ এসব?’

‘আরে না। ভেবেই রেখেছি, তুমি হবে আমার ধানকলের ম্যানেজার। চলো।’

কুমুদের হঠাৎ ভারী লজ্জা করল। বলল , ‘লেংটি পরে যাব?’ পরেশ ধমক দিয়ে বলল , ‘এতক্ষণ তো দিব্যি ছিলে। নাও বরং আমার আলোয়ানখানা একটু ঝুল রেখে জড়িয়ে নাও। লোক পাঠিয়ে ধুতি জামা সব আনাচ্ছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *