কৃষ্ণকান্ত এবং…
আমাদের বেড়াল কৃষ্ণকান্তের বয়েস তখন বোধহয় দেড় মাসের বেশি হবে না। একদিন বাসায় এক কেজি মাংসের কিমা আনা হয়েছে, রান্নার টেবিলের নীচে শালপাতার ঠোঙাটা, যাতে কিমা ভরা ছিল, সেটা রাখা হয়েছিল। হঠাৎ একসময় দেখা গেল কিমার ঠোঙাটা উধাও। নেই, কোথাও নেই।
একটু পরে খুঁজে পাওয়া গেল বারান্দায়, শূন্য ঠোঙার শুকনো শালপাতাগুলি হাওয়ায় গড়াগড়ি যাচ্ছে,কিমার কোনও চিহ্ন নেই। এমনকী কোনও শালপাতার গায়ে এক ফোঁটা কিমার টুকরোও লেগে নেই। একেবারে ধোয়ামোছা, পরিষ্কার।
কিছু পরে কৃষ্ণকান্তকে খুঁজে পাওয়া গেল। তার মুখে কেমন একটা চোর চোর ভাব, সিঁড়ির নীচে লুকিয়ে রয়েছে। ধরে আনতে দেখা গেল, পেটটা অসম্ভব মোটা আর ভারী রীতিমতো পাঁচ নম্বর ফুটবলের মতো গোল, টনটনে।
কিন্তু সব সত্ত্বেও কেমন খটকা লাগল, ওইটুকু দেড়মাসি, আধফুটি বেড়াল সে পুরো এক কিলো কিমা চেটেপুটে সাফ করে খেয়েছে, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।
আমরা সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধান করে ফেললাম। (আমাদের পরিবারের একটা বড় গুণ, পারিবারিক ঐতিহ্য হল, ভালভাবে হোক, খারাপভাবে হোক যে কোনও সমস্যা দ্রুত সমাধান করা।) রাস্তা দিয়ে একটা পুরনো খবরের কাগজওয়ালা যাচ্ছিল। তাকে ডেকে আনা হল। তারপর তাকে এক টাকা বকশিস দেওয়া হবে কথা দিয়ে তার দাঁড়িপাল্লা এবং ওজনের পাথর পাঁচ মিনিটের জন্য ধার নেওয়া হল। অবশ্য তাকে কারণটা বলা হল না। যদি সে জানতে পারত যে তার তুলাদণ্ডে একটি মার্জার শিশুকে ওজন করা হবে সে হয়তো এক টাকার লোভেও দাঁড়িপাল্লা দিতে রাজি না হতে পারত।
এর পরের অধ্যায় আরও কঠিন। বুদ্ধিমতী প্রাণাধিকা পাঠিকা কখনও বেড়াল ওজন করার চেষ্টা করে দেখেছ ? সে এক অসাধ্য ব্যাপার। অনেক আঁচড় কামড়, কলাকৌশল ইত্যাদির পরে কৃষ্ণকান্তকে দাঁড়ির এক পাল্লায় তুলে অন্য পাল্লায় পাথর দিয়ে বহু কষ্টে ওজন করা সম্ভব হয়েছিল। সেই পাঁচ মিনিটের নির্দিষ্ট সীমা ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, ফলে পুরনো কাগজওয়ালা পয়সার ক্ষতি হচ্ছে বলে রাস্তায় ইতিমধ্যে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।
সে অন্য গল্প। আসল ঘটনা আরও মারাত্মক। কৃষ্ণকান্তকে ওজন করে দেখা গেল, তার ওজন হয়েছে ঠিক এক কিলোগ্রাম।
এক কিলোগ্রাম মাংস খাওয়ার পরে যদি বেড়ালের ওজন ঠিক এক কিলোগ্রামই হয় তা হলে মাংস খাওয়ার আগে ওই বেড়ালের ওজন কত ছিল ? স্বর্গীয় যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী মহোদয়ও কস্মিনকালে তাঁর বিখ্যাত পাটিগণিত গ্রন্থে এমন কোনও জটিল প্রশ্নের সন্ধান দেননি। সেখানে বাঁদরের বাঁশ বেয়ে ওঠা থেকে দুধে জল মেশানো পর্যন্ত হাজার রকম পাটিগাণিতীয় (নাকি পাটিগাণিতিক) উদাহরণ ছিল, কিন্তু তার কোনওটাই এতটা রহস্যময় নয়।
শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের কৃষ্ণকান্ত নামক মার্জার শিশুটির ওজন শূন্য, অর্থাৎ সে অশরীরী, অর্থাৎ, সে একটি ভূত। কিন্তু ঘটনা হয়তো তা নয়, তার সম্ভবত তখন ওজন ছিল পাঁচশো গ্রাম, আড়াইশো গ্রাম ওজনে মাংসওয়ালা কম দিয়েছিল আর আড়াইশো গ্রাম ওজন কমে গিয়েছিল পুরনো কাগজওয়ালার চোরাই দাঁড়িপাল্লার ভুলপ্রান্তে উপস্থাপনের জন্য।
কৃষ্ণকান্ত কিন্তু ভবিষ্যতে আর কখনও এমন করেনি। শুধু কৃষ্ণকান্ত কেন, আজকাল আমাদের বাড়ির সব কুকুর-বেড়ালই সব সময়ে রীতিমতো আইনশৃঙ্খলা মেনে চলে। তাদের আচার-সহবৎ সকলের প্রশংসা পায়।
মনীষী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যিনি কখনও কখনও চমকপ্রদ গল্প-উপন্যাস লেখেন, কখনও কখনও আমাদের বাড়িতেও আসেন। তিনি একদিন আমাদের বাড়িতে বিস্ময় প্রকাশ করেন আশ্চর্য সব কাণ্ড দেখে যে টেবিলের উপর খোলা বাটিতে দুধ রয়েছে বেড়াল খেয়ে নিচ্ছে না, কুকুর বিছানা বা সোফায় উঠে শুচ্ছে না ইত্যাদি ইত্যাদি—তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন এ ধরনের অরাজকতা দেখে।
সন্দীপনবাবু হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁকে যদি কখনও কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘ভাল আছেন ?’ তিনি কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে ঘাড় চুলকিয়ে বলেন, ‘দাঁড়ান, ভেবে বলতে হবে।’ সেই সন্দীপনবাবু পর্যন্ত কুকুর-বিড়ালের এতাদৃশ বাধ্যবাধকতা দেখে তাঁর স্বভাব-সুলভ বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, তখন তাঁকে আমরা সমস্ত ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বোঝাই।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, ‘দ্যাখ-মার সিসটেম।’ কৃষ্ণকান্তের ওই ঘটনার পরে আমার বিনম্রা স্ত্রী মিনতি দেবী এই পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। সম্প্রতি ওই পদ্ধতিটিকে ‘দ্যাখ-মার সিসটেম’ (Dhakh-Maar System) এই ট্রেড নামে আমরা পেটেন্ট নেওয়ার কথা চিন্তা করছি।
এই সিসটেম বা পদ্ধতিটি আর কিছুই নয়, কোনওরকম বেয়াদপি বা বেচাল দেখলে, দ্যাখা মাত্র মার। কুকুর, বিড়াল এবং সেই সঙ্গে আমরা সকলে ব্যাপারটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। মিনতি দেবীকে এই স্বপরিকল্পিত পদ্ধতিতে সিদ্ধহস্তা বলা উচিত। তিনি প্রতিবার রথের মেলায় একাধিক রুটি বেলবার এক্সট্রা বেলুন খরিদ করেন। আজকাল বেশি ব্যবহার করতে হয় না, একবার বেলুন তুলে দেখালেই অবলা জীবেরা সন্ত্রস্ত হয়ে যায়।
অনাবশ্যক এবং বিপজ্জনক বিষয়ে কথাচ্ছলে চলে গেছি, দ্রুত বিড়ালে প্রত্যাবর্তন করছি।
কুকুরের কথা বলার বিষয়ে একবার লিখেছিলাম। এবার বেড়ালের কথা বলার বিষয়ে কিছু লেখা যায়। একবার একটি চপলা তরুণী আমাকে জব্দ করেছিল, সে বলেছিল, তাদের বেড়াল নাকি নিজের নাম বলতে পারে। তাদের বাড়িতে আমি নিজের কানে বেড়ালের নাম বলা শুনতে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনি বেড়াল নাম বলতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার নাম হল ‘মিঁয়াও’। নাম জিজ্ঞাসা করলেই সে ‘মিঁয়াও’ ‘মিঁয়াও’ বলে।
বেড়াল যে সব সময় ‘মিঁয়াও’ ‘মিঁয়াও’ বলে ঠিক তা নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে একটি বেড়াল পড়ন্ত দুপুরে এসে এক হতভাগিনী রাঁধুনী মহিলার কাছে স্পষ্ট ‘মা’ ‘মা’ করে ডেকে খাবার চাইত। শীর্ষেন্দুর অমল বর্ণনায় বেড়ালের ‘মা’-‘মা’ ডাকে ভরা সেই মধ্য দুপুর বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে গেছে।
এক মার্জার-অনুরক্ত বিদেশি লেখক কিন্তু বেড়ালের কথা বলার ক্ষমতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দিহান। তিনি এ বিষয়ে যা বলেছেন তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর বক্তব্য, ‘বেড়ালদের আমি খুব ভালভাবে জানি। তারা খুব চতুর এবং মিথ্যাবাদী। যদি কোনওদিন কোনও বেড়াল আপনাকে বলে এবং দাবি করে যে সে কথা বলতে পারে, তার কথা মোটেই বিশ্বাস করবেন না।’
আরেকটা গল্প জানি, একটা বুড়ো হুলো বেড়াল কালীঘাটে নিত্যানন্দ ভোজনালয়ে গিয়ে একদিন মাছ ভাতের অর্ডার দিয়েছিল। যে রাঁধুনিবামুন পরিবেশন করছিল তাকে সে বলে, ‘আমার মাছের টুকরোটা যেন একটু কাঁচা থাকে, খুব বেশি সেদ্ধ বা ভাজা না হয়।’ ভাত-মাছ খেয়ে দাম দিতে দিতে কৌতূহলী বেড়ালটি পরিবেশনকারীকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এই যে আমি এ রকম খেলাম, আপনার খুব অবাক লাগছে না !’ বামুনঠাকুর বললেন, ‘না, না তাতে কী ? কত রকম খদ্দের আসে। অনেকেই বেশি ভাজা মাছ খেতে চায় না। আমি নিজেও খুব পছন্দ করি না।’
কথা বলতে পারুক আর না পারুক, বেড়ালের বুদ্ধি সম্পর্কে কিন্তু আমাদের মনে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। নিঃশব্দে রান্নাঘরে প্রবেশ করা, জালের আলমারির ছিটকিনি পা দিয়ে খুলে ফেলা, বিপদে দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যাওয়া পরে ফিরে এসে পায়ে মাথা ঘষে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, এগুলো বেড়ালের চরিত্রের অঙ্গ। আমি এমন একজনকে জানি, যিনি বেড়াল খুব পছন্দ করেন না, তিনি প্রতিদিন রাতে ঘুমোনার পরে তাঁর বিছানায় বালিশের পাশে একটি বেড়াল নিঃশব্দে এসে শয্যাগ্রহণ করত এবং ব্রাহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে ওঠার আগে উঠে চলে যেত। ভদ্রলোক টের পাননি, কোনওদিন জানতে পারেননি একটি রূপসী পূর্ণ যৌবনা মেনি বেড়াল রাত্রে তাঁর শয্যাসঙ্গিনী।
বেড়ালের অভিজ্ঞতা বোধও যথেষ্ট বেশি। সে অনেক ব্যাপারেই নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়। কথায় আছে, যদি কোনও বেড়ালের গরম দুধ খেয়ে কখনও জিব পুড়ে যায় তা হলে পরে সে ঠান্ডা দই খাওয়ার সময়েও ফুঁ দিয়ে খাবে। মার্ক টোয়েন সাহেবও অনুরূপ কথা লিখেছেন, ‘একটি বেড়াল যে গরম স্টোভের ঢাকনায় একবার বসেছে, সে আর জন্মে কোনওদিন ওই উত্তপ্ত স্থানে বসতে যাবে না। সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার এই যে, সে কোনওদিন ঠান্ডা হয়ে যাওয়া স্টোভের ঢাকনার উপরেও বসতে যাবে না।’