1 of 2

গঙ্গার ইলিশ – প্রনাবি

নীচের তলায় – প্রবোধকুমার সান্যাল

কোনো সংবাদ কোনোদিন যেখানে পৌঁছবে না, এই দেশেই এমন একটি ছোট্ট স্বর্গ খুঁজে পাওয়া দরকার। মাধবচন্দ্ৰ এজন্য তোক পাঠিয়েছিলেন নানা দিকে। যারা খোঁজ করতে গিয়েছে, তারা সকলেই এ-কাজে বিরক্ত, কেউ খুশি নয়। তারা জানে, এ হল জমিদারবাবুর একটা নতুন খেয়াল; এ-খেয়াল তাঁর হয়ত বেশী দিন থাকবে না, মাঝ থেকে কাছারি-সেরেস্তার লোকের একটা অহেতুক হয়রানি। কিন্তু উপায় নেই, কর্তাবাবুর বিশেষ অনুরোধ, এ-খেয়াল তাঁর চরিতার্থ করাই চাই। তাঁর একেবারে ধনুর্ভাঙা পণ।

কোনো সংবাদ পৌঁছবে না—এমন একটি স্থান, এ প্রস্তাবের কি তাৎপর্য? কি প্রকার সংবাদ? সংবাদ বলতে তিনি কি বোঝেন?—নানাবিধ কৌতূহল নিয়ে পুরাতন বন্ধু বৈকুণ্ঠবাবু মাধবচন্দ্রের বৈঠকখানায় এসে হাজির হলেন। সামনে রুপোর পানের ডিবে—তার সঙ্গে সুর্তি জর্দা ও কিমাম রয়েছে নানা পাত্রে, এ পাশে রূপার গড়গড়ায় সুগন্ধ অম্বরী তামাক পড়ছে, মাথার উপরে মৃদুগতি পাখা ঘুরছে—এবং ফরাসের ঠিক মাঝখানে বসে মাধবচন্দ্র তাঁর প্রিয় কাব্য শকুন্তলার নূতন ব্যাখ্যা রচনায় ব্যস্ত। লেখাপড়ার বিচিত্র ও বিবিধ সরঞ্জাম চারিদিকে সাজানো।

বৈকুণ্ঠবাবু কাছাকাছি গিয়ে বসলেন। মাধবচন্দ্র একটু হেসে চশমাখানা খুলে বললেন, টেলিফোনে কথা হয় না, তাই তোমাকে ডেকেছিলুম।

বৈকুণ্ঠ বললেন, তোমার নতুন হুজুগের চেহারাটা কি প্রকার, শুনি?

মাধব বললেন, খুব সহজ এবং সাবলীল।

যথা?

মাধবচন্দ্র বললেন, শোনো—আমি সেইখানে যাবো যেখানে খবরের কাগজ, রেডিয়ো, হুজুগে লোক, ভগ্নদূত—ইত্যাদি এসব কিছু নেই। শহরের কোনো দাগ যেখানে নেই, শহরের হাওয়া যেখানে পৌঁছয় না।

বৈকুণ্ঠ বেশ গুছিয়ে বসে বললেন, কণ্বমুনির আশ্রম এ যুগে তুমি পাবে কোথা?

মাধব বললেন, ভদ্রমনকে বাঁচাবার মতো জায়গা এখনো নিশ্চয়ই খুঁজলে পাওয়া যায়, বৈকুণ্ঠ।

বৈকুণ্ঠ বললেন, তুমি যদি সুন্দরবনের জঙ্গলে গিয়ে বাস করো, সেখানেও মৌচাক কেনবার জন্য শহুরে দালালরা ঘোরে। কিন্তু হঠাৎ তোমার এই বানপ্রস্থী ভাব কেন বলো দিকি? আইবুড়ো থেকে জীবনটা বেশ কাটিয়ে দিলে, কিন্তু খেয়াল-মর্জি কই কাটলো না ত? সহজে যা বোঝালে, সহজে কি তাই পেরে উঠবে?

শোনো বৈকুণ্ঠ—মাধবচন্দ্র বললেন, আমাকে ভাই যেতেই হবে। সেই মনের মতন জায়গা খুঁজে না পেলে আমার চলবে না। দেখতে পাচ্ছ আমার কত কাজ? এর পর আসবে মহাভারত আর রামায়ণ সম্পাদনের কাজ, এদিকে বাঙলার ইতিহাস সবে আরম্ভ করেছি, শঙ্কর আর বুদ্ধের কিছু তুলনামূলক আলোচনা,—কাজের শেষ নেই আমার!

বৈকুণ্ঠ বললেন, দিনকালের চেহারা ভালো নয়,—এ সময় হঠাৎ যাবেই বা কোথায়! স্বর্গলাভ ছাড়া আর কোনো লাভের জায়গা চোখে পড়ে না।

মাধব বললেন, তা সে যেখানেই হোক, কিন্তু এখানে আর নয়। কোনো খবর পাবো না, কেউ জানবে না, কোনো ঢেউ গিয়ে পৌঁছবে না—এমন জায়গা আমাকে খুঁজে পেতেই হবে।

এত অরুচি তোমার হল কি জন্যে বলো ত?

মাধব বললেন, মানুষে অরুচি নেই যদি মানুষ হয় তারা। পৃথিবীতে আর বৈচিত্র্য নেই, নতুনত্ব আরো কম। যা কিছু খবর, সবই দুর্ভাবনার, সবই আশঙ্কার। হত্যায় বাহাদুরি, প্রতারণায় গৌরব, চাতুরীতে জয়ধ্বনি—এরই তলায় ইতিহাস আর সভ্যতার সেই আদি ঘটনা—মানবতার অপমান আর মানবাত্মার উৎপীড়ন। পৃথিবী তার সমস্ত মহিমা হারিয়ে ফেলেছে। সেই খবর বার বার কানে তোলবার জন্য শহরে না বসে থাকলেও চলবে। আমাকে চলে যেতেই হবে, বৈকুণ্ঠ।

বৈকুণ্ঠ বললেন, কোথায় যাবে ঠিক করেছ?

মাধব বললেন, মন ঠিক হয়েছে, স্থান এখনো ঠিক হয়নি।

কতদিনের জন্যে যাবে?

চিরদিনের জন্যে! মানে, যে-ক’টা দিন আর বাঁচবো।

বক্রকটাক্ষে বৈকুণ্ঠ তাঁর পুরনো বন্ধুর মুখের দিকে একবার বেশ ভালো করে তাকালেন। তারপর ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাই, আমার অনেক কাজ। প্রলাপ আর বিলাপ শোনবার বয়স আমার আর নেই। যেখানেই যাও দু’লাইন চিঠি লিখে জানিয়ো, কবে ফিরছো!

মাধব বললেন, যেখানে যাবো, সে-অঞ্চলে আর যাই থাক্ ডাকঘর একটিও থাকবে না।

বৈকুণ্ঠ দু’পা বাড়িয়ে হাসলেন, ভীমরতি শব্দটা যাবার সময় আর ব্যবহার করবো না। দুষ্টু সরস্বতী তোমাকে সৎপথে চালিত করুন!

বৈকুণ্ঠবাবু আর বাক্যব্যয় না করে সোজা বেরিয়ে গেলেন।

সহস্র বন্ধনে মাধবচন্দ্র এ বাড়িতে বাঁধা। জমিদারি আছে উত্তরবঙ্গে নানা অঞ্চলে, অনেকবার তিনি গিয়েছেন দেশগাঁয়ে, অনেক তালুক তাঁদের খাস থেকে বেরিয়ে গেছে এক এক কালে—আদায় তহশিল কখনো বেড়েছে, কখনো বা কমেছে—কিন্তু শহরের এই প্রাচীন অট্টালিকায় তাঁদের কাটলো তিন পুরুষেরও বেশী। তিনি সংসার করেননি, কিন্তু তার জন্য কী এসে গেল? তাঁর অংশটা এখনো প্রায় অক্ষুন্নই আছে। তাঁর অংশে আছেন গৃহদেবতা, মাসোহারার কতকগুলি লোক, কতক বাধ্যবাধকতা, তাঁর ছবি আঁকার বাতিক, তামাকের নেশা, পানের সরঞ্জাম, তাঁর গাড়িচড়ার অভ্যাস, সিনেমা-থিয়েটারের হুজুগ, ফট্‌কা বাজার আর ঘোড়দৌড়ের মাঠ—এবং সকলের আড়ালে তাঁর নিরিবিলি সাহিত্যচর্চা। তিনি এ পল্লীর সেবাসমিতির সভাপতি, কয়েকটি ব্যাঙ্কের পৃষ্ঠপোষক, বীমা কোম্পানির পরিচালক, সঙ্গীত সঙ্ঘের তত্ত্বাবধায়ক, এবং সাহিত্য মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। সুতরাং এতগুলি বন্ধন থেকে মুক্তি নিয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হবেন, এবং আর তিনি ফিরবেন না, তাঁর এই প্রলাপোক্তি অনেকের কাছে বাস্তবিকই হাস্যকর।

দিন আষ্টেক পরে তাঁর লোকজন ফিরে এসে জানালো, তাঁর ফরমাসমতো কোন নিরিবিলি জায়গা খুঁজে পাওয়া বিশেষ কষ্টকর! মাধবচন্দ্র তাঁদের দিকে চেয়ে বললেন, তোমরা খুঁজে পেলে না, কিন্তু আমি এখানে বসেই আমার জায়গা স্থির করে ফেলেছি।

ছোটবাবু বললেন, কোথায়, কর্তামশাই?

ডোমজুড়িতেই আমি যাবো। আমাদের খাসে ওর দক্ষিণ অংশটা ছিল না?

আজ্ঞে, সে আর এখন নেই। তা ছাড়া—

তা ছাড়া কি বলো?

ওটা আর বাসের যুগ্যি নেই, কর্তামশাই। খানিকটা নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে, বাকিটা গেছে সেবারের মড়কে পরিষ্কার হয়ে।

ভিটেটুকুও গেছে?

একটুখানি চিহ্ন আছে তার এখনো। কিন্তু সেখানে পুরনো নীলকুঠির যত সাপখোপের আড্ডা। তা ছাড়া ওদিকটা আজকাল ডাকাতের ডাঙা। কাছাকাছি বসতি কোথাও নেই, কতামশাই।

মাধবচন্দ্র কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে সহসা একটু হাসলেন। পরে বললেন, হরিপদ, আমি ডোমজুড়িতেই যাবো ঠিক করেছি। তোমরা এদিকের ব্যবস্থা করো।

হরিপদ বললে, কর্তামশাই, ওখানে পত্তনী দেবার পর আর এক ছটাকও জমি নেই কিন্তু।

মাধব বললেন, একলা থাকার মতো একটুকরো মাটি ঠিকই পাবো, হরিপদ।

মাপ করবেন কর্তামশাই, তাদের দয়াতে আপনি থাকতে যাবেন কেন? তারা চিরকাল আপনাদের গোলাম।

অভিমান কিছু না নিয়েই যাবো, হরিপদ। তোমরা ব্যবস্থা করো।

খেয়াল বটে, কিন্তু খেয়ালটা অনন্যসাধারণ সন্দেহ নেই। সেইদিনই জনতিনেক লোকে ডোমজুড়ির উদ্দেশে রওনা হয়ে গেল। মাধবচন্দ্র সমারোহ ভালোবাসেন না। উপকরণ-বাহুল্যকে বর্জন করে নিতান্ত দরকারী জিনিসপত্রগুলিই তিনি সঙ্গে নিলেন। তাঁর অনুচরেরা যাতে তাঁর জন্য অসুবিধা ভোগ না করে সেদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল। তিনি নিজে বিবিধ সামগ্রী পরিত্যাগ করলেও তাঁর সঙ্গীরা তাঁর সুখসুবিধার দিকে নজর রেখে যথাসম্ভব আসবাবসজ্জা ও জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্সবন্দী করলো। সকলেই বিশ্বাস করে, তাঁর এই হুজুগ অল্পদিনেই কেটে যাবে, যথাকালে আবার হাসিমুখেই তিনি ফিরে আসবেন। তাঁর উৎসাহের সামনে এখন কোন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ একেবারেই নিষ্ফল। মাধবচন্দ্রের এই পরিবর্তনের মধ্যে কেমন একটি আকস্মিকতা ছিল, তিনি অন্যমনস্ক মনে এবং একটি নিস্পৃহ গাম্ভীর্যের সঙ্গে সকলের কাছে একে একে বিদায় নিয়ে সুদূরবর্তী গ্রামের দিকে যাত্রা করলেন। যেন একটি কঠিন প্রতিজ্ঞা তাঁকে কিছুকাল থেকে পেয়ে বসেছে। তিনি পিছন ফিরে আর তাকালেন না।

মাঝখানে দু’বার রেলগাড়ির বদল ছিল, তারপর হল গোযানের অভিযান, তারপরে পাওয়া মস্ত নদী—সেই নদী ধরে বজরায় কয়েক ঘণ্টা ভাসতে ভাসতে গেলে তবে ডোমজুড়ির হাট। ডোমজুড়ির হাটে আজকাল আর হাট বসে না, তবে আশ্বিনের শেষে জলকাদা কিছু শুকোলে তবে এক আধজন ফড়ে এবং দু’চারজন হেটুরেকে দেখতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি কিছুদিন এ অঞ্চলে একটা পাটের কেন্দ্র খোলার পর থেকে দু’চারজন মারোয়াড়ি এবং অবাঙালী অধ্যবসায়ীর আনাগোনা চলছে। তারা আসবার সময় নিজেদের সঙ্গে এমন কতকগুলি জিনিস আনে যেগুলি চাষীমহলে খুবই প্রিয়—যেমন চা, তামাক, চিনি, কেরোসিন, রঙিন কাপড় ইত্যাদি।

কিন্তু এই হাটতলা থেকেও ক্রোশদেড়েক দূরে মাধবচন্দ্র তাঁর দলবল নিয়ে তাঁবু ফেললেন। অদূরে এক প্রাচীন জরাজীর্ণ ভিটে, অনেককাল আগে এখানে সাহেবদের নীলকুঠি ছিল। দুখানা পুরনো ইমারতের ঘর এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে—কিন্তু জন্তু আর সরীসৃপের কবল থেকে তাকে আপাতত মুক্ত করা কঠিন। এপাশে অনেক কাল আগে তাঁদেরই এক নায়েবের জন্য দুখানা কাঁচাঘর তৈরী ছিল, কিন্তু একখানায় করোগেট নেই, অন্যখানায় দরজা জানলা সবই খুলে নিয়ে গেছে, আছে কেবল কাঠামোটা। বারংবার বর্ষার আঘাতে তাও মাটি ভাঙাচোরা। মাধবচন্দ্রের জন্য এই কাঁচাঘর দু’খানাই স্থির করা হল।

মনে মনে সকলেই বিশ্বাস করেন, মাধবচন্দ্র এখানে বেশী দিন নয়। সেজন্য তাঁর সহচররা এ অঞ্চলে জমিদারের অভ্যাগমন নিয়ে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ শোরগোল তোলেনি। কিন্তু মাধবচন্দ্র এই ঘর দুটিতেই এরূপ ব্যবস্থাদি করে নিলেন যাতে একথা বিশ্বাস করা যায় যে, তিনি স্থায়ীভাবেই এখানে বসবাস করবেন। জীবনের যে অংশটা উপকরণবহুল সেটাকে তিনি বলে থাকেন নাগরিক জীবন—সেটার সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার একটা বিশেষ মনোবৃত্তি জড়ানো—সেই জীবনটাকে তিনি নগরের অট্টালিকাতেই ফেলে এসেছেন। সুতরাং এখানে এসেছেন তিনি নতুন হয়ে; এখানকার জলমাটি আর পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নেবার জন্য অন্তরের যে স্বভাব-বৈরাগ্যের দরকার, সেটিকে তিনি বহুকাল আগে থেকেই মনে মনে লালন করেছেন। সেই জন্য অনুচরদের মধ্যে যতই উদ্বেগ ও দুর্ভাবনা থাকুক না কেন, তিনি নিজে স্বচ্ছন্দ জীবনের চেহারাই দেখতে পেয়েছেন। কোনো নালিশ এবং কোনো অভাব তিনি বোধ করছেন না।

নব্যপরিবেশের মাঝখানে তাঁর কাজের কোনো খর্বতা ঘটেনি, তাঁর লেখাপড়ার কাজ প্রত্যেকদিন সমান মাত্রার সঙ্গেই চলেছে। কয়েকদিন পরে তাঁর চাকর পরিতোষ এসে সকালের দিকে জানালো, কর্তামশাই, আপনার চা নৈলে একবেলাও চলে না, কিন্তু এখানে দুধ চিনি কোনোটাই যোগাড় করতে পারছিনে।

হাসিমুখে মাধবচন্দ্র বললেন, চা নৈলে আমার একবেলাও চলে না, একথা তোকে কে বলেছে? ওরা কোথায়?

ওরা গেছে ডোমজুড়ির হাটে, যদি জিনিসপত্র কিছু পাওয়া যায়।

মাধবচন্দ্র একবারটি বই কাগজের দিকে মনোযোগ দিয়ে পরে মুখ তুলে বললেন, চা আর আমাকে দিবিনে।

তাঁর কণ্ঠস্বরে কতকটা কাঠিন্য ছিল, সেজন্য পরিতোষ আর কিছু বলতে সাহস করলো না। চায়ের নিত্য অভ্যাস কর্তার পক্ষে ত্যাগ করা যে কত কঠিন, সেকথা পরিতোষ মনে মনে উপলব্ধি করে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে তিনি পান খাওয়া ছেড়েছিলেন, কেন না পান এখানে পাওয়া যায় না, দ্বিতীয়ত, সুপারি ও চুন কিনতে হয় মারোয়াড়িদের কাছে অগ্নিমূল্যে। সে-মূল্য অরাজক দেশেরই যোগ্য। পরিতোষ আর হরিপদরা হাটে গিয়ে জমিদারের নামে ফড়েদের এক আঁধবার হুমকি দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মেড়োরা চাষীদেরকে উসকিয়ে এমন দৃশ্যের অবতারণা করলো যে, ওদের সেদিন হাট থেকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হল।

মাস তিনেকের মধ্যেই যে অবস্থাটা দাঁড়ালো তাতে আর যাই থাক জমিদারের আভিজাত্য নেই। এদেশে সাবান অথবা ক্ষার দুটোই দুষ্প্রাপ্য, গৃহসজ্জা ও পরিচ্ছদকে পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য যে-সকল সামগ্রী আগে পাওয়া যেত—সে বছর মড়কের পর থেকে অদ্যাবধি আর কিছুই পাওয়া যায় না। আহার্য বস্তু যা পাওয়া যাচ্ছে, তা কেবল চাষীজগতের মধ্যেই পরিচিত, সভ্যসমাজের সঙ্গে তার কোন পরিচয় নেই। কারাবাসী চোর-ডাকাতের খাদ্যতালিকা এদের চেয়ে অনেক বেশী উন্নত, এ সংবাদ মাধবচন্দ্র জানেন। হরিপদ অথবা পরিতোষ পাগলের মতো দিবারাত্র ঘুরে বেড়িয়েও এই প্রকার জীবনযাত্রার কোনো প্রতিকার করতে সমর্থ হয়নি। আট দশ মাইলের মধ্যে কোথাও ডাকঘর নেই যে, কলকাতায় খবর পাঠানো যাবে। তাছাড়া মাধবচন্দ্রের কঠোর নির্দেশ ছিল—ডাকঘরে কারো যাওয়া চলবে না। টাকাকড়ি ওদের কাছে যা ছিল, গত তিন মাসে সমস্তই খরচ হয়ে গেছে। তারা অনুমান করেছিল, কর্তামশাই বেশ কিছু টাকা সঙ্গে এনেছেন, কিন্তু কি যেন একটা ব্যাপারে জানা গেছে, তিনি একেবারেই নিঃস্ব। যে কয়টা বাক্স তিনি এনেছেন, তাদের ভিতরে জামাকাপড়ের পরিমাণ যেমনই কম, বই কাগজ তত বেশী পরিমাণেই ঠাসা।

হরিপদ সকালে গিয়ে দুধ আনে অনেক দূর থেকে, কেন না সম্প্রতি দুধের একটা সন্ধান পাওয়া গেছে। পাশে একটা গ্রামে কয়েকটা কলার ঝাড় আছে, কিন্তু এ বছরে তেমন ফলন হয়নি। তবু কয়েকদিন কয়েকটা সবরি কলা পাওয়া গিয়েছিল। হরিপদরা জাতিতে ঘরামি, ডোমজুড়ির ওদিকে এক মারোয়াড়ির গুদাম তৈরীর কাজে সে লেগেছিল, তাতে কিছু সে রোজগার করে এনেছে। পরিতোষ লেগেছিল কয়েকদিন ধানকাটার কাজে। আসল কথা, তারা দুজন মাধবচন্দ্রের চিরকালের অনুগত লোক। কর্তামশাইয়ের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার ও পরিশ্রম করতে তাদের এতটুকু কুণ্ঠা নেই। কিন্তু মাধবচন্দ্রের এই বন্যজীবনের নেশা আরো কতদিনে কাটবে এই ভেবেই তারা আকুল। অথচ মাধবচন্দ্রের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ বড় কম। সম্প্রতি তিনি শকুন্তলা কাব্যের নতুন ব্যাখ্যাটি প্রস্তুত করে রামায়ণের কাজে লেগেছেন। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটির দিকে তাঁর এখন মনোযোগ দেবার সময় নেই। তাঁর অন্ন জুটছে কোথা থেকে, রাত্রে তাঁর বিছানার ওপর মশারি টাঙানো হয় কিনা, তাঁর গড়গড়ার তামাক সংগ্রহের জন্য পরিতোষ কোন্‌ কোন্‌ গ্রামে হানা দেয়, শাক সবজি এবং ফলফলাদির জন্য হরিপদ কি প্রকারে হয়রান হয়—এসব তথ্য জানবার জন্য তিনি একেবারেই ব্যস্ত নন। তিনি তাঁর কাব্য এবং সাহিত্য আলোচনায় নতুন আলো দেখতে পেয়েছেন।

হরিপদ একদিন এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো। চশমা নামিয়ে মুখ তুলে মাধব প্রশ্ন করলেন, তুই কোথায় মারামারি করে এসেছিস রে?

হরিপদ সবিনয়ে বললে, পাটখাটিয়ে নিয়েছে কর্তামশাই, এখন পয়সা দিতে চায় না।

গ্রামের লোকের সাথে ঝগড়া বাধিয়েছিস?

হুজুর, ওরা ঝগড়াই খুঁজছে। আপনি ওদের চক্ষুশূল। ওরা দিনরাত শাসিয়ে যায় আমাদের এখান থেকে উৎখাত করবে।

অপরাধ?

আমরা নাকি খাসদখলের জন্যে এসেছি।

তুই কি খাজনা আদায়ের চেষ্টা করেছিলি?

একেবারেই না, হুজুর। আমরা যে কারো সাতে-পাঁচে নেই, এ ওরা বিশ্বাস করে না। গোড়া থেকেই ওরা আমাদের কোনো মতলব ঠাউরেছে। আমি চৌকিদারকে জানিয়েছিলুম, কিন্তু সে ভয়ে কোনো কথাই বলে না।

মাধবচন্দ্র কিয়ৎক্ষণ কি যেন ভাবলেন। পরে বললেন, তুই এখান থেকে চলে যা।

হরিপদ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। মাধব শান্তকণ্ঠে বললেন, তোরা অনেক করেছিস এই ক’মাস, এবার তোদের ছুটি।

আমরা গেলে আপনার যে চলবে না, কর্তামশাই!

কে বললে তোকে? এ অহঙ্কার কেন তোর? কিছুদিন তোরা আমাকে চালিয়েছিস, কিছুদিন আমি তোদের কাছে আশ্রয় পেলুম। এবার আমি আমার জায়গা খুঁজে পেয়েছি, তোরা চলে যা।—মাধব পুনরায় বললেন, শোন্‌, কলকাতায় গিয়ে কখনো আমাকে কোনো সাহায্য করার চেষ্টা করবিনে। আমার বলবার আগে কেউ যেন আমার কাছে না আসে। এখন আমি ভালোই আছি, তোরা গেলে আরো ভালো থাকবো।

হরিপদ কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললে, আমাকে মাপ করুন, হুজুর। আর কখনো ঝগড়া করবো না কারো সঙ্গে। কিন্তু আপনাকে একলা রেখে আমরা কোথাও যেতে পারবো না।

একলা !—মাধবচন্দ্র ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মতো দপ করে উঠলেন। বললেন, একলা ! সিংহ একা থাকে জঙ্গলে, আর সব প্রাণী থাকে লক্ষ লক্ষ! বেশী বকাসনে হরিপদ, পরিতোষকে নিয়ে তোকে আজকেই চলে যেতে হবে।

হরিপদ আর কোনো কথা বলতে সাহস পেলো না। ওইখানে হেঁট হয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে সে সরে গেল।

এত নিঃসঙ্গতা আছে বলেই মাধবের এত আনন্দ। বিকালের দিকে তিনি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে অথবা পায়চারি করে খানিকটা সময় কাটান। কোনো দ্রুততা এদিকে নেই। দূর মাঠে গরু হেঁটে যায়, কী মন্থর তার গতি—মাঠ যেন আর ফুরোয় না। শিয়াল চলে যায় নিরুদ্বেগে—মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়। আকাশের সকল প্রান্তে আশ্চর্য স্বাধীনতা—বাতাসে কোনো নগরের কোনো কোলাহল এসে পৌঁছয় না। এখানে সংবাদপত্র নেই, কোনো অশান্তি আর হানাহানির খবর আসে না ; জাতির সঙ্গে জাতির মনোমালিন্য এখানে অজ্ঞাত। মাঠের সঙ্গে আছে সবাই মাটির গায়ে গায়ে লেগে, গাছে-পালায় শস্যে-মানুষে কীটপতঙ্গে পশুপক্ষীতে সবাই একাকার—কারো সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ নেই। কেউ স্বতন্ত্র নয়—চারিদিকের এই বিপুল ঐক্যবন্ধনের ভিতরে কোথাও ছন্দের কোনো ভাঙন নেই। মাধবচন্দ্র কেমন যেন অপরিসীম তৃপ্তি ও পুলক অনুভব করেন। এর বেশী কিছু তিনি চাননি, এর কমে তিনি বাঁচতে রাজি হননি। এদিকে সরকারী শয়তানির কেন্দ্র নেই, তাই সবাই সুখী। ব্যবসায়, কারখানা, ইলেকট্রিক, বহু আত্মকেন্দ্রিক লোকের স্বার্থক্রের কোনো সুবিধা নেই—সুতরাং এখানকার মৃন্ময় জীবনের আনন্দ অব্যাহত রয়েছে।

যারা দেখেছে মাধবচন্দ্রকে ছয় মাস আগে তারা তাঁকে চিনতে পারবে না। বর্ণের উজ্জ্বলতা তাঁর আর নেই, আরামপ্রিয়তা তাঁকে ঘিরে ছিল বহুকাল এবং এটা তাঁর পুরুষানুক্রমিক, সেটি তাঁর প্রত্যহের জীবনে আর কোনো চিহ্ন রাখেনি। তাঁর পায়ে কোনো পাদুকা নেই, পরনে জীর্ণমলিন একখানা খাটো ধুতি, কখনো বা একটা জোব্বা, বেশীর ভাগ সময় খালি গা। তাঁকে দেখলেই গত জীবনের প্রেত বলে মনে হবে। পাকা সোনা আগে ছিল চকচকে, এখন আগুনের আঁচে সেটা কালিবর্ণ হয়েছে। সুবিধা হল এই, মরচে ধরা লোহার সঙ্গে তার পার্থক্য কম। মাধবচন্দ্র এখানকার মাঠের জল-মাটির সঙ্গে মিলে গেছেন।

হরিপদ চলে গেছে। সে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে সে কর্তামশাইয়ের সম্পর্কে কোনো অপ্রীতিকর সংবাদ দেবে না। পরিতোষ যেতে চায়নি, সে অনেক কান্নাকাটি করে আরো কয়েকদিনের জন্য থেকে গেছে। সে নাকি খাবার জল আনে, কাপড় কাচে, ঘরদোর ঝাড় দেয় এবং কাঠ জ্বালিয়ে এটা-ওটা রান্না করে। এগুলি অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর কাজ—একাজের জন্য তার থেকে যাওয়া একেবারেই বাহুল্য। আসল কথা, কতার কাছে সে আবাল্য মানুষ হয়েছে। তার মন মোহগ্রস্ত—সহজে সে কাছছাড়া হতে চায় না।

কিন্তু সেই পরিতোষের অন্তিমকাল যে এইভাবে ঘনিয়ে এসেছে, সেকথা মাধব ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি। হরিপদর যাবার দিন আষ্টেক পরেই বেচারা নামা-ওঠা রোগে সহসা আক্রান্ত হয়, এবং কোনো প্রকার ঔষধপত্র ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করার আগেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে মারা যায়। এই শোকাবহ ঘটনাটি ঘটে ঠিক সন্ধ্যার পরে। পরিতোষের মৃতদেহ সামনে নিয়ে মাধবচন্দ্র শান্তভাবে অপেক্ষা করেন। রাত্রি অতিক্রম না করলে মৃতের সৎকার কোনো প্রকারেই সম্ভব নয়।

পুরাকাহিনীতে দেখা যায়, মানবতা ও সংস্কৃতির যজ্ঞ পণ্ড করার জন্য যুগে যুগে দুষ্ট শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। মৃত্যু, বিপ্লব, মন্বন্তর এবং অসৎশক্তির চক্রান্ত প্রগতিকে বার বার ব্যাহত করার চেষ্টা করে। মাধব একথা জানেন। কিন্তু তাঁকে সব খোয়াতে হবে এও ঠিক। তাঁর সাধনা হল সর্বস্বান্তের সাধনা, তাঁর পথ হল সর্বহারার। লোকযাত্রার কৃত্রিম চেহারাটা তাঁর জানা আছে, জীবনের কদর্য বিকৃতি, ভয়াবহ অপচয় সে অভিজ্ঞতাও তাঁর নতুন নয়। হরিপদ পরিতোষ এরা তাঁর সর্বাপেক্ষা আপন কেন না এদের ভিতর দিয়ে মানুষকে তিনি পান, আদর্শের দিকটা তাঁর চোখে পড়ে, মানবতার রূপটিকে প্রত্যক্ষ করেন। এরা সাধারণ কিন্তু এরাই অসামান্য। এরা জীবনকে সুন্দর করে বিশ্বাসের বনিয়াদকে নির্মাণ করে, প্রাণকে আনন্দিত করে তোলে।

মৃতদেহটাকে কোনোমতে চাপা দিয়ে রেখে তিনি ভিতরে এলেন। দূরের গ্রাম থেকে আজ সকালে পরিতোষ কেরোসিন আনতে পেরেছিল কিনা তিনি জানতে পারেন নি। এ অন্ধকারে কিছু খুঁজে পাওয়া তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। সুতরাং আর কোনো দিকে চেষ্টাচরিত্র না করে তিনি তাঁর দরিদ্র বিছানার ওপর গা এলিয়ে শান্তভাবে শুয়ে পড়লেন।

সম্ভবত জীবনের আরো একটা রূঢ় অভিজ্ঞতা লাভ করা তাঁর বাকি ছিল। গ্রামের চাষীমহলে নির্বোধ হরিপদ আর পরিতোষ যে যে বিবাদ ও মনোমালিন্য সৃষ্টি করেছিল সেটা যে ধূমায়িত হয়ে চলেছে অনেক দিন পর্যন্ত সেটার সম্বন্ধে মাধব একেবারেই এতটা অবহিত ছিলেন না। তারা যে আজ গভীর রাত্রে তাদেরই পাওনা নিতে এসেছে, এও তিনি কল্পনা করেননি। সারাদিন পরিশ্রমের পর মাধবচন্দ্র অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

ব্যাপারটি অপ্রত্যাশিত হলেও অসাধারণ নয়, এমনকি গ্রামাঞ্চলে এ রকম ঘটনা সচরাচর ঘটেই থাকে। বাড়ির একটা অংশে আগুন লেগেছিল, মাধব ঘুমের ঘোরে কিছুই টের পাননি। সেই আগুন ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে যখন চারিদিক থেকে বেরাজাল তৈরি করেছে তখন হয়ত তাঁর ঘুম ভেঙ্গে থাকবে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পরদিন অথবা তারও পরদিন—ঠিক হিসাবটা মেলে না, হরিপদ এবং আর দুজন লোক মাধবের বিধবা ভগ্নী ও তাঁর বড় ছেলেকে নিয়ে হাজির। কিন্তু বাড়িখানা এমনকি নীলকুঠির সীমানা পর্যন্ত এমনভাবে ভস্মীভূত হয়েছে যে ঘর-দরজার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত রেখে যায়নি। দগ্ধাবশেষ জিনিসপত্রের মাঝখানে মাধবের অন্তিমকালের এটা-ওটা সামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল বটে। স্তূপাকার গ্রন্থাবলী ও কাগজপত্র সমস্তই ধ্বংস হয়ে গেছে।

ভগ্নী সারাদিন বসে কাঁদলেন। হরিপদ এখানে ওখানে গিয়ে খবর নিয়ে জানলো, আগুন লেগেছিল মাঝরাতে—সে বিরাট আগুন—তার চতুর্দিকব্যাপী লেলিহান শিখা থেকে কর্তামশাই অথবা পরিতোষ কেউ বাঁচেনি। তাঁদের ভস্মীভূত কঙ্কাল সেই ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে ধূলিরাশিতে পরিণত হয়েছে সন্দেহ নেই।

অপরাহ্নের দিকে সকলে বিদায় নিলেন। আগামী দুদিনের মধ্যেই এ সংবাদ কলকাতার সকল সংবাদপত্রেই ছাপা হবে। বলা বাহুল্য মাধব রায়ের শেষ জীবনের ইতিহাস শুনে দেশের অনেকেই কৌতুক বোধ করবে।

গুয়াখোলা ওখান থেকে আট ক্রোশ দূরে। ছোট্ট চাষী গ্রাম। মুসলমান ও নমঃশূদ্র মিলে আট-দশ ঘর লোকের বাস। এ পাশে ছোটখাটো একটি জলের বাঁধ, ওধারে কয়েক ঝাড় কলাগাছ। এদিকে এবার ফসল হয়েছে মোটামুটি ভালো। মরাইগুলিতে ধান উঠেছে। মেয়েরা চাল তৈরীর কাজে লেগেছে।

মাধবচন্দ্র একটি ছোট্ট চালায় আশ্রয় পেয়েছেন। তাঁর আধপোড়া চেহারা, মুখে দাড়ি এবং পরনে জোব্বা দেখে মৈনাকের বউ জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি জাত গো?

মাধব বললেন, বাউলের কি জাত আছে মা?

ঘর কোথা?

মা গো, সংসারময় আমার ঘর। মায়ের কোলে আছি দিনরাত।

ছোট ছেলেমেয়ের দল মাধবকে ঘিরে কী যেন আমোদ পায়। লোকটা কত রাজ্যের গল্প জানে। হাতিখেদার রাজপুত্ত্বর—সে গিয়েছিল মহাবনে, সেখানে ছিল ময়দানবের প্রাচীন অট্টালিকা—সেই অট্টালিকায় থাকতো সোনার নূপুর পায়ে পরা স্বর্গের অপ্সরী চিত্রলেখা ;

তারপর?

সেই মহাবনে থাকতো এক মহাপীর, সে ছিল পয়গম্বর ;

তারপর?

বাউল বলে, বলবো সেই গল্প, শুনে তোরা ধেই ধেই করে নাচবি। ঠিক যেন জলফড়িং—ঝুমুর ঝুমুর নাচ।

ছোট ছেলেমেয়েরা ভারি মজা পায়। এমদাদ কাছে এসে হেসে বলে, কর্তা, তোমার জন্যে আমাদের কাজকর্ম হয় না ;

কেন ভাই?

হুল্লোড় করে তোমার থনে, কাজে মন নাই বউঝির।

মাধব হেসে বলে, আমি যে ওদের সকলের ছেলে—গাঁ-ভরা আমার মায়ের দল ;

এমদাদ খুশি হয়ে চলে যায়। মাধবের প্রতিষ্ঠা এখানে বেড়েছে। সাদাতের বড় মেয়ের পায়ের ঘা সারে না কিছুতে—বাউলের টোটকা তার ঘা সারিয়ে এনেছে। বাউল নিজের হাতে বেঁধে খাওয়াচ্ছে জটীরামকে আজ কদিন হল—লোকটার পেটের ব্যামো সারলো এতদিনে। একদিন হাফিজ মোড়ল তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কিছু কাজ জানো কর্তা?

জানি বৈকি, বাপজান। তোমার গরু ক’টাকে আমি খাওয়াবো, চরাবো। খামারে কাজ করবো। মোড়ল খুশি হয়ে বাউলকে একখানা কম্বল দিয়ে গেল। বাউলের কাজ ফুরোয় না সারাদিনে। ছেলেমেয়ের দলকে সে পড়ায়, গল্প শোনায়, তাদের কাপড় পরতে শেখায়, স্নান করায়—আবার তাদের মন ভোলাবার জন্য সঙ্গীত সঙ্ঘের সভাপতি লালন ফকিরের গানও গায়। বাউলের গান শুনতে আসে পাশের গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ। মাধবচন্দ্র বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।

এই ভালো, এর চেয়ে ভালো আর কল্পনায় নেই। সব ভুলে থাকা, সব হারানো, আত্মাভিমানের বোঝা নামানো পথের ধারে—এর চেয়ে সুখ আর নেই। সভ্যতার রেশ এখানে পৌঁছয়নি, নগরের কোনো মালিন্য নেই—এই ভালো। শকুন্তলা, রামায়ণ আর মহাভারতের ব্যাখ্যা হল এই নতুন জীবনে। বিরাট মহাজীবনের বীজ এখানকার মাটির নীচে ধীরে ধীরে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। মাধব রায়ের মৃত্যু ঘটেছে অগ্নিকাণ্ডের নীচে, সেই অঙ্গারের থেকে উঠেছে বাউল ভস্মরেণু মেখে।

মৈনাক আর তার বউ, হাফিজ মোড়ল, জটীরাম আর এমদাদ, মুনিয়া আর তার মা, সখারাম আর সাদাত—তার সঙ্গে আসে মাঠের লোক, গাঁয়ের নরনারী, আর সবাই, আর সকলে—ওরা বাউলের গানের আসরে ভিড় করে। মাধব মনে করেন, এই হল অমৃতলোক মৃত্যুর ভিতর দিয়ে উঠে আসা এই লোকে। বিপুল অন্ধকার পৃথিবীব্যাপী, সর্বনাশা ধ্বংসের চক্রান্ত দিগ্‌দিগন্তে, রুদ্রের করাল ভ্রুকুটি ছেয়ে গেছে বিশ্বময়, জীবনের অপচয় আর অপমৃত্যুর প্রবাহ চলেছে দেশ-দেশান্তরে ; কিন্তু গুয়াখোলার এই ছোট্ট গ্রামে সোনার ধানের ক্ষেত পেরিয়ে প্রান্তর আর জলাবিল ডিঙিয়ে একটুখানি শান্ত অপার্থিব আলোর রেখা বাউলের বেড়াবাঁধা এই ঘরটির প্রান্তে এসে নেমেছে। মাধবচন্দ্র প্রাণের আনন্দে গান ধরেন—আর আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে তাঁর দুই চোখ বেয়ে।

১৩৫৪ (১৯৪৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *