2 of 2

খুনি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

খুনি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শুভঙ্করকে যদি খুনি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তাহলে কিছু তথ্যগত ত্রুটি থেকে যাবে। কারণ, বস্তুত শুভঙ্কর এখনও কাউকে খুন করেনি। কিন্তু তাকে যারা খুব ঘনিষ্ঠভাবে জানে তারা অবশ্যই স্বীকার করবে যে, শুভঙ্করের মধ্যে, যাকে কিলার ইনস্টিংট বলে, তা আছে। সবচেয়ে বেশি জানে সে নিজে।

শুভঙ্করের বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ডান হাতে ঘড়ি বাঁধে। ঘড়িটা খুব শক্ত করে বাঁধে না। ঢিলে চেন-এ বাঁধা ঘড়িটা ঢলঢল করে। হাত নাড়লে ছপাৎ করে চেন-এর শব্দ হয়। বাঁ-হাতে স্টেনলেস স্টিলের একটা বালা, যেমন শিখদের হাতে থাকে। সে লম্বা চুল আর জুলপি রাখে, গোঁফ রাখে না। বিশাল তার কাঁধ, অসম্ভব পেশিবহুল হাত। জামার বুকের ওপরের তিনটে বোতাম সে কখনও আটকায় না। ফলে তার রোমশ এবং ফরসা বুক দেখা যায়। খুব চাপা প্যান্ট পরে। ফলে ঊরু ফুলে থাকে প্যান্টের ওপরে। শক্ত আর ভারী জুতো পরতে সে ভালোবাসে। অনেকটা লম্বাও শুভঙ্কর। ফরসা, বলিষ্ঠ, আক্রমণাত্মক চেহারা।

চরিত্র অবশ্য খুবই সরল—হাসির ব্যাপার ঘটলে হাসতে-হাসতে বেহেড হয়ে যায়। ফুটবল বা ক্রিকেটের মাঠে দর্শক হয়ে গিয়েও সে তুলকালাম চেঁচায় হা-হা করে। অল্পেই ভীষণ উত্তেজিত হয়, আবার অল্পেই ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রচণ্ড আড্ডা মারতে ভালোবাসে। খাওয়া তার প্রচণ্ড প্রিয় বিষয়। যখন খায় তখন মনে হয় জিঘাংসাবশে খাচ্ছে। সেসময়ে কারও দিকে তাকায় না, কথা বলে না, অন্যমনস্ক হয় না। ঘুমও তার অসম্ভব প্রিয়। যখন ঘুমোয় তখন অতলে তলিয়ে যায়। ছুটির দিন হলে, কাজ না থাকলে, একঘেয়েমি লাগলে সে সোজা গিয়ে বিছানা নেয়। ঠিক একমিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড সিনেমাও দেখে সে। সপ্তাহে তিনটে-চারটে। বেশিরভাগ নাইট-শো। আর তার প্রিয় হচ্ছে মহিলাবৃন্দ। কোনও বিশেষ মহিলার প্রতি নয়, কিংবা কেবল সুন্দরীদের প্রতিই নয়, সাধারণভাবে যে-কোনও মেয়েই তার জীবনপথে রাস্তা পার হয় তার প্রতিই সে মনোযোগী। অবশ্য এ-কথাও সত্য যে, মহিলাদের মধ্যে কাউকেই সে কখনও তেমন করে পায়নি। বার-দুই দুজন মহিলা তাকে কারণ-বশত চড় মেরেছিল বলেও শোনা যায়। আবার প্রেম নিবেদন করেছে, এমনতর মহিলাও আছেন।

হোসেন নামে এক বন্ধু আছে শুভঙ্করের। অবশ্য বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা না হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। হোসেনের বয়েস শুভঙ্করের চেয়ে অনেক বেশি। হোসেনের চুল এবং দাড়ি যথেষ্ট পাকা, চলন-বলন ধীরস্থির। রোগা এবং আপাতদৃষ্টিতে শান্ত মানুষ সে। কলেজ স্ট্রিটে ফুটপাথে তার একটা বইয়ের দোকান আছে, আর আছে একটা ছোটমতো বই-বাঁধাইয়ের কারবার। পাজামা আর শার্ট পরে শীত-গ্রীষ্ম, খালাসিটোলায় দিশি খায়, মাথার টাক ঢাকতে একটা মুসলমানী এবং মাড়োয়ারির মাঝামাঝি কায়দার কালো টুপি পরে। লোকে বলে, সে আসলে কায়েতের ছেলে, দেশের গ্রামে এক নষ্টচরিত্র ঘটনা ঘটার পর থেকে নাম ভাঁড়িয়ে কলকাতার জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। তা হোসেন বেশ ভালো জ্যোতিষী। পুরোনো পুঁথিপত্র ঘেঁটে সে বিস্তর জ্যোতিষ শিখেছে। তার সংগ্রহে অন্তত পঞ্চাশখানা দুর্লভ জ্যোতিষশাস্ত্রঘটিত বই আছে। সে সকলের হাত আর কোষ্ঠী বিচার করে।

শুভঙ্কর তার দোকান থেকে কয়েকবার বই কিনেছিল। খুব সহজেই শুভঙ্করের বন্ধু হয়ে যায় অচেনা লোক, তুই-তোকারির সম্পর্কে এসে যায়। হোসেনও সেরকমভাবেই বন্ধু হয়েছিল।

সেই হোসেনই একদিন তার হাত দেখে বলে, দ্যাখ শুভ, তোর সব ভালো, কিন্তু তোর মধ্যে খুনির ইনস্টিংট আছে।

কী করে বুঝলি?—বলে শুভঙ্করও নিজের হাত দেখতে থাকে।

রেখা তো আছেই। তার ওপর তোর দুটো হাতের বুড়ো আঙুলের আকার দেখেও বোঝা যায়।

খুন করব নাকি রে?

করবি।

যাঃ!

মাইরি। সাবধানে থাকিস।

কথাটা উড়িয়ে দেয়নি শুভঙ্কর। ছিটেফোঁটা সত্য ওর মধ্যে আছে। সে নিজেও ছেলেবেলা থেকে টের পায় যে, কাউকে-কাউকে তার প্রায়ই খুন করতে ইচ্ছে হয়।

হোসেন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, অবশ্য ভেবেচিন্তে খুন করা নয়। কোল্ড ব্লাডেড বা প্রি-মেডিটেটেডও নয়। দুম করে রাগের বশে করে ফেলতে পারিস। রাগ করতে সাবধান।

রাগটা অবশ্য শুভঙ্করের কিছু বেশি। রাগলে সে পাগলের মতো চেঁচায়। রাগলে সে নাচে। রেগে গেলে পৃথিবীটাই তার কাছে রক্তাক্ত হয়ে যায়।

হোসেন তাকে খালাসিটোলায় নিয়ে গিয়ে দিশি মদের মজা শেখাল। সে ভারী মজা! প্রথম ঝাঁঝ আর স্বাদ পার হয়ে মদের হৃদয়ে পৌঁছে যেতে পারলে এক কেরিকেটেড জগৎ—কথাটা হোসেনই তাকে বলেছিল।

তুই যে বলিস আমি খুন করব, সে কি সত্যি?—শুভঙ্কর একদা দিশি মদে তার ভেলা ভাসিয়ে কেঁদে বলেছিল, সকলের সামনে।

পাশে একটা ভিতু ঠেলাওলা বসে ছিল। কথাটা কানে যেতে সে উঠে অন্যপাশে সরে বসে।

হোসেন গম্ভীরভাবে বলে, সত্যি।

করবই?

করবিই।

শুনে শুভঙ্কর টলতে-টলতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তবে শালা—।

হোসেন হাত ধরে টেনে তাকে বসিয়ে দিয়ে বলে, আজ থাক।

না, আজই। করব যখন, এখনই করে ফেলি।

পরে করিস।

শুভঙ্কর বায়না করতে থাকে, না, আজই!

হোসেন বিরক্ত হয়ে বলে, মজাটা নষ্ট করিস না। এতগুলো লোক তেষ্টা মেটাতে এসেছে, এখানে ব্লাডশেড করলে সবাইকে তেষ্টা নিয়েই পালিয়ে যেতে হবে।

না, এখানেই। একটা খুন, মাত্র একটা!—শুভঙ্কর প্রায় কেঁদে ফেলে।

হোসেন গম্ভীর হয়ে বলে, কী দিয়ে করবি? ছোরা-টোরা আছে?

না তো!

তবে? বসে যা। ভালো করে খা, ফেজটা কেটে যাবে।

গেলও।

শুধু হোসেন নয়, আরও কয়েকজন বলেছে। যেমন কুমকুম নামে একটি মেয়ে একবার বলেছিল, আপনার যা চেহারা, ঠিক গুণ্ডার মতো।

নাকি?

সত্যি, আমি কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি, আপনি টগরকে গলা টিপে মেরে ফেলেছেন।

সত্যি?

বিশ্বাস করুন। স্বপ্ন যদিও, কিন্তু স্বপ্ন তো লোকে এমনি-এমনি দ্যাখে না? কিছু একটু সত্যি থাকেই।

টগরকে খুন করার অবশ্য কোনও কারণ নেই। টগর শুভঙ্করদের বাড়ির পুরোনো চাকর। তার বয়স আশির ওপরে। সে চোখে ভালো দ্যাখে না। কানে শোনে না, প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এ-বাড়িতে চাকরের কাজ করার পর সে ঝিম মেরে গেছে। ভুল বকে, ভুল করে, ভুল শোনে। এমনিই একদিন মরে-টরে যাবে। ভীমরতি খুব হয়েছে এখন। তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে শুভঙ্কর। বাড়ির সবাই বাসে। শুভঙ্করের মা তাকে নিজের হাতে ভাত বেড়ে খাওয়ায়। তবু শুভঙ্কর ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখে। একটু ভয় হয়। নিজের দু-হাতের বুড়ো আঙুল নিয়ে চিন্তা করে, হাতের রেখা নিয়ে ভাবিত হয়। তার ভিতরে অবিশ্বস্ত খুনি কি সত্যিই লুকিয়ে আছে?

শুভঙ্কর সম্প্রতি একটা বেশ ভালো চাকরি পেয়েছে। এ-গ্রেড কোম্পানির জুনিয়র অফিসার। প্রচুর টাকা কামায়। চাকরিটা অবশ্য ধরা-করা করে হয়েছিল। তার এক বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী জ্যাঠামশাই আছেন। আত্মীয় নন, ডাকের জ্যাঠামশাই। তিনি অনেককে চাকরি দিয়েছেন, শুভঙ্করকেও। শুভঙ্কর প্রচুর টাকা মাইনে পায়, কিছু করার নেই অত টাকা দিয়ে। সে ওড়ায়।

মাসের প্রথম দিকে পার্ক স্ট্রিটের রেস্তরাঁয় সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গিয়ে হাল্লা-চিল্লা আর খানা-দানা করে। মেয়েছেলেদের নাচ দেখে। একদিন একটা বড় রেস্তরাঁর বেয়ারা টিপস নিয়ে তাকে সেলাম দেয়নি। শুভঙ্কর এত রেগে গিয়েছিল যে বলার নয়।

সোজা উঠে গিয়ে সে বেয়ারাটার ঘাড় ধরে টেবিলের সামনে হিঁচড়ে নিয়ে এল, মাথার টুপি ফেলে দিল ঝাপড় মেরে। মাথাটা নুইয়ে ধরে প্রচণ্ড ঘুষি তুলেছিল। বন্ধুরা ধরে ফ্যালে।

সেই ঘটনার সাক্ষী সুদেব পরে নেশা কেটে গেলে ওই একই কথা বলে, তোর ভেতরে একটা ভয়ঙ্কর ক্রুয়েলটি আছে।

সেই রেস্তরাঁর গোলমালটা অবশ্য অনেক দূর গড়ায়। সব বড় রেস্তরাঁতেই ভাড়া-করা কিছু মস্তান থাকে, মাতালদের সামলায়। শুভঙ্করের সেই কাণ্ডের পর তারা এসে তাকে দলবলসুদ্ধ প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।

অপমানটা শুভঙ্কর ভোলেনি। বলে, কেন?

রেস্তরাঁর বেয়ারাটা আর-একটু হলে খুন হয়ে যেত।

যাঃ!

সত্যি। তোকে পুরো খুনির মতো দেখাচ্ছিল।

দুর!—শুভঙ্কর উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সুদেব সিরিয়াসভাবে বলে, উড়িয়ে দিয়ো না বাপ, আর-একটু হলে খুনটা হয়েও যেতে পারত।

কীভাবে?—শুভঙ্কর অবাক হয়ে বলে, কী ভাবে হত? একটা ঘুষি খেয়ে লোকটা মরে যেত নাকি?

ঘুষি নয়, চাঁদু—তোমার হাতে খাওয়ার ছুরিটা ছিল যে।

ছিল?

আলবাত। সেটা নিয়েই তো তুই উঠে গেলি। লোকটাকে ধরে ছুরিসুদ্ধ হাত ওপরে তুলেছিলি মারবার জন্যে।

শুভঙ্কর শিউরে ওঠে। খুব বেঁচে গেছে সে। সে নিজের হাতের বুড়ো আঙুল দুটোর দিকে চেয়ে থাকে। আঙুল দুটোর মাথা মোটা, চওড়া—অন্য আঙুলগুলোর সঙ্গে সে-দুটোর অনেক পার্থক্য।

সানি নামে একটা মেয়ের সঙ্গে লেক-এ বসেছিল শুভঙ্কর। সন্ধেবেলা। এই সময়টায় শুভঙ্করের অবসরপ্রাপ্ত বাবাও আরও কয়েকজন বুড়োমানুষের সঙ্গে লেক-এর ধার ধরে হাঁটাহাঁটি করেন। এখন হেমন্তকাল। তাই কিছু হিম পড়ে। বুড়োমানুষদের পক্ষে ঠান্ডাটা ভালো নয়। উপরন্তু লেক-এর গাছ-গাছালি থেকে বিশ্রামরত পাখিরা আচমকা গায়ে-মাথায় পুরীষ বর্ষণ করে। তাই শুভঙ্করের বাবা একটা ছাতা নিয়ে যান। সেইটে মাথায় ধরে হাঁটলে, ঠান্ডাও লাগে না, পাখিদের অবিমৃষ্যকারিতা থেকেও আত্মরক্ষা চলে।

সানিকে নিয়ে লেক-এ বসে প্রেমপূর্ণ কথাবার্তা বলার সময়ে সে হঠাৎ বাবাকে দেখল। ছাতা মাথায় কয়েকজন বুড়োর সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন। বাবাকে দেখে সতর্ক হওয়ার কিছু নেই। ছানি-কাটা চোখে এখন আর অতটা দৃষ্টিশক্তি নেই। তার ওপর শুভঙ্কর সানিকে নিয়ে একটু অন্ধকার ঘেঁষে বসেছে। বাবা বুঝতে পারবেন না।

শুভঙ্কর সানির কানে-কানে বলল, সানি, ওই তোমার হবু শ্বশুর যাচ্ছে।

কই, কোথায়?—বলে সানি কৌতূহল দেখায়।

এরকম অনেক মেয়েকেই বলে শুভঙ্কর। শেষ পর্যন্ত তার বাবা যে কার শ্বশুর হবেন সে-বিষয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা আছে।

ওই যে, ছাতা মাথায়।

অনেককে দেখছি—চার-পাঁচজন। ওরা সবাই কি শ্বশুরশিপের জন্যে অ্যাপ্লিক্যান্ট নাকি?

যাঃ!—লজ্জা পেয়ে শুভঙ্কর বলে, ওই যে রোগা মতো—সামনের জনের পরে যে যাচ্ছে।

তোমার বাবা?—সানি এই বলে অন্ধকারে যতদূর সম্ভব দেখবার চেষ্টা করে। ঠিক এসময়ে কতগুলো চ্যাংড়া ছোঁড়া ওপাশ থেকে বুড়োদের উদ্দেশ করে সুর করে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর…।

বুড়ো মানুষরা এই আওয়াজ শুনে দ্রুত হাঁটেন। একজন ম্লান স্বরে অন্যজনকে বলেন, নাতিরা কী বলছে শুনছেন?

অন্যজন, অর্থাৎ শুভঙ্করের বাবা, উত্তর দেন, ওরা বুঝবে কী? বয়েস হলে বুঝবে ছাতার কেন দরকার হয়।

কিন্তু অপমানটা সহ্য করতে পারেনি শুভঙ্কর। বিশেষত যখন সানি সঙ্গে রয়েছে এবং সবই শুনতে পাচ্ছে।

ছোঁড়াদের আওয়াজ শুনে সানি হেসে ফেলে কী বলছে শুনেছ? মা গো! পারেও দুষ্টু ছেলেরা বুড়োদের খেপাতে।

শুভঙ্কর সেই মুহূর্তেই বুঝতে পারে যে, তার ভিতরে সত্যিই খুনি ইনস্টিংট আছে।

এই শালা!—বলে লাফিয়ে উঠে ছুটে গেল সে।

ডান হাতে ঘড়ি, বাঁ হাতে বালা, লম্বা, ঝাঁকড়া চুল মাথায়। তার চেহারাটা তখন সাংঘাতিক দেখাচ্ছিল। সে প্রায় ছেলেগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়ল।

সব ছেলেই কিছু ষণ্ডাগুণ্ডা নয়। এই ছেলেগুলো ভিতু টাইপের ছিল। শুভঙ্করের চেঁচানি শুনে পালাল তারা।

বাবাকে অপমান! অ্যা, আমার বাবাকে নিয়ে ঠাট্টা!

ছেলেগুলো দৌড়ঝাঁপ করে পালিয়ে গেল। সন্ধেবেলাটা খাট্টা হয়ে গেল একেবারে।

সানি পরে বলল, শুভ, তোমাকে বিয়ে করতে ভয় হয়।

কেন?

তুমি বড় হুট করে রেগে যাও যে!

এরকম অপমান দেখলে রাগব না? বাঃ!

সানি গম্ভীর হয়ে বলে, অত রাগবার মতো কিছু বলেনি তো ছেলেগুলো। রাস্তা-ঘাটে এর চেয়ে অনেক খারাপ আর অপমানকর কথাবার্তা আমাদের কানে আসে।

শুভঙ্কর কিন্তু লজ্জিত হয়েছিল, বলল, হুঁ।

ছেলেগুলো ভালো।—সানি বলে, অন্যরকম ছেলে হলে তোমাকে ছেড়ে দিত না। শুভ, যখন সঙ্গে মেয়েমানুষ থাকে, তখন ওরকম বেহেড হতে নেই। মারপিট লাগলে আমি কী করতাম?

হুঁ!—শুভঙ্কর চিন্তান্বিত হয়ে বলে।

এটুকুতেই যদি এত রাগ হয়, তো সত্যিকারের তেমন কিছু হলে তো তুমি খুনও করতে পারো।

শুভঙ্করের বুকটা চমকে ওঠে। সেই যন্ত্রণা। হোসেন তাকে বলেই দিয়েছে, সে একদিন খুন করবে। কথাটা কি অমোঘ?

ঘটনাটা ঘটল এভাবে।

একটা মেঘলা ছুটির দিনে দুটো গাড়ি বোঝাই হয়ে শুভঙ্কর আর বন্ধুবান্ধবীরা ডায়মন্ডহারবারে পিকনিক করতে গেল। দুটো গাড়ির মধ্যে একটা হচ্ছে দামি শেভ্রলে, তার মালিক জয়ন্ত। জয়ন্তর সঙ্গে শুভঙ্করের খুব একটা প্রীতির সম্পর্ক নয়। জয়ন্তকে শুভঙ্কর সহ্য করতে পারে না। ও বড়লোক, ভালো ছাত্র, ভালো স্পোর্টসম্যান, মেয়েরা জয়ন্তকে সামনে পেলে আর কারও দিকে তাকায় না। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো কিছু স্বাভাবিক জন্মগত গুণ জয়ন্তর আছে। তার স্বভাব চমৎকার। সবসময়ে হেসে কথা বলে, কথায় ভরা থাকে সহৃদয়তা, ক্ষমা, দয়া ও মমতা।

এ-ছেলেকে কি সহ্য করা শুভঙ্করের পক্ষে সম্ভব? তাই জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলার সময় সবসময়েই শুভঙ্করের কথাবার্তায় একটা ব্যঙ্গ ও বিদ্রপ এসে যায়। যেমন, জয়ন্ত যখন গাড়িটা মনোযোগ দিয়ে চমৎকার চালিয়ে নিচ্ছে, তখন পিছন থেকে শুভঙ্কর বলল, জয়, তোর গাড়ির ইঞ্জিনে একটা শব্দ হচ্ছে কেন রে?

কীসের শব্দ?

গোলমেলে শব্দ।

আমি পাচ্ছি না।—জয়ন্ত বলে।

আমি পাচ্ছি।—শুভঙ্কর বলে।

মানময়ী নামে যে অসাধারণ সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে জয়ন্তর প্রেম, সে সামনের সিটে ওর পাশে বসে ছিল। সে হঠাৎ একটু কৌতুকের চোখে সানগ্লাসটা খুলে পিছু ফিরে শুভঙ্করের দিকে চেয়ে বলে, আপনি কি গাড়ির এক্সপার্ট?

শুভঙ্করের ভয়ঙ্কর রাগ হল। না, সে গাড়ি চালাতেও জানে না। সে মাথা নাড়ল।

মানময়ী হেসে বলল, কোনও ভয় নেই, শুভঙ্করবাবু। গাড়ির কোনও ডিফেক্ট নেই। আমিও তো গাড়ি চালাই, তাই জানি।

পিকনিকের জায়গায় গিয়েও নানারকম ঝামেলা হচ্ছিল। যেমন, শুভঙ্কর ভালো সাঁতারু নয়, আর জয়ন্ত দুর্দান্ত সাঁতার দেয়। জলে নেমে জয়ন্তর সঙ্গে কমপিট করতে গিয়ে সে নাকানি-চোবানি খেল। অকারণেই প্রায় তার মেজাজ চড়ে যাচ্ছিল।

মেয়েরা সঙ্গে আছে বলে মদের ব্যবস্থা ছিল না। একক্রেট সফট ড্রিংকস আনা হয়েছে।

শুভঙ্কর ঠাট্টা করে বলে, জয়ন্তটা মেয়েছেলে হয়ে গেছে। এই কোক কিংবা লেমনেড তো মেয়েদের ড্রিংকস।

আবার মানময়ী ঠাট্টা করে বলে, আপনি খুব মস্ত পুরুষ নাকি! ড্রিংক করলেই পুরুষ হয়?

না, না, তা বলিনি।

যান না, গাঁয়ের দিকে গেলে চোলাই পেয়ে যাবেন।

ঝগড়া নয়, কিন্তু সকলের সামনেই একটা অপমান।

জয়ন্ত দারুণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল। শুভঙ্কর গান জানে না। কিন্তু মেয়েরা মুগ্ধ হয়ে জয়ন্তকে ঘিরে আছে। তার মধ্যে সানি বা কুমকুমও রয়েছে। শুভঙ্কর বুঝতে পারে, তার চেহারা বা গুণাবলী জোর মার খেয়ে যাচ্ছে জয়ন্তর কাছে। তাই সে একসময়ে দলছুট হয়ে গেল অভিমানে। এক-একা গঙ্গার ধার ঘেঁষে-ঘেঁষে বেড়াতে লাগল। শীতের নদীতে জেলেরা মাছ ধরছে নৌকোয়। একটা হালকা মেঘ দূরে ঘুড়ির মতো স্থির হয়ে আছে আকাশে। ওপারে বনরাজিনীলা। কিন্তু প্রকৃতি তাকে আকর্ষণ করে না। ভেতরে-ভেতরে একটা অসম্ভব ফাটো-ফাটো প্রতিশোধস্পৃহা।

যখন সবাই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে, পাতা শতরঞ্চিও তোলা হয়ে গেছে, তখনও জয়ন্ত আর তিনটে ছেলে ঘাসে বসে তাস খেলছিল। তাগাদা দিতেই তারা বলে, যাচ্ছি, যাচ্ছি, আর পাঁচমিনিট, এই ডিলটা শেষ হলেই—।

সকলেই বিরক্ত। সন্ধে হয়ে আসছে। প্রচণ্ড শীত। ওরা তার মধ্যে একটা ডিল শেষ করে আর-একটা শুরু করে দিল।

শুভঙ্করের রাগটা ছিলই। সে ধমক দিয়ে বলল, দু-মিনিটের মধ্যে না উঠলে সব হাঁটকে-মাটকে দেব।

খেলোয়াড়দের একজন বলে, তাই নাকি? দে না। জিওগ্রাফি পালটে যাবে। বারো টাকা হারছি, ইয়ার্কি নয়।

জয়ন্তও বলে, তোরা অন্য গাড়িটায় চলে যা। আমরা পরে যাব।

কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ শুভঙ্কর মনে করল যে, এটা তাকে ইচ্ছাকৃত অপমান। আবছাভাবে তার নিজের কিলার ইনস্টিংটের কথা মনে হল। রাগে অন্ধ হয়ে গেল বোধ-বুদ্ধি।

সে লাফিয়ে পড়ে দুই লাথিতে ছিটকে দিল সকলের হাতের তাস। জড়ামড়ির মধ্যে একটা নির্ভুল লাথি কষাল জয়ন্তর পেটে। সবাই অবাক। তারপরই লাফিয়ে উঠে সবাই তাকে ধরতে চাইছিল।

শুভঙ্কর এক ঝটকা মেরে ছুটে গেল। মস্ত একটা ডেগের মধ্যে বঁটি, ছুরি, হাতা-খুন্তি সব ভরা হয়েছে—ডেগটা তোলা হয়েছে গাড়ির ক্যারিয়ারে। শুভঙ্কর গিয়ে সেটার ভেতর থেকে মাংসকাটা ছুরিটা টেনে নিয়ে এল।

সবাই বাধা দিচ্ছে, জয়ন্ত লাথি খেয়েও উঠে দাঁড়িয়েছে অবাক হয়ে। শুভঙ্কর সকলের হাত ছাড়িয়ে তার দিকেই ছুটে গেল।

কিছুই হয়নি।

হোসেনের কথাটা ফলেনি আজও।

কী করে ফলবে? ছুরি হাতে যখন ছুটে যাচ্ছিল শুভঙ্কর, তখনও নিশ্চিত সে জানত, আজই সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটবে। যা কখনও ঘটেনি, কিন্তু ঘটার অপেক্ষায় আছে।

সে তাই নিশ্চিত সেই পরিণতির দিকে বইয়ে দিয়েছিল নিজেকে। দৌড়ে গিয়ে সে জয়ন্তর সামনে একটা হাত তুলে কী একটা দুর্বোধ্য চিৎকার করে উঠেছিল।

জয়ন্ত তার ব্যথাতুর মুখখানায় সামান্য হাসি হেসে বলল, দুর শালা, ওভাবে লাথি মারতে আছে! খুব লেগেছে রে!

মানুষ এরকম নরম সহৃদয়ভাবে তার আক্রমণকারীর সঙ্গে কথা বললে মারা যায়?

সবাই শ্বাস বন্ধ করে চোখ বুজে যখন রক্তপাত এবং মৃত্যুর অপেক্ষা করছে তখন জয়ন্ত হাত বাড়িয়ে শুভঙ্করের কাঁধ ধরে বলল, আমাকে একটু ধরে-ধরে নিয়ে যা।

শুভঙ্কর হতভম্ব হয়ে বুঝল, সে পারেনি। জোর বেঁচে গেছে।

হোসেন বলে, খুব সাবধান, শুভ। তুই একদিন খুন করবি।

শুভঙ্কর বলে, যাঃ!

হোসেন বলে, করবিই।

শুভঙ্কর বড় ম্লান হয়ে যায়। আবার ভাবে, আমার মধ্যে যে-অচেনা লোকটা আছে, যে-খুনি, তাকে একবার পেলে হত।

শুভঙ্কর বলে, করব। শুভঙ্করকে।

ক্রাইম

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *