1 of 2

কুকুর-বাংলো – অজেয় রায়

কুকুর-বাংলো – অজেয় রায়

এত সহজে এবং বিনা ভাড়ায় এমন চমৎকার বাড়িটা পাওয়া যাবে, কানাইবাবু তা ভাবতে পারেননি।

কানাইবাবুর স্ত্রী অনেক দিন টাইফয়েডে ভুগলেন। সেরে ওঠার পর ডাক্তার বললেন, ‘একটু চেঞ্জ দরকার।’ কানাইবাবুর এক উকিল বন্ধু জানালেন, ‘আমার এক মক্কেলের একটা বাড়ি আছে ঘাটশিলায়। খালি পড়ে থাকে। ঠিকানা দিচ্ছি, দেখা করো। আমিও ফোনে বলে দেব। বোধহয় পেয়ে যাবে। ঘাটশিলা জায়গাটা বিউটিফুল। আমি গেছি একবার। ফাল্গুন মাস। এখনও গরম পড়েনি। ভালো চেঞ্জ হবে।’

বন্ধুর মক্কেল গোবিন্দগোপাল ঘোষ তাঁর ঘাটশিলার বাড়িটা এককথায় দিতে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওটা তো খালিই পড়ে আছে। আমরা কেবল বছরে একবার যাই পুজোর সময়। গিয়ে যদ্দিন ইচ্ছে থাকুন। ভাড়া? ও কথা থাক। আপনি মিস্টার রায়ের বন্ধু। আপনারা গেলে উপকারই হবে। একটু সাফসুফ হয়ে যাবে বাড়িটা। ও বাড়ির কেয়ারটেকার মালিটা অবশ্য এখন দেশে গেছে। ও না থাকলেও ক্ষতি নেই। ভরত আছে। সব ব্যবস্থা করে দেবে।’

কানাইবাবু দু—দিনের ছুটি নিয়ে একা চলে গেলেন ঘাটশিলায়। প্রথমে ভরতকে খুঁজে বের করলেন। ভরত সাইকেল—রিকশা চালায়। ওর রিকশায় চেপে চললেন বাড়ি দেখতে।

বাড়িটা খাসা। শহরের একদম সীমানায়। পাহাড়ি নদী সুবর্ণরেখা হাঁটা পথে আধ মাইলও হবে না। সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। নীচে ও ওপরে অনেকগুলো শোবার ঘর। বুক—সমান উঁচু পাঁচিল ঘেরা বিঘাখানেক কমপাউন্ড। ভিতরে আম, লিচু ইত্যাদির বড়ো বড়ো গাছ। কিছু ফুল ও বাহারি পাতার গাছও রয়েছে। কমপাউন্ডের একধারে ছোটো আউট—হাউস। এখন তালা—বন্ধ। ওখানে সিধু মালি থাকে।

কানাইবাবু চাবি নিয়ে গিয়েছিলেন। তালা খুলে দোতলার ঘরগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। খাট আছে। খাতে গদি পাতা। সুইচ টিপে দেখলেন আলো জ্বলছে। রান্নাঘর, বাথরুম ফার্স্ট ক্লাস। দক্ষিণ—পুব খোলা বারান্দা। আর কী চাই? হাতে সময় কম। চটপট সব দেখে নিয়ে তিনি স্টেশনে ফিরলেন।

শুধু মনে একটু খুঁতখুঁতুনি। বাড়িটা বড্ড বেশি ফাঁকায়। তা যাকগে। ঘোষবাবু তো ফ্যামিলি নিয়ে এসে কাটিয়ে যান।

ভরত লোকটি বেশ। বছর—পঞ্চাশ বয়স। ওই দেশি লোক। তবে দিব্যি বাংলা বলে। শান্ত প্রকৃতির। এই বাড়ির মালি সিধু সম্পর্কে তার ভাই হয়।

রাতের ট্রেনে কলকাতায় ফিরলেন কানাইবাবু।

এক সপ্তাহ বাদে অফিসে দশ দিন ছুটি নিয়ে স্ত্রী, দশ বছরের ছেলে বাবলু এবং ছোকরা কাজের লোক ঘেঁটুকে নিয়ে কানাইবাবু কলকাতা ছেড়ে রওনা দিলেন।

