খাঁড়ামশাই
বংশীবদন খাঁড়ার ছেলে হংসবদন–যার ডাকনাম চিচিঙ্গে–সে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এল।
ঝোলাগুড়ের ব্যবসায়ী বংশীবদন তখন নাকের নীচে চশমা নামিয়ে দুশো বত্রিশ মন গুড়ের হিসেব করছিলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন, ক্যা হয়েছে রে চিচিঙ্গে? অমন করে শেয়ালের বাচ্চার মতো কাঁদছিস কেন?
শেয়ালের বাচ্চা নিশ্চয় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদে না, কিন্তু বংশীবদন ওসব গ্রাহ্য করেন না। আর কী–কে–এগুলোকে তিনি ক্যা বলেন।
চিচিঙ্গে বললে, হেডমাস্টার কেলাসে তুলে দেয়নি।
-ক্যা বললি?
–হেডমাস্টার আমাকে
ঠাঁই করে বংশীবদন একটি চড় বসিয়ে দিলেন চিচিঙ্গের গালে। বললেন, পাঁঠার বাচ্চা কোথাকার! হেডমাস্টার! তোর গুরুজন না? বিদ্যের গুরু। বাপের চেয়েও বড়। কেন, মাস্টারমশাই–হেডস্যার এইসব বলতে পারিসনে? তুলে দেয়নি নয় তুলে দেননি। মনে থাকবে?
চড় খেয়ে চিচিঙ্গের কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গোঁজ হয়ে, ঘাড় নেড়ে সে জানাল-মনে থাকবে
বংশীবদন বললেন, কিন্তু ক্যা হয়েছে? কেন দেননি ওপর-কেলাসে তুলে?
–আমি অঙ্ক আর ভূগোলে পাশ করতে পারিনি। সবাই বলছে, তুই পেসিডেনের ছেলে হয়ে
বংশীবদন রেগে আগুন হয়ে গেলেন : আমার বাপের নামে ইস্কুল, আমি জমি দিইছি, বাড়ি করে দিইছি–আর আমার ছেলেকেই ফেল করানো? আচ্ছা, তুই ভেতরে যা–আমি দেখছি।
চিচিঙ্গে ভেতরে চলে গেলে বংশীবদন তক্ষুনি একটা চিঠি লিখলেন হেডমাস্টার শ্রীনাথ আচার্যিকে। লিখলেন, মহাশয়, অবিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করিবেন। আর চিচিঙ্গির কেলাসের একখানা ভূগোল আর একখানা অঙ্কের প্রশ্নপত্র সঙ্গে লইয়া আসিবেন।
হেডমাস্টার আচার্যিমশাই তখন কেবল প্রমোশন দিয়ে, খুব ক্লান্ত হয়ে, নিজের ঘরে বসে হুঁকোয় টান দিয়েছেন। এমন সময় বংশীবদনের লোক ভূষণ মণ্ডল চিঠিটা এনে হাজির করল। বললে, বাবু আপনাকে এক্ষুনি যেতে বলেছেন।
–যাচ্ছি–তটস্থ হয়ে হেডমাস্টার বললেন, তুমি এগোও, আমি আসছি।
ভূষণ চলে গেল। তামাক খাওয়া মাথায় রইল, হুঁকো নামিয়ে হেডমাস্টার ডাকলেন, ওহে বিমল!
