কয়েকটি দৃশ্য
চার-পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে-করতে যাচ্ছিল তপন। বন্ধুদের মধ্যে সুকুমার বেশ কৃপণ, মহা কিস যাকে বলে। আজ সবাই মিলে ঠাট্টা করে সুকুমারকে নাজেহাল করে তাকে দিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট কেনানো গেছে। অনেকদিন বাদে জক দেওয়া গেছে তাকে, ওরা সবাই সদ্য সিগারেট ধরিয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতার জলবহুল রাস্তা। অনেকরকম মানুষ। শীত শেষ হয়ে এসেছে অথচ গরম পড়েনি এখনও। বেশ ফুরফুরে মোলায়েম হাওয়া দিচ্ছে, এককালে একে বসন্তের হাওয়া বলত। এখন বসন্তের হাওয়া, ফুলের গন্ধ, জ্যোৎস্নার কথা কেউ উচ্চারণ করে না।
তন্ময় হয়ে তুমুল আড্ডা দিতে দিতে যাচ্ছিল ওরা। হঠাৎ তপন তার বন্ধুদের বলল, তোরা এগো, আমি আসছি। চট করে তপন পাশের একটা দোকানের মধ্যে ঢুকে গেল।
একটু বাদে তপন দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দেখল বন্ধুরা খানিকটা দূরে মোড়ের মাথায়। দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে তার জন্য, চকিতে একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে তপন ফিরে এল বন্ধুদের কাছে। একজন জিজ্ঞাসা করল, কীরে, কোথায় গিয়েছিলি? তপন হালকাভাবে বলল, একটা ইলেকট্রিক হিটারের দাম জিগ্যেস করে এলাম, অনেক দিন ধরেই কেনা হচ্ছে না। অথচ দরকার।
—গুল মারিস না! দোকানে একটা মেয়েকে দেখলাম, তোর চেনা বুঝি?
—না, সত্যি বলছি–
তপন আসলে মিথ্যে কথা বলছে, দোকানের মেয়েটি অবশ্য তপনের চেনা নয়। মেয়েটির জন্যও সে যায়নি। তবে ইলেকট্রিক হিটার কেনারও কোনও দরকার নেই তার। একটু দূরে তপন একজন মাস্টারমশায়কে দেখতে পেয়েছিল। তপন এখন কলেজে পড়ে, মাস্টারমশাইটি তার পুরোনো স্কুলের। সদ্য ধরানো সিগারেটটা সে ফেলতে পারছিল না। কিন্তু মাস্টারমশাইদের। মুখোমুখি পড়ে গেলে এখনও সে সিগারেট টানতে পারে না। এবং মাস্টারমশাইকে দেখে সিগারেট ফেলে দেওয়া বন্ধুদের সামনে ঠিক ফ্যাশানাবেল কি না বুঝতে না পেরেই সে পাশের দোকানে ঢুকে পড়েছিল।
তপন চেঁচিয়ে বলল, যা-যা বাজে কথা বলিস না, গোর্কি কক্ষনো এরকম কথা বলেননি।
সুকুমার বলল আলবৎ বলেছেন। তুই গোর্কির জীবনী পড়ে দ্যাখ—
—আমার ভালোভাবেই পড়া আছে, তোকে শেখাতে হবে না।
—পড়েছিস তুই? গোর্কির মাই ইউনিভার্সিটিজ পড়েছিস?
—নিশ্চয়ই পড়েছি। গোর্কি তাতে বলেছেন…
তপন মিনিটপাঁচেক ধরে গোর্কির মাই ইউনিভার্সিটিজ-এর সারাংশ বলে গেল, সুকুমার স্বীকার করতে বাধ্য হল যে তপন বইটা পড়েছে। তপন অবশ্য গোর্কির এ বইটা পড়েনি, মিথ্যা কথা। বলছিল। গোর্কির সম্পর্কে এর-তার কাছে যা শুনেছে, সেই ভাসা-ভাসা জ্ঞান দিয়ে কাজ চালিয়ে গেল। সুকুমারও বইটা পড়েনি। তাই তপনের কথা তাকে মেনে নিতেই হল।
*
অনেক রাত হয়ে গেছে, তপনের ঘরে আলো জ্বলছে, ঘুম আসছেনা, তপনের। তার মুখখানা বিষণ্ণ। খাট থেকে উঠে এসে সে তার টেবিলে বসল। একটা কবিতার বইয়ের পাতা উলটাল। কিছুক্ষণ, মন বসছে না। একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার ধারাবাহিক উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করেও ভালো লাগল না। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু তার কাছে সিগারেট থাকলেও দেশলাই। নেই; তপন নিজের বাড়িতে খুব সন্তর্পনে দরজা বন্ধ করে সিগারেট খায়। এখন এই রাত্রিতে সে দেশলাই খুঁজবে কোথায়?
একটা প্যাডে ডট পেন দিয়ে হিজিবিজি কাটল কিছুক্ষণ। তারপর লিখল, বনানী, তুমি আমাকে। ভুল বুঝবে আমি জানতুম,…এইটুকু লিখেই ছিঁড়ে ফেলল কাগজটা। পরের পাতায় পরিষ্কার করে লিখল, বনানী, ঠিক দুঃখ আমি পাইনি, তবে মনটা খুব অসাড় হয়ে আছে। জানি আমাকে সবাই ভুল বুঝবে। তুমি নিরঞ্জনের সঙ্গে অতক্ষণ কথা বললে, ওর সঙ্গে এক বাসে উঠলে—তাতে। আমার আপত্তির কিছু নেই, আমার মন অত ছোট নয়। কিন্তু আমি কাছেই দাড়িয়ে ছিলাম, তুমি যদি একবার আমার সঙ্গে এসে কথা বলতে, সেটা কি খুব দোষের হত? তুমি আমাকে যেন চিনতেই পারলে না—খ্যাঁচ করে সেই পাতাটাও ছিঁড়ে ফেলল তপন, ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিল বাইরে তারপর আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল। জেগে রইল আরও কিছুক্ষণ।
ফুটপাথে পুরোনো দোকানে গোর্কির মাই ইউনিভার্সিজি বইটা খুঁজছে তপন, তিন-চারটে দোকান ঘুরে পেয়ে গেল। বারো আনার কমে কিছুতেই দেবে না। তপনের কাছে ঠিক বারো আনা পয়সাই আছে। তপন কিনে ফেলল। বাস ভাড়া রইল না, অনেকখানি রাস্তা তাকে হেঁটে যেতে হবে।
তপনদের পাড়া থেকে বত্রিশ জন ছেলেকে পুলিশ সন্দেহ করে থানায় নিয়ে এসে জেরা করছে। টেবিলের ওপর একটা ছোট্ট লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে ও.সি. তাকে বলল, তুমি সুবিমল দাসগুপ্ত কে চেনোনা?