ঘাটশিলায় পৌঁছলেন দুপুরে। সিধু তখনও ফেরেনি। তবে ভরত হাজির ছিল। কানাইবাবুরা দোতলায় থাকবেন। ভরত ওপরতলার ঘর—বারান্দা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলল। জল তুলে দিল কুয়ো থেকে। লোকটি সত্যি কাজের। মুখে সর্বদা একটু হাসি লেগে আছে।

বিকেলে ভরতের রিকশা চেপে কানাইবাবু বাজারে গেলেন। এক স্টেশনারি দোকানে ঢুকলেন কেনাকাটা করতে। দোকানের মালিক বাঙালি। কানাইবাবুকে দেখে বুঝলেন চেঞ্জার। জিনিস দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উঠেছেন কোথায়?’

‘হ্যাপি লজ। এক্কেবারে শেষে। সাদা দোতলা বাড়ি।’

‘ও, কুকুর—বাংলো। কদ্দিন থাকবেন?’

‘অ্যাঁ, কুকুর—বাংলা!’ কানাইবাবু দোকানির মুখের পানে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। হ্যাপি লজ—এমন সুন্দর নাম থাকতে এই বিশ্রী নামটা কেন?

দোকানদার কানাইবাবুর মনে ভাব বুঝলেন। বললেন, ‘ওই হল। আমরা কুকুর—বাংলোই বলি।’

‘কেন?’

‘ওটা ছিল হ্যারিস সাহেবের বাড়ি। সাহেবের একগাদা কুকুর ছিল। তাই বাড়িটার ওই নাম চালু হয়ে গেছে।’

‘হ্যারিস সাহেব এখন কোথায়?’ কানাইবাবুর কৌতূহল হয়।

‘সাহেব মারা গেছে। মাথা খারাপ হয়ে গিছল। তারপরই মেমসাহেব বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গেল। ঘোষবাবু কিনলেন। এই তো বছর পাঁচেক হল।’

‘মাথা খারাপ হল কেন?’

‘কে জানে। বয়েসে একটু মাথার গন্ডগোল হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন সকালে খেপে গিয়ে এলোপাতাড়ি বন্দুক ছুঁড়তে শুরু করল। নিজের একটা কুকুরকে গুলি করে মারল। কয়েকটা পাখি মারল। মেমসাহেবকে তাড়া করেছিল। মেম তো ঘরে দোর দিয়ে প্রাণ বাঁচাল। সব্বাই সামনে থেকে পালাল। তারপর গুলি ফুরিয়ে গেলে লোকে গিয়ে সাহেবকে ধরে ফেলল। তখন ঘোর উন্মাদ। রাঁচির পাগলা—গারদে পাঠানো হয়েছিল। ছ—মাসও বাঁচেনি।’

‘সাহেব করতেন কী?’

‘কাঠের ব্যবসা। ওই যে আপনার রিকশাওলা ভরত, ও তো কাজ করত হ্যারিস সাহেবের কাছে। ওখানেই থাকত।’

পথে বেরিয়ে কানাইবাবু ভরতকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি হ্যারিস সাহেবের কাছে ছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ও বাড়ি ছাড়লে কেন? ঘোষবাবু ছাড়িয়ে দিলেন?’

‘না বাবু। উনি রাখতে চেয়েছিলেন। আমিই রইলাম না। ওখানে থাকতে আর মন হল না। দশ বচ্ছর ছিলাম। সিধুকে আমিই এনে দিইচি ওই বাড়িতে।’

কানাইবাবুদের দারুণ লাগছে। এখানে দিগন্ত—ছোঁয়া রুক্ষ মাঠ—প্রান্তরে ছোটো—বড়ো পাথরের চাঁই। তারই মাঝে—মাঝে টুকরো—টুকরো খেত। কাছেই ফুলডুংরি পাহাড় পরিষ্কার দেখা যায়। দূরে আরও পাহাড়ের ঢেউ। বাড়ির সামনের রাস্তাটা ডান ধারে কিছু দূরে শাল—বনের গা ঘেঁষে এগিয়ে গেছে।

ভরত প্রতিদিন এসে খোঁজখবর নিয়ে যায়। বাবলু ছটফটে দুরন্ত ছেলে। কেবল চায় মাঠে—ঘাটে ঘুরি। বাবলুর মা বেশি হাঁটতে পারেন না। কানাইবাবু স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি হাঁটেন। বাবলু ঘেঁটুকে সঙ্গী করে চারপাশে বেড়িয়ে বেড়ায়। এখানে গাড়ি—ঘোড়ার ভয় নেই। তবে বাবলুকে বারণ করা হয়েছে সুবর্ণরেখা নদীতে যেন না নামে বা শালবনে না ঢোকে।

রাতে কিন্তু বেশ গা ছমছম করে। কানাইবাবুরা শহুরে লোক। এখানে সন্ধে হলেই চারধারে নিঝুম হয়ে আসে। এই বাড়ির ডান দিকে , পিছনে ও সামনে রাস্তার ওপারে খোলা মাঠ। বাঁ পাশে খানিক তফাতে—তফাতে পর—পর দুটো বাড়ি। আবার অনেকটা খোলা জমি। পাশের বাড়ি দুটো এখন ফাঁকা। এগুলোয় কালেভদ্রে লোক আসে বেড়াতে। কানাইবাবুর সামনের রাস্তায় আলো নেই। কাছাকাছি বাড়িতে আলোর চিহ্ন দেখা যায় না। আকাশের অজস্র তারা আর একফালি চাঁদ মিলে যা সামান্য আলো দেয়। সূর্য ডুবলেই শীত—শীত করে। সন্ধের পর সামনের রাস্তা দিয়ে দু—চারটি মাত্র লোক চলে। তবে এই নির্জনতা খানিকটা সয়ে এল ক্রমে।

একদিন বাবলু বলল, ‘জানো বাবা, ভরতের একটা কুকুর আছে। এই এত্ত বড়ো। বিরাট। কালো রঙের।’

‘দিশি কুকুর?’

‘না, বিলিতি। আমার সাথে খুব ভাব হয়ে গেছে। ওর নাম কালু।’

ভরতের বাসা মাইলখানেক দূরে। বাবলু গিয়েছিল সেখানে। বাবলু বেজায় কুকুর—ভক্ত। কানাইবাবুও কুকুর ভালোবাসেন। কিন্তু বাবলুর মা কুকুর দেখতে পারেন না। তাই তাদের কুকুর পোষা হয় না। বাবলু অন্য বাড়ির কুকুর আদর করে সাধ মেটায়।

‘বাবা, তোমায় কালুকে দেখাব একদিন। ভরতকে বলব নিয়ে আসতে।’ বাবলু উৎফুল্ল হয়ে জানাল।

সেইদিনই বিকেলে। কানাইবাবু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন বাড়ির সুমুখে। ভরতকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। তার সঙ্গে চেনে বাঁধা এক প্রকাণ্ড কালো কুকুর। পিছনে—পিছনে আসছে বাবলু আর ঘেঁটু। বাবলু চেঁচাল, ‘বাবা, কালুকে এনেছি।’

সত্যি কুকুর বটে। যেন একখানা বাঘ। মাটি শুঁকতে—শুঁকতে এগুচ্ছে। ওর গায়ে কী প্রচণ্ড জোর, বোঝা যায়। কারণ ভরতের মতো জোয়ান লোক দু—হাতে ওর চেন টেনে রাখতে পারছে না। মাঝে—মাঝে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কানাইবাবুর হাত—কুড়ি দূরে এসে থামল ভরত। এক ধমক দিয়ে থামাল কুকুরটাকে। কুকুর জ্বলজ্বলে স্থির চোখে দেখতে লাগল কানাইবাবুদের।

‘কালু’—বলে ডাক দিয়ে, বাবার কাছে বাহাদুরি দেখাতে বাবলু ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা।

বাবলুর মা অমনি আঁতকে উঠে বলতে লাগলেন, ‘ছেড়ে দে বাবলু। কামড়ে দেবে। এই বাবলু, ছেড়ে দে বলছি!’

বাবলু কালুর গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘ধ্যাত!’

কালু চুপ করে দাঁড়িয়ে আধবোজা চোখে বাবলুর কোমল হাতের আদর খেতে লাগল আর আড়—চোখে লক্ষ করতে লাগল তার মাকে।

কালুকে দেখে কানাইবাবু মুগ্ধ। কিন্তু স্ত্রী নার্ভাস হয়ে পড়ছেন দেখে বললেন, ‘থাক বাবলু, কুকুরের গায়ে হাত দিও না। যাও এখন ঘরে যাও। মায়ের সঙ্গে যাও।’

বাবলু ও তার মা বাসায় ফিরে চলল।

কানাইবাবু আর—একটু কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলেন কালুকে। হাউন্ড জাতের কুকুর। কুচকুচে কালো লোম। শুধু চারটে থাবায় সাদা সাদা ছোপ। বাঃ!

‘এ—কুকুর তুমি কোথায় পেলে?’ কানাইবাবু অবাক।

ভরত বলল, ‘সাহেবের ছিল। মেমসাহেব চলে যাবার সময় সব কুকুর দিয়ে দিলেন। বিক্রি করে দিলেন। এটাকে আমি চেয়ে নিইচি। তখন দু—মাসের বাচ্চা।’

কানাইবাবু বারবার কালুর তারিফ জানিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

এরপর বাবলু প্রায়ই মায়ের আড়ালে বাবার কাছে কালুর গল্প করত। ও নাকি মস্ত বীর। একবার হায়নার মুখ থেকে ভরতের ছাগল উদ্ধার করেছে। রবারের বল ছুঁড়ে দিলে ও তীর বেগে ছুটে গিয়ে বলটা ধরে ফেলে। তবে কালুকে এ—বাড়ি আনতে আর সে ভরসা পায়নি। মা যা ভিতু। কালুর খোঁজে সেই যেত ভরতের বাসায়।

আট দিন কেটেছে।

সকালে বেরিয়েছিলেন কানাইবাবু। বেলা দশটা নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখেন একজন লোক নীচের তলায় দাঁড়িয়ে আছে।—’কে?’

অচেনা লোক। ষণ্ডা চেহারা। চোখের চাউনিটা কেমন চোরা—চোরা। লোকটা বলল, ‘বাবু, গামছা নেবেন? ভালো গামছা আছে।’

কানাইবাবু দেখলেন মাটিতে একটা ছোটো পুঁটুলি। ‘নাঃ।’ তিনি জবাব দিলেন।

লোকটা নড়ল না। এদিক—সেদিন তাকাতে—তাকাতে বলল, ‘কাজের লোক রাখবেন বাবু? সব মেহনতি কাজ করে দেব। মাহিনা যা খুশি দেবেন।’

‘না। আমার লোক আছে।’

‘ওই ছোকরা কুয়াসে জল তুলতে পারে?’ ঘেঁটুকে দেখিয়ে বলল লোকটা।

‘জল একজন তুলে দিয়ে যায়।’

‘ও’—লোকটা এবার মোট তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

দুপুরে একবার দোতলার বারান্দায় এসে কানাইবাবু দেখেন সকালের সেই গামছাওলা কিছু দূরে একটা বটগাছের নীতে বসে। তার সঙ্গে আর—একটা লোক। এই দিকেই চেয়ে রয়েছে।

এই খাঁ—খাঁ রোদে ওরা করছে কী? কানাইবাবু তাকানো মাত্র লোক দুটো মুখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর উঠে ধীরেসুস্থে চলে গেল। কানাইবাবুর মনটা খচখচ করে। হাবভাব ভালো নয় লোকগুলোর।

সেই রাতে ঘুম আসছিল না কানাইবাবুর। পাশে বাবলু ও বাবলুর মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কানাইবাবুর মনে জমছে নানান চিন্তা। রাত বারোটা বাজল। কানাইবাবু বিছানা ছেড়ে উঠে ডান দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালেন। পর্দাটা একটু সরিয়ে তাকালেন বাইরে।

বাইরে ফিকে চাঁদের আলোয় গাছপালা, প্রান্তরের উঁচু—নীচু অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খানিক দূরে মাঠের মধ্যে একটা বড়ো পাথরের ঢিবি। তার পাশে কী জানি নড়ল? সন্দিগ্ধ মনটা ধক করে ওঠে। কানাইবাবু পর্দাটা টেনে দিয়ে অল্প ফাঁক রেখে তাই দিয়ে খর চোখে চেয়ে রইলেন পাথরটার দিকে।

হুঁ, কেউ বসে আছে পাথরের আড়ালে—আঁধারে। একটা। দুটো। তিনটে মাথা। দুটো লাল আলোর বিন্দু। ও বিড়ির আগুন। কানাইবাবুর হৃৎপিণ্ডের গতি ভীষণ বেড়ে যায়। নিরীহ ভালো লোক কেউ এই রাত—দুপুরে ওখানে বসে থাকবে কেন লুকিয়ে? কী মতলব ওদের?

তিনটে ছায়া—মূর্তি খাড়া হল। কানাইবাবুর বাড়ির পাঁচিলের কাছে এগিয়ে এল।

কানাইবাবুর মনে ঝড় বইছে। এই বাড়ির অনেক দরজা জানলা পুরোনো। মোটেই পোক্ত নয়। অনায়াসে খোলা যায় বা ভেঙে ফেলা যায়। যদি ওরা চোর—ডাকাত হয়? ঢোকে বাড়িতে। ওরা তিনজন, কানাইবাবু একা। এখান থেকে চেঁচালে কারও সাহায্য পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। এর পরের বাড়িটায় একজন মালি থাকে। কিন্তু সে লোকটা সন্ধে থেকে অঘোরে ঘুমোয়। তার কানে ডাক পৌঁছবে কি?

হেঁকে বলব নাকি—কে? হয়তো ভয় পেয়ে পালাবে লোকগুলো। কিন্তু একটা মুশকিল আছে। বাবলুর মা চমকে জেগে উঠবে। তার হার্ট খারাপ। ভয় পেলে চমকালে বিপদ হতে পারে।

ওদের জাগিয়ে তুলে ব্যাপারটা বলি। কিন্তু তাতেও যে ভয় পাবে ভীষণ।

লোকগুলো পাঁচিলের ধারে আরও ঘেঁষে এল। একজন চড়ে বসল পাঁচিলের ওপর।

কানাইবাবু আর থাকতে পারলেন না। ঘরের আলোটা জ্বেলে দিই। বাবলুরা জেগে উঠবে। অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করে ভয় পাবে। উপায় নেই। বাড়ির লোক জেগে গেছে দেখলে যদি ওরা পালায়, এই ভরসা।

দেয়ালের গায়ে সুইচের দিকে এক পা বাড়িয়েই থমকে গেলেন কানাইবাবু। কানে এল কোনো কুকুরের গভীর চাপা গর্জন। সঙ্গে সঙ্গে—’বাপরে’ বলে ভীত চিৎকার।

কানাইবাবু চট করে ফের জানলায় দাঁড়ালেন। আবছা জ্যোৎস্নায় দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য। মাঠ দিয়ে তিনটে লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে আর তাদের পিছনে লাফাতে—লাফাতে ছুটে চলেছে এক প্রকাণ্ড মিশকালো জীব। কী ওটা? নিশ্চয়ই কুকুর। ও ডাক কুকুরের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তারা বাড়ির পেছন দিকে মিলিয়ে গেল। কানাইবাবু থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

বোধহয় আরও মিনিট দু—তিন বাদে দূরে শোনা গেল আবার সেইরকম কুকুরের ডাক। মানুষের গলার একবার আর্তনাদ। তারপরই তীক্ষ্ন শিসের মতো একটা আওয়াজ। এরপর সব চুপ। শুধু একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক।

প্রায় ঘণ্টাখানেক জানলার কাছে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন কানাইবাবু। কিন্তু আর অস্বাভাবিক কিছু কানে এল না, দেখতেও পেলেন না।

তিনি বিছানায় গিয়ে শুলেন। ঘুম আসে না। দপদপ করছে মাথা। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ব্যাপারটা। অতিরিক্ত উত্তেজনার ক্লান্তিতেই শেষে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

‘বাবা ওঠো, মাছ আনতে যাবে না?’

বাবলুর ডাকে কানাইবাবুর ঘুম ভাঙে।

প্রায়ই ভোরে কানাইবাবু সুবর্ণরেখার তীরে যান টাটকা মাছ কিনতে। জেলেরা তখন নদীতে মাছ ধরে। আজ মাছ আনার কথা। চটপট তৈরি হয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। পথে যেতে যেতে হঠাৎ মনে পড়ল গত রাতের ঘটনা। এমন সুন্দর সকালে ঘটনাটা যেন মনে হল দুঃস্বপ্ন। অবাস্তব।

নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। চওড়া নদী, এখন অবশ্য জল কম। কানাইবাবুর পায়ের কাছ থেকে খাড়া পাড় নেমেছে। তলায় ধারের দিকে জল নেই। ছোটো—বড়ো পাথর ছড়ানো। সেখানে কয়েকজন ছেলে জটলা করছে। তাদের সামনে মাটিতে পড়ে আছে একটি মানুষের দেহ। এমন ভেঙে—চুরে দ হয়ে আছে শরীরটা, মনে হয় যেন প্রাণ নেই। ঘাড়টা ওপাশে ঘোরানো। তাই কানাইবাবু তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না। পাথরের গায়ে শুকনো রক্তের দাগ। জেলেরা নিজেদের ভিতর উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে।

কানাইবাবুর বুকে ধুকপুকুনি। তিনি না পারলেন নীচে নেমে গিয়ে ভালো করে দেখতে, না পারলেন চলে যেতে। ওইখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন ঠায়। মিনিটপাঁচেক বাদে সেখানে সাইকেল চড়ে হাজির হল একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর এবং দু—জন কনস্টেবল। পুলিশের লোকেরা নেমে গেল নীচে। একজন সেপাই দেহটাকে উলটে দিলেন। কানাইবাবু চমকে উঠলেন। এ যে সেই গামছাওলা। লোকটা মরে গেছে নির্ঘাত। কপাল ও মুখের খানিকটা একেবারে থেঁতলে গেছে। চোখ—দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।

ইনস্পেক্টর জেলেদের প্রশ্ন করতে লাগলেন। ওপর থেকে বিশেষ কিছু বুঝতে পারলেন না কানাইবাবু। আরও লোক আসছে চারদিক থেকে। মৃতদেহ ঘিরে ভিড় বাড়ছে। ভরতকে আসতে দেখা গেল। তার হাতে দড়ির আংটায় ঝোলানো একটি পিতলের ঘটি। ভরত রোজ ভোরে কানাইবাবুকে তার গোরুর দুধ দিয়ে যায়। ভরতও নদীর ধার বেয়ে নেমে ভিড়ে ঢুকল।

একটু পরে কানাইবাবু সাহস করে নীচে নামলেন। ভরতের কনুইয়ে টোকা দিলেন। ভরত ফিরে বলল, ‘ও বাবু, আপনি? চলুন। দুধ দিতে দেরি হয়ে গেল। ভরতের পিছনে পিছনে কানাইবাবু ফের উঠে এলেন ওপরে।

‘কী হয়েছে? লোকটা কে? কানাইবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

‘দাগি ডাকাত। এখানকার লোক নয়। বাইরের। টাটানগরে একটা ডাকাতির কেসে পুলিশ খুঁজছিল ওকে। দারোগাবাবু বলছিলেন।’

‘ও মরল কী ভাবে?’

‘ওপর থেকে পড়ে। মাথায় চোট লেগেছে।’

‘জানো ভরত, ওই লোকটা কাল আমার বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়েছিল। আরও দুটো লোক ছিল সঙ্গে।’

‘সে কী!’

‘হ্যাঁ। তোমার কালু আমাদের বাঁচিয়েছে।’

‘কালু!’

‘হুঁ। সকালে ওই লোকটাই একবার আমার বাড়িতে ঢুকেছিল। তারপর—’ কানাইবাবু সকাল থেকে রাত অবধি সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে বলে গেলেন। শেষে বললেন, ‘নিশ্চয়ই কালুর তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে লোকটা গড়িয়ে নদীর ভেতর পড়ে গেছে।’

ভরত একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘না বাবু, ও কালু নয়।’

‘আলবত কালু। আমি নিজের চোখে দেখেছি। এমন কুকুর আর কার আছে এখানে?’

আবার মাথা নাড়ে ভরত। বলে, ‘বাবু কাল রাতে কালু আমার ঘরে আটক ছিল। একবারও বেরয়নি। আমি বুঝেছি বাবু, ও কালু নয়, টাইগার।’

‘টাইগার। টাইগার কে?’

‘কালুর বাপ। সাহেবের সব চেয়ে পেয়ারের কুকুর ছিল। সাহেব পাগল হয়ে গুলি করে মেরে দিলেন টাইগারকে। আর ওই যে বলছেন শিস। অমনি সিটি দিয়ে সাহেব টাইগারকে ডাক দিতেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *