1 of 2

কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

কে তুমি? – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

গ্রাম আমি কখনও দেখিনি। শহরেই জন্ম, শহরেই বড় হয়েছি। শহরেই কেটেছে জীবনের এই পঁচিশটি বসন্ত।

আমার এক বন্ধু জুটেছে চাকরি করতে গিয়ে। বন্ধুর নাম সুজিত। বীরভূম জেলার কোন একটি গ্রামে তার বাড়ি। বাড়ির অবস্থা মন্দ নয়। হঠাৎ একদিন সুজিত আমাকে বললে, যাবি আমাদের বাড়ি? গ্রাম কখনও দেখিসনি বলছিস, দেখে আসবি।

সামনে চারদিন ছুটি। বললাম, যাব।

সুজিতদের গ্রামে এসেছি। রেল স্টেশান থেকে বহু দূরে—কতক গরুর গাড়িতে, কতক-বা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। দুই বন্ধুতে বেড়াতে-বেড়াতে তাই গেলাম।

গ্রামখানি চমৎকার। ঢেউ-খেলানো মাটি, চারিদিকে ধানের মাঠ। গ্রামের দক্ষিণে একটি জঙ্গল। শাল, তাল আর তমাল গাছের সারি। মনে হয়, প্রতিটি গাছ যেন যত্ন করে পোঁতা। একে এরা জঙ্গল কেন বলে বুঝতে পারি না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মাটির ওপর শ্রেণীবদ্ধ গাছের ছায়া-নিবিড় তপো-বনের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম জায়গাটি আমার এত ভালো লাগল যে, সহজে সেখান থেকে আসতে মন চাইল না।

সুজিতের বাড়িখানা পুরোনো। আগেকার দিনের তৈরি দোতলা বাড়ি—কিছু ভেঙেছে, কিছু বা মেরামত করা হয়েছে।

দোতলার একটি ঘরে আমার শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দক্ষিণ দিকের জানলাটি খুললে দেখা যায়—পাশেই একখানি মাটির বাড়ি। পোড়ো-বাড়ি বলেই মনে হয়। লোকজন কেউ বাস করে না। উঠোনে একটি আমের গাছ। গাছে তখন অজস্র মুকুল ধরেছিল। আমের মুকুলের গন্ধে আমার ঘরখানা যেন ভরে আছে।

রাত্রি তখন কত ঠিক মনে নেই। সেদিন কার ডাকে যেন ঘুম ভেঙে গেল শুনছেন? শুনছেন?

স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর।

জানলার পথে তাকিয়ে দেখলাম, সেই পোড়ো-বাড়িটার উঠোনে আমগাছটির তলায় তন্বী এক তরুণী দাঁড়িয়ে। জ্যোৎস্নার আলো গাছের ফাঁকে-ফাঁকে এসে পড়েছিল মেয়েটির সর্বাঙ্গে। মেয়েটি সুন্দরী বলেই মনে হল।

জিজ্ঞাসা করলাম, কী বলছেন?

মেয়েটি বললে, আমার মা কোথায় বলতে পারেন?

বললাম, আমি নতুন এসেছি এ-গ্রামে। আমি কিছু জানি না।

আর কিছু বললে না মেয়েটি।

মনে হল যেন সে চলে গেল। আলোছায়া ঘেরা সেই গাছের তলায় তাকে আর দেখতে পেলাম না। কোন দিক দিয়ে কোথায় গেল বুঝতে পারলাম না।

ঘটনাটা আমি ভুলতে পারছিলাম না। পরের দিন সকালে বললাম সুজিতকে।

সুজিত বললে, ও জানলাটা আর খুলো না। বন্ধ করে দিয়ো।

কেন বলো দেখি? মেয়েটা কি—।

সুজিত বললে, না, না, সেরকম কিছু নয়। কাজ কী বাবা পরের মেয়ের সঙ্গে…দু-দিনের জন্যে এসেছিস—।

বুঝলাম। সেই ভালো।

সেদিন রাত্রে জানলাটা বন্ধ করেই আমি শুয়েছিলাম।

কিন্তু সেদিন আবার। আবার সেই কণ্ঠস্বর। আবার সেই ডাক শুনছেন? শুনছেন?

জানলার কপাটটা ঠেলছে বলে মনে হল।

বাধ্য হয়ে জানলাটা খুলে ফেললাম।

কিন্তু এ কী? সেই সুন্দর মুখখানি জানলার শিকগুলোর ঠিক পেছনে! মেয়েটি মনে হল যেন জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? জানলার পেছনে তো কিছু নেই! মেয়েটি তা হলে দাঁড়িয়ে আছে কীসের ওপর।

এই কথা ভাবতেই টপ করে মাথাটা আমার ঘুরে গেল।

বললাম, আমি জানি না—কাল তো বলেছি আপনাকে!

আমার কপালে তখন বিন্দু-বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। আমি কাঁপছি ঠকঠক করে। জানলাটা বন্ধও করতে পারছি না, চিৎকার করে ডাকতেও পারছি না সুজিতকে।

আমার অবস্থা দেখেই বোধহয় খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি।

সুন্দর সাজানো দাঁতের সারি। উজ্জ্বল দুটি টানা-টানা চোখ।

মেয়েটি বললে, আমি তো কোনও কথাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করিনি! আমি জানি আপনি নতুন এসেছেন। ক’দিন থাকবেন?

খুব খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে জানলাটা বন্ধ করবার জন্যে হাত বাড়িয়েছিলাম বোধহয়। কিন্তু জানলাটা বন্ধ করবার অবসর আমি পেলাম না। তার আগেই মেয়েটি এসে দাঁড়াল একেবারে আমার সুমুখে—ঘরের ভেতর।

আবার তার সেই হাসি!

তারপর কী হয়েছে আমার আর কিছু মনে নেই।

বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।

জ্ঞান যখন ফিরে এল দেখি, আমি শুয়ে আছি সুজিতের ঘরে। সুজিতের ছোট বোন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাওয়া করছে। মাথার চুলগুলো ভিজে। মাথায় বোধ করি জল ঢালা হয়েছে।

সুজিত দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাসছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, হাসছিস যে? কী হয়েছিল রে?

সুজিত বললে, কীরকম ভীতু রে তুই! ওরকম করে চেঁচিয়ে উঠেছিলি কেন?

কেন তা আমি কেমন করে বলি! বললাম, তারপর?

সুজিত বললে, তোর চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম। ভাগ্যিস দোরে খিল বন্ধ করিসনি। নইলে কী যে হত কে জানে!

খুব হয়েছে আমার গ্রাম দেখা!

পরের দিনই বললাম, আমি কলকাতায় যাব।

সুজিতকেও আসতে হল আমার সঙ্গে।

গ্রামে থাকতে সুজিত আমাকে কোনও কথাই বলেনি। কোনও রহস্যই ভাঙেনি।

ট্রেনে আসতে-আসতে সুজিত বললে, বেচারা সুবী! ওকে আমরা দেখেছি সবাই। কিন্তু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা গ্রাহ্য করি না। মেয়েটা আসে। তার মায়ের খবর জানতে চায়। বলে, তার মা কোথায় তোমরা বলো।

—আমি কিছু বুঝতে পারছি না। খুলে বল সব কথা।

সুজিত বললে, তা হলে শোন!

সংসারে মাত্র দুটি মানুষ। মা আর মেয়ে।

মায়ের বয়স হয়েছে, মেয়ের বয়স এই সবে আঠেরো-উনিশ, কিন্তু দুজনেই বিধবা।

ঝগড়াঝাঁটি তাদের চব্বিশ ঘণ্টা লেগেই থাকে। মেয়েটাই দিবারাত্রি খিটির-খিটির করে। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করবার ছুতো খুঁজে বেড়ায়। আবার অবাক কাণ্ড—খুব খানিকটা ঝগড়া করে নিজেই শেষে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে।

মা বলে, তুই একটা কিছু না করে আর ছাড়বিনে দেখছি! মাথার একপিঠ চুল এলিয়ে এই ভর দুপুরবেলা কাঁদতে বসলি যে? আয়, চুলগুলো বেঁধে দিই।

এই বলে চুলগুলো বেঁধে দেওয়ার জন্যেই মা হয়তো তার কাছে এগিয়ে যায়, কিন্তু মেয়ে তখন রেগে একেবারে টং। চুলে হাত দিতে সে কিছুতেই দেবে না। বলে, যাও, যাও, খুব হয়েছে। তোমাকে আ—।

মায়ের চোখ দুটি তখন জলে ভরে আসে।

আঁচলে চোখ মুছে বলে, থাক তবে, কাঁদ ওইখানে! বলে ধীরে-ধীরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে গিয়ে এর বাড়ি খানিকক্ষণ বসে, ওর বাড়ি খানিকক্ষণ বসে, কথা কইবার মতো কাউকে যদি কাছে পায় তো বলে, ওই বয়েস আর ওই রূপ নিয়ে বিধবা হল, মা, মেয়েটার মুখের পানে আর তাকাতে পারছিনি।

প্রতিবেশিনী হয়তো আশ্বাস দেয়। বলে, ভেবো না, মা, গা-সওয়া হয়ে যাবে।

মা কিন্তু তার নিজের কথাই বলতে থাকে। বলে, আমার কী মনে হয় জানিস বাছা, মনে হয়—এই নিয়ে সুবী হয়তো দিবারাত্তির ভাবে। ভেবে আর যখন কিছু কূলকিনারা পায় না, তখন হয়তো ও অমনি করে। হয় কাঁদতে বসে, নয়তো ঝগড়া করবার জন্য খুনসুটি করে বেড়ায়।

প্রতিবেশিনী মেয়েটি এবার নীরবে শুধু ঘাড় নেড়ে কথাটা সমর্থন করে।

সুবীর মা তার মুখের পানে তাকিয়ে বলে, বুঝতে সবই পারি, বাছা, কিন্তু মা হয়ে আমি যে আর—।

বলতে-বলতে ঠোঁট দুটি তার থরথর করে কাঁপতে থাকে, চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে আসে।

সে চোখের জল আর কিছুতেই থামতে চায় না। আঁচল দিয়ে মোছে আর তৎক্ষণাৎ কানায়-কানায় ভরে ওঠে।

মায়ের সে-কান্না বুঝি বিধাতারও সহ্য হল না। তাই সে-কান্নার পালা হঠাৎ একদিন চুকে গেল। বিধাতা চুকিয়ে দিলেন কি সুবী নিজেই চোকালে কে জানে!

সেদিন দুপুরে মা ও মেয়ে দুজনেই খেতে বসেছে। ভাত চিবোতে গিয়ে কটাং করে সুবী তার দাঁতে একটা কাঁকর চিবিয়ে ফেললে। হাতের গ্রাসটা তৎক্ষণাৎ সে থালার ওপর ছিটকে ফেলে দিয়ে বলে উঠল, না, আর পারিনে বাবা! কেন, চালগুলো বেছে নিতে পারোনি?

মা বললে, চাল আর কত বাছব, বাছা! ভাতে কাঁকর-পাথর দু-একটা অমন থাকে। তাই বলে তোর মতো এমন বিটকেল কেউ করে না—খা।

মেয়ে আর না খেয়ে হাত গুটিয়ে বসে রইল দেখে মায়ের মনে সত্যিই এবার একটুখানি রাগ হল। বললে, এমন তিরিক্ষে মেজাজ তোর কেন হল সুবী? কই, আগে তো এমন ছিল না!

সুবীর মুখখানা ভারি হয়ে উঠল।

তাই না দেখে মা আবার বললে, এতই যদি লবাবের মেয়ে হয়ে থাকিস তো চালগুলো কাল থেকে তুই নিজের হাতে বেছে দিস।

—তাই দেব।—বলে থালাটাকে হাত দিয়ে সরিয়ে সুবী উঠে দাঁড়াল।

সর্বনাশ! বিধবা মেয়ে, একবারের বেশি খেতে নেই! মা চট করে বাঁ-হাত বাড়িয়ে তার আঁচলটা চেপে ধরে বলে উঠল, বোস মা বোস, চারটি খেয়ে নে! কেউ দ্যাখেনি, তাতে দোষ নেই, নে বোস!

ঝাঁকানি দিয়ে সুবী তার আঁচলটা ছাড়িয়ে নিলে। বললে, না, আর খাব না।

—সারাদিন খেতে যে আর পাবি নে হতভাগী, উপোস দিয়ে মরবি?

—মরণ হলে তো বাঁচি! মরণ যে হয় না ছাই!

—তাই মর তুই! আমারও হাড়টা জুড়োয় তা হলে।

বিড়বিড় করে কী যেন বলতে-বলতে সুবী আঁচাতে চলে গেল।

মা-ই বা আর কেমন করে খায়! থালাটা সরিয়ে দিয়ে মা-ও উঠে দাঁড়াল।

খিড়কির পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সুবী দেখলে, এঁটো থালা তেমনি পড়ে আছে, আর ঘটির জলে উঠোনে হাত ধুয়ে মা তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে।

তার মা সেদিন যেখানে-সেখানে কেঁদে-কেঁদে সারা হল।—না, মা, রইল ওই দস্যি মেয়ে আমার বাড়িতে, আমায় দেখছি কোনও দেশ গিয়ে পালাতে হল।

প্রতিবেশিনী মেয়েরা কেউ বা সান্ত্বনা দেয়, আবার কেউ বা বলে, কী জানি, মা, তোমাদের ঝগড়ার কিছু বুঝিনে আমরা!

মায়ের চোখ দিয়ে জল আসে। বলে, বুঝতে কি ছাই আমিই পারি, বাছা? ও যে কেন অমন করছে, মা, তা কে জানে!

মা আবার সে-বাড়ি থেকে উঠে আর-এক বাড়িতে গিয়ে বসে। সেখানেও সেই কান্না আর ওই এক কথা!—আজ আর আমি বাড়ি ঢুকছিনে। দেখি, ও আমায় খুঁজতে আসে কি না।

এমনি করে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করতে-করতে সূর্য ডুবল। রোজ ঠিক এমনি সময় পুকুর থেকে এক কলসী করে খাবার জল তাকে আনতে হয়। পাড়ার মেয়েরা সব কলসী কাঁখে নিয়ে পুকুরে যাচ্ছিল, করালীর মা বললে, চলো, না-হয় আমার একটা কলসী নিয়েই চলো আজকে।

সুবীর মা বললে, না, বাছা, থাক, আজ আর যাব না। মজাটা একবার বুঝুক।

মজা বোঝাবার জন্যে সে বসে রইল বটে, কিন্তু দেখতে-দেখতে চারদিক আঁধার হয়ে এল, ঘরে-ঘরে প্রদীপ জ্বলল, তবু সুবী তাকে ডাকতে এল না।

মায়ের মন ঘর ছেড়ে এমন করে কতক্ষণই বা বাইরে থাকে। তুলসীতলায় এখনও হয়তো সন্ধে পড়ল না…এতক্ষণে সে হয়তো তার নিজের লণ্ঠনটি জ্বেলে নিয়ে রামায়ণ পড়তে বসে গেছে….মা তার মরল না বাঁচল বয়ে গেছে তার দেখতে!

সরু একটা গলির অপরপ্রান্তে একেবারে একটেরে তাদের সেই ছোট্ট মাটির ঘরখানি—চারদিকে মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সদর দরজা পেরিয়েই বাঁ-হাতি উঠোনের একপাশে বহুদিনের প্রাচীন একটা আমের গাছ—অজস্র ডালপালা বিস্তার করে জায়গাটাকে অন্ধকার করে রেখেছে। তা হলেও ঘরে যদি আলো জ্বলে তো বাইরে থেকেই টের পাওয়া যায়। কিন্তু আলো জ্বলা দূরে থাক, সুবীর মা সদর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দ্যাখে, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।

হেঁকে বললে, সুবী, দরজা খোল! কাজ দ্যাখো দেখি মেয়ের! ঘরে ঢুকতে না দেওয়ার মতলব!

ভেতর থেকে সুবী সাড়া আর কিছুতেই দেয় না, দরজাও খোলে না।

কাছেই তারাপদদের বাড়ি। তারাপদ তখন সবেমাত্র গোয়ালে গাইগরুগুলিকে খেতে দিয়ে ঘরে এসে বসেছে, এমন সময় সুবীর মা এসে বললে, আয় তো, বাবা, সুবীকে একবার আচ্ছা করে ধমকে দিবি। সদর দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে, আমায় ঢুকতে দেবে না।

তারাপদ হেসে বললে, ঝগড়া হয়েছে বুঝি? বলেই লন্ঠনটি হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দরজায় বারকতক জোরে-জোরে ধাক্কা দিয়ে বললে, খোল বলছি, সুবী, নইলে কিছু বাকি রাখব না।

দরজা তবু খুলল না।

লন্ঠনটা হাত থেকে নামিয়ে তারাপদ বললে, তুমি দাঁড়াও, মাসি, আমি পাঁচিল টপকে দরজাটা খুলে দিই।

খাটো মাটির প্রাচীর। উঠতে বিশেষ বেগ পেতে হল না।

কিন্তু ঝুপ করে ওপাশে নেমেই সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে কী যেন দেখে সে আমগাছের তলা থেকে সহসা বিকৃতকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, মাসি! মাসি!

বাইরে থেকে সুবীর মা বললে, কী, বাবা?

কিন্তু জবাব দেওয়ার অবসর তখন আর নেই। দড়াম করে দরজাটা খুলে ফেলেই তারাপদ কাঁপতে-কাঁপতে বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি লণ্ঠনটা তুলে নিয়ে সে আমগাছের তলায় দিয়ে দ্যাখে—সর্বনাশ!

সুবীর মা তো অস্ফুটকণ্ঠে বিকট একটা চিৎকার করে সেইখানেই আছাড় খেয়ে পড়ল।

আর স্তম্ভিত নির্বাক তারাপদ কম্পিত হস্তে লণ্ঠনের আলোটা তুলে ধরে দেখলে—আমগাছের একটা ডালের গায়ে মোটা একটা দড়ির ফাঁসি লটকে সুবী আত্মহত্যা করেছে। পায়ের নীচে দড়ির ভাঙা খাটিয়াটা উলটে পড়ে আছে। টকটকে ফরসা গায়ের রং যেন দুধে-আলতায় গোলা, পিঠের ওপর ঢেউখেলানো কালো একপিঠ চুল, কিন্তু মুখের চেহারা দেখলে আর সে-সুবী বলে চেনবার উপায় নেই, দাঁতের ফাঁকে খানিকটা জিভ বেরিয়ে গেছে, চোখ দুটো বড়-বড়, গায়ের কাপড়-চোপড় বেসামাল অবস্থায় মাটিতে লুটোচ্ছে। হতভাগী মরবার আগে বাঁচবার জন্যে চেষ্টা করেছিল কি না তাই-বা কে জানে!

ব্যস! সমস্ত গ্রাম একেবারে ঠান্ডা।

গ্রামদেশে আত্মহত্যা এমন কিছু নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা নয়, দু-দশ বছর পরে কদাচিৎ কোনও গ্রামে দৈবাৎ যদি বা এক-আধটা এমন আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটে যায় তো কিছু বলবার থাকে না।

এখন এ-মৃতদেহ নিয়ে কী করা যায়—এই হল গ্রামের লোকের ভাবনা। আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও তাদের আছে কি না কে জানে! সুবীর মা তো সেই যে মাটিতে উপুড় হয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে সেই থেকে আর ওঠেনি।

শিবমন্দিরের পাশে গ্রামের একটা রাস্তার ধারে সেই রাত্রেই মজলিশ বসল। অনেক কথা-কাটাকাটির পরে শেষে এই ঠিক হল যে, কী জানি বাবা, আত্মহত্যার মড়া শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে আসবার পর কেউ যদি পুলিশে খবর দিয়ে দেয় যে, সে আত্মহত্যা করেনি, কেউ তাকে মেরে ফেলে দিয়ে গাছে অমনি টাঙিয়ে রেখেছিল—তখন?…তারচেয়ে আগে থেকেই পুলিশে খবর দেওয়া হোক।

গ্রাম থেকে তিন ক্রোশ দূরে থানা। কিন্তু সুবীর দুর্ভাগ্য, চৌকিদার ফিরে এসে খবর দিলে—দারোগাসাহেব ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন, জমাদারসাহেব আসবেন কাল সকালে। বলেছেন, দাঁড়া, আমি দেখাচ্ছি মজা, গলায় দড়ি নিয়ে মরা আমি বের করছি।

গ্রামের লোক তো ভয়ে অস্থির!

দুগু ভটচায বললে, কেন, তখনই তো বলেছিলাম, দাদা, পুলিশে খবর দিয়ে কাজ নেই—দিই জ্বালিয়ে।

লোকনাথ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল।—ব্যাটা বলে কী হে! তারপর? তারপর ঠেলাটি কে সামলাত?

দুগু বললে, ঠেলা আবার কীসের?

হরিপদ তাকে বুঝিয়ে দিলে যে, কেউ যদি বলত যে, না, ও গলায় দড়ি দিয়ে মরেনি, দুগু ভটচাযের সঙ্গে দিনেরবেলা ঝগড়াঝাঁটি না কীসব যেন হয়েছিল—।

দুগু ভটচায কালা মানুষ, কানে ভালো শুনতে পায় না। এদের আগেকার মন্তব্য সে কিছুই শোনেনি। হরিপদর মুখে তার নাম শুনে সে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল, খবরদার বলছি, হরিপদ, মিছে কথা বলিসনে। আমার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি।

সবাই তখন মুচকি-মুচকি হাসছে।

হরিপদর সঙ্গে শেষে হাতাহাতি হওয়ার জোগাড়! অনেক কষ্টে ভটচাযকে থামানো গেল। কিন্তু পরদিন সকালেও থানা থেকে জমাদারসাহেব এলেন না।

গ্রামে মানুষ মরেছে, বাসী মড়া তো হলই, তার ওপর আত্মহত্যার মড়া। ঠাকুর-দেবতার শিলা-বিগ্রহের নিত্য সেবা যাদের বাড়িতে আছে তারা তো ভেবেই অস্থির। ঘর থেকে মৃতদেহটাকে বের না করা পর্যন্ত ঠাকুর-দেবতার পুজো হবে না এবং পুজো যারা করবে, পুজো না হলে তাদের জলগ্রহণ করার উপায় নেই।

লোকনাথের বাড়ি প্রত্যহ শালগ্রাম শিলার ভোগ হয়। সকালে উঠেই ভিন্নগ্রামে সে একটা প্রায়শ্চিত্ত করাতে গিয়েছিল, প্রায় বেলা বারোটার সময় তেতে-পুড়ে ফিরে এসেই শুনলে, পুলিশও আসেনি এবং মড়া তখনও ঘরের উঠোনেই পড়ে আছে। মড়া দেখতে যারা গিয়েছিল, সকাল থেকে সুবীর মা নাকি তাদের প্রত্যেককেই কেঁদে-কেটে হাতে-পায়ে ধরে মড়াটাকে একটুখানি বের করে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিল, কিন্তু কেউ তা শোনেনি।

লোকনাথের তখন পিপাসায় কণ্ঠরোধ হয়ে এসেছে। ভেবেছিল, বাড়ি গিয়ে শালগ্রামের পুজোটা করে দিয়েই জল খাবে। কিন্তু তাও যখন হল না, তখন সে নিজেই হনহন করে বেরিয়ে গেল।

দেখা গেল, আপাদমস্তক ঢাকা-দেওয়া সুবীর মৃতদেহ আগলে তার মা আমগাছের তলায় একাকিনী চুপ করে বসে আছে। চোখে জল নেই, মুখখানি শুকনো—কেঁদে-কেঁদে সে যেন হয়রান হয়ে গেছে।

দরজার বাইরে থেকে লোকনাথ চেঁচিয়ে উঠল, বলি ও ঠাকরুন, মেয়ে তো না হয় সাতকুল উজ্জ্বল করে দিয়ে মলো, তাই বলে কি ও-হারামজাদীর সঙ্গে-সঙ্গে আমাদেরও মরতে হবে নাকি? মড়া বের না করলে যে ঠাকুরের ভোগ হয় না!

মুখ তুলে একবার চাইতেই সুবীর মায়ের চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়িয়ে এল। কথা সে কিছুই বলতে পারলে না, গলা তখন তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

লোকনাথ ভাবলে, বুঝি মাগী এইবার হয়তো তাকেই অনুরোধ করে বসবে।

রাগের মাথায় এখানে আসবার আগে অতটা সে ভাবেনি, তাই সে তৎক্ষণাৎ ঘোঁতঘোঁত করতে-করতে সেখান থেকে চলে গেল।

জমাদারসাহেব এলেন সন্ধের সময়। পিলপিল করে লোকজন তাঁর পিছু-পিছু ঢুকল সুবীদের বাড়ি।

কিন্তু সেখানে গিয়ে দ্যাখে, আমগাছের তলায় সেই ভাঙা খাটিয়াটা মাত্র পড়ে আছে, সুবীর মৃতদেহও নেই, সুবী মা-ও নেই।

কোথাও গেল তারা? বাগদিদের একটা ছোঁড়া আঙুল বাড়িয়ে দূরের একটা পুকুর দেখিয়ে বললে, উ-ইকানে বসে রয়েছে দেখলাম।

কিন্তু কখন যে সেখানে গেছে কেউ তা জানে না। লোকনাথ চলে যাওয়ার পর সুবীর মা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে নিজেই একবার মৃতদেহটা তার কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভারি মৃতদেহ কাঁধে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন সে সুবীর মাথার দিকটা দু-হাত দিয়ে ধরে কোনওরকমে টেনে-টেনে তাকে ঘরের বার করে এবং অমনি করেই একটু-একটু করে দূরের ওই পুকুরটায় নিয়ে গিয়ে ফ্যালে। আরও দূরে নিয়ে হয়তো সে যেত, কিন্তু পুকুরের চারিপাড়ে শুধু শক্ত-শক্ত কাঁকর আর পাথরের কুচি, এইতেই সুবীর রাঙা টুকটুকে পা দুখানি পথের ধুলোয় ম্লান হয়ে গেছে, তার ওপর মা হয়ে ওই শক্ত কাঁকর-পাথরের ওপর দিয়ে মেয়েকে তার হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়ই বা কেমন করে? তাই সে ওইখানেই চুপটি করে বসে আছে।

জমাদারসাহেব ভেবেছিলেন যা, এসে দেখলেন ঠিক তার উলটো। ভেবেছিলেন, অবস্থাপন্ন লোকের বিধবা মেয়ে, আত্মহত্যা করেছে, মর্গে চালান দেওয়ার নামে বেশ একটু ধমকা-ধমাকি করলেই কিছু বেরিয়ে আসবে। সাহেবের স্ত্রী নাকি অন্তঃসত্ত্বা, বাড়িতে এ-মাসে মোটারকম টাকা পাঠানো তাঁর একান্ত প্রয়োজন। সারা রাস্তা তিনি তাই ভাবতে-ভাবতে এসেছেন—আত্মহত্যা করে মানুষ মরেছে, তার দরুণ টাকা ঘুষ নিয়ে তিনি বাড়িতে পাঠাবেন, আর সেই টাকা খরচ হবে তার সন্তানের জন্মোৎসবে! তা হোক, পুলিশের কাজ করে অত সব ভাবতে গেলে চলবে না।

কিন্তু সাহেবের দুর্ভাগ্য কি সৌভাগ্য জানি না, কিছু না নিয়েই তাঁকে ফিরতে হল। মৃতদেহ সৎকার করবার হুকুম তিনি দিয়ে গেলেন।

শীতকালের রাত। মৃতদেহ সৎকারের পর স্নান করতে হবে। তার ওপর রাত্রে আর বাড়ি ফিরতে নেই। শ্মশানেই রাত কাটাতে হয়। সুতরাং কেউ আর বাড়ি থেকে সহজে বেরোতে চায় না।

গামছা কাঁধে নিয়ে লোকনাথ এসে দাঁড়াল।

দুগু ভটচায লাফিয়ে উঠল : ব্যস, কাউকে চাইনে। একজন সঙ্গী পেলে আমি একাই পুড়িয়ে ফেলতে পারি!

লোকনাথ ঘাড় নেড়ে বললে, উঁহু, ভেবে দেখলাম, পোড়ানো চলবে না।

সকলেই তার মুখের পানে তাকিয়ে আর কী বলে শোনবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রইল।—বাঁচালে বাবা! শীতকালের রাত—।

লোকনাথ বললে, একে গলায় দড়ি, তায় বাসী মড়া, অঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত না করলে ওর মুখাগ্নি চলবে না, আর মুখাগ্নি না করে অগ্নিক্রিয়া করতে দোষ আছে। তা ছাড়া যারা ওকে নিয়ে যাবে তাদেরও যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে!

কে যেন বলে উঠল, তা হলে দরকার নেই বাপু!

ভুবন তার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে মহা উৎসাহে গামছা কাঁধে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, লোকনাথের কথা শুনে তা মা দরজা থেকে ডাকলে, ওরে ও ভুবন! তা হলে চলে আয় বাবা! শুনছিস তো!

লোকনাথ বললে, শাস্ত্রে বলছে—গলরজ্জুঃ বৃক্ষশাখায়াং ত্রিসন্ধ্যাং কালেং যদি মৃত্তিকায়াং প্রোথিত অগ্নিক্রিয়া নৈবচ নৈবচ।—এর পরেও যদি কেউ যেতে যায় তো যাক—আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আমার বিবেচনায় গ্রামের দুজন বাউরি-বাগদি নিয়ে ওকে পুঁতে ফেলাই উচিত।

এমন সময় বিকট একটা চিৎকারের শব্দে সবাই যেন চমকে উঠল। গ্রামের বাইরে থেকে চিৎকার। মনে হল যেন স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর।

হঠাৎ খেয়াল হল সুবীকে আগলে সুবীর মা সেই পুকুরের ধারে একাকী এই অন্ধকারে এখনও চুপ করে বসে আছে। এ তারই গলার আওয়াজ!

ব্যাপারটা দুগু ভটচায ভালো বুঝতে পারেনি, হাঁ করে এর-ওর মুখের পানের তাকিয়ে বললে, কী?

কে একজন জোরে-জোরে তাকে বুঝিয়ে বললে, সুবীর মা চেঁচাচ্ছে।

এই কালা-খ্যাপা মানুষটির কোথায় গিয়ে যে বাজল কে জানে, সর্বাগ্রে সে উঠে দাঁড়াল এবং কাউকে কোনও কথা না জিগ্যেস করে যে একাই সেইদিক পানে চলে গেল।

খানিক পরে, তার দেখাদেখি জন দশ-বারো গ্রামের ছোকরা প্রত্যেকেই হাতে একটা করে লণ্ঠন নিয়ে সেখানে গিয়ে দ্যাখে, পুকুরের পাড় থেকে খানিক দূরে একটা মাঠের ওপর দুগু ভটচায দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে আর তার পায়ের কাছে সুবীর মৃতদেহ অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় পড়ে আছে।

ব্যাপার কী?

দুগু ভটচায বললে, একপাল শেয়াল এসেছিল আর দুটো বড়-বড় গো-বাঘা! বাপরে বাপ! ব্যাটারা ছাড়তে কি চায়! ওই দ্যাখো না, পায়ের কাছটা কেমন করে খুবলে নিয়েছে।

দেখা গেল, সুবীর বাঁ-পায়ের আঙুলগুলো একরকম নেই বললেই হয়। তা ছাড়া সর্বাঙ্গে তীক্ষ্ন দাঁতের চিহ্ন।

মা তার তখনও একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিজের পরিধেয় বস্ত্রটা সামলাচ্ছে। কারণ, ওরই সঙ্গে প্রথমে কাড়াকাড়ি শুরু হয়। এবং জন্তু-জানোয়ারের মুখ থেকে কন্যার মৃতদেহটাকে বাঁচাতে গিয়ে পরনের কাপড়খানা তার একেবারে শতচ্ছিন্ন জর্জরিত হয়ে গেছে।

লোকনাথও ছিল সেইখানে দাঁড়িয়ে। বললে, তা হলে ওই ব্যবস্থাই হোক। দুগু যখন মড়াটা ছুঁয়েইছে তখন ও-ই যাক শ্মশানে, সঙ্গে আরও জনকতক বাউরি-বাগদি নিক, নিয়ে বেশ ভালো করে পুঁতে দিয়ে আসুক। অগ্নিক্রিয়া যখন হবেই না, তখন পোঁতা ছাড়া আর উপায় কী! কিন্তু শোনো, ভটচায, যেন শেয়াল-কুকুরে টেনে না বের করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত তাই হল।

মা তার একটি প্রতিবাদও করলে না।

দু-একদিন পরেই দেখা গেল, গ্রামের খেঁকি কুকুরের দলে কীসের যেন একটা মহোৎসব লেগে গেছে। খাওয়া-খাওয়ি মারামারি করে তারা ক্রমাগত গ্রামের চতুর্দিকে ছুটে-ছুটে বেড়াচ্ছে!

নিবারুণ বললে, মেষের পুকুরের পাশে সুবীর আস্ত একখানা হাত নিয়ে কয়েকটা কুকুরকে কামড়াকামড়ি ছেঁড়াছেঁড়ি করতে সে দেখে এল। তোমাদের বিশ্বাস না হয় তো তোমরাও স্বচক্ষে দেখে আসতে পারো।

তারপর শুধু হাত নয়, সেইদিনই গ্রামের ছেলে-ছোকরার দল আবিষ্কার করলে যে, সুবীর মৃতদেহ শেয়ালে গো-বাঘায় মাটি থেকে টেনে তো তুলেইছে এবং হাত-পা আর পাঁজরার হাড়গুলো শ্মশান থেকে মুখে করে এনে সমস্ত গ্রামময় ছড়িয়ে চলেছে।

কুকুর দেখলেই ছোট-ছোট ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় সুবীর হাড় দেখবার জন্যে। কিন্তু ফিরে তারা আর বাড়ি ঢুকতে পায় না।

মায়েরা সব হাঁ-হাঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে, খবরদার বলছি ঘরে ঢুকিসনে। মরা মানুষের হাড় ছুঁয়ে এলি নাকি—যা, পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আয়গে।

কাউকে বা ডুব দিতে হয়, কেউ বা মাথায় জল ঢালে, আবার কাউকে বা মাথায় একটুখানি গঙ্গাজল ছিটিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হয় যে, আর কখনও সে সুবীর হাড় দেখতে যাবে না।

গ্রামের মধ্যে বয়স্ক যারা তাদের মজলিশে এই নিয়ে কথা ওঠে। বলে, সর্বনাশ হল দেখছি। এইবার ঘরে-ঘরে ভূত নাচবে।

নিবারণ বললে, ওই শালা দুগু ভটচাযকে যে এত করে বলে দেওয়া হল—ভালো করে পুঁতিস, যাতে শেয়াল-কুকুরে না তুলতে পারে, তা শালা দিয়ে এসেছে হয়তো, এমনি নাম-নাম পুঁতে, তা না হলে এমন হয় কখনও?

দুগু ভটচায বললে, মাইরি বলছি, আমি একবুক গর্ত খুঁড়ে তবে পুঁতেছিলাম। বিশ্বাস না হয় তো বলো—আমি ঠাকুরঘরে হাত দিয়ে বলতে পারি।

কিন্তু সে-কথা কেউ বিশ্বাস করে না। বলে, গ্রামের মধ্যে ভূতের ভয় যদি হয় তো শালা বুঝতেই পারবি, তোকে সুদ্ধ খণ্ড-খণ্ড করে কেটে আমরা সুবীর সঙ্গী করে দেব।

ভটচায কালা মানুষ, শুনতে পায় না তাই রক্ষে, নইলে তৎক্ষণাৎ একটা ফৌজদারি বেধে যেত।

সেদিন থেকে এমন হল যে, সন্ধে হলে আর কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। অপমৃত্যুতে মরা মানুষের হাড়-পাঁজরা যখন গ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তার প্রেতাত্মাই বা গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে না কেন?

নবীন বললে, মাইরি বলছি, আমি কাল স্বচক্ষে দেখেছি, সুবীদের বাড়ির পাশ দিয়ে সন্ধেবেলা বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, আমগাছটা ঝড়ঝড় করে নড়ে উঠল। গা-টা শিউরে উঠতেই ‘রাম-রাম’ বলতে-বলতে এগিয়ে গেলাম। রাম নাম করেছিলাম বলে ছুঁতে আমায় পারলে না, কিন্তু পেছনের পুকুরটার জলে মনে হল যেন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এই না শুনে গ্রামের গিরিশ চৌকিদার তো রাত্রিবেলা এ-পাড়ায় হাঁক দেওয়া একরকম ছেড়েই দিলে। আবালবৃদ্ধবনিতা ভূতের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। অন্ধকারে হঠাৎ কুকুর-বেড়াল দেখলেও লোকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠতে লাগল।

সুবীর মা তো সেইদিন থেকে অন্ধকারে-অন্ধকারে ঘুরে বেড়ায়, যে-আমগাছে দড়ি বেঁধে মেয়ে তার মরেছিল, গভীর রাত্রে সেই আমগাছটির তলায় চুপটি করে বসে থাকে। কেউ কিছু জিগ্যেস করলে বলে, কোথায় মা, তার চিহ্নও কোনওদিন দেখতে পাই না। বলেই সে কাঁদতে থাকে।

লোকে তা বিশ্বাস করে না। ভাবে, বুঝি মাগী মিথ্যা কথা বলছে।

লোকনাথ তাই সেদিন দুপুরে তাকে ডেকে বললে, ওগো, শোনো! তুমি তো দিব্যি আরামে দিন কাটাচ্ছ, এদিকে তোমার মেয়ের দায়ে আমাদের গ্রামে টেঁকা ভার হয়ে উঠল দেখছি। তার চেয়ে শোনো বাপু, ভালো চাও তো গয়ায় গিয়ে মেয়ের নামে একটা পিণ্ডি দিয়ে এসো।

গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে সুবীর মায়ের ছিল না, তবু তাকে জোর করে সবাই মিলে বলে-কয়ে গয়ায় পাঠিয়ে দিল। বেচারা একাকিনী কাঁদতে-কাঁদতে চলে গেল গয়ায়। মেয়ের নামে দুর্নাম রটবে তাই-বা সে সহ্য করে কেমন করে? অথচ সে নিজে যদি তাকে একটিবার দেখতে পেত! মায়ের মন—যে-মেয়ে তার রাগ করে চলে গেছে, তাকেই সে একটিবার শুধু চোখে দেখতে চায়। শ্মশানের যে-জায়গাটায় সুবীকে পোঁতা হয়েছিল, সুবীর মা সেইখানে বসে কাঁদতে লাগল। ভাবলে, না, সে গয়ায় যাবে না। ভূত হয়েও মেয়েটা যদি একবার দেখা দেয়! গয়ায় পিণ্ডি দিলে সে-আশাও হয়তো আর থাকবে না! সুবীর মা ভাবলে রাত্রিটা সে আজ এই শ্মশানেই কাটিয়ে দেবে। ভূত হয়েও যদি সে আসে তো একবার জিগ্যেস করবে, হতভাগী, রাগ করে তুই কেন গেলি!

সারারাত সুবীর মা সেই অন্ধকারে শ্মশানের মাঝে বসে রইল।

এদিকে গ্রামের লোক জানে যে, সে গয়ায় গেছে।

দিন দুই পরেই গ্রামের মধ্যে আবার এক হুলস্থুল ব্যাপার।

থানা থেকে পুলিশ এসেছে। গ্রামের জনকতক ভারিক্কি মাতব্বর লোককে তারা থানায় নিয়ে যাবে। কী জন্যে নিয়ে যাবে জিগ্যেস করলে বলে না। বলে শুধু, সেখানে গিয়ে কী একটা বস্তু শনাক্ত করতে হবে!

জ্বালাতন!

এই গ্রামের ওপরেই যত অত্যাচার রে বাবা!

লোকনাথ বললে, দাঁড়া, তবে আর ভূতের উপদ্রব বলেছে কাকে? বললে, গয়া থেকে সুবীর মা ফিরে আসুক, এলেই দেখবি সব হাঙ্গামা চুকে যাবে।

কিন্তু গ্রামের লোক থানায় গিয়ে দ্যাখে, কাঠের একটা বাক্সের মধ্যে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা কী একটা জিনিস।

ইন্সপেক্টরবাবু বললেন, দেখুন দেখি চিনতে পারেন কি না?—বলে যেই ঢাকা খুলেছে আর চক্ষুস্থির!

সবাই দেখলে, রেলের লাইনে কাটা তালগোল পাকানো একটা মৃতদেহ, মুখখানা কিন্তু তখনও পর্যন্ত দেখলে চেনা যায়—সুবীর মা ছাড়া আর কেউ নয়।

ব্যস, সেই অবধি সুবীদের বাড়িখানা রইল অমনি পড়ে। মানুষ বাস করা দূরে থাক, সন্ধের অন্ধকারে ও-পথ দিয়ে কেউ আর সহজ যেতে চায় না। যেতে হলে এখনও গা ছমছম করে। প্রথম বছর ঘরের খড়ো চাল গেল উড়ে, দ্বিতীয় বছর কাঠামোটাও গেল ভেঙে—আজকাল খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু ওই চারপাট মাটির দেওয়াল। যে-আমগাছে সুবী মরেছিল, গাছটা এখনও ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। বছরের পর বছর ঠিক সময়ে তার শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, কচি-কচি পাতা গজায়, মুকুলের গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে ওঠে, শেষে থলো-থলো আম ধরে। কিন্তু গ্রামের মধ্যে এত যে ডানপিটে ছেলে তারা কেউ আর সাহস করে ও-আমগাছটার তলা দিয়ে পেরোয় না—ও-আমও কেউ খায় না—গাছের আম গাছেই পাকে। আবার সময় হলে ঠিক মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি যায়।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৫৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *