খেলার হুজুগ

খেলার হুজুগ 

খেলার হুজুগ যে আমাদের ছেলেবেলায় ছিল না, তা নয়। তবে আজকের মত এমন উৎকট ধরনের নয়। তাছাড়া, এ হুজুগটা প্রধানত ফুঠবল খেলাকেই কেন্দ্র করে ছিল। ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে মোহনবাগানের আই.এফ.এ. শিল্ড লাভই ছাত্রসমাজে এই হুজুগটা সঞ্চারিত করেছিল। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য একটা কারণও ছিল। ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দের মোহনবাগান বিজয়ীদলের দুই খেলোয়াড় শিব ভাদুড়ি ও বিজয় ভাদুড়ি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। এ দু’জনের কোলে-পিঠে চেপেই আমি ছেলেবেলায় মানুষ হয়েছিলাম (আমার শতাব্দীর প্রতিধ্বনি’ দ্রঃ) এঁরাই ফুটবল প্রীতিটা আমার মনে জাগিয়েছিল। 

ক্রিকেটটা আমাদের ছেলেবেলায় খুব জনপ্রিয় খেলা ছিল না। কলকাতায় প্রথম ক্রিকেট খেলা হয়েছিল ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি তারিখে ইটোনিয়ান সিভিল সার্ভেন্টস্ দলের সঙ্গে অন্যান্য ইংরেজদের। তারপর এক শতাব্দীর ওপর ধরে সাহেবরাই এ খেলাটা খেলতো। কলকাতা রাজধানী শহর হলেও, পশ্চিম ভারতের পার্শি সম্প্রদায়ই এই খেলাটা ভারতীয়দের মধ্যে প্রবর্তন করেছিল। ইতিমধ্যে ভারতের সন্তান প্রিন্স রঞ্জিৎ সিংজি ইংলণ্ডের কাউন্টি ও ইংলণ্ডের জাতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে চমকপ্রদ ব্যাটিং করে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন। 

কলকাতায় ক্রিকেটটা সাহেবরাই খেলতো। এসব সাহেবদের মধ্যে ছিল কলকাতার সওদাগরী অফিসের সাহেবরা, আসামের চা-বাগানের সাহেবরা ও বিহারের নীলকর সাহেবরা! কলকাতায় ব্রিটিশ, অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ও ইংরেজ মিশনারি পরিচালিত স্কুল কলেজগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক খেলা হত। তবে ভারত টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণ করবার পূর্বে এ দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতামূলক খেলা ছিল কোয়াড্রাঙ্গুলার ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হয়ে, ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতা চলেছিল। 

বাঙালিদের মধ্যে ক্রিকেট খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন কোচবিহারের মহারাজা ও নাটোরের মহারাজা। এঁরা দু’জনেই বিলাত থেকে কোচ আনিয়ে বাঙালিদের মধ্যে উচ্চ মানের ক্রিকেট খেলা সম্বন্ধে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এসবই আমার জন্মের বহু পরে ঘটে। তবে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে যে দু’জন কৃতিমান পুরুষকে চিনতাম ও যাঁদের খেলা দেখেছি, তাঁরা হচ্ছেন বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায় (এস. রায়.নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন) ও আমাদের পাড়ায় দুখীরামবাবু (ভালো নাম উমেশচন্দ্র মজুমদার)। দু’জনেই এদেশে অনেকদক্ষ বাঙালি ক্রিকেট খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। তবে দু’জনের প্রশিক্ষণ দেবার পদ্ধতির মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। সারদাবাবু খেলার সৌকষার্যে নানারকম সাজসরঞ্জামের ওপর জোর দিতেন। তাছাড়া ক্রিকেটের সাজসরঞ্জাম বিক্রির জন্য নিজের একটা দোকানও ছিল। ছেলেদের খেলায় উদ্বুদ্ধ করবার জন্য তিনি বলতেন, ‘প্রকৃত শিক্ষা মাত্র স্কুল কলেজেই হয় না, প্রকৃত শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় খেলার মাঠে।’ দুখীরামবাবুর ওসব কিছু বালাই ছিল না। তাঁর বাড়ির সামনে রামধন মিত্র লেনের গলিটাতেই (তখন কলকাতার রাস্তা পিচ দিয়ে মোড়া হয়নি) উইকেট বসিয়ে তিনি ছেলেদের খেলা শেখাতেন। তিনি ছিলেন ‘এরিয়ান’ ক্লাবের প্রাণপুরুষ। ক্রিকেট এবং ফুটবল দুইয়েতেই ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। বহু ভাল ভাল খেলোয়াড় তিনি নিজে হাতে তৈরি করেছিলেন। আমাদের ছেলেবেলায় যেসব বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড়ের নাম শুনেছি ও খেলা দেখেছি তারা হচ্ছে কার্তিক ও গণেশ দুই ভাই, টগরে ও ফগড়ে দুই ভাই (ভাল নাম রমণী মুখুজ্যে ও মোহিনী মুখুজ্যে)। শেষের দু’জনেই আমার সহপাঠী ছিল। শ্যামবাজার বিদ্যাসাগর স্কুলের ফাস্ট ক্লাসে (এখনকার ক্লাস টেন) আমার ডান পাশে বসত টগরে ফগড়ে ও বাঁ পাশে ছোনে (বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় ছোনে মুজমদার, দুখীরামবাবুর ভাইপো)। সুতরাং ছেলেবেলা থেকেই বড় বড় খেলোয়াড়দের সাহচর্য লাভ করেছিলাম। আমার পরবর্তীকালের বিখ্যাত ক্রিকেটের শুটে ব্যানার্জি ছিল আমার ছাত্র, আমি ছিলাম ওর গৃহশিক্ষক। 

সেযুগে সাহেবদের বড় ক্রিকেট ক্লাব ছিল ক্যালকাটা ক্লাব। তারাই উদ্যোগী হয়ে প্রথম ইংলণ্ডের পয়লা নম্বর ক্লাব এম, সি,সি, কে এদেশে নিয়ে এসেছিল। বিলাতী সাহেবদের সে খেলাই আমি আমার জীবনে প্রথম দেখি। 

এক সময় আমার স্মৃতিশক্তিটা কিংবদন্তীর মত ছিল। কিন্তু ইদানীংকালে শোক-তাপে জর্জরিত ও পারিবারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত হয়ে আমার স্মৃতিশক্তিটা ঠিক আগের মত নেই। তবে আমার যতদূর মনে আছে, এম.সি.সি. এসেছিল ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে। আমি তখন এম.এ. পড়ি। আমার সহপাঠী ছিল আমাদের পাড়ার শ্যামাচরণ (শ্যামাচরণ পরে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র স্পোর্টস এডিটর হয়েছিল)। একদিন শ্যামাচরণ আমাকে বলল, শুনেছিস এম. সি. সি. এবার ভারতে আসছে। জিজ্ঞাসা করলাম, এম, সি, সি, আবার কারা? শ্যামাচরণ জানাল, এম. সি. সি. হচ্ছে বিলাতের মেরেলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের সংক্ষিপ্ত নাম—বিলাতের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেট ক্লাব। শুধু বিলাতের নয়। ক্রিকেট খেলা সম্বন্ধে এব. সি. সি. যেসব নিয়মকানুন বানিয়ে দিত, সারা বিশ্বের ক্রিকেট ক্লাবসমূহকে তা মানতে হতো। শ্যামাচরণ বলে যেতে লাগল, এম, সি, সি আসছে আর্থার গিলিগানের অধিনায়কত্বে। ক্যালকাটা ক্লাব ওদের নিয়ে আসছে। আর ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা নাকি সমস্ত ব্যয় বহন করছে। যদিও এটা এম, সি, সি,-র কলকাতায় প্রথম সফর এবং এর পিছনে কোনরকম সরকারি স্বীকৃতি ছিল না, তথাপি এটা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সফর। কেননা, এই শফরের পদক্ষেপেই ভারতে প্রথম ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড স্থাপিত হয় ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে। এর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী ছিলেন দু’জন, গ্রান্ট গোভান ও অ্যান্টনি ডিমেলো। এঁরাই ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম সভাপতি ও সেক্রেটারি হন। এই সময় ক্রিকেটের মুখপাত্র হিসাবে দিল্লিতে ইণ্ডিয়ান ক্রিকেটার’ নামে এক পত্রিকা প্রকাশ করবার আয়োজন করা হয়। আমি এই পত্রিকার কলকাতার প্রতিবেদক নিযুক্ত হই। সুতরাং কিছুকাল আমাকে কলকাতার ক্রিকেট জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট থাকতে হয়েছিল। এম, সি, সি-র খেলা দেখার জন্য শ্যামাচরণ দু’খানা টিকিট জোগাড় করেছিল। সুতরাং শ্যামাচরণের সঙ্গে আমাকে খেলা দেখতে যেতেই হ’ল। ইডেন গার্ডেনে গ্যালারিতে বসে আমরা খেলা দেখছি। একটা ভারি মজার ব্যাপার ঘটল। আমাদের সামনেই নিচের সারিতে বসে দু’জন কোট-প্যান্ট পরা (সেযুগে অফিসাররা ছাড়া অফিসের আর কোনও কর্মচারী কোট প্যান্ট পরতো না) লোক অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। আমরা ঠিক করতে পারছিলাম না, ওরা ভারতের কোন প্রদেশের লোক। ওরা যে ভাষায় কথা বলছি সে ভাষা আমরা মোটেই বুঝতে পারছিলাম না। ভাষা বুঝতে পারলে হয়তো আমরা বুঝতে পারতাম ওরা কোন প্রদেশের লোক। হঠাৎ শ্যামাচরণ বলে উঠল ওই শোন্, ওরা কি ভাষায় কথা বলছে। আমি শুনলাম, ওরা বলছে—”রা নঃ স্পেণ্ডিনো মনি ওয়াটারু ওয়াটারু’। শ্যামাচরণ বলল, বুঝলি ওরা কোন ভাষায় কথা বলছে? আমি বললাম, না। তখন শ্যামাচরণ বলল, বুঝলি না, ওরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে। ওরা মদ্রদেশীয় লোক বলে ওই রকম বিকৃত উচ্চারণ করছে। ওরা বলছে রাজা জলের মত(ওয়াটারু ওয়াটারু) অর্থ ব্যয় করছে (স্পেণ্ডিনো মনি)। 

ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড স্থাপিত হবার পরই ভারতের ক্রিকেট দল পেল সরকারি মর্যাদা। তখন ভারতীয় ক্রিকেট দলসমূহ সরকারী ক্রিকেট ম্যাচে খেলবার অনুমতি পেল। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৮-৪৯ -এর মধ্যে ভারত কুড়িটা টেস্ট ম্যাচ খেললো স্বদেশে ও বিদেশে। আমি এই কুড়িটা টেস্ট ম্যাচের কথাই এখানে বলব। কেননা, ১৯৪৮-৪৯-এর পর আমি আর খেলার মাঠে যাইনি। 

এই কুড়িটা টেস্ট ম্যাচের মধ্যে সাতটা ইংল্যাণ্ডে (১৯৩২-এ ১টা, ১৯৩৬-এ ৩টে, ও ১৯৪৬-এ ৩টে) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আটটা ভারতে (৯৩৩-৩৪-এ ৩টে, ১৯৪৮-৪৯- এ ৫টা), এবং পাঁচটা অস্ট্রেলিয়ায় (১৯৪৭-৪৮)। ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে ইংলণ্ডে যে টেস্ট ম্যাচ হয়, তাতে ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন সি, কে, নাইডু, ১৯৩৬ সালের ম্যাচগুলিতে ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজা ও ১৯৪৬ সালের ম্যাচগুলিতে পতৌদির নবাব (বড়)। ভারতে যে সাতটা টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল, ১৯৩৩-৩৪ সালে অধিনায়কত্ব করেছিলেন সি, কে, নাইডু ও ১৯৪৮-৪৯ সালে লালা অমরনাথ। ১৯৪৭-৪৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচসমূহেও লালা অমরনাথ। সেযুগে, সি, কে, নাইডুর মত অল-রাউণ্ডার খুব কম ছিল। অধিনায়কত্বে ভারতীয় লালা অমরনাথ ছিল আদর্শ। তাছাড়া,, ১৯৩৩-৩৪ খ্রীষ্টাব্দের খেলায় ভূমিকায় ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রথম আবির্ভাবেই সেঞ্চুরি (১১৮) করেছিলেন লালা অমরনাথ। তার পর সেঞ্চুরি অবশ্য অনেকেই করেছে। তবে উল্লেখনীয় হচ্ছে ১৯৩৬ সালের ম্যাঞ্চেষ্টার টেস্টে মুস্তাক আলি ও মার্চেন্টের সেঞ্চুরি। ওই ম্যাচে ওরা দু’জনে মিলে ১৭৫ মিনিটে ২৩৫ রান করেছিলেন। আর ব্যাটিং-এ যথাক্রমে ব্যক্তিগত গড় সংখ্যা ছিল ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে ওয়াজির আলির ৩৫.০০ ও জাহাঙ্গীর খানের ২৩.৫০, ১৯৩৩-৩৪ খ্রীষ্টাব্দে দিলওয়ার হুসেনের ৪৯.২৫ ও লালা অমরনাথ-এর ২৭.২৮, ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে সি, রামস্বামীর ৫৬-৬৬ ও মহম্মদ নিসারের ২৮.৫৯, ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে বিজয় মার্চেন্টের ৪৯.০০ ও লালা অমরনাথের ২৫.৩৩। ১৯৪৭-৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ডি, জি, ফাদকারের ৫২.৩৩ ও লালা অমরনাথের ২৮১৫ এবং ১৯৪৮-৪৯ খ্রীষ্টাব্দে বিজয় হাজারের ৬৭.৪৭ ও শুঁটে ব্যানার্জির ২৫.৪০। 

আগেই বলেছি যে আগেকার দিনে খেলার হুজুগ এখনকার মত ছিল না। তবে খেলার দিন এলে বাড়ির মেয়েদের নাকালে পড়তে হত। কেননা, সকলেই টিফিন কেরিয়ারে করে খেলার মাঠে লাঞ্চ-টাইম-এ খাবার জন্য পরটা, আলুর দম ও ডিমের কালিয়া নিয়ে যেত। দেখতাম খেলার চেয়ে এগুলো উদরস্ত করার প্রবণতাই ছিল বেশি। টি, ভি’র দৌলতে বাড়ির মেয়েরা বোধ হয় আজকাল এই নাকালের হাত থেকে খানিকটা রেহাই পেয়েছে তবে একটা বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটেছে। আগেকার দিনে মেয়েরা খেলা বুঝতো না। আজ টি, ভি-তে খেলা দেখবার জন্য ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা সমানভাবেই উদগ্রীব। মেয়েদের কাছে উত্তমকুমার যা গাভাসকারও তাই। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *