ক্ষুধিত জীবন
এক
আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে।
আমাদের ছোটো শহরটিতে অসাধারণ ঘটনা ঘটত না। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে দস্তুরমতো উত্তেজনার সাড়া পড়ে গিয়েছে। ভৈরব গড়গড়ি ছিলেন তান্ত্রিক। আমাদের বাড়ির কাছেই দু-খানা ঘর ভাড়া নিয়ে বাস করতেন। সারাদিন এবং গভীর রাত পর্যন্ত তিনি তাঁর পূজা-অর্চনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।
বেশি লোকের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিল না। তবে কী কারণে জানি না আমার দিকে তিনি কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মাঝে মাঝে সময় পেলে আমার বাড়িতে এসে গল্পস্বল্প করে যেতেন।
ভৈরবের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। রং কালো, দেহ শীর্ণ কিন্তু অতি দীর্ঘ। তাঁর চেহারার ভিতরে সব আগে নজরে পড়ে চোখদুটো। মনে হত কোটরের ভিতর থেকে যে দুটো তীক্ষ্ন চোখ উঁকি মারছে, তারা যেন ভৈরবের নিজের চোখ নয়! কেন এমন মনে হত জানি না। কিন্তু মনে হত অমন রহস্যময় চোখ আমি আর কোনো মানুষের দেখিনি।
খবর পেলুম হঠাৎ ভৈরব মারা পড়েছেন। আমি ডাক্তার, খবর পেয়েই দেখতে গেলুম। পরীক্ষা করে বুঝলুম, হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি চোখ খুলেই মারা পড়েছেন— সেই দুটি অদ্ভুত চোখ! এখন তারা স্থির বটে, কিন্তু এখনও তেমনি রহস্যময়! স্থিরতা ছাড়া তাদের মধ্যে মৃত্যুর আর কোনো লক্ষণই ছিল না।
ভৈরবের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তিনি একেবারেই একলা থাকতেন। কাজেই শবদাহের ব্যবস্থা করতে হল পাড়ার লোকদেরই।
সন্ধ্যার সময় জন কয়েক লোক নিয়ে ভৈরবের বাসায় গিয়ে হাজির হলুম। যে ঘরে ভৈরবের দেহ ছিল তার দরজায় আমি স্বহস্তে তালা বন্ধ করে দিয়েছিলুম। এখন গিয়ে দেখি দরজা খোলা, তালাটা পড়ে রয়েছে মেঝের ওপরে! চোর-টোর এসেছিল নাকি?
তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে আরও হতভম্ব হয়ে গেলুম।
এই একটু আগে আমি নিজে চৌকির ওপরে যে মৃতদেহটা পরীক্ষা করে গিয়েছি, সেটা আর সেখানে নেই। ঘরে-বাইরে চারিদিকে অনেক খোঁজাখুঁজি করা হল। মড়া পাওয়া গেল না।
মড়া নিজে বেঁচে উঠে ভিতর থেকে বাইরের তালা খুলে বেরিয়ে যায়নি। তবে কেউ লাশ চুরি করেছে? সম্ভব। কিন্তু মড়া চুরি করে কার লাভ হবে, সেটা আন্দাজ করা গেল না।
ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের ছোটো শহরটি কিছুদিনের জন্য সরগরম হয়ে উঠল।
তারপর ভৈরবের কথা আমরা একেবারেই ভুলে গেলুম।
দুই
তিন বছর পরের কথা।
দেশে আবার চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নানা লোকের হাঁস, মুরগি, ছাগল, বিড়াল, কুকুর— এমনকী গোরু-মোষ পর্যন্ত চুরি যেতে লাগল।
পুলিশে খবর দিয়েও কোনো কিনারা হল না। কারা চুরি করে এবং এত জন্তুজানোয়ার লুকিয়েই বা রাখে কোথায়, কেউ তা আবিষ্কার করতে পারলে না। গৃহস্থরা জ্বালাতন হয়ে উঠল।
গোরু-মোষ প্রভৃতি যেন মূল্যবান জন্তু, কিন্তু বিড়াল ও দেশি কুকুরও যে অদৃশ্য হচ্ছে— এই বা কীরকম রহস্য? বিড়াল-কুকুর নিয়ে চোর কী করবে? অনেক মাথা খাটিয়েও এই অদ্ভুত নির্বুদ্ধিতারও অর্থ বুঝতে পারলুম না।
সেদিন একটু বেশি রাত পর্যন্ত বসে বই পড়ছিলুম। বাইরে ক্ষীণ চাঁদের অস্পষ্ট আলো। বাগান থেকে শোনা যাচ্ছে একটা বিড়ালের ম্যাও-ম্যাও ডাক। খানিক পরেই বিড়ালটা হঠাৎ খুব জোরে আর্তনাদ করেই একেবারে চুপ মেরে গেল!
চোরের উৎপাতে মনটা সন্দিগ্ধ হয়েই ছিল। কোথাও ছায়া নড়লেই চোর দেখি। বিড়ালটার তীব্র চিৎকারে চমকে বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে হল একটা মূর্তি দৌড়ে ঝুপসি বট গাছটার তলায় গিয়ে অন্ধকারে দিল গা ঢাকা।
ওই কি চোর? নইলে পালাবে কেন? তাড়াতাড়ি ঘরের কোণ থেকে একগাছা লাঠি তুলে নিয়ে আমিও বেরিয়ে বট গাছের দিকে ছুটে গেলুম। এতদিন পরে বোধ হয় চোরকে হাতে পেয়েছি। বট গাছের তলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক জায়গায় কী যেন চকচক করছে— চোরের চোখ নাকি?
হাঁকলুম, ‘কে তুমি?’
সাড়া নেই। কিন্তু চোখই হোক আর যা-ই হোক, আরও বেশি চকচক করে উঠল।
লাঠিগাছা বাগিয়ে ধরে সাবধানে এগুতে লাগলুম। তখনি শুনলুম হিংস্র বন্য জন্তুর মতন কণ্ঠে কার একটা ক্রুদ্ধ গর্জন। কে বলে উঠল— ‘আর এগিয়ো না ডাক্তার, শিগগির চলে যাও!’
আমায় চেনে দেখছি। আবার জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কে তুমি?’
‘আমি ক্ষুধার্ত! আমার অন্য পরিচয় নেই!’
‘তুমি আলোয় বেরিয়ে এসো। আমি তোমাকে দেখতে চাই।’
‘আমাকে দেখবার চেষ্টা কোরো না! আমি হচ্ছি সাক্ষাৎ মৃত্যু! পালিয়ে যাও ডাক্তার, পালিয়ে যাও! আর শোনো, রাত্রে আর কখনো বাইরে বেরিয়ো না! ভয় পাবে, বিপদে পড়বে!’
‘আবার ভয় দেখানো হচ্ছে? দাঁড়াও, তোমার চালাকি বার করছি!’
আমার উচ্চ চিৎকারে চারিধার থেকে লোক ছুটে এল। সকলেরই মুখে এক প্রশ্ন— ব্যাপার কী?
‘চোর ধরেছি। ওইখানে লুকিয়ে আছে।’
সকলে চারিদিক থেকে গাছটাকে ঘিরে ফেললে। আলো এল। কিন্তু গাছের তলায় কেউ নেই।
কেবল দূর থেকে ভেসে এল বিকট ও সুদীর্ঘ অট্টহাসির শব্দ! সে হাসিও যেন ক্ষুধার্ত। শুনে শিউরে উঠতে হয়।
কে এই লোক? চোর, না আর কেউ? ও যা বললে তার অর্থই বা কী? ও ক্ষুধার্ত বলে আত্মপরিচয় দিলে কেন? আমাকে রাত্রে পথে বেরুতে মানা করলে কেন? এমনি নানান প্রশ্ন মনের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগল।
তিন
আবার সব নতুন কাণ্ড!
জন্তু-চুরি বন্ধ হল না, তার ওপরে মানুষও অদৃশ্য হতে লাগল।
এক মাসের মধ্যে পাঁচজন মানুষ অদৃশ্য হয়েছে! প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তারা রাত্রে বাইরে বেরিয়ে আর বাড়িতে আসেনি।
বলেছি, আমাদের ছোটো শহরে অসাধারণ ঘটনা ঘটে না। এই নতুন কাণ্ডের জন্যে দিকে দিকে জাগল বিষম বিস্ময় ও ভীষণ আতঙ্কের সাড়া। শহরের পথে পথে সারারাত ঘুরে বেড়াতে লাগল দলে দলে পাহারাওয়ালা। সন্ধ্যা হলেই গৃহস্থরা বাড়ির দরজা বন্ধ করে বসে থাকে, দলে ভারী না-হলে কেউ আর পথে পা বাড়াতে ভরসা করে না। সূর্য অস্ত গেলেই, সব দোকানে তালা পড়ে।
অবশেষে একদিন একটা অদৃশ্য মানুষের মৃতদেহের খানিকটা পাওয়া গেল। তার দেহের ওপর অংশটা শেয়াল বা অন্য কোনো জানোয়ার খেয়ে গেছে। কেমন করে সে মারা পড়ল তা কেউ আন্দাজ করতে পারলে না।
তাহলে যারা অদৃশ্য হয়েছে তাদের সবাই মারা পড়েছে হত্যাকারীরই হাতে? কিন্তু অমন অকারণ নরহত্যার হেতু কী? যাদের পাওয়া যাচ্ছে না তাদের প্রত্যেকেই নিম্নশ্রেণির গরিব লোক। টাকার লোভে কেউ তাদের খুন করেনি। তাদের শত্রু আছে এমন প্রমাণও পাওয়া গেল না। কে এই মহানির্দয় খুনি— যে কেবল হত্যার আনন্দে হত্যা করে?
চার
ডাক্তার মানুষ, রাত্রে প্রায়ই আমাকে রোগী দেখতে যেতে হয়। তবে বেশিদূরে যেতে হলে সঙ্গে আজকাল লোক নিই।
আজ বাড়ির কাছেই একটা কলেরা রোগীকে দেখতে যেতে হল। বেশিদূর নয়, মিনিট সাত-আটের পথ। একলাই ফিরছি— চাঁদনি রাত। এতক্ষণ চারিধার ধবধব করছিল। কিন্তু হঠাৎ মেঘ এসে গ্রাস করলে চাঁদকে। বাতাসের জোর ক্রমেই বাড়ছে। বৃষ্টি আসতে দেরি নেই।
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে দিলুম, হাতে নিলুম টর্চ। এমন অন্ধকার হবে জানলে একলা আসতুম না। ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি।
পথ একেবারে নির্জন। মফসসলের এই শহরে চাঁদনি রাতে, পথে আলো দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালতে হচ্ছে। পথ একটা ছোটো মাঠে গিয়ে পড়েছে। ওই মাঠ পেরুলেই আমাদের পাড়া।
মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর, তার পাড়ে গোটা কয়েক গাছ। সেইখানে এসেই মনটা ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করতে লাগল। মনে পড়ল অজানা হত্যাকারীর কথা।
গাছের ডালপাতায় বাতাসের শব্দ শুনেও চমকে চমকে উঠতে লাগলুম।
আমি বরাবর লক্ষ করে দেখেছি, রাত্রে খোলা জায়গায় ভয় হয় না। কিন্তু যেখানে থাকে জঙ্গল বা গাছপালা, রাত্রির বিভীষিকা যেন সেইখানে গিয়েই বাসা বাঁধে। গাছে গাছে শোনা যায় যেন অশরীরীদের কানাকানি, আঁধারে আবছায়ায় চলতে থাকে যেন ইহলোকের বিরুদ্ধে পরলোকের ষড়যন্ত্র!
মেঘলা রাত, অন্ধ পৃথিবী, জনশূন্য মাঠ!
আচম্বিতে বিরক্ত কণ্ঠস্বর শুনলুম, ‘ডাক্তার, ডাক্তার! আবার তুমি রাত্রে বেরিয়েছ?’
বুক কেঁপে উঠল। মুখে বললুম, ‘কে?’
‘ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত— দারুণ ক্ষুধা আমার মাংস চাই, হাড় চাই, রক্ত চাই! দিতে পারবে তুমি? পারবে না পারবে না— হি হি হি হি হিঃ হিঃ!’
ভয়ানক হাসি, ভয়ানক কণ্ঠস্বর! কে এ? পাগল? এই কি মানুষ খুন করে? যেন বোবা হয়ে গেলুম।
‘ভয় নেই ডাক্তার, আমি তোমার শত্রু নই। তাই তো বার বার তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। কখনো রাত্রে বেরিয়ো না! কী জানি, যদি আমার ক্ষুধা জাগে— আমার যে বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা! শিগগির পালাও— শিগগির!’
আতঙ্কের মধ্যেও মনে জাগল বিষম কৌতূহল। ধাঁ করে দিলুম টর্চটা টিপে।
হা ভগবান, এ কী বিভীষিকার মূর্তি! গাছতলায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে এ যে সেই তান্ত্রিক ভৈরব গড়গড়ি! তিন বছর আগে আমাদেরই সামনে যে মারা পড়েছে এবং যার মড়া খুঁজে পাওয়া যায়নি! ভৈরবের মুখময় রক্ত এবং তার সামনেই মাটির ওপরে পড়ে রয়েছে রক্তাক্ত মৃতদেহ!
প্রচণ্ড গর্জন করে ভৈরব এক লাফ মেরে টর্চের আলোকরেখার বাইরে গিয়ে পড়ল— সঙ্গে-সঙ্গে শুনলুম দ্রুত পদশব্দ।
আমিও ঝড়ের বেগে ছুটলুম মাঠের ওপর দিয়ে বাড়ির দিকে।
সবকথা আমার মনে পড়ে গেল, তাড়াতাড়ি উঠে বসলুম।
মা উদবিগ্ন স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা, তোর কী হয়েছিল বাবা? এখানে অত গোলমাল হচ্ছিলই বা কেন, আর ওই ”গ্লাস-কেস”টাই বা ভাঙল কেমন করে?’
আমি এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে দেখি, ‘গ্লাস-কেস’টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে এবং তার ভিতরে বামুনের সেই মমিটা আর নেই!
তাড়াতাড়ি ফিরে বললুম, ‘মা, মা, এখানে এসে তুমি আর কারুকে দেখতে পেয়েছ?’
মা কিছুই বলতে পারলেন না।
চেঁচিয়ে দরোয়ানকে ডাকলুম, তার মুখে জানলুম ফটক দিয়ে কেউ বাইরে বেরিয়ে যায়নি।
সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও এমিন পাশা বা সেই মমির কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না। ঘরের মেঝেয় শুধু কুড়িয়ে পেলুম, এমিন পাশার সেই টুপি, চশমা, কম্ফর্টার, জামা, ইজের ও একজোড়া জুতো!
আমি কি অসুস্থ দেহে কোনো বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি! না, কোনো চোর ছদ্মবেশে এসে আমাকে ভয় দেখিয়ে ঠকিয়ে মূল্যবান মমিটাকে চুরি করে নিয়ে গেল?