গঙ্গার বিভীষিকা
।। ১ ।।
গঙ্গা! এ নামে ভারতের কোটি কোটি হিন্দুর মনে যে-ভাবের উদয় হয়, পৃথিবীর আর কোনো দেশের আর কোনো নদীর নাম শুনে আর কোনো জাতির মনে সে-ভাব জাগে না। ক্রিশ্চানদের জর্ডন নদীর মহিমাও গঙ্গা-মাহাত্ম্যের কাছে ম্লান হয়ে যায়।
মিসিসিপি, অ্যামাজন, সেন্ট-লরেন্স, ম্যাকেঞ্জি, লা প্লাটা, নাইল, কঙ্গো, অ্যামুর, ভোলগা প্রভৃতি পৃথিবীর আরও অনেক নদ-নদী গঙ্গার চেয়ে আকারে বড়ো হলেও সম্মানে বড়ো নয়। আদি-গঙ্গা তো সামান্য একটুখানি গঙ্গার খাল, কিন্তু নামের গুণে তারও আদর কত! অথচ আসলে গঙ্গা হয়েও বিভিন্ন নামে ডাকা হয় বলে অত বড়ো পদ্মানদীও এত বেশি পূজার ফুল আর ফলমূলের নৈবেদ্য পায় না। সত্যি, নামের গুণে অধমও তরে যায়!
গঙ্গাতীরে যারা বাস করবার সৌভাগ্য পায়, ভারতে অ-গঙ্গা দেশের লোকেরা তাদের ভাগ্যবান বলে মনে করে। গঙ্গাকে দেখলেই হিন্দুর প্রাণ আনন্দে উচ্ছ´সিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ে সময়ে এই গঙ্গার ধারে গেলেও মনে যে আনন্দের ভাব জাগে না, আপনারা কি তা বিশ্বাস করতে পারবেন?
আমি প্রায়ই ডায়মন্ড হারবারে যাই—গঙ্গার বিশাল রূপ দেখতে। হরিদ্বার, এলাহাবাদ, বিন্ধ্যাচল, বেনারস, চন্দননগর ও কলিকাতা প্রভৃতি আরও অনেক জায়গা থেকে আমি গঙ্গার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখেছি, কিন্তু ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গার ভিতরে অন্য সব রূপ তলিয়ে যায়।
অপূর্ব তার বিশালতা—ভীষণ বললেও চলে! এ গঙ্গার তুলনা খুঁজলে সমুদ্রের কথাই মনে পড়ে! ডায়মন্ড হারবারকে পিছনে রেখে তীরে গিয়ে বসলে চোখে পড়ে কেবল আকাশের অ-সীমার তলায় ওপারের লুপ্তপ্রায় সামান্য তটরেখা এবং বিরাট এক উচ্ছ´সিত ও তরঙ্গিত জলের জগৎ,—আর-একদিকে মুখ ফেরালে অনন্ত জলরাশির ভিতরে এতটুকু তটরেখাও আর দেখা যায় না।
অতুল, অপূর্ব, আশ্চর্য! কে বলবে এই গঙ্গাই হিমালয়ে হয়ে যায় এতটুকু নালার মতো!
এইখানে একদিন শেষ-রাতে আমি গঙ্গাকে দেখতে গিয়েছিলুম। ঠিক দেখতে গিয়েছিলুম বললেও ভুল বলা হয়, কারণ সে রাতে কালো আকাশে চাঁদের চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। থমথম করছে নিশুত কালো রাত, তার অন্ধকার গর্ভে পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্য যেন ফতুর হয়ে হারিয়ে গিয়েছে। দেখব আর কী,—কিছুই দেখা যায় না! পিছন ফিরলে শুধু নজরে আসে দূরে ডাকবাংলোর দ্বিতল থেকে ম্লান আলোকের একটুখানি শিখা মাত্র। এবং কানে আসে অনেক কিছুই। একটানা ঝিঁঝির কান্না, বাদুড়ের ডানার ঝটপট, প্যাঁচার কর্কশ ধমক, অন্ধকারে নিষ্পেষিত বনস্পতির দীর্ঘশ্বাস, শৃগালের দ্রুত পদধ্বনি, সুদূর থেকে কুকুরদের ভীত চিৎকার—এবং আরও অনেক স্পষ্ট-অষ্পষ্ট অজানা শব্দের সঙ্গে বিশাল গঙ্গার বিরাট কোলাহল! মহাসাগরের কাছ থেকে গঙ্গা যেন তার বুকচাপা গর্ভযন্ত্রণার দিগ্বিদিকব্যাপী গম্ভীর চিৎকারকে এখানে চুরি করে এনেছে!
সে কোলাহল নিবিড় অন্ধতার ভিতর দিয়ে আমার প্রাণে অজ্ঞাত এক আতঙ্কের বার্তা বহন করে আনলে! আমার মনে হল পৃথিবী যেন আসন্ন মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ক্রন্দন করছে! প্রলয়ের পূর্বমুহূর্তে নিখিল জীবের সৃষ্টিব্যাপী যে হাহাকার জেগে উঠবে, এ যেন তারই ধ্বনিময় ইঙ্গিত! বিশ্বের যত অবিচার, ব্যভিচার, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, রোগ, শোক আর দারিদ্র্যের যন্ত্রণা যেন এখানে আর্তধ্বনির তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে বয়ে যাচ্ছে আর বয়ে যাচ্ছে!
চর্মচক্ষে শব্দের রূপ দেখা যায় না, কিন্তু মন দিয়ে তার প্রত্যেকটি রেখা অনুভব করা যায়। অদৃশ্য আকাশের আঁধারপটে অন্ধ শব্দের তিমির-তুলি কালোর উপরে কালো ছবি এঁকে চলেছে—বীভৎস সব শব্দময় দানব-মূর্তি ফুটে উঠছে! প্রত্যেক মূর্তিই কালবৈশাখীর আঁধির মতো, নিষ্ঠুর নিয়তির দুঃস্বপনের মতো পাকসাট খেয়ে হু-হু-হু-হু হাওয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ইহলোক থেকে পরলোকে, পরলোক থেকে ইহলোকে আনাগোনা করছে,—প্রত্যেকেরই চক্ষে হিংসার হত্যা-উল্লাস, প্রত্যেকেরই মুখে ক্ষুধিত বিকৃত ভঙ্গি, প্রত্যেকেরই হাবেভাবে জীবন্ত ধরণীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড অভিযোগ!
বেশিক্ষণ সেদিন গঙ্গার কাছে বসে থাকতে পারিনি।
।। ২ ।।
কলকাতায় রোজ সন্ধ্যার সময়ে গঙ্গার জলস্রোতের পাশে জনস্রোত বইতে থাকে।
পথে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এখানে-ওখানে দলে দলে লোক জটলা ও হল্লা করছে, দলে দলে চানাচুরওলা চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে কান কালা করে দিয়ে যাচ্ছে এবং ঘাটে ঘাটে ‘কণ্ঠ’হীন নরগর্দভরা প্রাণপণে গান গাইবার মিথ্যে চেষ্টা করছে! এই শেষোক্ত শ্রেণির জীবরা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর। বাগবাজার থেকে হাওড়ার পোল পর্যন্ত—কলকাতার গঙ্গাতীরের সর্বত্রই এদের ভয়াবহ অস্তিত্বের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। সারা শহরে গান গাইতে জানে না এমন যত বেসুরো বেতাল লোক আছে এবং বাড়িতে বসে গান গাইবার উপক্রম করলেই পাড়ার লোকেরা লাঠি নিয়ে যাদের কণ্ঠরোধ করবার চেষ্টা করে, তারা প্রত্যেকেই গঙ্গার ধারে পালিয়ে এসে তান ধরে লোকের সান্ধ্যভ্রমণকে বিষাক্ত করে তোলে। এদের জন্যে আলাদা আইন হওয়া উচিত।
এমনি সব নানান উপদ্রব থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যে, আমি গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাই রাত বারোটার পর। তখন গঙ্গাতীরের গাইয়েরা পর্যন্ত ঘুমোতে যায়—যদিও মাঝে মাঝে এক-একজন নাছোড়বান্দা গাইয়েকে আমি রাত বারোটার পরেও গঙ্গার ঘাটে আবিষ্কার করেছি!
চারিদিকে তখন জনতার সাড়া থাকে না। ওপারে দেখা যায় সার-বাঁধা, রাত-জাগা কল-কারখানার সুদীর্ঘ বৈদ্যুতিক আলোর মালা। মাঝে মাঝে যেখানে সে-মালা ছিঁড়ে গেছে সেখানে জেগে রয়েছে খানিকটা করে অন্ধকার। পূর্ণিমার চাঁদও সে-অন্ধকারকে মুছে দিতে পারে না। দিনের আলো ফুটলে বোঝা যায়, সে খণ্ড খণ্ড অন্ধকারগুলো নীল বন ছাড়া আর কিছু নয়।
এখানেও গভীর নিশীথে বসে বসে শুনি, গঙ্গা যা বলতে চায় তা আনন্দের রূপকথাও নয়, শান্তির বাণীও নয়। ও কলবেদনার গানে ছন্দে ছন্দে জাগে যেন সংখ্যাহীন অশান্ত আত্মার আর্ত কলরব! আমি ভূতের ভয় করি না, ভূতও মানি না, তবু আমার মনে হয়,—রাত্রে গঙ্গার অশ্রান্ত তরঙ্গ-দোলায় দুলে দুলে অশরীরীরা যেন শরীরী মানুষের সঙ্গে কানাকানি করতে চায়! আজ পর্যন্ত হাজার হাজার যত অভাগা ভ্রান্ত ব্যর্থ শান্তির খোঁজে ওই ঠান্ডা জলের স্রোতে শেষ-ডুব দিয়েছে, তারা যেন আবার নতুন করে পৃথিবীর বাসিন্দার কাছে অভিশপ্ত আত্মার চিরন্তন অশ্রুজলের কাহিনি বলতে চায়!
আকাশে সেদিন একটুখানি চাঁদের ফালি জ্বালা ছিল। গঙ্গাজলে তারই সামান্য ছায়া চিকচিক করছে। কুৎসিত নারীর অলঙ্কারের মতন এটুকু চন্দ্রলেখা সমান ব্যর্থ,—কারণ কালো রাতের ঘোমটাকে তা স্বচ্ছ করে না।
যে-জায়গায় বসে আছি তার নাম বিচালিঘাট। একতলা কি তার চেয়েও উঁচু বড়ো বড়ো খড়বোঝাই নৌকোগুলো গায়ে-গা-দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—আশেপাশে আবছায়ার সৃষ্টি করে। সামান্য আলোর আভায় তাদের নৌকো বলে চেনাই যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে গঙ্গাতীরে যেন অগুনতি কুঁড়েঘর নিয়ে একখানা ঘুমন্ত গ্রাম রাত-আঁধারে আড়ষ্ট হয়ে আছে!
ওই ভাসমান গ্রামের তলায় অলিগলির ভিতরে গঙ্গাজল ঢুকে কত রকম রহস্যময়, ভীতিকর শব্দ তুলছে! দিনের বেলায় তো ওখানে ও-রকম শব্দ শোনা যায় না! রাত্রে যারা ঘুমোয় না, অন্ধকারে যাদের অদৃশ্য চোখে দৃষ্টি জাগে, তারাই কি এখন ওখানে সাঁতার-খেলা খেলতে এসেছে? এক-একটা অলিগলিতে জল ঢুকে অমন গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে কেন? ওদের ভয়াবহ হাত-পায়ের তাড়নায় গঙ্গাও কি ভয়ে-ব্যথায় কাতরে উঠছে? …রাত যত বাড়ে, পৃথিবীর ঘুম যত গাঢ় হয়ে ওঠে, মানুষের সাড়া যখন আর কখনো শুনতে পাব না বলে সন্দেহ হয়, কষ্টিপাথরের মতো কালো অন্ধকারের গর্ভে বন্দি জলকল্লোলের অপার্থিবতা মনকে তখন একেবারে পঙ্গু ও আতুর করে তোলে!
চাঁদের ফালি অত্যন্ত অসহায়ের মতো টিপটিপ করছে! সে জানে, তাকে চাঁদের ফালি বললেও চাঁদকে অপমান করা হয়। সে যেন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত চাঁদের হীন, হাস্যকর, অক্ষম অনুকরণ, কিংবা চাঁদের শত্রু রাহুর দন্তবিকাশ! ওই তুচ্ছ আলোর আভাস গঙ্গাজলের আবর্তকে ভয়মাখা করে তুলেছে। মনে হচ্ছে, গঙ্গাস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে যেন সন্দেহজনক ছায়াময় কী সব ভেসে যাচ্ছে—যেন তারা জ্যান্ত না হলেও মৃত নয়! যেন তারা আমাকেও তাদের কাছে যাবার জন্যে ইশারা করছে!
ওইরকম কী একটা অস্পষ্ট বস্তু আমার দিকে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। এক-একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় বস্তুটা যেন কোনো জীবন্ত দেহের মতো উপরে ভেসে উঠেই আবার ডুবে যাচ্ছে।
একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম। বস্তুটা একেবারে তীরের কাছে এসে থামল। ভালো করে দেখবার চেষ্টা করেও কিছুই বুঝতে পারলুম না।
আমার চোখের ভ্রম কি না জানবার জন্যে নীচে নেমে গেলুম! দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বাললুম এবং এক-মুহূর্তেই তার সমস্তটা দেখতে পেলুম।
একটা মৃতদেহ তার দুটো মরা চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঢেউ -এর ধাক্কায় জীবন্ত এক মড়া! ভয়ানক!
দ্রুতপদে ঘাটের উপরে উঠে এলুম।
।। ৩ ।।
আর এক রাতে গঙ্গার এক ঘাটে চুপ করে বসে আছি। সেদিনও গঙ্গা ছাড়া আর কেউ নিশীথিনীর নিদ্রাভঙ্গ করছে না।
আকাশে প্রতিপদের চাঁদ আছে, কিন্তু ভাদ্রমাসের খণ্ড খণ্ড মেঘের গুণ্ঠনে আকাশের চাঁদ-মুখ ঘন ঘন ঢেকে যাচ্ছে—গঙ্গাজলের উপরে বারে বারে আলো-আঁধারের অভিনয়!
ঘাটের ধারে অনেকগুলো নানা আকারের নৌকা বাঁধা রয়েছে, কিন্তু দাঁড়ি-মাঝিরা এখন নৌকার ভিতরে, হয়তো কেউ আর জেগে নেই।
নিস্তব্ধতার সঙ্গে গঙ্গা কী কথা কইছে, অনেকক্ষণ ধরে তা বুঝবার চেষ্টা করলুম।
এর-মধ্যে কখন একখানা বড়ো মেঘ এসে আকাশকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, কিছুই টের পাইনি।
হঠাৎ একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালুম,—কিন্তু কাছে কোথাও মাথা গোঁজবার ঠাঁই দেখলুম না। ঘাটের পাশেই বাঁধা ছিল একখানা পানসি, তার উপরেই গিয়ে উঠলুম।
পানসির ভিতরে অন্ধকার, দাঁড়ি-মাঝিরা সেখানে নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে, নিরুপায় হয়ে তারই ভিতরে ঢুকে পড়লুম। তাদের ঘুম তবু ভাঙল না, কারণ কারুরই সাড়া নেই। সারাদিনের পরিশ্রমের পর বেচারিরা গভীর নিদ্রায় অচেতন, তাই আমিও তাদের ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করলুম না। এককোণে বসে বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষায় রইলুম।
কিন্তু সেদিনকার এই একগুঁয়ে বৃষ্টি কিছুতেই থামবার নাম করল না। গঙ্গাজলের উপরে ক্রমাগত ঝরঝর জল ঝরার একঘেয়ে শব্দ শুনতে শুনতে আমার চোখে কেমন তন্দ্রার ঘোর এল। সে ভাবটাকে তাড়াবার জন্যে একটা সিগারেট মুখে দিয়ে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বাললুম। এবং সেই আলোতে দেখলুম, পানসির ভিতরে জনপ্রাণীও নেই।
আশ্চর্য হলুম না। নৌকোর লোকেরা হয়তো কোনো কাজে কাছেই কোথাও গিয়েছে, বৃষ্টি ধরলেই ফিরে আসবে।
সিগারেট ফুরিয়ে গেল, কিন্তু আকাশে জলের ভাণ্ডার তবু ফুরোল না। আবার তন্দ্রা এল। এবারে আর জাগবার চেষ্টা না করে, পানসির ভিতরে দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, কিন্তু ঘুম যখন ভাঙল বৃষ্টি তখন থেমে গিয়েছে, আকাশে আবার চাঁদ উঠেছে।
তারপরেই মনে হল, নৌকো যেন চলছে!
পানসির বাইরে চাঁদের আলো, ভিতরেও জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে,—কিন্তু ভিতরে-বাইরে কোথাও দাঁড়ি-মাঝিরা কেউ নেই, অথচ নৌকোসুদ্ধ আমি একেবারে মাঝ-গঙ্গায় এসে পড়েছি!
প্রথমে ভাবলুম, ঝোড়ো-হাওয়ায় বা অন্য কোনোগতিকে বাঁধন খুলে গিয়ে নৌকোখানা স্রোতের মুখে আপনি ভেসে চলেছে!
কিন্তু তারপরেই ভালো করে দেখে বুঝলুম, নৌকো স্রোতের মুখে ভেসে যাচ্ছে না—যাচ্ছে স্রোতের টান এড়িয়ে সোজা গঙ্গার এপার থেকে ওপারের দিকে! ঠিক যেন অদৃশ্য হাতের হাল আর দাঁড় ধনুক-থেকে-নিক্ষিপ্ত বাণের মতো নৌকোখানাকে সিধে একদিকে বইয়ে নিয়ে চলেছে!
এও কি সম্ভব? আমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছি? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলুম। কোথায় দাঁড়ি, কোথায় মাঝি? দাঁড়ের কোনোই শব্দ নেই, কিন্তু নৌকোর গতি ওপারের দিকে!
ভূত মানি না, চোখের সামনে কোনো ছায়াদেহও দেখছি না, কিন্তু এ কী ব্যাপার?
কেমন একটা অজানা ভয়ে সর্বশরীর আচ্ছন্ন হয়ে গেল,—কী করি? পানসির ভিতরে গিয়ে বসব? না—না, যদি ঢুকে দেখি, ভিতরটা এখন আর নির্জন নয়, যদি আমার পাশে অন্য কেউ এসে ধুপ করে বসে পড়ে?
পানসি তখন মাঝ-গঙ্গা পেরিয়ে এসেছে! নৌকোর হাল শূন্যে উঁচু হয়ে আছে, দাঁড়গুলো পাটাতনের উপরে পড়ে আছে—কিন্তু নৌকোর তীব্র গতির মুখে দু-ধারে কল কল করে জল কাটার শব্দ হচ্ছে! মানুষের বদলে নৌকোর উপরে আমি যদি কতগুলো অমানুষী, স্বচ্ছ ছায়ামূর্তিও দেখতুম, তাহলেও আমার মনে বোধহয় এতটা অস্বাভাবিক আতঙ্কের সঞ্চার হত না! তাহলে হয়তো একটা কোনো হদিশ পেতুম—মানুষ হোক অমানুষ হোক নৌকো কেউ চালাচ্ছে বলে অনেকটা আশ্বস্ত হতে পারতুম! কিন্তু এই যে অদৃশ্য নীরব আত্মার অস্তিত্ব আমার চারিদিকে অনুভব করছি, যারা আমার খুব কাছে থেকেও চোখের আড়াল হয়ে আমাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করছে, তাদের সহ্য করা অসম্ভব! আমি আর অগ্র-পশ্চাৎ ভাবলুম না—একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়লুম গঙ্গার বুকে!
ভালো সাঁতার জানি। খানিকক্ষণ পরে কলকাতার এক ঘাটে এসে উঠলুম। যতক্ষণ সাঁতার দিয়েছি খালি ভয় হয়েছে, পানসিখানা যদি আবার আমাকে তুলে নিতে আসে!
পরদিন বেলা থাকতে আবার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে হাজির হলুম।
কালকের মতো ঘাটের পাশেই একখানা পানসি বাঁধা আছে। একজন দাঁড়ি কি মাঝি পানসির ধারে পা ঝুলিয়ে বসে জাল বুনছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বাপু, বলতে পারো, কাল রাতে এখানে কার পানসি বাঁধা ছিল?’
—‘আমারই পানসি, হুজুর!’
—‘কিন্তু পানসিতে তোমরা কেউ ছিলে না!’
—‘না হুজুর, ছিলুম না। শনিবার রাতের বেলায় এ পানসিতে আমরা কেউ থাকি না।’
—‘থাকো না কেন?’
লোকটা চুপ করে রইল।
আমি বললুম, ‘আমার কাছে লুকিয়ো না। কাল হঠাৎ বৃষ্টি এসে পড়াতে আমি ওই পানসির ভিতরে গিয়ে বসেছিলুম। তোমরা কেউ ছিলে না, তবু পানসিখানা আমাকে নিয়ে ওপারে ভেসে যাচ্ছিল। এর মানে কী?’
লোকটা খানিক ইতস্তত করে বললে, ‘আজ্ঞে, হুজুর যখন জেনেছেন তখন বলতে আর দোষ কী? শনিবারে এ পানসির ওপরে ভর হয়।’
—‘ভর হয়?’
—‘হ্যাঁ হুজুর, আমরা বেঁধে রাখলেও সকালে উঠে দেখি পানসিখানা ওপারে গিয়ে পৌঁছেছে!’
—‘বরাবরই এই রকম হয়?’
—‘না হুজুর, মাস-চারেক আগে এক শনিবারে গঙ্গা পার হবার সময়ে কালবোশেখিতে আমাদের নৌকো উলটে যায়। তিনজন লোক জলে ডুবে মারা পড়ে। তারপর থেকেই ফি শনিবারে এই ব্যাপার হচ্ছে!’
___