১.
ভারতের মধ্যপ্রদেশে একটি ছোট গ্রামের নাম খাজুরাহো। খেজুর হতো বলেই হয়তো খাজুরাহো নাম গ্রামটির। খাজুরাহোর জঙ্গলের মন্দিরগুলো চান্দেলা রাজপুত রাজারা বানিয়েছিলেন ৯৫০ সালের দিকে। ওরা রাজত্ব করেছিল দশম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত। মহারাজা রাও বিদ্যাধরের সময় শুরু হয়েছিল খাজুরাহোর মন্দির নির্মাণ। খাজুরাহোর জঙ্গলে ৮৫টি মন্দির ছিল। এখন আছে সাকুল্যে ২৫টি। বাকিগুলো ধ্বংস করেছে শত্রুসৈন্য। গজনির সুলতান মাহমুদ ছিলেন ধ্বংসকারীদের একজন।
সেই প্রাচীনকালে যৌনতার যে চর্চা ছিল ভারতবর্ষে, তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাই মন্দিরগুলোর গায়ে। আমি তো মুগ্ধ দেখে নারীপুরুষের কামশিল্প। কোনও সংকোচ নেই কারওর। নারীও পুরুষের মতো যৌনশিল্পে দক্ষ। কবে যে রক্ষণশীলতা গ্রাস করে ফেলেছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ, জানি না। সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার পর। মানুষের মগজধোলাই তো অনেকটাই হয়েছে। তা না হলে যৌনতার যে চিত্র আমরা ধর্মের মন্দিরে দেখি, সেই যৌনতা এত শীঘ্র এই অঞ্চলে ট্যাবু হয়ে যায় কী করে! আজকাল তো হিন্দু আর মুসলিম— দুই ধর্মীয় মৌলবাদীই নারী স্বাধীনতাবিরোধী, খাজুরাহো মন্দিরের যৌনশিল্পের ঘোরবিরোধী তারা।
কামসূত্রের অনেক আসনই দেখি মন্দিরের গায়ে। কামসূত্র ভারতবর্ষে লেখা হলেও জনপ্রিয় ভারতবর্ষের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। ভারতবর্ষের মানুষ কামসূত্রের চর্চা করে না বললেই চলে। যৌনতা, এখনকার সাধারণ হিন্দুরাও মনে করে, পাপ। গান্ধীও তো বলেছিলেন সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছাড়া সুখভোগের উদ্দেশে যে সেক্স করে, সে পাপ করে।
মন্দিরে নারী পুরুষের যৌনশিল্প আমাকে মুগ্ধ করলেও, পশুর সঙ্গে পুরুষের সঙ্গম আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছে। পশু-ধর্ষণ তাহলে প্রাচীনকাল থেকেই ছিল! পশুরা নিশ্চয়ই মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে চায় না, মানুষকে সঙ্গমের অনুমতি নিশ্চয়ই দেয় না তারা। তাহলে এই সঙ্গম সঙ্গম নয়, এ নিতান্তই ধর্ষণ। সেই প্রাচীনকাল থেকে পশুপাখিদের নির্যাতন করে আসছে মানুষ। তাদের হত্যা করেছে, বন্দি করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে। পশুপাখিরাও পুরুষের যৌন-নির্যাতনের শিকার।
এখনও সব বয়সের নারী তা আছেই, দুধের শিশুরা, এমনকী পশুও পুরুষের যৌন নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না। পুরুষ যে কবে মানুষ হবে! জানি সব পুরুষই মন্দ নয়, সব পুরুষই ধর্ষক নয়, কিন্তু ভালো পুরুষের ওপর তো দায়িত্ব বর্তায় পুরুষ জাতটাকে মানুষ করার। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভালো পুরুষরা কেন সংগঠিত হচ্ছে না। তারা কিভাবে আন্দোলন করার দায়িত্ব শুধু ভিকটিমদের, তাদের নয়? সমাজটাকে কলুষমুক্ত করার, বৈষম্যমুক্ত করার, শুদ্ধ করার দায়িত্ব শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়?
২.
খাজুরাহোর আমার সঙ্গে পুলিশ ছিল। পুলিশ সবসময়ই থাকে। একবারই শুধু ছিল না হায়দারাবাদে, যখন একপাল মুসলিম মৌলবাদী এসে আমার ওপর চড়াও হয়, অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করে। হাতের কাছে যা পায়, এমনকী লোহার চেয়ারও ছুড়ে মারতে থাকে আমার শরীরে। আমি মাঝে মাঝে নিজেও নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করি। খাজুরাহোয় অনেকে জিজ্ঞেস করে আমি তসলিমা কি না। আমি না বলে দিই। জানি যারা জিজ্ঞেস করে, তারা শত্রু নয় আমার। তারপরও অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফের ঝামেলায় সবসময় যেতে ইচ্ছে করে না। একটি প্রশ্ন তো করেই অধিকাংশ মানুষ, ‘এখন কী লিখছেন?’ এই একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্নটির সামনে আমার নিরুত্তর থাকতে ইচ্ছে করে।
খাজুরাহোর পুলিশদের একজনের নাম বিধু বিশ্বাস। আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছেন। পূর্ববঙ্গে ছিল তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি, ১৯৬৫ সালে বাবা মা চলে আসেন ভারতের মধ্যপ্রদেশে, এখানেই বাবার চাকরি হয়ে যায়, এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। বিধু বিশ্বাস কোনও দিন পূর্ববঙ্গে যাননি, ঢাকায় তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিও দেখেননি। নচিকেতার গান শুনেছেন? জিজ্ঞেস করে টের পেলাম নচিকেতার নামই শোনেননি কখনও। বাংলাটা বলতে শিখেছেন বাড়িতে বাবা মা বাংলা বলতেন বলে, আর প্রতিবেশীদের অনেকে ছিলেন বরিশাল থেকে আসা, তাদের কাছ থেকেও শিখেছেন বাংলা। বাংলা পড়তে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে আমার আশঙ্কা হয় বিধু বিশ্বাস বলবেন যে তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। এই উত্তরটি শুনতে ভালো লাগবে না বলেই জিজ্ঞেস করিনি। তাঁর বাবা নাকি একবার বলেছিলেন, ‘দেশের গাছ থেকে আম খেতাম, এত বড় বড় কাঁঠাল হতো কাঁঠাল খেতাম, পেয়ারা খেতাম, লিচু খেতাম, পুকুরের মাছ খেতাম, আহা কী সুখেই না ছিলাম! এ কোন দেশে এলাম, এখানে তো মাটি নেই, চারদিক শুকনো, কিছুই ফলে না, চারদিকে শুধু পাথর, শুধু পাথর। ’ বিধু বিশ্বাস আমার মনে হয় তাঁর বাবার কথাগুলো শুধু শুনে গেছেন, অনুভব করতে পারেননি। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সব মধ্যপ্রদেশে। মধ্যপ্রদেশের বাইরেও কোথাও যাননি। জানেন না বাংলা ঠিক কাকে বলে, কেমন দেশকে বাংলা দেশ বলে। তাঁকে বলি একবার ঢাকা ঘুরে আসতে। একবার দেখে আসতে তাঁর বাপ দাদার ভিটেমাটি, দেখে আসতে গাছগাছালি, পুকুর নদী। মনে আছে নচিকেতা কেমন কেঁদেছিলেন পূর্বপুরুষের মাটিতে গিয়ে! জানি না বিধু বিশ্বাস সেভাবে কাঁদবেন কি না। ধর্মের কারণে মানুষের উদ্বাস্তু হওয়াটা আমাকে কাঁদায়। ‘ফেরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম অনেক আগে, ওই উপন্যাসে লিখেছিলাম নিজের দেশের মাটি ত্যাগ করার কষ্টের কথা। আমার নিজের কিন্তু তখনও নির্বাসন দণ্ড হয়নি। তার আগেই মানুষের নির্বাসনের কষ্টটা কী করে অনুভব করেছিলাম জানি না।
ধর্মের কারণে মানুষ নিষ্ঠুর হয়েছে, স্বার্থান্ধ হয়েছে। নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থান্ধতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বিধু বিশ্বাসের বাবার মতো কত মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে সরতে বাধ্য হয়েছে! বিধু বিশ্বাসের ছেলে মেয়েরা কি নিজেদের বাঙালি বলে? হয়তো বলে না। কিন্তু বিধু বিশ্বাস ইচ্ছে করলে যেতে পারেন বাংলাদেশে, ঘুরে বেড়াতে পারেন ও দেশে। আমি পারি না। আমারই অনুমতি নেই বাংলাদেশে ফেরার। মাঝে মাঝে ভাবি ওরা অমুসলিম হয়ে যত অপরাধ করেছে, আমি অধার্মিক হয়ে তার চেয়েও বেশি অপরাধ করেছি। আসলেই কি আমরা অপরাধ করেছি? নাকি তারাই অপরাধী যারা আমাদের আদর্শ বা বিশ্বাসের কারণে আমাদের অত্যাচার করে, আমাদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে, আমাদের জেলে পোরে, নির্বাসনে পাঠায়?
৩.
খাজুরাহো গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে পান্না ন্যাশনাল পার্ক। ওখানে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েকবছর আগে ৪০টিরও বেশি বাঘ ছিল ওখানে। এখন একটি বাঘও নেই। সবকটা বাঘকেই মেরে ফেলেছে মানুষ। মানুষের মতো হিংস্র প্রাণী, সত্যিই, দ্বিতীয়টি নেই। এখন শাকাহারি কিছু প্রাণী পড়ে আছে। হরিণ টরিণ। পুরো এলাকা ধূসর, কোনও ঘাস নেই, গাছগুলোও শুকনো। কী খেয়ে ওরা বেঁচে থাকে জানি না। এই পৃথিবী তো ওদেরও। অথচ আমরা কাউকে বাঁচতে দিতে চাই না। গরু ঘোড়া মোষ হাতি উট এসবকে তো নিজেদের ভারি ভারি মাল টানতে বাধ্য করছি। বরফের দেশে কুকুরকে দিয়েও স্লেজগাড়ি টানাচ্ছি। পৃথিবীর কত প্রাণীকেই যে আমরা আমাদের দাস বানিয়েছি!
সেই পেঙ্গুইনের কথা শুনে সেদিন ঝরঝর করে কেঁদেছিলাম, যে পেঙ্গুইনটি ৫০০০ মাইল সাঁতার কেটে প্রতিবছর ডি সুজা নামের এক ব্রাজিলিয়ান লোককে দেখতে আসে। ডি সুজা কোনও একদিন তেলে ডুবতে থাকা পেঙ্গুইনটির জীবন বাঁচিয়েছিল। আমরা তো জীবন বাঁচিয়েছে এমন মানুষদের কিছুদিন পরই ভুলে যাই। একটি পেঙ্গুইন কেন ভোলে না! নিজেদের কী কারণে যে আমরা শ্রেষ্ঠ জীব বলি!
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৭ এপ্রিল, ২০১৬