গঙ্গাযাত্রা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
‘বলিসনে, উ কথা বুলতে নাই। বমভোল আমাদের দেবতা। আমরা যদি ওদের কাজকম্ম না করব, তা হলে করবে ক্যারা? লে, ডাক, সব জুটেপুটে সকাল করে বেরিয়ে পড়—হাঁ রে, সুধীর আছে? আ কাড়ছিস না যে রে? ভাত খেঙেছিস তো, দে হুঁকো দে—’
হুঁকো দিয়ে পানু মোড়ল বললে, ‘এই দ্যাখ দামুদা ; তু আগাগোড়া না বুঝে হড়বড় করে বকে যাস। তাইতে বেজায় আগ-দুঃখ হয়। বামুনরা যখন ঠেলায় পড়ে তেখুনি এই চাষাদিকিন ডাকে। আর অন্য সময়ে, খাবার সময়ে, বলে, ও চাষা, হবে পরে হবে। বামুনদের অনেক উবকার করে দেখলাম। ওরা বেজায় বজ্জাত—’
‘আরে এ তো ই-দিশি বামুন লয়, এ বামুন পাকিস্থলী হনে আলছে।
সে আবার কি! পানু মোড়ল তাকিয়ে রইল।
‘ঐ যে রে—পাপীস্থান না পাখিস্থান হয়েছে—সেই মুলুকের লোক। বাঙাল বামুন’।
যেই বামুনই হোক, উপকার করতে নাই। বাঙাল তো, গাঁয়ের শ্মশানে পুড়িয়ে দিক না। গঙ্গায় যাবার সাধ হয় কেন? ওদের দেশে গঙ্গা দেখেছে কোনোদিন? বিভুয়ে যখন মরতে এসেছে তখন আবার গঙ্গা না পুকুরের গাবা অত দেখবার কী দরকার!
কি বলিস তার ঠিক নাই। যখন গঙ্গার সীমানার মধ্যে এসেই পড়েছে তখন কার না ইচ্ছে হয় গঙ্গাতীরেই দাহন হোক। তাই বুড়োর স্ত্রী চাটুজ্জেমশায়কে ধরেছে। আর চাটুজ্জেমশায়ের কথায় আমি তোদের কাছে এসেছি।
তা তুমি এসেছ ভালই করেছ। কিন্তু ঐ চাটুজ্জেমশায়ের কোনো কাজ করতে আমাদের মন সরে না।
‘বলে কি জানিস? বলে চাষারা সব মড়া গঙ্গায় দেয় না, নদীতে ফেলে দেয়, নইলে কুমিরের গোলের মুখে মড়া রেখে গোয়ালদের বাথানে গিয়ে ঘুম মারে। এই সব কথা শুনে মন কেমন হয় বোল্ দিকিনি। কাজ কামাই করে তিন-চারদিন কষ্ট কত্তে লোক যাবে ক্যানে? আরো তো পাড়ার অনেক আছে—ডাকো সমাইকে, তারপর যা হয় তাই হবে’।
যে লোক সুপারিশ করতে এসেছে সে গাঁয়ের চাষাদের একজন মাথাল-মুরুব্বি। নাম দামোদর। রামহরি চাটুজ্জে আবার তাকে ডেকে পাঠাল।
‘কি ব্যাপার বলো তো? তোমরা থাকতে এ বিদেশী দুঃস্থ ব্রাহ্মণ গঙ্গা পাবে না? শেষকালে শ্মশানে পুড়িয়ে দেব? সন্ধে হল, যা হয় কথার একটা শেষ কর। ভদ্দরলোকের স্ত্রী তো যা লাগে সব টাকা দিতে রাজি—’
‘আচ্ছা, মড়া আপনি শ্মশানে পাঠিয়ে দিন। আমি দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে’।
গাঁয়ের বাইরে একটা পতিত ডোবার ধারে শ্মশান। সেইখানে মুখাগ্নি করে লাশ পেশাদার মড়া-ফেলাদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। সবচেয়ে নিকট-গঙ্গা এখান থেকে বারো তেরো মাইল, সারা রাস্তা বুনো ঝোপে ঝাড়ে ভরা, কোথাও বা দ, কোথাও বা সৃষ্ট নদী। ডোঙাতে-নৌকাতে পার হতে হয় মড়া নিয়ে।
ভদ্দরলোকদের সাধ্যি নেই মড়া কাঁধে নিয়ে অতটা পথ হাঁটে, রাস্তার অত ঝঞ্জাট পোহায়। তাই টাকা কবলে পরের হাতে মড়া ছেড়ে দিতে হয়। মড়া-বওয়া লোকেরা ভাবে, একটা দাঁও জুটেছে।
ভুড়ি চুলকোতে চুলকোতে দামোদর মণ্ডল আবার এসে দাঁড়াল মজলিশে। বললে, ‘তোরা এ গাঁয়ের মানসম্মান আখবিনে? আমার মুখটা ছোট করে দিবি? আমহরি চাটুয্যের সঙ্গে ঝগড়া বলে ঐ বিদেশী বামুনের তোরা গতি করবি না?
কানিকুড় লাফিয়ে উঠল। বললে, ‘আমি যেতে আজি আছি, সব কটা যদি আমাদের জাত হয়। ঐ যে তুমরার লবশাক—ও আমি মানতে চাই না। ঐ শালা তাঁতির সঙ্গে এক কাঁধে মড়া বইব না। শালার তাঁতি বলে কি, সৎগোপের চেয়ে তাঁতি বড়’!
‘এ গাঁয়ে লোক কুলোয় না বলেই তাঁতি-তামিলি কামার-কুমোর ধরতে হয়’।
‘ক্যানে, ভিন গাঁ থেকে আনাও তাঁতি বাদে, অন্যা জাত লাও। তাও হবে না? নোকই বা চাই কত? ন-দশজন হলেই হবে। আমার হব ছ’জন, আর তিন-চারজন হবে না? না হয় নাই হবে। ছ’জনাতেই যাব। কষ্ট হবে, তার আবার কি!’
‘তা হলে বেরিয়ে পড় সব। তারা তো শ্মশানে চলে গেলছে। তোমাদের সবাইকে এক জায়গায় এক কথায় না পেলে আমি গিয়ে বুলব কি? সেটা বোঝো?
‘শুদু আমাকে বললে তো হবে না। আর সব কই? আমার মনের কথা শুদু বললাম’।
‘তোদের সব আক্কেল নাই? দামোদর ধমকে উঠল : ‘সব চালই বাইশ পশুরী। টাকাও লিবি আবার ঘোঁটও করবি। যা, সব ডাক, বেরো, তারপর দেখছি। ক’জন হচে, তারপর অন্য কাউকে ডাকবার বেবোস্তা। আমি ঠাকুরদের কাছে চললাম’।
মড়া শ্মশানে পাঠিয়ে দিয়েছে রামহরি। দ্বিতীয় পক্ষের সবচেয়ে বড় ছেলেটির বয়েস তেরো-চৌদ্দ। সে গিয়েছে মুখাগ্নি করতে। আর কটি কাচ্চা বাচ্চা, একটি বাড়ন্ত গড়নের কুমারী মেয়ে, তাদের মাকে ঘিরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বিদেশী বাঙালের পক্ষে গলা ছেড়ে কান্নাটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। আর মা খালি মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে নিঃসাড় হয়ে। কেন মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারছে না এই তার লজ্জা।
মুনিষ এখনো যোগাড় হচ্ছে না। শীতের রাত কনকনে হাওয়া দিয়েছে, এখন সবাই যেতে রাজি হলে হয়। সব তো গেছেই, বাড়িঘর জোত-জমি, সংসার-গৃহস্থি—এমন কি ভবিষ্যতের জীবিকা—তারপর মড়ার পর এই একটু গঙ্গাপ্রাপ্তিও জুটবে না?
জুটবে। আপনি ব্যস্ত হবেন না। এই সব এসে পড়ল বলে। তবে এ রাত্তিরে বেরুতে চাইবে না হয়ত। বেরুলেও রাস্তার মাঝে এক জায়গায় বসে থেকে রাত কাটাতে হবে। তার চেয়ে এক কাজ করা যাক। মড়াটা গাছিয়ে রাখা যাক আজ রাতে। কাল ভোর ভোর ঠিক চলে যাবে কেঁধো-রা।
‘তুমি যা ভাল ঝেঝো—’ রামহরির এদিকে অনেক ব্যবস্থা বাকি।
‘কিন্তু টাকা কত দেবেন? দামোদর মুখে একটা কুণ্ঠিত ভাব আনল।
তার জন্যে আটকাবে না।’
‘আক্রাগণ্ডার বাজার। কেঁধো দশবারোজন হবে কাঠ—মোট আছে, ঘাটের ডোম, চাল মুড়ি—বাজার আজকাল আর বসে নেই বাবু, খালি ছুটছে, ছুটছে, পই-পই করে ছুটছে—’
সে একটা বিবেচনা করে দিতে হবে বৈকি। তোমার এখনো লোকই যোগাড় হল না।
‘না, হয়েছে’। কানিকুড় এসে বললে, ‘নোক সব ঠিক হয়েছে। আমরা সাত জন, কম্মকারদের দু’জন, আর ভোপেন নাপিত—এই দশ জনাতেই হবে। পথ এখন খরা-শুকনো বটে, তবে এ আত্রিতে কেউ যেতে চাইছে না, বলছে—খুব শীত, সারা আত্রি কষ্ট হলে দিনে তখন হাঁটব কি করে? মড়া আজকের মতন গাছিয়ে থুলে ভাল হয়। কাল ঠিক আত থাকতে সম-সম কালে উঠে পড়ব সবাই। নদীতে এখন পার-পারোয়ারী নাই, সাঁ সাঁ করে চলে যাব এক বগগা’।
তাই ভাল। যে ক’জন মুনিষ যোগাড় হয়েছে সঙ্গে করে দামোদর শ্মশানে চলল। মুখাগ্নি সারা হতেই খাটুলি-সমেত মড়াটা একটা আমগাছের উপর খড়ের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখল।
যেখানে যা বিধি-ব্যাপার তাই পালন করতে হবে। সমস্ত পরিবার তাই কিছু জিজ্ঞাসা করে না, প্রতিবাদও করে না। এ অঞ্চলে তারা বিদেশী, তারা বাঙাল, যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, চোখেমুখে এমনি একটা ভয়খেকো অপরাধীর ভাব। যতক্ষণ শ্বাস আছে পরের দয়ার উপরই বাঁচতে হবে এমনি একটা নিঃসম্বল অবোলা প্রাণীর কৃতজ্ঞতা। এখানে এসে তাদের একজন যে হঠাৎ মরে গেল, এই যেন তাদের কত বড় ত্রুটি।
রামহরিই তাদের জন্যে যা করছে। তাই রামহরির দিকেই তারা এগিয়ে থাকে।
‘এমনি সব মড়াকেই গাছায়। এ কিছু নতুন নয়। শীতের রাতে কেঁধোরা যদি চলতে না চায় তবে মরা এমনি গাছেই বেঁধে রাখে’। একটু কৈফিয়ত দেবার মত করে রামহরি বলে।
প্রমীলা আর তার নাবালক ছেলেমেয়েরা অবোধর মত একবার তাকায়।
‘আমরা এবার তবে বাড়ি ফিরি’। বললে কানিকুড়।
‘ঠিক-ঠিক সময় ডাক দিলে উঠবে তো? না, তখন ঘুমের ঘোর ছাড়বে না?’
‘ঘোর ছাড়বে না—এ কি তামাসার কথা?’
‘আমার মন এই রেতে গেলেই ভাল হত’। বললে ভূপেন নাপিত, ‘পথে এক জায়গায় আগুন-টাগুন জ্বেলে একটু বিচরাম কল্লেই হত। তা আর সমারি মন সমান হল না’।
‘তা যা হবার তো হল—এখন, বাবুদাদা, টাকা কত দেবেন বলুন দেখি। সবাইর সামনেই দামোদর কথাটার আস্কারা করতে চাইল : ‘গঙ্গাতীরে বেজায় খরচা। দোকানদাররা মড়াওলা দেখলেই দু পয়সার জিনিসে আট আনা দাম ধরে। হাতি বেকচ্চায় পড়লে চামচিকেও লাথি মারে আজকাল’।
‘এক বস্তা চাল আর মুড়ি আর এক ঘটি গুড় আমি দিচ্ছি। আর—’ ঘরের মধ্যে ফাটা লণ্ঠনের আলোতে প্রমীলাকে একবার দেখতে চাইল রামহরি। ‘আর নগদ টাকা গোটা ষাট’।
দলের ভিতর থেকে রগচটা দুকড়ি ঝাঁঝিয়ে উঠল : ‘দশজন নোক যাব—তাও কেও ঢোসা নোক নই, ঘেসো ভুঁড়ি লয়, সব জোয়ান মর্দ-দশজন না হলে ঐ বুড়ো মড়া বেজায় ভারী হবে, টানব কি করে? ঐ ষাট টাকায় কি হবে? প্যাট পর্যন্ত নামবে না। প্যাট তো এখানে থুয়ে যাব না মশায়। সঙ্গে যদি কিছু যায় প্যাটই যাবে। প্যাটে দুটো না খেলে হাঁটব কি করে?’
খুব কড়া তাকেই রয়েছে আর সবাই। কানিকুড় বললে, ‘বেশ, আপনারা একজন সঙ্গে চলুন কেনে। ষাট টাকা ছেড়ে দশ টাকায় হয় আমাদের আপত্তি নাই। তিনবেলা আন্না, চারবেলা জলখাওয়া। ঘাটের ডোমের পাওনা, কাঠ-মোট—ঘি—হিসেব করুন কেনে—’
‘কত, চাও কত তোমরা?’ রামহরি দামোদরের শরণ নিল।
দামোদর মুখ গম্ভীর করে বললে, ‘ছ কুড়ির কম হবে না।’
‘বিদেশী লোক, সব ফেলে-বেচে উদ্বাস্তু হয়ে চলে এসেছে—এদের বেলায় একটু কমসম করে না নিলে চলবে কেন দামুদা?’ রামহরি তাকাল আরেকবার প্রমীলার দিকে।
প্রমীলা ততক্ষণ উঠে বসেছে মাটি ছেড়ে। পাড়ার মেয়েরা যারা তাকে ঘিরে বসেছিল এতক্ষণ আস্তে আস্তে একে একে উঠে চলে গিয়েছে। ফাঁকায় একবার চোখোচোখি হয়ে গেল।
যেন বলল, আমি আর কি বলব? আমার আর কি বলার আছে? দরদামের আমি কি জানি? আপনি যা ভাল বোঝেন করুন। আমার স্বামী যেন গঙ্গা পায়। লেখাজোখা নেই এত ধকল গিয়েছে তাঁর উপর দিয়ে যেন গঙ্গাতীরে একটু শান্তি পান শেষ দিনে।
মরার আগে অনেক করে বলে গিয়েছে প্রমীলাকে, ভিটে-মাটি ছেড়ে যখন এদেশেই চলে এলাম, তখন মা-কালী করুন, যেন গঙ্গা পাই। জ্ঞান-গঙ্গা তো হবে না, অন্তত গঙ্গাতীরে দাহনের ব্যবস্থা কোরো।
স্বামীর অসুখ বাড়াবাড়ি হয়ে উঠতেই একশোটা টাকা প্রমীলা রামহরির কাছে জিম্মা রেখেছিল। বলেছিল, যখন যা দরকার খরচ করবেন। যতদূর সাধ্য, চিকিৎসার যেন না ত্রুটি হয়। যেভাবে পারেন, বাঁচিয়ে তুলুন ওঁকে—
বাঁচানো গেল না। অনেক করেছে রামহরি, তবু বাঁচানো গেল না। এখন মরণে অন্তত একটু আসান হোক.। এ জন্ম তো গেল, যদি এর পরে আর কোনো জীবন জন্ম থাকে!
দলের মধ্যে সুধীরই খুব করিয়ে-কম্মিয়ে। সে খেপে উঠে বললে, “যদি মশায় টাকার ক্যাঁচ করেন তা হলে কেও যাবে না। সোজা কথা মশায়। তা হলে মড়া নামিয়ে পুড়িয়ে দেন গা’।
‘তা নয়তো সঙ্গে চরণদার দিন, সে দেখুক কোথায় কত টাকা লাগে—’ দুকড়ি টিপ্পনি ঝাড়লে।
‘তেমন কোনো আত্মীয়স্বজন হলে হত! কে আছে ওদের? এই কটা নাবালক শিশু।’ রামহরি স্নেহকরুণ চোখে তাকাল সবাইর দিকে।
‘আর চরণদার দিলেই বা কি! যা বলব ঘাটের ডোকল তাই আদায় করে লেবে। লইলে ঝিল সাজাবে না’। বললে কানিকুড়। ‘ঘাটওলা দোকানওয়ালা ওরা কি আমাদের থেকে কিছু আলাদা?’
‘তোমাদের কি এদের মুখের দিকে চেয়ে একটু দয়ামায়া হয় না?’ রামহরি আবার মিনতি করল।
‘আমাদের মুখের দিকে কোনো শালো তাকায় তো কই দেখি না। যে সদ্গতি করে দেবে তারই বেলায় পয়সা নাই। ঐ যে বলেছে না, যে এল চষে সে থাক বসে, নাড়াকাটাকে ভাত দাও, খাক ঠেঁসে ঠেঁসে। এখানে এসে দিব্যি তো একটুকরো জমি লিয়েছে, ঘর তুলেছে একখানা—পয়সা নাই তা মানব কেনে?’ বললে সুধীর।
ভূপেন নাপিত একটু মোটা বুদ্ধি। বললে, ‘তুইই যখন গেলি তখন জমি-বাড়ি এখে লাভ কি? যার জমি-বাড়ি তার কাজেই খরচ হয়ে যাক। এতেই তো শেষ লয়, এর পর ভোজ-ফলারেরও তো যোগাড় দেখতে হবে—’
দুর ছাই! দরকার নেই গঙ্গায় গছিয়ে। শ্মশানেই দাহ হয়ে যাক। কি মনে করে রামহরি নিজেকে আবার তক্ষুনি গুটিয়ে নিল। না, বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল লোকটার। এই যে না-জানা রাস্তা ধরে চলে আসা, এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে—এটাকে সে একটা তীর্থযাত্রার মূল্য দিতে চেয়েছিল। যদি মরি যেন গঙ্গাতীরে দাহ হয়। উদ্বাস্তু-উদ্ধারিণী গঙ্গা।
‘বেশ, মুনিষ সব তোমরা ঠিক থেক। যাও, ঘ্যানরঘ্যাং কোরো না—আশি টাকাই দেব। আশি টাকাই আমার কাছে আছে’। রামহরি বললে শেষ কথা।
‘হেরজা হোরজা করেই পাঁচ কুড়ি টাকাই দিয়ে দেবেন।’ বললে দামোদর। সব ব্যালেক মার্কেট মশায়, সব ব্যালেক। আঙ্গার-ধোঁয়াও ব্যালেক’।
‘না, এর বেশি আর এক পয়সা নয়’। রামহরি হুমকে উঠল।
সবচেয়ে বড় ছেলেটিও যেন তাতে সায় দিয়ে রামহরির পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।
কানিকুড় বললে ছেলেটিকে লক্ষ্য করে : ‘গঙ্গার দেশে এসে গঙ্গা দিতে না পারাটা অধম্ম। তা এখন বাপু কি করবা? দেশের আজকাল বোলচালই এই রকম। তা ছাড়া বাবা তো বারে বারে আসবে না। এ দায়ই তো একবার—
‘না, তোমাদের দিয়ে হবে না। আমি মাতুনগর যাচ্ছি’। রামহরি নিজের বাড়ির দিকে এগুতে লাগল ; সেখানে আমাদের প্রজা আছে, খাতক আছে। ওদিকে ধরলে নিশ্চয়ই কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে। তোমাদের মত তারা এমন অমানুষ নয়’।
মাতুনগর এখান থেকে প্রায় তিন পো রাস্তা। তা হোক গে। বাড়িতে বাঁধা মুনিষ আছে, তার হাতে একটা লণ্ঠন আর নিজের হাতে একটা তেলে-পাকানো লাঠি নিয়ে সটান চলে যাবে রামহরি। সে যখন মনে করেছে তখন সমাধা সে করবেই।
বাজি চটিয়ে দেয়া হল নাকি হে?
রেখে দাও। মাতুনগরের লোকেরা দেড়শো টাকা চাইবে। তার এক আধলা কম নয়। আর ও অমনি মাতুনগর যাবে তুমি বিশ্বাস কল্লে? ও শুধু একটা ভুজুং দিয়ে দর নামাবার চেষ্টা।
তাছাড়া আবার কি! সেখানে ওর কত প্রজা, কত খাতক! খাজনা বলতে দু আনা/তিন আনার কোর্ফা আর খাতক বলতে চার-পাঁচ টাকার হ্যাণ্ডনোট। যত বারফট্টাই ঐ বাঙালদের সামনে কোরো। আমাদের চোখে ধুলো দিতে হবে না।
হ্যাঁ বাবা, খুঁটি আঁকড়ে পড়ে থাক। আমাদের দর ঠিক মেনে নেবে।
বড় ছেলেটি এসে দামোদরকে ডেকে নিয়ে গেল মার কাছে।
“দামুর কথা ছামু-ছামু। পাঁচকুড়ির কম হবে না। পাঁচকুড়িই লেয্য টাকা।
‘ওঁর হাত থেকে আপনারা আশি টাকাই নিন, বাকি কুড়ি টাকা আমি লুকিয়ে দিচ্ছি’। ছেলেকে দিয়ে প্রমীলা বাক্স খোলাল। টাকা দেওয়াল কুড়িটে। বললে, ‘মুখে-মুখে ওঁর কথাটা মেনে নিন—মোটমাট আপনাদের পাওনা ঠিকই মিটে গেল। বাড়তি টাকা পাবার কথাটা ওঁকে জানতে দেবার দরকার নেই। কাজটা ভালয়-ভালয় সেরে দিন। ওঁকে আমরা অনেক কষ্ট দিয়েছি—
‘না, না, কষ্ট কি! কাজ আমরা ঠিক উদ্ধার করে দেব’। দশ টাকার নোট দু’খানা দামোদর কাপড়ের খুঁটে গিঁট পাকিয়ে-পাকিয়ে বাঁধল।
সুধীর বললে, ‘নগদ টাকা মাইরি—আগাম। চল্, সনজের ঝোঁকে দু-পাত্তর আগে হোক—’ দামোদর একবার ভাবলে রামহরির সঙ্গে রফানিস্পত্তিটা আগে সেরে রাখি। মাতাল শালার নাম শুনে মনটা অন্যদিকে ভেসে পড়ল। কিন্তু যার-যার ভাঁড় তার-তার পয়সা। এ টাকা এজমালি।
সব শুতে যাবে-যাবে এমন সময় মাতুনগরে পৌছুল রামহরি।
দু হাঁটুর ফাঁকে হুঁকো চেপে ধরে মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে ‘ব’-টান দিচ্ছে অধর, রামহরি কাছে এসে দাঁড়াল।
‘একি, চাটুজ্জে মশায়? এত আতে? কি মনে করে?’ ‘ব’-টানের পরে ছোট করে ‘শুঁ’-টান আর মারা হল না, অধর হুঁকো গুটোল।
‘তোমাকে কজন “কাঠুরে” যোগাড় করে দিতে হবে। গাঁয়ের লোকে কেউ গঙ্গা দিতে যাবে না। অসম্ভব টাকা হাঁকছে। তাই বিপদে পড়ে তোমার কাছে আসা। তুমি আমার আপ্তজন’।
‘মরেছে কে?’
‘পাকস্থলীর এক বামুন। সর্বস্ব খুইয়ে এসেছিল বিঁভুয়ে, শেষকালে নিজের দেহটাও ছেড়ে গেল। তেমনি করে আমরা যারা পড়শী, গ্রামবাসী, আমাদের কি ছেড়ে দেওয়া উচিত?’
‘পাকস্থলী-পূর্বস্থলী যে থলিরই হোক, বামুন যখন, তখন যেমন করে হোক, দায় উদ্ধার করবই। কোন ভয় নাই। যা লোক লাগে আমি সব যোগাড় করে দিছি’।
‘কত টাকা লেবে?
‘আমরা তো চামার নই যে গলা কাটব! ওরা যা চেয়েছে তার চেয়ে দশ টাকা কম দেবেন’।
‘কথাটা ঠিক হল না। ওরা যদি এখন দুশো টাকা চায়, তোমাদের তা বলে একশো নব্বই দেব?
“আরে মশাই, অত হিসেব কি আমরা জানি?’ অধর ফিরল। কত দিতে চান আপনারা?
কম করেই আরম্ভ করা ভাল, ক্রমে ক্রমে ধাপে ধাপে উঠবে না-হয় শেষে।
‘সত্তর দেব।
‘তাই দেবেন। বিদেশী বিপন্ন লোক, জুলুমবাজি ঠিক লয়। আপনি বসুন কেনে ঐ মোড়াটায়, আমি লোক দেখি।
অধর পাড়ায় বেরিয়ে পড়ল। কিছু দূর এগুতেই দ্বিজপদর বাড়ি। তাকে তুললে ডাকিয়ে, বললে, শল্যাপরামর্শটা দাও দেখি। কি করা’।
‘মড়াটা গোছতে হবে বৈকি’। বললে দ্বিজপদ : ‘টাকা কম হয় আসবার সময় ময়রার দোকানে মড়ার নামে খাতায় বাকি রেখে ডবল পুষিয়ে লোব। সেই বাকি টাকা মড়ার ওয়ারিশানরাই দিক বা রামহরি চাটুজ্জেই দিক তা আমাদের জানবার কথা লয়’।
‘আরে, ময়রার দোকান তো সব আমাদের চিনহা হে—ঠিক হবে!
জন আষ্টেককে রাজি করানো গেল।
‘টাকা বেজায় কম হচ্ছে অধরা। এই শীতের রাতে বিছানা ছেড়ে উঠে আলাম—একটা বিবেচনা করতে হয়’।
‘দ্যাখ, মড়া গঙ্গায় দিয়ে আসা—এর মত বড় কাজ আর নাই ভোমণ্ডলে। আগের দিনে গাঁয়ের লোকেরা নিজের ঘরে থেকে চাল মুড়ি টাকা চাঁদা করে দিয়ে কাঁধ বদ্লে বদ্লে মড়া গঙ্গাতীরে নিয়ে গিয়ে সৎকার করে দিয়ে আসত। আজকাল অবস্থাদোষে এ কাজ আমাদের ব্যবসা-রোজগার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাই বলে একে একটা দাঁও ঠাওরানো ঠিক নয়। বুক-চাপ হয়ে কাজ বাগানো অধর্মের কথা। এদিকে মরা যায় স্বর্গস্থলীতে, আমরা নরককুণ্ডে’।
নরম মাটি দেখলেই বেড়ালে আঁচড়াবে এ কি লজ্জার কথা! ‘আচ্ছা বাবু, বোলচাল করে ছোঁড়াগুলোকে আমি পটিয়ে লিচ্ছি, আপনি আর দশটি টাকা বেশি দিন’। অধর মুরুব্বির মত বললে, ‘একেবারে বিছানা হনে উঠে আলছে, একটু বড় তামাক-টামাক চাই আর কি! ভূত তাড়াবার জন্যে হরিবোল আর ঘুম তাড়াবার জন্যে বড় তামাক’।
‘দেব আরো দশ টাকা, মোটমাট আশি। এখুনি বেরুবি তো?’ রামহরি সবাইর মুখের দিকে তাকাতে লাগল।
‘এখুনি বেরুব। এই দণ্ডে। শীত বর্ষা মানি না আমরা। কি রে’, অধর দূরের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ল, ‘কি রে, তোরা আবার বসলি কেনে? একেক জনে একেক রকম ফ্যাচাং তোলে। যাই, শুনে আসি, শুদিয়ে আসি’।
দুটো লোকের সঙ্গে কি-কতক্ষণ কানাকানি করল অধর। তার পরে গলা উঁচু করল। ছি ছি ছি, একি কথা! আমাদের যে মালিক, আমাদের যে মহাজন, তাকে অবিশ্বেস! টাকা তোরা আগে চাস? কে কবে কাঠুরে-ভোজনের পর টাকা না দিয়ে বলেছিলো এই ভোজনেই টাকা উশুল হয়ে গেল, তার সঙ্গে চাটুজ্জেমশায়ের তুলনা? ডোম-ডোকলের টাকা কাঠ-মোটের টাকা আগে লিবি বই কি। না, বেশ, খাই-খরচের বাবদেও কিছু লে। আর যেটা নিছক মজুরি বা বিদেয় সেটা না হয় ঘুরে এসে বুঝসুঝ করলি।দু পক্ষেরই আসান কর। পঞ্চাশ আগে লে—ওরে বাবাঃ, একেবারে যে ফোঁস-চক্কর একেকটি। সব টাকা এক মুস্তে না পেলে গা তুলবি না কেউ ? অমনি গতরে জং ধরে গেল ?
‘পুরোপুরি আশি টাকাই আগাম দিচ্ছি।’ রামহরি টাকা বের করতে লাগল গেঁজে থেকে।‘যাও, বেরিয়ে পড়। আর তানানানায় কাজ নাই’।
অধরের দল হাজির হল সেই শ্মশানের আমতলায়। গাছ থেকে খাটুলি-সমেত মড়া নামিয়ে আবার বাঁধলে দড় করে। বল হরি—হরি বোল—চার কাঁধে ফেলে চলল গঙ্গামুখো পথ ধরে। একজনের মাথায় চাল-মুড়ির বস্তা, একজনের হাতে গুড়ের ঘটি, একজনের হাতে হেরিকেন আর একজনের হাতে লাঠিসোটা।
গঙ্গা ভীষ্মজননী—গঙ্গাযাত্রীদের রওনা করিয়ে দিয়ে রামহরি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। রাত আড়ইটে তিনটে হতেই দামোদর তার দলের লোক গোল করলে। বললে, ‘আমি আর কানিকুড় চাল-মুড়ি আনতে চললাম, তোরা মড়া নামা গে যা। কই রে, সুধীর কই?’
চাটুজ্জেমশায়ের বাড়ির দরজায় ডাকাডাকি করতে লাগল দামোদর। সাড়াও নাই শব্দও নাই—সব নিটুট নিঝুম। এর মানে কি? সুধীর কিংবা পানু এসে তবে কি সব চুকিয়ে নিয়ে গিয়েছে? পানু তো আর সবাইর সঙ্গে শ্মশানেই গেল। তবে, ঠিক সুধীরেরই এই কাণ্ড, আগ বাড়িয়ে লাফ দেওয়া। সুধীরই এতক্ষণ গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে। চল, শ্মশানে চল, সেখানে গিয়েই সব খোলসা হবে।
শ্মশানে গিয়ে সবাইর চক্ষুস্থির। গাছে মড়া নাই।
সবাই গাছের দিকে তাকিয়ে। কেউ-বা আশে-পাশের ঝোপঝাড় খুঁজছে, কেউবা হাতিয়ে দেখবার জন্যে উঠছে গাছের উপর। ফুস! কোথাও কিচ্ছু নাই।
কি সর্বনাশ! মড়াতে শ্মশান চাপল নাকি?
‘আমাদের কথায় ওরা মড়া গাছিয়ে থুলো। আর, মড়া নাই!’ দামোদর আকাট বনে গেল।
‘উঁহু। এ কারু চালাকি। অন্য লোকে এসে লিচ্চয় মড়া লিয়ে চলে গিয়েছে’।
‘এখন করা যায় কি! আমার হাতে টাকা,—কি ব্যাপার!’ দামোদর জনে জনে তাকাতে লাগল মুখের দিকে।
‘দাও টাকা—কুড়ি টাকা, কুড়ি টাকাই সই।’ বললে কানিকুড় : ‘আমরা পথ ধরব, মড়া ধরব গিয়ে রাস্তায়। আর কিছু লয়, শালা তাঁতিতে যুক্তি করে লিচ্চয় মড়া লিয়ে পালালছে। চল তো সব দৌড়ে, দেখি আমাদের মড়া লিয়ে শালারা কদূর যায়!’ কানিকুড় পিছন ফিরলে : ‘তুমি মোড়ল বাড়ি যাও। আমরা চললাম গঙ্গাতীর—হকের মড়া ছাড়ব না কিছুতেই। আয় তোরা এক সঙ্গে। লাঠি লে’।
আরেক দল মড়া নিয়ে চলেছে এ পথ দিয়ে।
ওরে, হাঁটার বেগ কিছু কমিয়ে দে ছোঁড়ারা। পথি মধ্যে অন্য মড়ার সঙ্গ হওয়া ভাল লয়।
‘তোমরা কোন গাঁয়ের হে?’ জিগ্যেস করলে অধর।
‘আমরা আসছি জটারপুর থেকে’।
‘যাচ্চ কোন্ ঘাটে?
‘সাঁটুয়ের ঘাটে যাব মন লিছে। চল না একসঙ্গে যাই।’
না ভাই, তোমরা আগিয়ে চল, আমাদের আবার একজনার পায়ের গোলুই ছেড়েছে, আবার আরেকজন রাতকানা। আমাদের অনেক দেরি।’
‘বেশ তো, এস কেনে, একসঙ্গে কোথাও বসে জিরোই। পরে তোর হলে যাওয়া যাবে একসঙ্গে।
‘ওরে বাবা, আমরা যাব কাঁট্লের ঘাটে। মাঝখানে এক আপ্তজনকে মড়া দেখিয়ে যেতে হবে—আমাদের এখন কতক্ষণে ভোর হয় কিছু ঠিক নাই। আমাদের লেগে বোসো না। তোমরা এগোও।’
পিছনের মড়ার দল চলে গেল এগিয়ে।
ক্রোশ দুই প্রায় হাঁটা হয়েছে, এবার বোসস কেনে এই বটগাছের তলায়। আগুন না পোহালে চলছে না। ঠাণ্ডার ধারে হাত-পা সব কেটে কেটে যাচ্ছে। তামাক সাজ, লণ্ঠনটা জ্বালা, ঘুমুতে চাস যদি কেউ কেউ, শুয়ে পড়।
রাত্রি প্রায় শেষ হয়-হয়। লিকলিকে চাবুকের মত বাতাস বইছে সাঁ-সাঁ করে। ওরে, আবার কোনো মড়াওয়ালা আসছে নাকি? মানুষের গলার শব্দ শুনছি না? কে জানে, বিদেশী পথিকও হতে পারে।
কানিকুড়ের দল খুব তেড়ে-ফুঁড়ে ছুটে আসছে। নজর রাখছে চারদিকে। বেশি দূর যেতে পারবে না। পাখি তো নও যে উড়ে পালাবে। ঠিক ধরব।
‘হ্যাঁ রে, ঐ গাছের গোড়ায় একটা আলো দেখা যায় না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক হবে, ঐ শালারাই হবে’।
‘এই দ্যাখ, হুঁ করলেই পানু আর ভাপেন দু’জনায় খপ করেই মড়া তুলে নিয়েই পথ ধরবি’।বললে কানিকুড় : ‘তারপরে যত যা হয় আমরা দেখে লোব’।
কাঁধ খালি, বিদেশী পথিকই কেউ হবে, অধবের দল নিঝঞ্ঝাট হল।
‘কার গো?’ হাঁক দিল কানিকুড়।
‘আমরা নাতুনগরের। দেবেশপুরের কে এক বাঙাল বামুন মরেছে তাকে গঙ্গাতীরে লিয়ে যাব। তোমরা কোথাকার?
‘আমরা কোথাকাব? লণ্ঠনের আলোর এলাকার মধ্যে এসে পড়ল কানিকুড় : ‘তোমরা কি রকম চলে এলে বল দিকি? আর যদি এলেই তো, আমাদিকে একটু সংবাদ দিতে পাল্লে না? আমরা মড়া গাছিয়ে থুলাম, কথাবাত্রা ঠিক হল—তোমরা ভিন গাঁ থেকে উপরপড়া হলে কি রকম? তোমরা তো খুব ভদ্দ লোক—’
‘আমরা কি জানি? অধরও গলা মোটা করল : ‘আমরা ভাল-মন্দ কি জানি। বললে, গাঁয়ের লোক আজি হলছে না, তাই তোমাদের কাছে আলছি। দায় উদ্ধার করে দাও। আমরা কি জানি! নেয্য টাকা দিলে আমরা আজি হলাম—’
‘তাই বলে আমাদের গাছানো মড়া তোমরা নামাবে হাতে ধরে? আমাদের যজমান তোমরা কেড়ে লেবে?’
‘মড়ার আবার শিষ্য যজমান কি! যে কাঁধে করবে তার।’
‘যে কাঁধে করবে তার! বেশ, তাই—হুঁ—হুঁ—হুঁ—হুঁ—,’ সঙ্কেত ঝাড়ল কানিকুড়।
আর অমনি চকিতে পানু আর ভূপেন দু’জনেই খাটিয়াসুদ্ধ মড়া নিয়ে সামনের দিকে ছুট দিলে।
‘পালালছে, পালালছে—আমাদের মড়া নিয়ে পালালছে—’ অধর মড়াকান্না জুড়ে দিলে।
ছোকরাদের ঘুম ছুটে গেল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটে ধরে ফেলল খাটুলি। জোর করে নামিয়ে ফেললে মাটির উপর। বললে, ‘আমাদের মরা চুরি করে লিয়ে পালালছিস—’
‘তোদের মড়া! আমরা চুরি করেছি?’ পানু ঘাড়ের গামছা মাথায় বাঁধল।
‘মড়া লিয়ে এতটা পথ আলাম—বিশ্রাম করতে একটু শুয়েছি কি না-শুয়েছি, কওয়াবলা নেই, খাটুলি তুলে লিয়ে ছুট দিলি—এ চুরি করা লয়?’
‘আর আমাদের গাছের মড়া না বলে-কয়ে নামিয়ে নিয়ে এলি বাঁধন কেটে—তোরাই তো পয়লা চোর। গেছো চোর’। ভূপেন নাপিতও তেরিয়ার মত ভঙ্গি করলে।
‘আমরা কি জানি! আমাদের বায়না-বরাত দিয়েছে, মড়া লামিয়ে লিয়ে এসেছি।মড়া যখন আমাদের জিম্মা তখন মড়া আমাদের’।
‘হ্যাঁ রে, তোদের জিম্মা হলে মড়া আমরা গাছালাম কি করে?’ এবার সুধীর এল ফণা তুলে।
‘তবে তোরাই তখন গেলি না কেনে? আমাদিকে ডেকেছিল, না, আমরা আপনা থেকে গেলছিলাম? কাঁধে করে এতটা পথ যে হেঁটে এলাম এ শুধু তামাসার জন্যে?’
‘হা হে, তুমি তো খুব বুলছ’। কানিকুড় এগিয়ে এল : ‘বলি এ কাদের গাঁয়ের মড়া? আমাদের গাঁয়ের মড়ায় আমাদের জোর বেশি না ভিন্ গাঁয়ের লোকের জোর বেশি?’
‘আমাদের জোর বেশি’। বললে মাতুনগরের ছোকরা। ‘কেননা এ মড়া আমাদের স্বত্বদখলী’।
‘যা, দেওয়ানিতে মামলা কর গা, ডিক্রি লে গা মড়া-পোড়ার। চল, তোল কাঁধে খাটুলি। মড়া আমরা গাছিয়েছি, এ মড়া আমাদের সম্পত্তি’।
পানু আর ভূপেন নাপিত আবার খাটুলি তুলল কাঁধের উপর। পিছনে মাতুনগরের ছোকরাদের উদ্দেশ করে বললে, ‘ওপড়-পড়া হয়ে যেমন গেলছিলি তেমনি এখন ফেন-চাটার মত পেছু-পেছু আয়—’
হঠাৎ মাতুনগরের এক ছোকরা চেঁচিয়ে উঠল : ‘ও শালাদিকে ঠেঙিয়ে মড়া কেড়ে লাও। জোর-জুলুম নাই, যত সব ভেঁড়ুয়া জুটেছে। ধারও নাই ভারও নাই—যত সব গোল গোবর টিপ। তোদের কোলের মাগ কেড়ে লিয়ে গেলেও ও-মুখে বাক্যি বেরুবে না। যত সব বাঁদীর বাচ্চা—’ বলতে না বলতেই একগাছা লাঠি তুলে নিয়ে ভূপেন নাপিতের পিঠে বসিয়ে দিলে।
মড়াসুদ্ধ খাটুলি ছিটকে পড়ে গেল রাস্তার ঢাল বেয়ে।
‘তবে রে—আজ চরম হবে—’
‘ঐ খাটুলিতে একা ঐ মড়াই শুধু যাবে না, আরো দু’একজনকে যেতে হবে’।
লেগে গেল লাঠালাঠি। উঠন্ত সূর্যের লালিমায় রক্তের ছোপ লাগল।
‘ওরে, তোরা থাম, থাম। কার জন্যে লড়াই করছিস? মড়া কই? অধর চেঁচিয়ে উঠল—এবার আর ভয়ে নয়, উল্লাসে।
সত্যিই তো, মড়া কই?
খাটুলিসুদ্ধ মড়া মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তার পাশে। রাস্তার পাশে নালার মধ্যে।
বেশ জায়গায় পড়েছে। এখানেই থাক ও হতচ্ছাড়া। পাকস্থলীর বামুন, ওর আর অন্য কোথায় জায়গা হবে। আহা, শেয়াল-শকুনের খোরাক হোক।
তবে মিছিমিছি আর মারামারি করে ফয়দা কি? যার বিয়ে তার মনে নাই, পাড়াপড়শীর ঘুম নাই! মড়া রইল নালায় পড়ে, আর তোরা কিলোকিলি করে কাঁটাল পাকাচ্ছিস?
সত্যি তো! কানিকুড়ে আর অধরে হাসি-হাসি চোখ-তাকাতাকি হয়ে গেল। রতনে রতন চেনে। এসো বাপু, রফা-নিষ্পত্তি করে ফেলি। আপন শাক-বেগুন পরে খায়, পরের শাক-বেগুন তুলতে যায়। কী দরকার? বিরানা বিদেশীর জন্যে গাঁয়ে-গাঁয়ে ঝগড়া বাধানো? হ্যাঁ বাবা, বাড়লে চাষা বামুন মারে। উপায় নাই। আগে নিজের কাজ গুছোও, পরে পরের কাজ। তুমি কে-না-কে বামুন, তোমার জন্যে আমরা ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই হতে পারব না। এরা আমরা চিরকেলে বন্ধু পাতানো।
এ খুব সত্যুদ্ধির কথা। তোদের দিয়েছে কত? আশি? আমাদের দিয়েছে কুড়ি। আয়, সমান-সমান ভাগ করে ফেলি। তোদের গাঁ পঞ্চাশ আমাদের গাঁ পঞ্চাশ। ঘাটের ডোকলকে টাকা খাইয়ে লাভ নেই।
একবার কৃষ্ণানন্দে হরি হরি বল। হরিধ্বনি দিয়ে উঠল সবাই। লড়াই-ফ্যাসাদ বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তে। টাকা ভাগ হয়ে গেল আধাআধি।।
পাকা কাঁচা কি মদ আছে সঙ্গে বের কর। একটা কেড়ামাতন জুড়ে দি। দুপদ গায়েন করি গলা ছেড়ে।
কিন্তু যাই বলো, একেবারে চলাচলের রাস্তার ধারে মড়াটাকে আরাম করতে দেয়া হবে না। তা তো বটেই, তা তো বটেই! ঐ তিরপুনির মাঠে নদীর একটা দ আছে তারই গাবায় পুঁতে থুয়ে আসি। কোলগত করে রেখে আসি। তাই চলো পা চালিয়ে। শীতের সকালে কুয়াশার কম্বল গায়ে জড়পুটলি হয়ে আছে মাঠঘাট। রাস্তায় জনপ্রাণীর রেখা নাই কোথাও।
এই বেলা সেরে নাও চটপট। নইলে আবার আরেক রাত্রের আঁধারের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।
দু গাঁয়ের লোক হাতে-হাতে হাত মিলিয়েছি। একের বোঝা দশের লড়ি। খাটুলিসুদ্ধ মড়াটাকে নিয়ে চলল দু’জন—দেবেশপুরের সুধীর আর মাতুনগরের দ্বিজপদ। দহের একটা বুনো-বাসে-ভরা নিরালা কোণ বেছে নিয়ে মড়াটাকে কাদার মধ্যে দাৰিয়ে খুঁজে-পুঁতে দিলে। দশে মিলি করি কাজ হারিজিতি নাই লাজ।
কি করবে বল। কপালের লিখন, গোপথে মরণ। খাবার কেউ নাই। নইলে অমন আস্ত-মস্ত সোনার দেশ, তাই বা খণ্ড-খণ্ড হয় কেন? উপায় নাই। অভাগার বৈকুণ্ঠে গেলেও সুখ হয় না। গঙ্গানদীর দেশে এসেও মজা বিলের জল খেতে হয়।
বেশ হয়েছে। যেমন বিয়ে তেমন বাজনা। সস্তা করতে গিয়েছিলে পস্তাও এবার। আমাদের কি। যেমন কলি তেমনি চলি।
আগুন করে গোল হয়ে বসে হাত-পা সেঁকতে লাগল সবাই।
অধর বললে, “আমাদের তবু একবার গঙ্গাতীরে যেতে হয়। কি বলল হে বেয়াই?’
‘লিচ্চয়। তোমাদের তো ফিরে এসে পরতাল করতে হবে।’ সায় দিলে কানিকুড় : ‘কিছু সাক্ষীপ্রমাণ চেনা-চিহ্নৎ আনতে হবে বৈকি’।
‘আর তোমরা?’
‘আমরা ফিরে যাব। গিয়ে বলব, মাতুনগরের দল মড়া নিয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ—ধরতে পালাম না। কাগ হয়ে কাগের মাংস খাব না আমরা।’
‘কেমন সুন্দর ফায়সালা হয়ে গেল বলো দিকিনি’।
‘যার শেষ ভাল তার সব ভাল।
কানিকুড়রা ফিরে চলল গাঁয়ের দিকে আর অধরবা সাঁটুইয়ের পথ ধরল।
গঙ্গাধারের মাটির বাসন কিছু কিনলে—কলসি কুঁজো কলকে আর পাঁচচোরো, ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা করার ছোট জাঁতা, আর ভাবঘড়া। আর কান্দির বাজার থেকে মুড়িভাজা খোলা আর ঝাঁটার খিল আর ফুলকপি।
তিন দিনের মাথায় ফিরে এল দেবেশপুরে—রামহরি চাটুজ্জের বাড়িতে। পরতাল করতে।
পাশাপাশি বাড়িতে প্রমীলা কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলে আর তাকে কাঁদতে দেখে তার ছেলেমেয়েরা।
‘হাঁ গো, কেমন দাহন হল?’ জিগ্যেস করল রামহির।
“ওরে বাবা, মড়া ভারী কত! যেন পাষাণ চেপেছে!’ হাঁপ ছাড়ার মত করে বললে দ্বিপদ।
‘এই বয়সে অনেক মড়া বয়েছি, কিন্তু এত ভারী মড়া কখনো বইনি। একেবারে যেন নোহা, সিসের মতন ভারী, কাঁধ কেটে বসে গেলছে।’ বললে খুদু মোড়ল।
‘আর অমন পোড়াও কাওকে দেখিনি—ধন্যি পোড়া!’ বললে অধর : একেবারে মাহাতাপের মতন আগুনের রঙ। জটাম করে এক জায়গা ফাটে আর কড়-কড় করে চর্বি বেরিয়ে দপদপ করে, পাঁচ হাত খাড়াই হয়ে আগুন উঠে পড়ে। ঐ একবার কাঠ দিয়েই হয়েছে, আর নাগেনি’।
‘তা অমন পুড়বে না কেনে?’ দ্বিজপদ বুলি ঝাড়তে শুরু করল : ‘দাদাঠাকুর সারাজন্ম দুধ ঘি খুব খেয়েছেন মনে হলচে—হাড় পেকে ঠিক হয়ে আছে—চর্বিও খুব! কাজেকাজেই অমনি পুড়েছেন! সৎকার খুব ভালই হয়েছে। এত ভারী মড়া আমরা বলেই নিয়ে গেলছি, আর কোনো মামু হলে পারতে হত না’।
‘কই নিজের গাঁয়ের নোক তো এল না—এল সেই ভেন্না গাঁয়ের মানুষ।’ বললে অধর : ‘আর এ শুধু এয়েছি বললে হল না, মরণ স্বীকার করে মড়া গঙ্গা দিয়েছি—’
মিষ্টি-জল খেল কাঠুরেরা। এবার দিনের দিন কাঠুরে ভোজন করাও।
কানিকুড়ের দল খাপ্পা হয়ে উঠল যখন শুনলে মাতুনগরের ওদেরকেই শুধু নেমন্তন্ন করেছে। সে কি কথা? মাতুনগরের ওরা এ নেমন্তন্ন নেয় কি করে? টাকা যখন ভাগাভাগি হল তখন ভোজও ভাগাভাগি করতে হবে।
সব বুঝে-সুঝে দামোদর ঠাণ্ডা করতে গেল। বললে, ‘মালিকের চোখে আসলে মাতুনগরের ওরাই তো মড়া পুড়িয়েছে। ওরাই তো পরতাল করলে। তোরাও তো বলে গেলি চাটুজ্জে মাশাইকে যে মাতুনগরের কেঁধোরা ঠিক লিয়ে গেলছে মড়া। এখন খাওয়া লিয়ে দাদ-বেদাদ করতে গেলে চাতরে হাঁড়ি-ভাঙা হয়ে যাবে।
‘হোক হাঁড়ি-ভাঙা। ভোজ আমরা ছাড়তে পারব না। ওরা যদি আমাদিকে ফেলে খায় তবে কুলের কথা সব ফাঁস করে দেব। যা হবে সব একসঙ্গে হবে। এক যাত্রায় পৃথক ফল ঘটতে দেব না। কখনও না’।
‘গায়ে-ঘরে হলে পরেসপর উবকার করতে হয়—তা আমরা করি, করেছি। আমাদের গাছানো মড়ায় আমাদেরই ষোল আনা ভাগ উচিত ছিল, তা ওদিকে দিছি আট আনা। আর আজ ভোজের আট আনা ওরা দেবে না? খিটকেল হয় তো হবে। চো, দেরি করিসনে, শালোদের দেখে লোব’।
মাতুনগরের কাঠুরেদের চিঁড়ে-ফলারের নেমন্তন্ন হয়েছে। চিড়ে, দই, গুড় আর সন্দেশ।
পাত পেড়ে কেবল বসেছে অধর আর তার সাকরেদরা, হই-হই করে এসে পড়ল কানিকুড়ের দল। প্রায় লাঠি উঁচিয়ে।
‘কি হে হা হে, আমাদের ফেলে তোমরা একা-একা ফলার মারতে বসলে যে?’
‘তা আমরা কি জানি! আমাদের লেমন্তন্ন করেছে আমরা খেতে এয়েছি।’
‘তোমরা এই লেমন্তন্ন লাও কি বলে? তোমরা যদি কাঠুরে হও আমরাও কাঠুরে’।
‘তোমরা কাঠুরে হও কি করে হে?’ রামহরি এসে পড়ল।
বলার ভঙ্গি নকল করে ভূপেন নাপিত বললে, ‘ওরা কি করে হল হে?’
‘ওরা মড়া বয়েছে।’ বললে রামহরি।
‘আর মড়া আমরা গাছিয়েছি। আমাদের মড়া চুরি করে লিয়ে যত হামখোদাই। চোর মোঙলা কোথাকার?’
‘চোর বলবি তো চোয়াল চ্যাপটা করে দেব।’ দ্বিজপদ লাফিয়ে উঠল।
‘আহাহা, বিবাদ করবার সময় এটা নয়’। রামহরি শান্তভাবে ব্যাপারটা মেটাতে চেষ্টা করল : ‘মড়া আমি মাতুনগরের লোকদের হাতে গাছিয়েছি, টাকাও দিয়েছি ওদেরকে। ওরাই মড়া বয়ে নিয়ে গিয়ে গঙ্গাতীরে দাহন করে এসেছে। আমার জানিত মত ওরাই মরার কাঠুরে’।
‘আপনি যা জানেন আপনি ঠিকই করেছেন’। বললে কানিকুড় : ‘কিন্তু ও শালোরা তো জানে আসল ঘটনা কি। তবে ওরা কোন সাহসে অধম্ম করে এসে ধম্মের ঘরের ভোজ খায়?’
‘অধম্ম—অধম্ম কোথা রে হারামজাদা ?’ পাত ছেড়ে অধর ফের লাফিয়ে উঠল।
‘অধম্ম লয়? পাকস্থলীর সেই বাঙালকে তুরা পুড়িয়েছিস?’ সুধীর এক আছাড়ে হাঁড়ি ভেঙে: ‘শালো, বাঁশচাপা, এখনো সেই নদীর দ-তে পাখমারার ডোবে গেলে বামুনের চিহ্নৎ মিলবে—শেয়ালে-শকুনে এখনো হয়তো সবটা সাবাড় করতে পারেনি। এই তোমার দাহন? এই দাহনের জোরে খ্যাঁট মারতে এয়েছ? শালো জায়জাতা, টাকা বাঁটতে পাল্লে, আর ভোজ বাঁটবে না? কাঠুরে সেজে একা-একা ফলার করে যাবে? —’
হই-হই কাণ্ড, রই রই ব্যাপার। মারামারি, লাঠালাঠি, পাত-ছেঁড়াছিঁড়ি।
ভোজ-কাজ আর কিছু হল না। গাঁয়ের প্রধানরা এসে ঝগড়া কাজিয়া মিট করে দিলে। ‘হা বাপু, খাব না তো কেউ খাব না—আর যদি খাবই দু দলেই খাব। তোদের যেমন কীত্তিকম্ম, আমাদেরও তেমনি কীত্তিকম্ম—’ তখনো বাই ঠুকছে সুধীর।
একজন প্রধান গলা নামিয়ে বললে, ‘যা হয়ে গেলছে তা বয়ে গেলছে। ওরে মুখ্যু, আর সে-কথা তুলিসনে। ফৌজদারি হবে’।
দামোদর আরো গভীরে গেল। বললে, ‘ওরে, গত কম্মোর বিধি নাই। পরের লেগে আমাদের গাঁয়ে-গাঁয়ে কেন গণ্ডগোল হবে? কেনে পরেসপরের বিরুদ্ধ?’
নতুন করে মৃত্যুশোক হয়েছিল প্রমীলার। সম্বিৎ ফেরে পেয়ে সে রামহরিকে ডেকে পাঠাল। জিগ্যেস করলে : ‘এখন কী করব?’
মনে-মনে ভাবল কোথায় তাদের সেই বাড়ি-ঘর, নারকোল-সুপারির বাগান—আর কোথায় এই পাখমারার ডোব? কোথা থেকে কোথায়!
রামহরি মুখ নামিয়ে চুপ করে রইল। এক, পুলিশে খবর দেওয়া যেতে পারে। তাতেও হাঙ্গামা কম পড়বে না ওদের। কিছুই সুরাহা হবে না।
‘এখন তবে কুশপুত্তলী দাহ করতে হয়। পুরোত নেই আপনাদের গাঁয়ে? পুরোত ডাকুন—বিধি নিন—’
এর পর আবার পুরোত! পুরোতরা তো কাঠুরেদের চেয়েও বেশি চশমখোর। কাত হয়ে শুয়ে মরেছে, না চিত হয়ে শুয়ে মরেছে—তার উপরে পয়সা নেবে। কি বার, কেমন সময়, কোন শিয়রে শুয়েছিল—সবার উপরে হিসেব!
‘আপনি মিছিমিছি উতলা হচ্ছেন। ওরা ঠিকই আপনার স্বামীকে গঙ্গাতীরে দাহন করেছে। শুধু ভোজ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া বাধাবার জন্য অমনি এক আজগুবি গল্প ফেঁদেছে। এমনিতরো হামেসাই হয় আমাদের গাঁয়ে-ঘরে। শুধু ঝগড়া বাধানোর জন্যে কেচ্ছা বানানো’।
‘আপনি বলছেন গঙ্গাতীরে আমার স্বামীর দাহন হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, বলছি বৈকি। দাহন না হলে মাতুনগরের ওরা কাঠুরে সেজে ভোজ খেতে আসবে কেন? বিশ্বাস করতে বড় ইচ্ছা হল প্রমীলার। ম্লানকণ্ঠে বললে, ‘কিন্তু সুধীর নামে ঐ ছোকরাকে ডেকে আমি কটা টাকা দিয়েছি’।
‘কেন? ভোজ খেতে?’
না। ঐ পাখমারা ডোব থেকে আমার স্বামীর—যদি খুজে-পেতে পায়—এক-আধটা অস্থি আনবার জন্যে’।
‘হয়তো কোনো জন্তু-জানোয়ারের হাড় নিয়ে আসবে’।
‘আনুক। তবু বিশ্বাস করে তাই আমি নিজের হাতে করে গঙ্গায় গিয়ে ফেলে আসব’।
রামহরি মূঢ়ের মত তাকিয়ে রইল প্রমীলার দিকে।
প্রমীলার দু-চোখ কান্নায় ভরে গেল : ‘উনি যদি এতটা বিশ্বাস করতে পারেন, আমি কি তবে সামান্য এই এতটুকু বিশ্বাস করতে পারব না?’
১৩৫৫ (১৯৪৮)