বিমলবাবু ইস্কুলের জুনিয়ার টিচার। কিন্তু ছেলেমানুষ হলে কী হয়, যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি চটপটে। খুব ভালো পড়ান। সব কাজেই হেডমাস্টার তাঁর পরামর্শ নেন।
বিমলবাবু আসতেই হেডমাস্টার বললেন, দ্যাখো কাণ্ড। খাঁড়ামশাই ডেকে পাঠিয়েছেন। তখনই তোমায় বললুম, প্রেসিডেন্টের ছেলে দিয়ে দিই প্রমোশন কী হবে ঝামেলা করে। কিন্তু তোমার কথায় ওকে আটকে দিলুম, এখন
বিমলবাবু বললেন, স্যার, স্কুলের একটা নিয়ম তো আছে। প্রেসিডেন্টের ছেলে তো কী হয়েছে, ফেল করলেও প্রমোশন দিতে হবে? তাহলে গরিবের ছেলেরা আর কী দোষ করল–সব্বাইকে তো পাশ করিয়ে দেওয়া উচিত।
–আরে, উচিত-অনুচিত আর মানছে কে। যার টাকা আছে ওসব তার বেলায় খাটে না। এখন খাঁড়ামশাই যদি খেপে যান, তাহলে আমাদের অবস্থাটা ভাবো। তাঁর টাকায় স্কুল, তিনি প্রেসিডেন্ট। এদিকে সায়েন্স ব্লকের জন্যে সামনের মাসে পনেরো হ্যাজার টাকা দেবেন কথা আছে। এখন যদি বিগড়ে যান, আমরা মারা পড়ে যাব।
বিমলবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আমার তা মনে হয় না স্যার। খাঁড়ামশাই অত অবিবেচক নন। টাকা অনেকেরই আছে, কিন্তু এরকম মহৎ মানুষ দুজন দেখা যায় না। স্কুল করেছেন, হেলথ সেন্টার খুলিয়েছেন, দুমাইল রাস্তা করেছেন। নিজেদের খরচে গ্রামের লোকের জন্যে তিনটে টিউবওয়েল করে দিয়েছেন। কত লোককে যে দুহাতে দান করেন তার হিসেব নেই। তিনি নিশ্চয় বুঝবেন।
ব্যাজার মুখে হেডমাস্টারমশাই বললেন, কে জানে! সেকেলে লোক, মেজাজের থই পাওয়া শক্ত। যা হোক, তুমিও চলে। তুমি সঙ্গে থাকলে একটু ভরসা পাব।
আচ্ছা, চলুন—
দুজনে গিয়ে হাজির হলেন খাঁড়ামশাইয়ের বাড়িতে।
বংশীবদন দুশো বত্রিশ মন ঝোলা গুড়ের কতটা ইঁদুর খেয়েছে, নাগরি ফুটো হয়ে কতটা নষ্ট হয়েছে, কতটাই বা আরশোলা-পিঁপড়ের পেটে গেছে–এইসব লোকসানের হিসেবের মধ্যে তলিয়ে ছিলেন। হেডমাস্টার আর বিমলবাবুকে দেখে প্রথমটায় বললেন, ক্যা ব্যাপার, আপনারা বলতে বলতেই তাঁর চিচিঙ্গের কথাটা মনে পড়ে গেল।
বসুন, বসুন। তারপরেই বিনা ভূমিকায় তাঁর সোজা জিজ্ঞাসা : চিচিঙ্গে ওপরের কেলাসে উঠতে পায়নি কেন?
হেডমাস্টামশাই একটা ঢোক গিলে বললেন, আজ্ঞে, ও অঙ্কে আর ভূগোলে ফেল করেছে।
কত পেয়েছে?—
অঙ্কে সাত। ভূগোলে বারো।
–হুঁম।–বংশীবদন গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ওদের কেলাসের যে দুটো কোশ্চেন আনতে বলেছিলুম, এনেছেন?
আজ্ঞে এনেছি–বিমলবাবু তক্ষনি দুখানা প্রশ্নপত্র এগিয়ে দিলেন খাঁড়ামশাইয়ের হাতে।
চশমাটাকে তুলে, জায়গামতো বসিয়ে, বংশীবাদন উলটে-পালটে প্রশ্ন দুখানা পড়লেন। একবার বললেন, ইরে বাবা, একবার বললেন, ও-ওয়াফ আর-একবার বললেন, এসব ক্যা কাণ্ড। মাথার ওপরে যেন খাঁড়া উচিয়ে রয়েছে, এইভাবে তটস্থ হয়ে বসে থাকলেন দুই মাস্টারমশাই।
তারপর :
–এটা বুঝি ভূগোল।
হেডমাস্টার বললেন, আজ্ঞে।
–অ। কেরল রাজ্যের রাজধানী ক্যা? হুম। ভারতের কোথায়-কোথায় কয়লা ও পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায়, তাহা বলো। হু-হুম। ভারতের একখানি মানচিত্র আঁকিয়া গঙ্গা নদীর উৎপত্তিস্থল হইতে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত প্রধান-প্রধান শহরগুলি–বেশ, বেশ।–প্রশ্নপত্রটি একদিকে সরিয়ে রেখে খাঁড়ামশাই বললেন, এসব না জানলে বুঝি বিদ্যে হয় না?
কথার সুরটা বাঁকা। হেডমাস্টার ঘামতে লাগলেন।
বললেন, আজ্ঞে, নিজের দেশটাকে তো জানতে হবে।
-ক্যা? নিজের দেশ? তা ভালো, খুব ভালো। আচ্ছা হেডমাস্টারমশাই, আপনি তো জ্ঞানী লোক, নিজের দেশের সব খবরই জানেন–দুদুবার এমএ পাশ করেছেন। বলুন দিকিনি, আমাদের এই জেলায় কটা গ্রাম আছে?
দুই মাস্টামশাই এ-ওর মুখের দিকে চাইলেন। ওঁরা অনেক খবর জানেন, কিন্তু
খাঁড়ামশাই একটু হাসলেন : আচ্ছা বলুন দেখি, বাংলা দেশের কোন্ কোন্ জেলায় বেশি আখের চাষ হয়?
বিমলবাবু বললেন, মুর্শিদাবাদ।
–আর?
দুজনেই চুপ।
বলতে পারেন, আমাদের এই কাঁসাই নদীর ধারে–এই জেলায় ক্যাক্যা গঞ্জ আছে?
তিন নম্বর খাঁড়ার ঘা। বিদ্যের জাহাজ দুই মাস্টারমশাই স্রেফ বোবা বনে গেলেন।
মিটমিট করে হাসলেন খাঁড়ামশাই : আপনারা দুই জাঁহাবাজ পণ্ডিত হয়ে নিজের বাংলা দেশ, নিজের জেলার এটুকু খবর বলতে পারলেন না, আর চিচিঙ্গে কেরলের রাজধানী কিংবা কোথায় কয়লা আর পেট্রোল পাওয়া যায়–তা লিখতে পারল না বলেই ফেল হয়ে যাবে? আচ্ছা, এবার অঙ্কে আসুন। এই যে
আতঙ্কে হেডমাস্টারমশাইয়ের দম আটকে এল, এর পরে যদি কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া, মনকষা কিংবা শুভঙ্করের ফাঁকি নিয়ে পড়েন, তা হলে আর দেখতে হবে না। হাতজোড় করে বললেন, ঠিক আছে আমি এক্ষুনি গিয়েই হংসবদনকে প্রমোশন দিয়ে দিচ্ছি! মানে, আমাদেরই ভুল হয়ে গিয়েছিল।
–প্রমোশন দেবেন?–বংশীবদনের কপাল কুঁচকে গেল : কেবল চিচিঙ্গেকেই?
আজ্ঞে, আপনার ছেলে
–আমার ছেলে বলে পীর হয়েছে নাকি? ওটা তো একটা শেয়ালের বাচ্চা। ওকে একা কেন দিতে হলে সবগুলোকেই দিতে হয়। যারা গোল্লা খেয়েছে, তাদেরও। পারবেন?
মাস্টারমশাইরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
–একটা কাজ করুন। সবগুলোকে কেলাসে তুলে দিন। যারা পাশ করেছে, একেবারে ডবল প্রমোশন দিয়ে দিন তাদের। বাপরে কী বিদ্যে। যারা গঙ্গা নদীর উৎপত্তি থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ছবি এঁকে দেখাতে পারে, সব শহরগঞ্জের খবর দিতে পারে, তারা সামান্যি লোক।
খুকখুক করে একবার কাশলেন হেডমাস্টার।
আজ্ঞে, বোর্ডের নিয়ম মেনে তো আমাদের পড়াতে হয়। এসব করতে গেলে স্কুল তুলে দেবে।
খাঁড়ামশাই বললেন, দিক তুলে। যে-শিক্ষে দেশ-গাঁয়ের খবরটুকুও জানায় না, তা থাকলেই কী আর গেলেই কী। তা হলে তাই করুন। যারা ফেল হয়েছে, সব পাশ। যারা পেট্রোল আর কয়লার খবর দিয়েছে, তাদের ডবল-প্রমোশন। যান।
মামলা মিটিয়ে দিলেন বংশীবদন। তারপর খাতা খুলে আবার দুশো বত্রিশ মন ঝোলা গুড়ের হিসেব মেলাতে বসে গেলেন।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুই মাস্টারমশাই কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে। তারপর বিমলবাবু আস্তে-আস্তে ডাকলেন : খাঁড়ামশাই?
অন্যমনস্কভাবে বংশীবদন বললেন, আবার ক্যা হল?
–আমি একটা কথা বলব?
–নিশ্চয় নিশ্চয়।
–মই বেয়ে ওঠার সময় লোকে ওপরে তাকায়, না নীচের দিকে?
–নীচে তাকাবে কেন, ওপরেই তাকায়।
–আর ওপরে উঠে কাছের জিনিস দেখে, না দূরের?
–ওপরে উঠলে তো দূরেই তো চোখ যায়। কিন্তু একথা কেন?
বলছি। বিদ্যে হল সেই মই। ওপরে যত উঠবে তত দেশ-বিদেশের খবর জানবে সে। কোথায় গঙ্গার উৎপত্তি, কোথায় কেরোসিন-পেট্রোল, কেরলের রাজধানী কী, ইত্যাদি
বংশীবদন হাসলেন : বুঝেছি আপনার কথাটা। কিন্তু মইটা যে-মাটির ওপর–মানে দেশ-গাঁ, সে-মাটিটাকে কে চেনাবে?
-খাঁড়ামশাই, শিক্ষা তো কেবল স্কুলের জিনিস নয়। তার অর্ধেক ঘরে, অর্ধেক স্কুলে। আপনি জ্ঞানী লোক, এত বড় ব্যবসায়ী আপনার ছেলেকে কি আপনি শেখাবেন না, আমাদের থানায় কটা গ্রাম, কাঁসাইয়ের ধারে কী কী গঞ্জ? আপনি কি তাকে চেনাবেন না চারদিকের কোন গাছের কী নাম, কোনটা কী ফুল, কোন পোকাটা কোন জাতের? আপনারা শেখাবেন ঘরের খবর, আমরা বাইরের। অভিভাবক যদি তাঁর কাজ না করেন, আমরা কতটুকু পারি, বলুন। এই ঘরের শিক্ষাটা আমরা পাইনি বলেই তো আপনার কথার জবাব দিতে পারিনি। আপনারা এই সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিন, আমরা সারা দুনিয়াকে চিনিয়ে দিই। আপনি তো গুড়ের ব্যবসা করেন, আপনার ছেলেও কি জানে বাংলা দেশের কোথায়-কোথায় আখের চাষ হয়?
একটু চুপ করে থেকে হা-হা করে হেসে উঠলেন খাঁড়ামশাই।
–ঠিক বলেছেন। এ তো আমাদেরই কাজ। আপনারা মই দিয়ে তুলবেন ওপরে, আমরা ভালো করে নীচের মাটিটাকে চিনিয়ে দেব। হুঁ, আমরাই ভুল হয়েছে। আজ থেকেই আমি চিচিঙ্গিকে নিয়ে পড়ব। ফেল করিয়েছেন, বেশ করেছেন–কেরলের রাজধানীর খবর দিতে না পারলে আর সাতবার ফেল করিয়ে দেবেন। তারপর দেখি আমি ওই হতচ্ছাড়াকে নিয়ে কী করতে পারি।
বলেই চিৎকার :
ওরে ভূষণ, শিগগির মাস্টারমশাইদের জন্য ভালো করে জলখাবার নিয়ে আয়। ওঁরা অনেক খেটেখুটে এসেছেন।–বলে নিজেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন ভেতরে।
হেডমাস্টারের ঘাম দিয়ে জ্বল ছাড়ল।
বাঁচালে বিমল, যা ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলেন খাঁড়ামশাই।
বিমলবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নাড়লেন।
না স্যার, উনি আমাদেরও চোখ খুলে দিয়েছেন। আজ বুঝতে পারছি, এতগুলো ডিগ্রি পেয়েও নিজের দেশকে আমরা কিছুই চিনিনি। সব আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।