মেঘ-মল্লার
মৌরীফুল
যাত্রাবদল
জন্ম ও মৃত্যু
কিন্নর দল
বেনীগীর ফুলবাড়ি
নবাগত
তালনবমী
উপলখন্ড
বিধুমাস্টার
ক্ষণভঙ্গুর
অসাধারণ
মুখোশ ও মুখশ্রী
নীলগঞ্জের ফালমন্ সাহেব
1 of 2

খুকীর কাণ্ড

খুকীর কাণ্ড

হরি মুখুয্যের মেয়ে উমা কিছু খায় না। না-খাইয়া রোগা হইয়া পড়িয়াছে বড়।

উমার বয়স এই মোটে চার। কিন্তু অমন দুষ্টু মেয়ে পাড়া খুঁজিয়া আর একটি বাহির করো তো দেখি!… তাহার মা সকালে দুধ খাওয়াতে বসিয়া কত ভুলায়, কত গল্প করে, সব মিথ্যা হয়। দুধের বাটিকে সে বাঘের মতো ভয় করে—মায়ের হাতে দুধের বাটি দেখিলেই সোজা একদিকে টান দিয়া দৌড়।

মা বলে—রও দুষ্টু মেয়ে, তোমার দুষ্টুমি আমি…দুধ খাবেন না, সুজি খাবেন না, খাবেন যে কী দুনিয়ায় তাও তো জানিনে—চলে আয় ইদিকে…

খুকী নিরুপায় দেখিয়া কান্না শুরু করে। তাহার মা ধরিয়া ফেলিয়া জোর করিয়া কোলে শোয়াইয়া ঝিনুক মুখে পুরিয়া দুধ খাওয়ায়। কিন্তু জোরজবরদস্তিতে অর্ধেকের উপর ছড়াইয়া–গড়াইয়া অপচয় হয়, বাকি অর্ধেকটুকু কায়ক্লেশে খুকির পেটে যায় কী না যায়।

সময়ে সময়ে সে আবার মায়ের সঙ্গে লড়াই করে। চার বছর বয়স বটে, না খাইয়া খাইয়া কাটি কাটি হাত-পাও বটে, কিন্তু তাহাকে কায়দায় ফেলিতে তাহার মায়ের এক-একদিন গলদঘর্ম। রাগ করিয়া মা বলে—থাক আপদ বালাই কোথাকার, না-খাস তো বয়ে গেল আমার সারাদিন খেটে খেটে মুখে রক্ত উঠবে, আবার ওই দস্যি মেয়ের সঙ্গে দিনে পাঁচবার কুস্তি করে দুধ খাওয়াবার শক্তি আমার নেই—মর শুকিয়ে।

খুকী বাঁচিয়া যায়, ছুটিয়া এক দৌড়ে বাড়ির সামনের আমতলায় দাঁড়াইয়া চেঁচাইয়া সমবয়েসি সঙ্গিনীকে ডাকে—ও নেনু-উ-উ–

তাহার বাবা একদিন বাড়িতে বলিল—দেখো, খুকীটাকে আজ দিন পনেরো ভালো ক’রে দেখিনি—আসবার সময় দেখি পথের ওপর খেলা কচ্ছে, এমনি রোগা হয়ে গিয়েছে যেন চেনা যায় না, পিঠটা সরু, কণ্ঠার হাড় বেরিয়েছে, অসুখ-বিসুখ নেই, দিন দিন ওরকম রোগা হয়ে পড়ছে কেন বলো তো?

খুকীর মা বলে—পড়বে না আর রোগা হয়ে? সারা দিনরাতে ক-ঝিনুক দুধ পেটে যায়? মরে মরুক, আমি আর পারিনে লড়াই করতে…কে এখন ওই দস্যি মেয়েকে রোজ রোজ যায় দুধ খাওয়াতে? যাই ওর কপালে থাকে তাই হোক গে…

তাই হয়! দস্যি মেয়ে শুকাইতে থাকে!

ভাদ্র মাস, হঠাৎ বর্ষা বন্ধ হইয়া রৌদ্র বড়ো চড়িয়া উঠিয়াছে, গ্রামের ডোবা পুকুরে সারা গাঁয়ের পাটখেতের পাটের আঁটি ভিজানো। নদীর ধারে কাশের ফুল ফুটিয়াছে।

গ্রামের হীরু চক্রবর্তীর অড়াতে এই সময় কাজকর্মের বড়ো ভিড়। নানা দেশের ধানের ও পাটের নৌকো সব গঙ্গার ঘাটে জড়ো হইয়াছে। হরিশ যুগী অড়াতের কয়ালকাঁটার ফেৰ্তায় এক মণ ধানে, আরও সের দশেক ঢুকাইয়া লওয়া— তাহার কাছে ছেলেখেলামাত্র। হাঙরের মুখখখাদাই বড়ো একখানা মহাজনি নৌকো হইতে ধানের বস্তা নামিতেছে, পটপটি গাছের ছায়ায় উঁচু-করা ধানের স্থূপ হইতে হরিশ সুরসংযোগে কাঁটায় করিয়া ধান মাপিতেছে—রাম—রাম—রাম হে রাম— রাম হে দুই—দুই-দুই—দুই হে তিন—তিন তিনি…

গফুর মাঝি ডাবা হুকায় তামাক টানিতে টানিতে বলিতেছে—তা নেন গো কয়াল মশাই, একটু হাত চালিয়ে নেন দিকি, মোরা একবার দেখি? ইদিকি নোনা গাঙের গোন নামলি কী আর নৌকো বাইতি দেবানে?

হরি মুখুয্যে মহাশয়কে একটু ব্যস্তসমস্তভাবে আসিতে দেখিয়া হীরু চক্রবর্তী বলিলেন—আরে এসো হরি, কী মনে করে?…এসো তামাক খাও…

—না থাক—তামাক—ইয়ে আমার মেয়েটাকে ইদিকে দেখেছ হীরু? …বড়ো মুশকিলে ফেলেছে বাঁদর মেয়ে…বারোটা বাজে, সেই বাড়ি থেকে নাকি বেরিয়েছে সকাল ন-টার সময়…একটু দেখি ভাই খুঁজে, এত জ্বালাতনও করে তুলেছে মেয়েটা, সে আর তোমাকে কী বলব…

অনেক খোঁজাখুঁজির পরে রায়বাড়ির পথে উমাকে ধুলার উপর পা ছড়াইয়া বসিয়া কী একটা হাতে লইয়া চুষিতে ও আপন মনে বকিতে দেখা গেল।

ওরে দুষ্টু মেয়ে…

হরি মুখুয্যে গিয়া মেয়েকে কোলে তুলিয়া লইলেন। বাবার কোলে উঠিতে পাইয়া উমা খুব খুশি হইল, হাত-পা নাড়িয়া বলিতে লাগিল—বাবা, ও বাবা…ওই ওদের নাদু ভারি দুত্ত…এই, এই দুধ এই খায় না…আমি দুধ খাই, না বাবা?

—বেশ মেয়ে, দুধ খেতে হয়। ওটা কী খাচ্ছিস, হাতে কী?

—নেবেথুস, ওই পুঁটির মামা এসেছে, তাই দিয়েছে।

বাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উমার শাস্তি শুরু হয়। বাটিভরা দুধ, ঝিনুক, টানাটানি ইত্যাদি। তাহার কান্না, কাকুতি-মিনতি পাষাণী মা শোনে না, জোর করিয়া ঝিনুক মুখে পুরিয়া দিয়া ঢোঁকে ঢোঁকে দুধ খাওয়ায়…শেষের দিকটায় সে পা ছুড়িতে গিয়া খানিকটা দুধসুদ্ধ বাটিটা উলটাইয়া ফেলিয়া দিল।

দুম দুম দুই নির্ঘাত কিল পিঠে। পিঠ প্রায় বাঁকিয়া যায়।

–হতভাগা দস্যি আপদ কোথাকার—ছ-সের করে দুধ টাকায়, ভাত জোটে, দুধের খরচ জোগাতে জোগাতে প্রাণ গেল…দস্যি মেয়ের ন্যাকরা দেখো…আদ্ধেকটা দুধ কিনা ঠ্যাং ছুড়ে মাটিতে দিলে ফেলে!…

খুকী দম সামলাইয়া লইবার পরে পা ছড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। অনেকক্ষণ কাঁদিল।

বেলা পড়িয়া আসে। ওদের উঠোনে পূর্বপুরুষের আমলের বীজু আমগাছের ছায়ায় অপরাহের রোদকে আটকাইয়া রাখে। খুকি বসিয়া বসিয়া ভাবে অপরের বাড়িতে ভালো খাবার খাইতে পাওয়া যায়—মিষ্টি—তাহাদের বাড়িতে শুধু দুধ

আর দুধ!

তাহার মা বলিল—টিপ পরবি ও দস্যি?

খুকী ঘাড় নাড়িয়া মায়ের কাছে সরিয়া আসিল।

—বলে নয়নতারা টিপ, দুটো করে এক পয়সায়, বেশ টিপগুলো—সরে এসে। বোস দিকি।

টিপ পরিয়া খুকী আবার পাড়া বেড়াইতে বাহির হয়। বাঁশবনের তলা দিয়া গুটি গুটি হাঁটে। পুনরায় সে লোভে লোভে রায়বাড়ি যায়, পরের বাড়িতেই যত ভালো খাবার। বিস্কুট, নেবেথুস, কত কী।

নানুদের উঠানে পেঁপেগাছের মাথার দিকে তাহার চোখ পড়িতে সে প্রথমটা অবাক হইয়া গেল। সঙ্গিনীকে ডাকিয়া দেখাইয়া কহিল—ও নানু, ওই পিঁপে।

পেঁপে তাহার মা কাটিয়া খাইতে দেয়, বেশ খাইতে লাগে, কিন্তু তাহা গাছের আগডালে কি অমনভাবে দোলে! চাহিয়া চাহিয়া সে কিছু ঠাহর করিতে পারিল না।

পূজার কিছু পূর্বে খুকীর আপন মামা কলিকাতা হইতে আসিল। এত ধরনের খাবার কখনও সে চক্ষেও দেখে নাই। কিশমিশ দেওয়া মেঠাই, বড়ো বড়ো অমৃতি জিলিপি, গজা, কমলালেবু আরও কত কী।

পাশের গ্রামে মামার এক বন্ধুর বাড়ি। মামা পরদিন সকালে উঠিয়া তাহাকে সাজাইয়া সঙ্গে করিয়া লইয়া চলিল।

পথে কে একজন সাইকেলে চড়িয়া যাইতেছে, খুকী চাহিয়া চাহিয়া দেখিল। মামাকে বলিল—ও কে গেল মামা?

–ও রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে একজন লোক…

উমা বলিল—ফরসা মুখ, ফরসা জামা গায়, না মামা?…চমৎকার!…

তাহার মামা হাসিয়া বলিল—’চমৎকার’ কথাটা তুই শিখলি কী করে?…আচ্ছা খুকু, তুই ওকে বিয়ে করবি?

উমা সপ্রতিভ মুখে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল—তাহার কোনো আপত্তি নাই।

ভাদ্রের শেষ, ম্যালেরিয়ার সময়, তবে এখনও খুব বেশি আরম্ভ হয় নাই, বাড়ি বাড়ি কাঁথামুড়ি দেওয়া শুরু হইতে এখনও দেরি আছে। উমার হাঁটুনির বেগ নিস্তেজ হইয়া পড়িতে থাকে, ক্রমে সে মাঝে মাঝে পথের ধারে বসিতে লাগিল, মাঝে মাঝে হাই তুলিতে লাগিল। তাহার মামা বলিল—কী হয়েছে খুকু, রোদুর বড্ড বেশি রে, আর বেশি নেই, চল…

বন্ধুর বাড়ি পৌঁছিবার পূর্বেই উমা বলিল—মামা, আমার শীত লাগছে…

—শীত কী রে? ভাদ্র মাসে এই গরমে শীত? ও কিছু না, চল… খুকী আর কিছু না-বলিয়া বেশ চলিল বটে, কিন্তু খানিক দূর গিয়া তাহার মনে হইল শীত একটু বেশিই করিতেছে। শুধু শীত নয়, তৃষ্ণাও পাইয়াছে। সে সাহসে ভর করিয়া বলিল—মামা, আমি জল খাব।

—বড়ো বিপদ দেখছি তো, আচ্ছা, আগে চল গিয়ে পৌঁছাই—খেও এখন জল…

গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়া উমার মামা তাহার কথা ভুলিয়াই গেল। অনেকদিন পরে পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, গল্পগুজব ও হাসিঠাট্টায় মশগুল হইয়া উমার সুখ দুঃখের দিকে চাহিবার অবকাশ পাইল না। উমা দু-একবার কী বলিল, আলাপের গোলমালে সেকথা কেহ কানে তুলিল না।

খানিকক্ষণ পরে তাহার মামা ফিরিয়া দেখিল, সে গুটিসুটি হইয়া রৌদ্রে বসিয়া আছে, মামার প্রশ্নের উত্তরে বলিল—জল খাব মামা, জলতেষ্টা পেয়েছে…।

—দেখি? তাই তো রে, গা যে বড়ো গরম—উঃ, খুব জ্বর হয়েছে—যে ম্যালেরিয়ার জায়গা! আয়, চল ওদের ঘরে শুইয়ে রাখিগে, ওঠ…

খুকীকে জল খাওয়াইয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া মামা পুনরায় পাড়ার দিকে বাহির হইল, স্নানাহার বন্ধুদের বাড়িতেই সম্পন্ন হইল; ক্রমে দুপুর গড়াইয়া গেল, মুখুয্যে পাড়ার হাফ-আখড়াই-এর ঘরে গ্রামের নিষ্কর্মা ছোকরার দল একে একে আসিয়া পৌঁছিল, প্রকাণ্ড কেটলিতে চায়ের জল চড়িল, গল্পে গল্পে বেলা একেবারেই গেল পড়িয়া।

এতক্ষণে হঠাৎ খুকীর কথা মনে পড়িয়া গেল তাহার মামার। সে বলিল—ওই যাঃ, তোমরা বোসো ভাই, খুকীটার অসুখ হয়েছে বলে ডোম্বলদের বাইরের ঘরে শুইয়ে রেখে এসেছি অনেকক্ষণ, দেখে আসি দাঁড়াও…

ভোম্বলদের বাড়ির বাইরের উঠানে গোয়ালের কাছে আসিতে ভোম্বলের বড়ো ছেলে টোনা বলিল—খুকু কোথায় কাকা?

খুকীর মামা বিস্ময়ের সুরে বলিল—কেন, সে তোদের বাইরের ঘরে শুয়ে নেই?

—না কাকা, সে তো অনেকক্ষণ আপনার কাছে যাবে বলে বেরিয়েছে, তখন খুব রোদুর, উঠে কাঁদত লাগল, বললে, মামার কাছে যাব—শুনলে না, তখুনি রোদুরে আপনাকে খুঁজতে বেরুল…

—সে কী রে! আমি কোথায় আছি তা সে জানবে কেমন করে? আর তোরা বা ছেলেমানুষকে ছেড়ে দিলি কী বলে? বেশ লোক তো! আর এ মেয়ে নিয়েও হয়েছে—

মামা অত্যন্ত ব্যস্ত ও উদবিগ্নভাবে পুনরায় পাড়ার দিকে ফিরিল। পরিচিত স্থানগুলিতে খোঁজা শেষ হইল, কোথাও সে নাই, কোন পথ দিয়া কখন চলিয়া গিয়াছিল কাহারও চোখে পড়ে নাই, কেবল মতি মুখুয্যের ছেলে বলিল, অনেকক্ষণ আগে একটি অপরিচিত ছোটো খুকীকে চড়চড়ে রৌদ্রে টলিতে টলিতে ভোম্বলদের বাড়ির উঠোনের আগল পার হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল বটে, খুকীকে সে চেনে না, ভাবিয়াছিল ভোম্বলদের বাড়িতে কোনো কুটুম্ব হয়তো আসিয়া থাকিবে, তাহাদের মেয়ে।

অবশেষে তাহাকে পাওয়া গেল গ্রামের বাহিরের পথে। মামাকে খুঁজিতে বাহির হইয়া পথ হারাইয়া ঘুরিতে ঘুরিতে নিরুপায় অবস্থায় পথের উপর বসিয়া কাঁদিতেছিল, বৃদ্ধ হারাণ সরকার দেখিতে পাইয়া লইয়া আসেন।

জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল, সে সারাদিন কিছু খায় নাই—খাইবার মধ্যে দুপুরবেলা ডোম্বলদের বাড়ির কোন ছেলে এক টুকরা আমসত্ব হাতে দিয়াছিল, জ্বরের ঘোরে সেটুকু শুধু চুষিয়াছে শুইয়া শুইয়া। তাহার মামাকে সকলে বকিতে লাগিল। সরকারমশায় বলিলেন—তোমারও বাপু আক্কেলটা কী—ছোটো মেয়েটাকে নিয়ে দুপুর রোদে এক কোশ হাঁটিয়ে আনলে, পথে এল তার জ্বর, দেখলেও না, শুনলেও না, ওদের চণ্ডীমণ্ডপে কাৎ করে ফেলে রেখে তুমি বেরুলে আড্ডা দিতে—না একটু দুধ, না কিছু—ছিঃ…

তাহার মামা অপ্রতিভ হইয়া বলিল—তা আমি কী আনতে গেছলাম, আমি বেরুবার সময় ছাড়ে না কোনোরকমেই—তোমার সঙ্গে যাব মামা, তোমার সঙ্গে যাব মামা—আমি কী করব?

—বেশ, খুব আদর করেছ ভাগনিকে—এখন চলো আমার বাড়ি, ওকে একটু দুধ খাইয়ে দি, কচি মেয়েটাকে সারাদিন—ছিঃ–

খুকীর মামা একটু দমিয়া গিয়াছিল, বাড়ি ফিরিবার সময় খুকীকে বলিল—কিন্তু বাড়ি গিয়ে কিছু বোলো না যেন খুকু! মার কাছে যেন বোলো না যে জ্বর হয়েছিল, কি হারিয়ে গিয়েছিলে, কেমন তো? লক্ষ্মী মেয়ে, বললে আমি কলকাতা যাব পরশু, সঙ্গে করে নিয়ে যাব না…

—আমি কলকাতা যাব মামা…

—যদি আজ কিছু না বলো, পরশু ঠিক নিয়ে যাব…বলবিনে তো?

কিন্তু বাড়ি পৌঁছিয়া খুকী বুদ্ধির দোষে সব গোলমাল করিয়া ফেলিল। তাহার শুষ্ক মুখ ও চেহারায় তাহার মা ঠাওরাইয়া লইল একটা কিছু যেন ঘটিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল—কী খেলি রে খুকী সেখানে?

খাওয়ার কথা মামা কিছু শিখাইয়া দেয় নাই, সুতরাং খুকী বলিল—আমসত্ব খুব ভালো—এত বড়ো আমসত্ব…

—আমসত্ব? আর কিছু খাসনি সেখানে সারাদিনে? হ্যাঁ রে ও যতীশ, খুকী সেখানে কিছু খায়নি?

—খেয়েছে বইকী, খেয়েছে বইকী—তা, হ্যাঁ–জানোই তো ওকে, কিছু খাওয়ানোই দায়…

মা একটু অড়ালে গেলে খুকী মুখ নীচু করিয়া হাসিমুখে মামার দিকে চাহিয়া হাত নাড়িয়া বলিল—মাকে কিছু বলিনি মামা—কাল আমায় কলকাতায় নিয়ে যাবে তো?

—ছাই যাব, না-খাওয়ার কথা বললি কেন? বাঁদর মেয়ে কোথাকার…

মামার রাগের কারণ খুকী কিছু বুঝিতে পারিল না।

খাওয়ার কথা সম্বন্ধে মামা তো কিছু বলিয়া দেয় নাই, তবে সে কথা যদি বলিয়া থাকে তাহার দোষ কী?

তাহার মামা এ কথা বুঝিল না। রাগিয়া বলিল—তোমার জন্যে যদি আর কখনো কিছু কিনে আনি খুকী, তবে দেখো বলে দিলাম—কখনো আনব না, কলকাতাতেও নিয়ে যাব না।

তাহার প্রতি এই অবিচারে খুকীর কান্না আসিল। বা রে, তাহাকে যে কথা বলিয়া দেয় নাই, তাহা বলাতেও দোষ? সে কী করিয়া অতশত বুঝিবে?

খুকী খুব অভিমানী, সে চিৎকার করিয়া হাত-পা ছুড়িয়া কাঁদিতে বসিল না, এক কোণে দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া নিঃশব্দে ঠোঁট ফুলাইয়া ফুলাইয়া কাঁদিতে লাগিল।

পরদিন সকালে তাহার মামা কলিকাতায় রওনা হইল—যাইবার সময় তাহার সহিত কথাটিও কহিল না।

 

আবার দিন কাটিতে লাগিল। বর্ষা শেষ হইয়া গেল, শরৎ পড়িল—ক্রমে শরৎও শেষ হয়। পূজা এবার দেরিতে, কার্তিক মাসের প্রথমে, কিন্তু বাড়ি-বাড়ি সবাই জ্বরে পড়িয়া, পূজায় এবার আনন্দ নাই। প্রবীণ লোকেও বলিতে লাগিলেন, এরকম দুর্বৎসর তাঁহারা অনেকদিন দেখেন নাই।

উমা সারা আশ্বিন ধরিয়া ভুগিয়া সারা হইয়াছে। একে কিছু না-খাওয়ার দরুন রোগা, তাহার উপর জ্বরে ভুগিয়া রোগা—তাহার শরীরে বিশেষ কিছু নাই। তবুও জ্বরটা একটু ছাড়িলেই কাঁথা ফেলিয়া উঠিয়া পড়ে…কারুর কথা শোনে না তারপর গয়লাপাড়া, সদগোপপাড়া, কোথায় নবীন ধোপার তেঁতুলতলা—এই করিয়া বেড়ায়। বাড়ি ফিরিলেই দুম দুম কিল পড়ে পিঠে। মা বলে—দস্যি মেয়ে, মরেও না যে আপদ চুকে যায়, কবে যাবে ষষ্ঠীর মাঠে। কবে তোমায় রেখে খুকি খুকি বলে কাঁদতে কাঁদতে আসব…।

ওঘর হইতে বড়ো-জা বলিয়া ওঠে—আচ্ছা, ওসব কী কথা সকাল বেলা ছোটো বউ…বলি মেয়েটার ষষ্ঠীর মাঠে যাবার আর তো দেরি নেই, ওর শরীরে আর আছে কী?…তার ওপর রোগা মেয়েটাকে ওইরকম করে মার?…ছি ছি, একটা পেটে ধরেই এত ব্যাজার, তবুও যদি আর দু একটা হত। এসো উমা, আমার দাওয়ায় এসো তো মাণিক! এসো এদিকে।

তাহার মা পালটা জবাব দিয়া বলে—বেশ করছি, আমি আমার মেয়েকে বলব তাতে পরের গা জ্বলে কেন? যাসনে ওখানে, যেতে হবে না। শৌখিন কথা সকলে বলতে পারে—যখন জ্বর হয়ে পড়ে থাকে, তখন যত্ন করতে তো কাউকে এগুতে দেখিনে—তখন তো রাত জাগতেও আমি, ডাক্তার ডাকতেও আমি, ওষুধ খাওয়াতেও আমি—মুখের ভালোবাসা অমন সবাই বাসে…

দুই-জায়ে তুমুল ঝগড়া বাধিবার কথা বটে এ অবস্থায়, কিন্তু বড়ো-জা হরমোহিনী বড়ো ভালো মানুষ। সাতে-পাঁচে থাকিতে ভালোবাসে না, খুকীর ওপর একটা স্নেহও আছে, সে কিছু না-বলিয়া নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া যায়।

পূজার সময় খুকীর মামা আবার আসিল। তাহারও বয়স এই কুড়ি-একুশের বেশি নয়, এই দিদিটি ছাড়া সংসারে তাহার আর কেহ নাই। এতদিন কলিকাতায় চাকুরির চেষ্টায় ছিল, পূজার কিছুদিনমাত্র পূর্বে কোনো ছাপাখানায় মাসিক আঠারো টাকা বেতনে লিনো টাইপের শিক্ষানবিশি করিতে ঢুকিয়াছে।

অনেক খাবারদাবার, খুকীর জন্যে ভালো ভালো দু-তিনটি রঙিন জামা, ছোটো ডুরে শাড়ি ও জাপানি রবারের জুতা আনিয়াছে। তাহার দিদি বকে—এসব বাপু কেন আনতে যাওয়া, সবে তো চাকরি হয়েছে, নিজের এখন কত খরচ রয়েছে, দু-পয়সা হাতে জমাও, ভালো খাওদাও—শরীর তো এবার দেখছি বড্ডই খারাপ

—অসুখ-বিসুখ হয় নাকি?

ছেলেটি হাসিয়া বলে—না দিদি, অসুখ-বিসুখ তো নয়, বড্ড খাটুনি, সকাল ন-টা থেকে সারাদিন, বিকেল ছ-টা অবধি—এক-একদিন আবার রাত আটটাও বাজে—এক-একদিন আবার রবিবারেও বেরুতে হয়, তবে তাতে ওভারটাইম পাওয়া যায় বারো আনা করে—এবার গুড় উঠলে এক কলসি গুড় নিয়ে যাবই এখান থেকে, ভিজে ছোলা আর গুড় সকালে উঠে বেশ জলখাবার হবে।

তারপর সে চিনামাটির খেলনা বাহির করিয়া খুকীকে ডাকে—ও উমা, দেখে যা কেমন কাচের ঘোড়া সেপাই, এদিকে আয়…

খুকী নাচিতে নাচিতে ছুটিয়া আসিল, মামা আসাতে খুকির খুব আহ্লাদ হইয়াছে, এসব ধরনের খাবার মামা না-আসিলে তো পাওয়া যায় না!…পূজার কয়দিন খুকী মামার কাছেই সর্বদা থাকিল। সকাল হইতে-না-হইতে খুকী চোখ মুছিয়া আসিয়া মামার কাছে বসে, মাঝে মাঝে বলে, এবার কলকাতায় নিয়ে যাবে না মামা?

পূজা ফুরাইয়া গেলে খুকীর মামা দিদির কাছে প্রস্তাবটা উঠায়, দিদি সহোদর বোন নয়, বৈমাত্রেয়, তবুও তাহাকে বেশ ভালোবাসে, যত্ন করে। সেও ছুটি-ছাটা পাইলে এখানে আসে। স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করিয়া দিন-দশেকের জন্য আপাতত খুকীকে কলিকাতা ঘুরাইয়া আনিবার সম্মতি দিল।

খুকীর মামা খুশি হইয়া বলে—আমি ওকে লেখাপড়া শেখাব, সেখানে গিয়ে মহাকালী পাঠশালায় ভরতি করে দেব—দেখতে পাই কেমন গাড়ি আসে, বাড়ি থেকে ছেলে-মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়—গাড়ির গায়ে নাম লেখা আছে ‘মহাকালী পাঠশালা’।

ভগনিপতি হরি মুখুয্যে বলেন—পাগল আর কী! অতটুকু মেয়ে স্কুলে ভরতি আবার কী হবে?…হুজুগে পড়ে যেতে চাচ্ছে—ছেলেমানুষ, ও কী আর গিয়ে টিকতে পারে? যাও নিয়ে দু-দিন—এখানে তো ম্যালেরিয়ায় ম্যালেরিয়ায় হাড় সার করে তুলেছে—যদি দু-দিন হাওয়া বদলাতে পারলে সেরে যায়…

 

ট্রেনে কলিকাতা আসিবার পথে উমা খুব খুশি। প্রথমটা তার ভয় হইয়াছিল, রেলগাড়ির জানালার ধারে মামা বসাইয়া দিয়াছে, গাড়িটা চলিতেই খুকির মনে হইল তাহার পায়ের তলা হইতে মাটিটা সরিয়া যাইতেছে, ভয়ে তাহার চোখ বড়ো বড়ো হইল—আতঙ্কে মামাকে জড়াইয়া ধরিতে যাইতেই তাহার মামা হাসিয়া বলিল—ভয় কী, ভয় কী খুকু? এ যে রেলের গাড়ি-দেখ আরও কত জোরে যাবে এখন…

রেলগাড়ি চড়িবার আনন্দকে যে বয়সে বুদ্ধি দিয়া উপভোগ করা যায়, উমার সে বয়স হয় নাই। সে শুধু চুপ করিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া বসিয়া থাকে। মাঝে মাঝে তাহার মামা উৎসাহের সুরে বলে—কেমন রে খুকী, সব কেমন বল

তো? কেমন লাগছে রেলগাড়ি?

খুকী বলে—খুব ভালো…

কিন্তু খানিকক্ষণ পরে তাহার মামা দুঃখের সহিত লক্ষ করে যে খুকী বসিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে, দেখিতে দেখিতে সে ঘুমাইয়া পড়ে।

গাড়ি কলিকাতায় পৌঁছিলে একখানা রিকশা ভাড়া করিয়া তাহার মামা তাহাকে বাসায় আনিল। অখিল মিস্ত্রি লেনে একটা ছোটো মেসে বাসা, অফিসের বাবুদের মেস, সকলেই বয়সে প্রবীণ, সে-ই কেবল অল্পবয়স্ক। খুকীর আকস্মিক আবির্ভাবে সকলেরই আনন্দ হইল। বাড়িতে ছেলে-মেয়ে সকলেরই আছে, কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা মাস-মাহিনার বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া পড়িবার দরুন মাসে একবার কী দুইবার ভিন্ন বাড়ি যাওয়া ঘটে না, ছেলে-মেয়ের মুখ দেখিতে পাওয়া যায় না। খুকীকে পাইয়া একটা অভাব দূর হইল। চার-পাঁচ বছরের ছোটো ফুটফুটে মেয়ে, চাঁদের মতো মুখখানি, কোঁকড়া কোঁকড়া কালো চুল, কালো চোখের তারা আপিসের ছুটির পর তাহাকে লইয়া কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়। এ ডাকে উহার ঘরে ও ডাকে তাহার ঘরে।

কিন্তু তাহার মামার বড়ো দুঃখ, খুকীর বেশভূষা একেবারে খাঁটি পাড়াগেঁয়ে। মাথায় বিনুনি, কপালে কাঁচপোকার টিপ, অতটুকু মেয়ের পায়ে আবার আলতা, ছোটো চুরি শাড়ি পরনে, ওসব সেকেলে কাণ্ড আজকাল শহর-বাজারে কী আর চলে? দিদি পাড়াগাঁয়ে পড়িয়া থাকে, শহরের রীতিনীতি বেশভূষার কি ধার ধারিবে? এখানকার ভদ্রঘরের ছেলে-মেয়েদের কেমন সুন্দর চুলের বিন্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট সাজানো, দেখিতে যেন কাচের পুতুল। খুকীকে ওই রকম সাজানো যায় না?

ভাবিয়া ভাবিয়া সে খুকীকে সঙ্গে করিয়া ট্রামে ধর্মতলার এক চুল ছাঁটাই দোকানে লইয়া গেল। নাপিতকে বলিল—ঠিক সাহেবদের ছেলে-মেয়েদের মতো যদি চুল কাটতে পারো তবে কাঁচি ধরো, নইলে অমন ঘন কালো চুল নষ্ট কোরো না যেন।

মেস হইতে সে খুকীর মাথার বিনুনি খুলিয়া আনিয়াছিল। চুল ছাঁটিতে উমার বেশ ভালো লাগিতেছিল। সামনে একখানা প্রকাণ্ড আয়না, চার-পাঁচটা বড়ো বড়ো আলো জ্বলিতেছে, নাপিত মাঝে মাঝে আবার ময়দার মতো কী একটা গুঁড়া তাহার ঘাড়ের চুলে মাখাইতেছে…এমন সুড়সুড়ি লাগে!…

তাহাকে সাজাইতে খুকীর মামা পাঁচ-ছয় টাকা খরচ করিয়া ফেলিল। মেসের নিয়োগী-মশায় একে একে কয়েকটি পুত্র-কন্যাকে উপরি উপরি চার-পাঁচ বৎসরের মধ্যে হারাইয়াছেন, উমাকে পাইয়া আর ছাড়িতে চাহিলেন না। সন্ধ্যার পর রঙিন ফ্রক পরা, ববড চুল, মুখে পাউডার, পায়ে জরির জুতো, আর এক উমা যখন তাহার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে দেখিয়া তো নিয়োগীমশায় বিষম খাইবার উপক্ৰম করিলেন।

তাহার মামা হাসিয়া বলে—গেলই না হয় কিছু খরচ হয়ে, এমন সুন্দর মেয়ে কি ক’রে ভূত সাজিয়ে রেখেছিল বলুন দিকি?…ও কুণ্ডুমশায়, চেয়ে দেখুন পছন্দ হয়?

কী করিয়া খুকীর শীর্ণতা দূর করা যাইতে পারে, এ সম্বন্ধে নানা পরামর্শ চলিল। গলির মোড়ের একজন ডাক্তার কডলিভার অয়েল ও কেপলারের মল্ট এক্সট্রাক্টের ব্যবস্থা দিলেন, তাহা ছাড়া বলিলেন—খাওয়া চাই, না-খেয়ে খেয়ে এমন হয়েছে। —পুষ্টির অভাব, এ বয়েসে এদের খুব পুষ্টিকর জিনিস খাওয়ানো চাই কিনা। সকালে কোয়েকার ওটস খাওয়াবেন দিন পনেরো দেখুন কেমন থাকে।

কিন্তু চতুর্থ দিনে খুকীর কম্প দিয়া জ্বর আসিল। খুকীর মামার লিনোটাইপের কাজে যাওয়া হইল না, সারাদিন খুকীর কাছে বসিয়া রহিল। অন্যদিন বৃদ্ধ নিয়োগী মহাশয়ের তত্বাবধানে রাখিয়া ছাপাখানায় যাওয়া চলিত, আজ আর তাহা হইল ।…সন্ধ্যার পূর্বে জ্বর ছাড়িয়া গেল, খুকী উঠিয়া বসিয়া এক টুকরো মিছরি চুষিতে লাগিল। অফিসফেরতা ফণীবাবু একটা বেদানা ও গোটাকতক কমলালেবু, খুকীর জন্য আনিয়াছেন, সতীশবাবু পোয়াটাক ছোটো আঙুর ও পুনারায় গোটাতিনেক কমলালেবু আরও দু-তিন জনের প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু কিনিয়া আনিয়াছেন।… সকলে চলিয়া গেলে খুকী মামার দিকে একবার চাহিল, পরে ঠোঁট ফুলাইয়া মাথা নীচু করিল। মামা বিস্মিত হইয়া বলিল—কী রে খুকী? কী হয়েছে?

খুকী দুঃখের চাপা কান্নার মধ্যে বলিল—বাড়ি যাব মামা…মার কাছে যাব…

—আচ্ছা কেঁদো না খুকু-জ্বর সারুক, নিয়ে যাব এখন।

দু-তিন দিন গেল। জ্বর সারিয়া গিয়াছে বটে, কিন্তু রাত্রে মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে মায়ের জন্য কাঁদিয়া ওঠে।… ভুলাইবার জন্য তাহাকে একদিন হগ সাহেবের বাজারে খেলনার দোকানে লইয়া যাওয়া হইল, সেখানে একটা খুব বড়ো মোমের খোকা-পুতুল তাহার খুব পছন্দ হইল, কিন্তু দামটা বড়ো বেশি, সাড়ে চার টাকা-খুকীর মামার এক মাসের মাহিনার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। মামা বলিল—

অন্য একটা পুতুল পছন্দ করো খুকু, ওটা ভালো না। কেমন ছোটো ছোটো এইসব কুকুর, হাতি, কেমন না?

খুকী দ্বিরুক্তি না-করিয়া ঘাড় নাড়িল বটে, কিন্তু পুতুলটা ফিরাইয়া দিবার সময় (সে পূর্ব হইতেই পুতুলটাকে দখল করিয়া বসিয়াছিল) তাহার ডাগর চোখ দুটি ছল ছল করিয়া আসিল।

দোকানদার বলিল—বাবু, খুকীর মনে কষ্ট হয়েছে, আপনি বড়ো পুতুলটাই নিন, কিছু কমিশন বাদ দিয়ে দিচ্ছি…

তাহার মামা বলিল—আচ্ছা, আচ্ছা, খুকু তুমি বড়ো খোকা-পুতুলটাই নাও কুকুরের দরকার নেই—ধরো বেশ ক’রে, যেন ভাঙে না দেখো।…

প্রায় এক সপ্তাহ কাটিয়াছে। সেদিন রবিবার, খুকীর মামা বিশেষ কারণে চেতলার হাটে এক বন্ধুর সহিত দেখা করিতে গিয়াছে। এখনি আসিবার কথা, কিছু টাকা পাওনা আছে, তাহারই আদায়ের চেষ্টায় যাওয়া, ততক্ষণ অন্যান্য দিনের মতো নিয়োগী মহাশয়ের তত্বাবধানেই খুকীর থাকিবার কথা।… খানিকক্ষণ খুকীর সহিত গল্পগুজব করিবার পর বৃদ্ধ নিয়োগী মহাশয়ের মাধ্যাহ্নিক নিদ্রাকর্ষণ হইল। কথা বলিতে বলিতে খুকী দেখিল তিনি আর কথা বলিতেছেন না, অল্প পরেই তাঁহার নাসিকা গর্জন শুরু হইল। মেসে কোনো ঘরে কেহ নাই, উমার ভয়-ভয় করিতে লাগিল। একবার সে জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া চাহিয়া দেখিল, গলির মোড়ে দুইজন কাবুলিওয়ালা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গল্প করিতেছে, তাহাদের ঝোলাঝুলি, লম্বা চেহারায় ভয় পাইয়া সে জানালা হইতে মুখ সরাইয়া লইল।

মামা কোথায় গেল? মামা আসে না কেন?

সে ভয় পাইয়া ডাকিল—ও জ্যাতাবাবু, জ্যাতাবাবু?

তাহার মামা তাহাকে শিখাইয়া দিয়াছে—নিয়োগী মহাশয়কে জ্যাঠাবাবু বলিয়া ডাকিতে।

সাড়া না-পাইয়া সে আর একবার ডাকিল—আমার মামা কোথায় জ্যাতাবাবু নিয়োগী মহাশয় জড়িতস্বরে ঘুমের ঘোরে বলিলেন— আচ্ছা, আচ্ছা।…

তিনি স্বপ্ন দেখিতেছিলেন, দেশের বাটিতে রাত্রিতে শুইয়া আছেন, মালপাড়ার কেতু মাল চৌকিদার লাঠি ঘাড়ে রোঁদে বাহির হইয়া তাঁহার নাম ধরিয়া হাঁক দিতেছে।

খুকী এদিক-ওদিক চাহিয়া উঠিয়া পড়িল—সিঁড়ির দরজা খোলা ছিল, সে নামিয়া নীচে আসিল। ঝি-চাকর রান্নাঘরের তালা বন্ধ করিয়া অনেকক্ষণ চলিয়া গিয়াছে, একটা কালো বিড়াল চৌবাচ্চার উপর বসিয়া মাছের কাঁটা চিবাইতেছে।

বাহির হইয়াই রাস্তা। খুকীর একটা অস্পষ্ট ধারণা আছে যে, এই রাস্তাটা পার হইলেই তাহার মামার কাছে পৌঁছানো যাইবে, এই পথের যেখানটাতে শেষ, সেখান হইতেই পরিচিত গণ্ডীর আরম্ভ।

ঘুরিতে ঘুরিতে সে পথ হারাইয়া ফেলিল, গলি পার হইয়া আর একটা বড়ো গলি, তাহার পর একটা লোহার বেড়া-ঘেরা মাঠ মতো, সেটার পাশ কাটাইয়া আর একটা গলি। ক্রমে খুকীর সব গোলমাল হইয়া গেল, এ পর্যন্ত সে একবারও পিছনের দিকে চাহে নাই, একবার পিছনের দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইল সে দিকটাও সে চেনে না।…সামনের পিছনের দুই জগই তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত, কোথাও একটা এমন জিনিস নাই যাহা সে পূর্বে কখনো দেখিয়াছে।…

সে ভয় পাইয়া কাঁদিতে লাগিল। ঠিক দুপুরবেলা, পথে লোকজনও কম, বিশেষত এই সব গলির মধ্যে। আরও খানিকদ্দূর গিয়া একটা লাল রঙের বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে, তাহাদের বাড়ির মতিঝিয়ের মতো দেখিতে একজন স্ত্রীলোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল—কী হয়েছে খুকী, কাঁদছ কেন?…তোমাদের কোন বাড়িটা, এইটে?

খুকী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল—আমি মামার কাছে যাব…

—তোমাদের ঘর কোথা গো?

খুকী আঙুল তুলিয়া একটা দিক দেখাইয়া বলিল—ওই দিকে।

—তোমার বাপের নাম কী?

বাপের নাম…কই তাহা তো সে জানে না! বাপের নাম ‘বাবা’—তা ছাড়া আবার কী? সে চোখ তুলিয়া ঝিয়ের মুখের দিকে চাহিল।

স্ত্রীলোকটি একবার গলির দুই দিকে চাহিয়া দেখিল, পরে বলিল—আচ্ছা এসো এসো খুকী, আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমার মামার কাছে নিয়ে যাচ্ছি, এসো…।

এ-গলি, ও-গলি ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে একটা ছোট্ট খোলার বাড়ি। ঝি কাহাকে ডাকিয়া কী একটা কথা নীচুস্বরে বলিল, তারপর দুইজনে খানিকক্ষণ কী বলাবলি করিল, নবাগত স্ত্রীলোকটি হাত দিয়া কী একটা দেখাইল, খুকী সেসব বুঝিতে পারিল না। পরে তাহারা খুকীকে একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। ছোটো ঘুলঘুলির কাছে একটা প্রকাণ্ড মাটির জালা ও তাহার চারিপাশে একরাশ অন্ধকার। খুকীর কেমন ভয়-ভয় করিতে লাগিল—যক্ষিবুড়ি যে জালাতে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের লুকাইয়া পুরিয়া রাখিবার গল্প শুনিয়াছে, যেন সেই ধরনের জালা। সে কাঁদো কাঁদো সুরে বলিল—আমার মামা কোথায়?

নবাগত স্ত্রীলোকটি বলিল—কেউ দেখেনি তো আনবার সময়ে? আমার বাপু ভয় করে। এই সেদিন সৈরভীর বাড়িতে পুলিশ এসে কি তম্বি, আমি থালা ফেরত দিতে গেনু তাই…

খুকীদের বাড়ির মতিঝিয়ের মতো দেখিতে যে স্ত্রীলোকটি সে বিদ্রুপ করিয়া বলিল—নেকু! যাও, সামনের দরজাটা খুলে ঢাক করে রেখে এলে কেন?…নেকু,। জানে না যেন কিছু!

সে খুকীকে চৌকির উপর বসাইয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া অনেক আদরের কথা বলিল, তাহাকে একটা রসগোল্লা খাইতে দিল। পরে খুকীর হাতের সোনার বালা দু-গাছা ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া বলিল—এখন তুলে রেখে দি খুকী?…বেশ নক্ষি মেয়ে—দেখি…

খুকী ভয়ে ভয়ে বলিল—বালা খুলো না…আমার মামাকে ডেকে দাও…

কিন্তু ততক্ষণে ঝি তাহার হাত হইতে বালা দু-গাছা অনেকটা খুলিয়াছে, দেখিয়া খুকী কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল—আমার বালা নিও না, মামাকে বলে দেব আমার বালা খুলো না…

মতিঝিয়ের ইঙ্গিতে নবাগতা স্ত্রীলোকটি তাহার মুখ চাপিয়া ধরিল। কিন্তু একটা বিষয়ে দুইজনেই বড়ো ভুল করিয়াছিল, উমার কাটি কাটি হাত-পা দেখিয়া তাহার লড়াই করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে সাধারণের হয়তো সন্দেহ হইতে পারে, কিন্তু এ ধারণা যে কতদূর অসত্য, তাহা গত মাসে দুগ্ধপানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের সময় উমার মা ভালোরূপেই জানিত। ইহারা সেসব খবর জানিবে কোথা হইতে? বেচারিদের ভুল ভাঙিতে কিন্তু বেশি বিলম্ব হইল না, ধস্তাধস্তিতে বিছানা ওলটপালট হইয়া গেল, উমার আঁচড়-কামড়ে মতি-ঝি তো বিব্রত হইয়া উঠিল। গোলমালে একগাছা বালা হাত হইতে খুলিয়া কোথায় চৌকির নীচের দিকে গড়াইয়া গেল। পিছন হইতে তাহার হাত-মুখ চাপিয়া ধরিয়া অন্যগাছা নবাগতা স্ত্রীলোকটি ছিনাইয়া খুলিয়া লইল।

মতি-ঝি বলিল—ছেড়ে দে, ছেড়ে দে—হাঁপিয়ে মরে যাবে—দেখি ও আপদকে রাস্তার ওপর রেখে আসি—বাপরে, কী দস্যি!…

—এখন কোথায় রাখতে যাবি লো? খ্যান্তমণিকে একটা খবর দিবিনে?

—না বাপু, তাতে আর দরকার নেই, ওকে রেখে আসি—কেউ টের পাবে, দেখ না বসে বসে…

তুমুল গোলমাল, খোঁজাখুঁজি, হইচই-এর পরে সন্ধ্যার সময় উমাকে পাওয়া গেল নেবুতলার সেন্টজেমস পার্কের কোণে। কেবিন-ছাঁটাই বড় চুল হেঁড়াখোঁড়া, কপালে ও গালে আঁচড়ের দাগ; হাত শুধু, ফ্রকের কোমরবন্ধ ছিঁড়িয়া ঝুলিতেছে…’মামা’ ‘মামা’ বলিয়া কাঁদিতেছিল, অনেক লোক চারিধারে ঘিরিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছে, একজন গিয়া একটা পাহারাওলা ডাকিয়া আনিয়াছে—ঠিক সেই সময় নিয়োগীমশায়, কুণ্ডুমশায়, সতীশবাবু, অখিলবাবু, খুকীর মামা সবাই গিয়া উপস্থিত হইলেন।

যথারীতি থানায় ডায়েরি ইত্যাদি হইল। কে তাহার বালা খুলিয়া লইয়াছে এ সম্বন্ধে খুকী বিশেষ কোনো খবর দিতে পারিল না। খুকীর মামাকে সকলে যথেষ্ট ভসনা করিল। খবরদারি করিবার যখন সময় নাই, তখন পরের মেয়ে আনা কেন ইত্যাদি। সবাই বলিল—যাও ওকে কালই বাড়ি রেখে এসো ছিঃ, ওইরকম করে কী কখনো…মেসের সকলে চাঁদা তুলিয়া খুকীকে দু-গাছা পালিশ-করা বিলাতি সোনার বালা কিনিয়া দিল।

গাড়িতে যাইবার সময় তাহার মামা বলিল—খুকু, বাড়িতে গিয়ে যেন এসব কথা কিছু বলো না?…কেমন তো? কক্ষনো বলো না যেন?…হ্যাঁ, লক্ষ্মী মেয়ে

তাহলে আর কলকাতায় নিয়ে আসব না…

খুকী ঘাড় নাড়িয়া রাজি হইল। বলিল—আমায় তখন একটা পুতুল কিনে দিও মামা…আর একটা মেমপুতুল…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *