1 of 2

কুকুরদল – ৮

অধ্যায় ৮

একজন হাতকাটা মানুষ।

ক্লাসরুমে পরিপাটি পোশাকে ঢুকে পড়েছে একজন হাতকাটা মানুষ। মোবাইলে “ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ টু” খেলা থামিয়ে মুহিবকে সেদিকে তাকাতেই হলো।

গোল ফ্রেমের চশমা। কপালে কুঞ্চিত ভাঁজ, বাঙালির কপালে এমন ভাঁজ দেখা যায় না সচরাচর। চুলগুলো খুব বড় নয়, স্পাইক করে ওপরের দিকে তোলা। ডান গালে একটা ক্ষতচিহ্ন। অক্ষত ডানহাতে ধরা পরিচিত এক ফাইল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এমন ফাইল বহন করেন। ভেতরে অ্যাটেন্ডেন্স শিট থেকে দেখে দেখে বোর্ডে তোলার জন্য ‘চোথা’ (যা শিক্ষকদের একাংশকে হাসির পাত্র করে তুলেছে ইতোমধ্যেই, যারা স্রেফ ওই চোখা দেখে দেখেই বোর্ড ভর্তি করেন আর মোছেন এবং চোথা তোলা শেষ হলে লম্বা পায়ে ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যান) থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রই রাখা হয়। এই এক ফাইল দেখেই বিষয়টা স্পষ্ট হলো ওদের কাছে।

একজন স্পাইক করা চুলের একহাতী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

আগ্রহোদ্দীপক তো বটেই।

পাশ থেকে শামীম পর্যন্ত বলে উঠলো, “দিস উইল বি ইন্টারেস্টিং, মাইট!”

ইদানিং অস্ট্রেলিয় অ্যাকসেন্টের প্রতি বাড়তি দরদ শামীমের। মেট-কে বলছে ‘মাইট’। শিট-কে বলছে ‘শাইট’। শামীমের মন্তব্যটা চুপচাপ হজম করলো মুহিব।

সশব্দে ডান হাতে ধরে থাকা ফাইলটা ডায়াসের ওপর আছড়ে ফেললেন অদ্ভুত শিক্ষকটি। তারপর তাকালেন ক্লাসের দিকে। দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টি। যেন ওদের চিড়ে ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন।

“হ্যালো, এভরিওয়ান।” ভরাট কণ্ঠে বললেন, “মাই নেইম ইজ জামান খান। দ্য ডেজিগনেশন ইজ প্রফেসর। বাট ইউ মে কল মি রবিন।”

“এভরিওয়ান’ যথারীতি চুপ করে বসে থাকলো। শুধুমাত্র তিন নম্বর সারি থেকে ইলোরা বলল, “হ্যালো, মি. রবিন। ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্লাস।”

অনেকেই সভয়ে ইলোরার দিকে তাকালো এবার। একজন শিক্ষককে নাম ধরে ডাকার সাহস এই মেয়ে দেখালো কি করে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার নিয়ম হলো, বাক্যের শুরু, মাঝ এবং শেষে তিন তিরিক্কে নয়বার ‘স্যার’ উচ্চারণ করা। তবে ইলোরা নির্বিকার। কাঁধও একবার ঝাঁকালো বাকিদের উৎসুক দৃষ্টির উদ্দেশ্যে। ভাবনাখানা, “যস্মিন দেশে যদাচার।”

মি. রবিনের চেহারায় বিরক্তির কোনো লক্ষণ নেই। বরং ইলোরার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন, “হোয়াই, থ্যাংক ইউ, মিস-।”

“ইলোরা।”

হাল্কা করে তার উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ালেন প্রফেসর।

বোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে মার্কার দিয়ে লিখলেন “প্রোডাকশন প্রসেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট”।

“আপনাদের আমি এই কোর্সটা পড়াবো। যদি মনে করেন বাংলায় পড়ালে আপনাদের সুবিধে হবে, আমি বাংলায় পড়াবো। নয়তো ইংরেজিতে।”

একে অন্যের দিকে আরেকবার বিস্ময়ের সাথে তাকালো ওরা। একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাসে তাদের ‘আপনি’ করে বলছেন! এ তো স্রেফ অবিশ্বাস্য। অসম্ভব!

“স্বপ্ন দেখছি। আমি স্বপ্ন দেখছি।” বলতে বলতে শামীম নিজের হাতেই নিজে চিমটি বসালো, “ব্যথাও তো লাগে।”

“স্বপ্ন দেখছিস না।” ঠোঁট কামড়ে ব্যথা পরীক্ষা করতে ব্যস্ত মুহিব বলল, “শিট জাস্ট গট রিয়েল।”

“এখানে আঠারোর কম কেউ আছেন?” ক্লাসের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন প্রফেসর।

কেউ এর উত্তর দিলো না।

“তারমানে, নেই।” প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে করতে বললেন তিনি, “আমার নিয়মটা সাধারণ। আপনাদের সবাই বয়সে যেহেতু আঠারোর উর্ধ্বে, আমি আপনাদের ট্রিট করবো অ্যাডাল্ট হিসেবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে দিকটি আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, শিক্ষক মাত্রই ছাত্রকে ছোট করে দেখেন। অথচ তারা ভুলে যান, একসময় ছাত্রজীবন তাদেরও পার করে আসতে হয়েছে। আমার ক্লাসরুমে এরকম কোনো বৈষম্য থাকবে না। কারণ সামনে যারা বসে আছেন, আপনারাই ভবিষ্যতে আমার সমান কিংবা তার থেকেও বেশি যোগ্যতার অধিকারী হবেন। এই বিশ্বাসটা আপনাদের মধ্যে আসাটা জরুরি।”

“জোস।” বিড়বিড় করে বলে উঠলো মুহিব।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পায়চারি থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রফেসর, “ফিসফিস করে বলার কিছু নেই, যদি না একান্ত গোপন কোনো কথা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি, এটা বিশ্ববিদ্যালয়। স্কুল নয়। কাজেই আপনারা আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকছেন তা দেখতে দৃষ্টিকটু লাগছে। এই মাত্রই কে যেন নিচু গলায় কিছু বললেন। আশা করবো কথাটা আপনি জোরে বলবেন।”

অগত্যা উঠে দাঁড়াতে হলো মুহিবকে, “স্যার, আমি বলেছিলাম আপনি জোস।”

ক্লাসজুড়ে হাসির রোল পড়ে গেলো। মৃদু হাসলেন প্রফেসরও, “আপনার নামটা, মি.-?”

“মুহিব্বুল্লাহ খান। নিকনেম, মুহিব।”

“মি. মুহিব।” মাথা দুলিয়ে তাকে বসতে ইশারা করলেন তিনি, “আপনাকে ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে যে কোনো মন্তব্য আপনি প্রকাশ্যেই করবেন আশা করি। এমনকি সেটা আমার জন্য সুখকর না হলেও।”

শয়তানি হাসি খেলে গেলো মুহিবের ঠোঁটে, “অর্থাৎ যদি আপনার পড়ানো ভালো না লাগে, তাহলে তাও আমি জানাতে পারবো?”

মাথা দোলালেন প্রফেসর, “অবশ্যই। অবশ্যই জানাবেন। যদিও আমি জানি আপনারা তেমনটা করেন না। কারণ আমার কলিগরা…” নাক মুখ কুঁচকে বিচ্ছিরি এক মুখভঙ্গি করলেন তিনি, যেন প্রবল ঘেন্না আর অবজ্ঞা মেশানো আছে তাতে, “…অসহিষ্ণু। ওধরণের মন্তব্য আপনারা করলে তাদের পর্বতসম অহমিকায় ঘা পড়ে। যাক সেসব কথা। আমার মুখের ওপর নেগেটিভ মতামত দিতে আপনারা দ্বিধা করবেন না। এতে করে কারও নাম্বার কাটা পড়বে না ফাইনালে। এই কথা আমি আপনাদের দিচ্ছি।”

একে অন্যের দিকে দ্বিধাভরে তাকালো শামীম আর লিটু।

“নিজের পরিচয়টা প্রথমে পরিস্কার করি। আমাকে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে আপনারা আগে দেখেননি। কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলাম, এই প্রশ্ন আপনাদের মনে জাগবার কথা।” ডায়াসের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, “ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির একজন প্রফেসর ছিলাম আমি। সংক্ষেপে একে বলে ক্যালটেক। ঠিক এখানটাতেই আপনাদের প্রশ্ন করার কথা, ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিংয়ে টপ টেনের মধ্যে থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আমি কেন এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম যেটা বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বিশ হাজারের মধ্যে নেই?”

মাথা নাড়লো অনেকেই।

“দেশপ্রেমের বুলি আমি দিতে পারতাম। তবে কারণ সেটা নয়।” বোর্ডের দিকে একটু ঘুরে গেলেন তিনি, “আজকে আমি আপনাদেরকে ম্যানেজমেন্টের ব্যাসিক কিছু জিনিস নিয়ে বলবো।” ক্লাসের ফার্স্ট বয় তুহিনকে বইয়ের দিকে হাত বাড়াতে দেখে মাথা নাড়লেন, “না না, এজন্য বইয়ের দরকার পড়বে না। আমি কয়েকটা মজার গল্প শোনাবো কেবল, দ্যাটস অল।”

অনেকখানি হতাশা নিয়ে প্রফেসর রবিনের দিকে তাকালো ওরা। ক্যালটেক ফেলে এই পোড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কি করছেন তার উত্তর পাওয়া হলো না।

শামীম এবার খাতায় বড় বড় করে লিখলো, “দিস উইল বি ইন্টারেস্টিং, মাইট! দিস উইল বি।”

*

ক্যাফেতে পা রেখেই চেপে রাখা দমটা ছেড়ে দিলো মুহিব, “মার্ভেলাস! মার্ভেলাস। এবার যদি এই ভার্সিটির কিছু পাল্টায়।”

শামীম মাথা নাড়লো, “নো ওয়ে, ম্যান। তিনি একজন প্রফেসর কেবল। ভাইস চ্যান্সেলর তো আর নন। কিন্তু এমন আর দু’-চারটা প্রফেসর এই ভার্সিটিতে ঢুকলেই কাজ হয়ে যেতো।”

চোখ নাচালো ইলোরা, “লক্ষণ সেনকে নিজের মাটিতে পরাস্ত করতে একজন ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজিই যথেষ্ট।”

মুখ বাঁকালো মুহিব, “বখতিয়ার খিলজি তো ছিল এক ডাকাতদলের সর্দার। হুড়মুড় করে বাংলা দখল করতে হাজির। আরে ব্যাটা তোর সমস্যাটা কি? অন্যের এলাকায় অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ার দরকার ছিল কোনো? মেটাফোর হিসেবে তুই যাচ্ছেতাই এক উদাহরণ টানলি, মুখপুড়ি।”

মুখপুড়ি খেতাবের সাথে ইলোরার গাত্রদাহের সম্পর্ক। কিছু না বললেও একেবারে গোমড়া হয়ে গেলো সে।

হল ভ্যাকেন্ট হওয়ার পর খুলেছে মাত্র। তিন সপ্তাহ পর ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এসেছে অনেকটাই। শামস হত্যার বিষয়টা থিতিয়ে এসেছে অনেকটা। যদিও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় ওই এক ঘটনা নিয়ে, তারপরও আগের মতো নয়। সময় মানুষের সব ধরণের ক্ষত সারানোর ক্ষেত্রে অব্যর্থ এক নিয়ামক। ইলোরা আর লিটু ভুত অভিযানের পরদিনই সরাসরি শামীমদের ফ্ল্যাট থেকে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো। থেকে গিয়েছিলো শামীম আর মুহিব, তবে তিন দিনের বেশি সময়ের জন্য নয়।

শামস হত্যাকাণ্ডের ‘তদন্ত’ যথারীতি চলছে ‘কয়েক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনের’ মাধ্যমে। এবং তা চলতেই আছে। মুহিবের নাম এখন পর্যন্ত কোথাও ওঠেনি, বিষয়টা স্বস্তির। অর্থাৎ মুহিব সেরাতে ওখানে ছিল তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। এমনকী কেউ এখনও জানে না পর্যন্ত বিষয়টি! ধীরে ধীরে মুহিবের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিচ্ছে তিন বন্ধু।

ক্যাফেটেরিয়ার একটা টেবিল দখল করে ওরা চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলো।

“হাকারবিন।” দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে অবশেষে বলল লিটু।

“কি বিন?” মুহিবকে এড়িয়েই লিটুর দিকে তাকিয়েছে ইলোরা

“হাত কাটা রবিন। হাকা রবিন। হাকারবিন।” এমনভাবে লিটু বলল যেন এতে করেই সব ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে যাচ্ছে, “জাফর স্যারের কিশোর উপন্যাসিকা।”

“তাইতো!”

মুহিবের মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে পারলো না শামীম আর ইলোরা। ওদের মতো বই পোকা নয় তারা। প্রকৌশল বিদ্যা পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক-ই গ্রন্থভূক হয়ে থাকে।

“হাত কাটা রবিন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা বই। প্রধান চরিত্রদের একজনের নাম রবিন। বেচারার হাত কনুই থেকে কাটা। ঠিক আমাদের প্রফেসর রবিনের মতোই। শুধু বয়সে কম এই যাহ।”

“হয়তো জাফর স্যারের সময়ে যে ছোট্ট রবিন ছিল সেই বড় হয়ে ক্যালটেকের প্রফেসর হয়েছেন।” চোখ টিপ দিলো ইলোরা।

“প্রফেসর কি করেন দেখা যাক। এদিকে ন্যাংটামি কিছু যদি কমাতে পারেন ইন্সটিটিউশনটার একটা গতি হলেও হতে পারে।”

কিসের কথা বলা হচ্ছে তা ওরা সবাই জানে। গত বছর থেকে ওদের বিশ্ববিদ্যালয় একশ’ কোটি টাকা পেয়েছে গবেষণার জন্য। ফাইনাল ইয়ারে আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্ট এখানে আছে আটশ’জনের মতো। আন্ডারগ্র্যাডে সাধারণত দু-জন করে এক গ্রুপে গবেষণা করে। প্রতিটি গ্রুপেরই রিসার্চ বাবদ খরচ হয় বিশ হাজার থেকে লাখ দুয়েক টাকা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা পায় মাত্র আড়াই হাজার টাকা। বাকি টাকা যায় নিজেদের পকেট থেকে।

শেষ বর্ষে রিসার্চ না করে ইঞ্জিনিয়ারের সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। কাজেই নিজের পকেট থেকে দিয়ে হলেও গবেষণা তো শেষ করতেই হবে। সবাই তা করেও, তবে প্রশ্নটা আসে অন্যখানে। চারশ’ গ্রুপকে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ হয় দশ লাখ টাকা। গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি বরাদ্দ একশ’ কোটি টাকা, অথচ ছাত্ররা পাচ্ছে দশ লাখ।

কোথায় একশ’ কোটি টাকা আর কোথায় দশ লাখ?

তার থেকেও গুরুত্ব রাখা প্রশ্নটা হলো, তবে নিরানব্বই কোটি নব্বই লাখ টাকা যায় কার পকেটে?

এই প্রশ্ন করা অবশ্য এখানে নিষিদ্ধ। কেউ ভুল করে প্রশ্নটা করে ফেললে তাকে মুখস্ত উত্তর দেন শিক্ষকরা, অবশ্যই রোল নাম্বার জিজ্ঞেস না করে নয়!

“আমাদের সময় তো দুই হাজারেই রিসার্চ হতো। চল্লিশ বছর ধরে এতোগুলো ‘সিরিজ’ পারলে তোমাদের বেলায় কেন–”

এর ওপর কথা তোলার কে আছে? আন্ডারগ্র্যাডের স্টুডেন্টরা খুব বেশি কিছু চায় না। রিসার্চ বাবদ তাদের বরাদ্দটা দশগুণ বাড়ানো হোক, এই তাদের চাওয়া। দুই কোটির ব্যাপার, মোট বাজেটের মাত্র দুই শতাংশ। এতোটুকু না পাওয়া গেলে শিক্ষকদের এই অবিচারকে তারা একটা শব্দ দিয়েই সংজ্ঞায়িত করে।

ন্যাংটামি।

“এসব কমবে না। সরকারের উচিত আসলে এসব বাজেট ঘোষণা না করা।” ইলোরা বলল, “অন্য কোনো খাতে টাকাটা দিলেই পারতো। রাজনীতিবিদেরা এই টাকা হজম করে ফেলুক। তাদের আমরা সরকারি টাকা মেরে কেটে খেতে দেখে অভ্যস্ত। শিক্ষক জাতটাকে কোটি কোটি টাকা হাতে তুলে দিয়ে নষ্ট করে ফেললো না? আমাদের চোখে মহৎ পেশাটিকেও চোরদের কাতারে নামিয়ে আনলো না?”

“সরকার তো বরাদ্দ দেবেনই। সেই টাকা মেরে খেয়ে ফেলাটা যারা চুরি করছে তাদের নিজস্ব সমস্যা। এজন্য পুরো শিক্ষকতা পেশাকে দোষ দেওয়া অন্যায় হবে। সব পেশাতেই কিছু ন্যাংটা থাকে। মক্কাতেও চোর আছে।”

পক্ষে বিপক্ষে আলাপ চলছে, তবে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারছে না মুহিব। কাউন্টারের সামনে একটা হট্টগোল হচ্ছে। সেদিকে একপলকে তাকিয়ে আছে সে। হট্টগোলটা যে করছে সে সরকারদলীয় কর্মি। আস্তে করে চেয়ার ঠেলে এগিয়ে গেলো মুহিব।

তোমার বাপের ক্যাফে না এইটা, ঠিক আছে?” দৃঢ় গলায় বলল কমিটি, “এইখানে এই সব চলবো না।”

ক্যাফের শাহরিয়ার ভাইয়ের অবস্থা এখন বড়ই করুণ। সরকারদলীয় কর্মীর সঙ্গে লাগতে যাওয়ার ইচ্ছে কি তারও ছিল? না। নেহায়েত পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে বলে আপোষে আসার চেষ্টা করতে হচ্ছে তাকে। আরেকবার বোঝানোর চেষ্টা করলো সে, “জহিরভাইরে বিষয়টা ক্লিয়ার করছি তো, ভাই। উনাকে একটা ফোন দিয়ে দেখেন না? নেমকহারামি করার লোক এই শাহরিয়ার না, ভাই।”

মুহিব বুঝতে পারলো, ঝামেলাটা চাঁদাবাজি সংক্রান্ত। শাহরিয়ার ভাই নেতার চাঁদার টাকা দলের একজন কর্মিকে দিয়ে দিয়েছেন। তবে একই নেতার অপর এক কর্মি আলাদা করে আবারও চেয়ে বসেছে। মাসে দুই বার দেওয়ার মতো অঙ্ক তাদের ধার্য চাঁদার না।

কমিটি অবশ্য এসব ছেঁদো কথায় কান দিতে রাজি নয়। খপ করে শাহরিয়ারের কলার চেপে ধরলো সে, “বেশি চালাকি করার চেষ্টা করিস না, মাগির পুত—’

বজ্রাহতের মতো ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলো মুহিব। কণ্ঠটা শুনেই নাড়া খেয়েছিলো সে। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।

এই ছেলেই শামসের গলায় ছুরি চালিয়েছিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *