অধ্যায় ৪৬
চোখ খুলতেই প্রথমে দেখা গেলো ইলোরার উদ্বিগ্ন মুখ। তার এক হাতেরও কম তফাতে তূর্ণার কুঁচকে থাকা ভ্রু, আরেকটি উদ্বিগ্ন মুখ। হাসার চেষ্টা করলো মুহিব, ঠোঁটে যন্ত্রণা করে উঠলো। হাসি বলতে যে মাংসপেশির পরিবর্তন মানুষ বোঝে, সেসব মাংসপেশিদের অনেকেই আক্রান্ত। তারা নড়তে পারছে না।
“জ্ঞান ফিরেছে হারামজাদার।” মুখ ঝামটে উঠলো ইলোরা, “শামীমের সাথে তোর গুজুর গুজুর ফুসুর ফাসুর আমি বের করছি। তোকে পিটিয়ে যদি আমি তেলাপোকা না বানিয়েছি তো আমার নাম-”
“টেনশনে থাকলেই কি তোমার বান্ধবি রেগে যায়?” মুখ টিপে হাসলো তূর্ণা।
“আমি এখান থেকে বের হতে পারবো না।” গম্ভির মুখে বলল মুহিব, “বুঝতে পারছেন এখান থেকে বের হলে কি মারটা খেতে হবে আমাকে? এবার ঠিক মেরে ফেলবে।”
“কে?” কড়া গলায় জানতে চাইলো তূর্ণা, “তাজউদ্দিনের ছাত্রসংগঠনের সভাপতিকে পর্যন্ত তোমার ব্যাপারে জানিয়েছি। তুমি জানো, এই কেবিনের বাইরে একজন পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে? তোমাকে কেউ ফুলের টোকাটাও দিতে পারবে না।”
“যারা আমাকে মেরে ফেলবে তাদের পুলিশ দিয়ে ঠেকাতে পারবেন না।” চোখ টেপার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো মুহিব। একটা চোখের পাতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। চেষ্টা করলে দুটোই বন্ধ হয়ে আসে। দারুণ যন্ত্রণা।”যদি আপনার আর আমার ক্যাম্পাসের ছেলেরা শোনে দুই ভার্সিটির শীর্ষ সুন্দরির সাথে এক ঘরে শুয়ে আছি…”
তূর্ণা হেসে ফেললো। ইলোরার মুখ আগের মতোই থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে।
“এখান থেকে বের হয়ে তুই আমার সাথে লম্বা একটা সিটিং দিবি। কোনো রেস্ট নাই।”
“এখান থেকে বের না হওয়ার আরও ভালো একটা কারণ!”
মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো মুহিব। ওপরে একটা ব্লাডব্যাগ ঝুলছে। সেখান থেকে ওর চোখ এসে থামলো ইলোরার বাম হাতের কনুইয়ের ওপর। একটা ব্যান্ড-এইড। মেয়েটা তবে ওকে রক্ত দিয়েছে? জেগে ওঠার আনন্দ ছাপিয়ে তাকে ঘিরে ফেললো বিস্ময়। ওকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে কেন? সামান্য মুখ আর গাল কাটার জন্য কারও রক্ত লাগে নাকি?
“আমার কি হয়েছে?” সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে জানতে চাইলো মুহিব।
মাত্রই কেবিনে হেঁটে ঢুকছিলো শামীম। মুহিবের প্রশ্নটার উত্তর সে দিলো অট্টহাসি দিয়ে, “আরে নবাবের বাচ্চার ঘুম ভাঙছে দেখা যায়। নবাবজাদা বুঝতে পারতেছে না তার কি হইছে। ঐ খানকির পোলা জাকিকে যদি আমি মাটিতে পুইতা না ফেলছি…”
অবাক হয়ে তূর্ণা তার দিকে তাকালো, “জাকি?”
“মুহিবকে জাকি ভাই ডেকে পাঠিয়েছিলো। তারপর তারে ছুরি মারা হইছে। আর কে মারবে বলেন!”
“আমাকে তুমি আগে বলোনি কেন?” তূর্ণাকে আহত দেখাচ্ছে। জাকির সম্পর্কে তার ধারণা অনেক উঁচুতে, বোঝা যায়।
এতোক্ষণ দুশ্চিন্তায় ওরা কার্যকারণ নিয়ে কথা বলার চেষ্টাও করেনি। ডলফিন ক্লিনিকটা প্রাইভেট, দ্রুত সার্ভিস পাওয়া গেছে। বিকেলে একজন ছুরিকাহত রোগিকে আনার পর রাত আটটায় অপারেশন থিয়েটারে তাকে ঢোকানো হয়েছে। রোগির ভেতর ফরেইন পার্টিকলস পাওয়া গেছে, তাদের সরিয়ে সেলাই করে রোগিকে নিজের কেবিনে এনে রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে। ওয়েটিং রুমে তূর্ণা, ইলোরা, শামীমের সাথে আরও অনেকেই ছিল। মুহিবের মেসের প্রায় সব ছেলে চলে এসেছে। তাদের শামীম অনেক বুঝিয়ে আবার মেসে ফেরত পাঠিয়েছে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে ভালো-মন্দ খবরের আপডেট তাদের দেওয়া হবে। এতো মানুষের ভিড়ে জাকি গ্রুপ নিয়ে আলোচনা করা যায় না।
একটা হাত তোলার চেষ্টা করলো মুহিব, তেমন জোর পেলো না।”থাম তোরা। জাকি ভাইয়ের সাথে আমার অবস্থার কোনো সম্পর্ক নাই।”
“হুঁ!” বিদ্রুপের সুর শামীমের কণ্ঠে, “জাকির সাথে সম্পর্ক নাই। তোর পিঠে তিন ইঞ্চি ফলার ছুরি ঢুকিয়েছে তূর্ণা আপু। তারপর টেনে মেডিকেলে নিয়ে এসেছে, তাই বলতে চাইছিস?”
“ছুরি এলো কোথা থেকে?” অবাক হয়ে গেলো মুহিব।
“সেটাই।” সবজান্তার মতো বলল শামীম, “সেটাই ভাবছিলাম। তোর শর্ট টাইম মেমরি লস ঘটে গেছে। ছুরির কথা ভুলে গেছিস। এবার জানতে চাইবি জাকি এলো কোথা থেকে!”
কনুইয়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো মুহিব। উঠতে কোনো সমস্যা হলো না, তবে হা হা করে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিলো মেয়ে দুটো। ওদের শান্ত করতেই শুয়ে পড়লো আবার, “তুই পুরো কাহিনী জানিস না। অযথা দোষারোপ করার মানে হয় না। আমাকে রিলিজ দেবে কখন?”
কাঁধ ঝাঁকালো শামীম, “রাতটা থেকে যেতে বলছে। তবে আমি একটু চাপ দেওয়ার পর বলেছে এই ব্যাগটা দেওয়া হয়ে গেলে তুই বাড়ি ফিরে যেতে পারবি। বিশ্রাম ছাড়া প্রেসক্রিপশনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। গুরুত্বপূর্ণ কোনো রগ-টগ কেটে যায়নি। চাকু মেরে একেবারে হা করে দিয়েছিলো তোর পিঠ, সেইটা থেকে রক্তপাতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলি।
পালাক্রমে ইলোরা আর তূর্ণার দিকে তাকালো মুহিব। সোজা হয়ে বসার জন্য যাদের হাহাকার চোখে পড়ার মতো, তাদের সামনে আজ রাতেই ক্লিনিক ছেড়ে মেসে ফিরে যাওয়ার আলোচনা স্বাস্থ্যকর নয়। আশানুরূপ প্রতিফলন দেখা গেলো মুখ দুটোয়। পাথর খুঁদে বানানো হয়েছে যেন ইলোরার চেহারা, এতোটাই শক্ত। তূর্ণার চোখে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা, সেটাই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো।
“অসম্ভব। আজকে রাতে মুভমেন্টের দরকার নেই কোনো। কাল দেখা যাবে এসব।”
শামীম অবশ্য চোখ টিপলো, “দোস্ত, বেরিয়ে আয়। নারীকূলের কথায় কর্ণপাতের দরকার দেখি না। ভদকার একটা বোতল ম্যানেজ করেছি।”
দুই জোড়া অসন্তুষ্ট চোখের সামনেই শয়তানের মতো হাসলো ওরা। আরেকবার ব্লাড ব্যাগের দিকে তাকালো মুহিব, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটার দিকেই কেটে পড়া যাবে।
“এভাবে তাকাবি না।” ইলোরার দিকে পরের বার তাকিয়ে ধমক খেতে হলো।
“আমি আবার কোনভাবে তাকালাম? তোর ভ্রুটা সোজা কর। পরে কপালে পারমানেন্ট দাগ পড়ে যাবে।” হাসিমুখেই প্রতিবাদ করলো মুহিব, “আজকে রাতে আমি এখান থেকে ভাগছি, এটাই শেষ কথা। এমনিতেই সময় এখন বর্ষাকাল, হরিণ খামচায় বাঘের গাল।”
“এটার মানে কি?”
“তোর বয়ফ্রেন্ড যদি টের পায় রাতে তুই আমার সাথে থাকছিস, এবার হয়তো ছুরিতে থামবে না। তরোয়াল সেঁধিয়ে দেবে!”
তূর্ণা দু-হাত দুইদিকে ছড়িয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো, “হোয়াট?” ইলোরার মুখ সামান্য হা হয়ে গেছে, নিরেট বিস্ময় তার চোখেও, তূর্ণার প্রতিধ্বনীই তুললো সে, “হোয়াট?”
শামীম বসে পড়লো বিছানার পাশে, “কি বললি তুই?”
ভ্রুজোড়া কপালে তুলে ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো মুহিব, ঠিক ইলোরার মতোই। তারপর উষ্ণ একটা হাসি উপহার দিলো প্রত্যেককে।
“চল।” হাত নাড়লো ইলোরা, “রাতে তুই অবশ্যই যাবি, তবে তোর ঐ নোংরা মেসে না। এখান থেকে সরাসরি শামীমের বাসায় যাচ্ছিস। আর আমিও আজকে থাকবো শামীমের রুমে। ঝেড়ে কাশবি ওখানে, নাহলে এবার তোকে ছুরি আমি মারবো।”
একটা হাত তুললো তূর্ণা, তাকে অনেকটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে এখন “আমার মনে হয় এটা একটা খারাপ আইডিয়া হবে। ছেলেদের ভাড়া করা বাসায় এক দুই রাত থাকা অনেক অ্যাডভেঞ্চারাস আমি জানি, আমিও এভাবে থেকেছি অনেকদিন। তবে আজকে ছেলেটার জন্য এটা অনেক রিস্কি হবে।”
ইলোরার চেহারায় বিরক্তির ছাপ পড়লো, “আপু, স্রেফ অ্যডভেঞ্চার করতে যাচ্ছি না আমি।”
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো তূর্ণা, “জানি আমি। তারপরও আমি বলবো এটা একেবারে দরকার না পড়লে করা উচিত না। আর যখন তোমাদের হাতে একটা বেটার অপশন আছে, অহেতুক ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কি? এক দিনের জন্য ঝুঁকির পরিমাণটা কি যথেষ্ট হয়নি?”
মুহিব ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো। আজকে রাতে শামীমের রুমে ইলোরাকে রাখা এমনিতেও যেতো না। ভার্সিটির সবগুলো পরিচিত মুখ আজ ওখানে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। মুহিবের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা তাদের কারও জানতে বাকি নেই, দর্শনপ্রার্থিদের সংখ্যা হবে অগণিত। ওখানে গিয়ে তারা যদি দেখে ক্যাম্পাসের শ্রেষ্ঠ সুন্দরি শামীমের ঘরে রাত কাটাচ্ছে তো পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দারোয়ানরাও তা জানতে পারবে। এতোগুলো ছেলেকে ওদের “লিটল সিক্রেট’ জানতে দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। মুখ বন্ধ রাখার ব্যাপারে শামীমের আর সব সাবলেটরা দক্ষ হতে পারে, কিন্তু এক ক্যাম্পাস ভর্তি সাধুপুরুষ পাওয়া কঠিন। পরে এটা নিয়ে সমস্যা হবে এবং সেই সমস্যার শিকার হবে শামীম নিজেই।
“কোনো বেটার অপশন?” তূর্ণার কাছে জানতে চাইলো ইলোরা।
কাঁধ ঝাঁকালো তাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সুন্দরি, “আজকে রাতটা আমার বাসায় থেকে যাও। আমাদের বাসার গেস্ট রুমটা জোস। তবে,” সরাসরি শামীমের দিকে তাকালো সে, “ভদকার বোতল নট অ্যালাউড!”
*
তুর্ণার বাবা-মার সঙ্গে বিশ মিনিট কথা বলেই তাদের ভক্ত হয়ে গেলো ওরা তিনজন। রাত সাড়ে বারোটায় তিন তিনটে উটকো ঝামেলা এসে বাড়িতে জুটলে বাংলাদেশের ক’জনের বাবা-মা এতো সাদরে বরণ করতে পারতেন তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলো শামীমও। গল্পের জাদুকর বাবাটি, নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কিছু সংশ্লিষ্ট ঘটনা শেয়ার করতে করতে এতো নিখুঁতভাবে অপ্রচলিত কিছু প্রাপ্তবয়স্কদের কৌতুকে পৌছে গেলেন যে ওরা কেউ প্রসঙ্গের পরিবর্তনটা টের পেলো না। কোটিপতি বসায়ি, খুবই ওপেন মাইন্ডেড–তূর্ণার মতো সুন্দরি মেয়েদের জন্য এমন ব্যাকগ্রাউন্ডের বাবা-ই তো দরকার। একে অন্যের সঙ্গে কনুই দিয়ে খোঁচাখুঁচি করলো মুহিব।
মুহিবকে একেবারে রিলিজ দেওয়া হয়নি। ব্যান্ডেজ খোলা, ড্রেসিং ইত্যাদি নিয়ে নিয়মিত ডলফিন ক্লিনিকে যাওয়া আসার একটা শিডিউল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিসিপশনে বসে থাকা মেয়েটা জানিয়েছিলো রোগি চাইলে বাড়ি গিয়ে একজন ডাক্তার গিয়ে দেখভাল করে আসবে, তবে দাম পড়বে চড়া। চড়া খরচে মুহিবের আগ্রহ না থাকায় মেয়েটির মুখের একশ ওয়াটের বাল্বের মতো ঝলমলে হাসিটা একেবারেই বৃথা গেছে।
তূর্ণার বাবা মা রাত একটার মধ্যেই ওদের নিস্তার দিলেন। আর আধঘণ্টা সময় চেয়ে নিয়ে মেয়ে দুটো ওদের সঙ্গে থেকে গেলো। জুনিয়র বলে রক্ষা! শামীম আর মুহিব আরেক দফা কনুই খোঁচাখুঁচি করে ইলোরার ধমক খেলো। আসল আলাপে আসা গেলো ওরা একা হওয়ার পর। তূর্ণা তার দিক থেকে গল্পটা বলে গেলো। আগামীকাল ভার্সিটির এক বান্ধবির জন্মদিন, শায়লা মেয়েটাকে সবাই অবশ্য তূর্ণার বেস্ট ফ্রেন্ড বলেই জানে। সেলিব্রেশনের উদ্দেশ্যে আজকের রাতটা হলেই থাকার কথা ছিল তার। টুকিটাকির সামনের ছেলেদের আড্ডা থেকে উঠতে উঠতে তূর্ণার সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। হলে ফেরার পথেই রাস্তায় মুহিবকে দেখতে পায় সে। এটা অবশ্য নেহায়েত কাকতাল মনে করার উপায় নেই, মেয়েদের হলে যাওয়ার আর কোনো বিকল্প রাস্তা ছিল না।
ধীরে ধীরে পুরো ঘটনাটা তাদের খুলে বলল মুহিব।
“আউট অব জেলাসি?” তূর্ণা দুইপাশে মাথা নাড়লো, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না বিষয়টা, “তোফায়েলের মতো একটা পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে এমনটা করবে কেন?”
“তার নিজেরই তো রেকর্ড ভালো না।” একটা কাঠি চিবুতে চিবুতে বলল শামীম। রাতের খাবারে গরু ছিল, আন্টি অল্প সময়েই অনেকগুলো আইটেম করে ফেলেছিলেন।”কিছু মনে করিস না ইলোরা, মাগিবাজ হিসাবে তার খ্যাতি পুরা শহর জুড়েই আছে। সে কি আশা করতেছিলো, গার্লফ্রেন্ড হবে সতী-সাধ্বী?” আবারও দ্রুত একবার ইলোরার দিকে তাকালো শামীম, “কিছু মনে করিস না, তোকে মিন করে বলতেছি না।”
মাথা নাড়লো ইলোরা, “তোদের মিসকনসেপ্ট আমি আগেও ভাঙানোর চেষ্টা করেছি, তবে কানে তোলার চেষ্টা করিস নাই। আমি ঐ মাদারচোতের গার্লফ্রেন্ড না। এই জিনিসটা আমি তার সাথেও ক্লিয়ার করেছি অনেকবার, তোদের সাথেও করেছি।”
“বাল বকিস না।” এবার ক্ষেপেই উঠলো শামীম, “তুই একটা সিনিয়র ছেলের সাথে রোজ বিকেলে ঘুরে বেড়াবি, বাইকে জড়াজড়ি করে থাকবি, এখানে ওখানে হাত ধরাধরি করে হাঁটবি, তারপর বলবি গার্লফ্রেন্ড না। তোর মনে কি আছে তা কেবল খোদা জানে আর তুই জানিস, কিন্তু দুনিয়াবাসি কিভাবে তোদের দেখে বলে ভাবছিস?”
“আমি জানি দুনিয়াবাসি কিভাবে আমাদের দেখে। তোদের থেকে আমি ঠিকভাবে দেখাটা আশা করেছিলাম। ভুল করেছি হয়তো।” গাল ফুলিয়ে ফেললো ইলোরা।
ঝগড়ার মাঝে বাগড়া দিলো তূর্ণা, “ইলোরার ওপর এতো চাপ দেওয়াটা তোমাদের উচিত হচ্ছে না আসলে। তোফায়েলের রেকর্ড তোমরা জানো। এরকম একটা ছেলে যখন ক্যাম্পাসের কোনো মেয়ের পেছনে লাগে তখন তাকে ডিফেন্সিভ কিছু করতে হয়। একটা উপায় হলো মধ্যমপন্থায় থাকা। ইলোরা সেটা বেছে নিয়েছে, সে তোফায়েলকে চটিয়ে দেয়নি আবার নিজেকেও একটা নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে। নিজে একজন মেয়ে হিসেবে আমি তার অ্যাপ্রোচকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবো।”
“আমি ঠিক ডিফেন্সিভ অ্যাপ্রোচ বলবো না এটাকে, সেটা মিথ্যে বলা হবে।” ইলোরা বলল, “ছেলেটার নামে এতো বদনাম শুনেছি, ক্যাম্পাসে ঢোকার পর থেকে শুনছি। আমার এখনও মনে আছে, মেডিকেল সেন্টারের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও, আমার সাথে ছিল সিভিলের একটা মেয়ে। ও আমাকে প্রথম দেখায় তোফায়েলকে। বলেছিলো এই ক্যাম্পাসে একশ রেপ করা কোনো ছেলে না থাকলেও তাদের কাছাকাছি রেপ কেউ যদি করে থাকে তবে এই ছেলে। তারপর বন্ধুদের দেখেছি রেপের প্রসঙ্গ উঠলেই তোফায়েলের নাম নিতে। আমার কাছে এটাকে বাস্তবতার চেয়ে বেশি মনে হয়েছিলো ট্রল।” নিজের সুন্দর হাতজোড়া অযথাই দেখলো ইলোরা।”বলতে চাইছি, আমি মনে হয় নিষিদ্ধ বস্তুর আকর্ষণে পড়ে যাই।”
হাততালির শব্দে ঘরটা ভরে গেলো। শুয়ে থাকা মুহিবের দিকে একযোগে ঘুরে গেলো তিনজোড়া মাথা। ডাক্তার নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছে তাকে, বিশেষ করে হাত আর পিঠের পেশি নড়ে এমন সব কাজ করা আপাতত নিষিদ্ধ। আগামি কয়েক মাসে ক্রিকেট খেলার সম্ভাবনা একেবারেই নেই তার তবে দর্শকের কাতারে থেকে তালি দেওয়ার কাজটা যে সে এখনও করতে পারে তার একটা ছোটোখাটো প্রদর্শনী চালাচ্ছে সে এখন।
“তারমানে তুই তার প্রতি দুর্বল ছিলি। আর তোফায়েল তো স্পষ্টতই তোর প্রেমে ডুবে আছে। মাগিবাজের প্রেম যে এতো সিরিয়াস হয় তা জানতাম না। দু-জন দু-জনের প্রতি আগ্রহি, ঘুরছিস একসাথে, অথচ গার্লফ্রেন্ড বলা যাবে না। *
তূর্ণাই ঘরে নারীবাদী সংগঠনের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ইলোরার পক্ষ নিলো, “এরকম একটা ছেলের প্রেমে পড়া আরও কঠিন কাজ। তুমি জানবে না তার কাছে তুমি কতোটা নিরাপদ।”
কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপ হয়ে গেলো।
“ক্যাম্পাসে তুমি নিরাপদ তো?” তূর্ণাই নিস্তব্ধতা ভাঙে, এবারের প্রশ্নটা করা হয়েছে মুহিবের উদ্দেশ্যে।
মাথা দোলালো মুহিব, “তা নিরাপদ। ক্যাম্পাসের কেউ এসব নিয়ে জানুক এমনটা তোফায়েল চায়নি, নয়তো এতো রাখঢাকের দরকার ছিল না। ক্লাস থেকে ফেরার সময়ই দলবল ধরে পিট্টি দিতে পারতো। উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে প্রচার করে দিলেই কেউ কিছু জানতে চাইতো না। এমন হয়েছে না কয়েকদিন আগে? চাঁদার টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো সিভিলের তাহেরের সাথে। ওকে পরীক্ষার হলে গিয়ে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। পরে প্রচার করা হয়েছে ছেলেটা উগ্রবাদী সংগঠনের হয়ে ছাত্র রাজনীতি করে। আসলে তাহের একেবারেই নন-পলিটিকাল। জায়েজ করা হলো আরকি নিজেদের অপরাধটা।” খ্যাক খ্যাক করে হাসলো সে।
ছেলেটাকে কিছুটা বিস্ময় নিয়ে দেখলো তূর্ণা। মার খেয়ে হাসপাতাল ঘুরে এসেছে অথচ এ নিয়ে তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত মনে হচ্ছে না। বরং ঠাট্টার সুরে কথা বলছ বিষয়টা নিয়ে। হাসাহাসি করছে। ভয় পেয়েছে কি? না, ভয় পাওয়ার লক্ষণও তার মধ্যে নেই। এরকম কিছুই যেন ঘটা স্বাভাবিক ছিল। ভয়ের বদলে তার মধ্যে স্বস্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য এক ছেলে!
“আমার একটা প্রশ্ন আছে।” শামীম তার নাক উঁচু ভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত ঢঙে বলল। অনেকটা বিনয়ের মতোই শোনায়।
“শিওর।” অভয় দিলো তূর্ণা।
“তোফায়েল মুহিবকে ছুরি মেরেছে জানার পর আপনি এতোটা আগ্রহি হয়ে উঠলেন কেন?”
মিটিমিটি হাসিটা এখনও লেগে আছে মুহিবের মুখে, যেন ছুরি খায়নি, পিকনিকে এসেছে। শামীমের প্রশ্নের উত্তরটা এলো তার মুখ থেকে, “কারণ, আপু ঠিক ঠিক জানে শামস মার্ডারে তোফায়েলের ভূমিকার ব্যাপারে।”
“কি ভূমিকা?” গত কয়েকমিনিটে প্রথমবারের মতো মুখ খুললো ইলোরা!
“তোফায়েল শামস হত্যাকাণ্ডের একজন অন্যতম প্রধান খুনি, ইলোরা।” শান্ত গলায় তাকে বলল মুহিব, “আমি দুঃখিত, তোকে আগে জানাইনি। এটা পেটে ধরে রাখার জন্য একজন গার্লফ্রেন্ডের কাছে অনেক বড় তথ্য। সম্ভাবনা ছিল তুই এটা নিয়ে তোফায়েলকে কিছু জিজ্ঞেস করতি। একবার যদি সে বুঝতে পারে আমরা তার পেছনে লেগে আছি, গভির জলে ডুব দেবে সে। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ জোগাড় করার সম্ভাবনাই থাকবে না আমাদের।”
তথ্যটা জানার পর ইলোরা প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে আশা করেছিলো ওরা, তবে মেয়েটি তেমন কিছু করলো না। আবারও চুপ করে বসে নিজের হাত দেখতে শুরু করলো সে।
“তুমি ভুল ভাবছো, মুহিব।” তূর্ণা বলল, “ক্লিনিক থেকে আজ রাতে চলে যাবে এই আইডিয়াটা আমার পছন্দ হয়নি। যেহেতু তুমি নাছোড়বান্দা, মেসের
নোংরা পরিবেশে না ফিরে গিয়ে আমার বাসায় থাকাটাই তোমার জন্য ভালো হবে মনে করেছি। তোফায়েলের সাথে এর সম্পর্ক নেই।”
মাথা নাড়লো মুহিব, “আপনার এই কাজটা আমি খুবই অ্যাপ্রিশিয়েট করছি। কিন্তু সেই সাথে আলমগির কবির ভাইয়ের সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যাপারটাও আমি বুঝতে পেরেছি।
“কবিরকে এখানে টানছো কেন?” শক্ত হয়ে গেলো তূর্ণার গলা।
“বেয়াদবী হলে মাফ করবেন, আপনি তো ব্যাংকার ভদ্রলোকের সাথে ব্রেকআপ করেছেন বলেই জেনেছি।”
“ও একটা ব্যাংকে চাকরি করতো। ব্যাংকার নয় মোটেও।” এ নিয়ে শতবারের মতো এই ভুলটা তাকে শুধরে দিলো কেউ।”আমার লাভ লাইফ নিয়ে কথা বলার আগ্রহ সত্যি নেই, মুহিব। তোমার ওপর অনেক ধকল গেছে। আমার মনে হয় এখন তোমার ঘুমানো দরকার।”
মুচকি হাসলো মুহিব, “ধকল? উঁহু। মস্তিষ্ক পূর্ণ কর্মদক্ষতার সাথেই সচল আছে। ছুরি খেলে মাথা খুলে যায় বলে জানতাম না, তবে আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনই হয়েছে মনে হচ্ছে। আসলে গত কয়েক সপ্তাহ এতো দৌড়াদৌড়ি গেছে, ঘুমাতেও পারিনি ঠিকমতো। ছুরি খেয়ে ঘুমটা ভালো হয়েছে। ঠিকমতো চিন্তা করতে পারছি আবার।”
থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো তূর্ণা।
“কোন কারণে একটা মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ করতে পারে? কবির ভাই মনে করছেন আপনি শামসভাইয়ের মার্ডার নিয়ে শকড। সেজন্যই এধরণের একটা ‘হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তিনি সম্পূর্ণটাই ভুল ধরেছেন আসলে। এসব ছেঁদো কারণে কেউ কারও সঙ্গে ব্রেকআপ করে না। এরকম যুক্তি দিয়ে গল্প লিখা হলে সেই বই ডাহা ফ্লপ খাবে।”
তূর্ণার সুন্দর মুখটা এখন ধারালো ক্ষুরের মতোই দেখাচ্ছে। ভারি গলায় জানতে চাইলো সে, “ঠিক কি বোঝাতে চাইছো?”
ভ্রু উঁচু করলো মুহিব, “ব্যাপারটা সহজ। আপনি কবির ভাইয়ের সাথে ব্রেকআপ করেছেন, কারণ আপনার মনে তার জন্য আর কোনো অনুভূতি নেই। থাকার কথা নয় অবশ্যই, ভালোবাসার মানুষটি জীবনে ফিরে এলে মেয়েরা উচ্ছিষ্টদের মনে রাখে না। আমি যেটা বোঝাতে চাইছি আপু, শামসভাই তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনার জীবনে ফিরে এসেছিলেন। আপনি আবারও জড়িয়ে গেছিলেন তার সঙ্গে। আরও একবার প্রেমে পড়েছিলেন শামসভাইয়ের, অথচ তখন আপনি কবির ভাইয়ের সঙ্গে রিলেশনে। এর প্রেক্ষাপটেই আপনি ব্রেকআপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ, কবির ভাইকে আপনি যে ভালোবাসেন না তা শামসভাই ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করেছেন আপনি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুহিব, “মিসিং ডটগুলো জোড়া দিলে এরচেয়ে ভালো গল্পের প্লট বানানো আসলেই সম্ভব না।”
ইলোরার একনিষ্ঠ অনুসারীতে পরিণত হলো তূর্ণা। মনোযোগ দিয়ে নিজের হাতজোড়া দেখতে থাকলো সে। ইলোরার চেয়েও সুন্দর তার আঙুলগুলো, লম্বা, শীর্ণকায়, শিল্পীর আঙুল বলতে যেমনটা বোঝানো হয়ে থাকে।
“আপু।” শামীম ডাকলো এক পাশ থেকে, “মুহিবের কথাটা যদি সত্য হয়, আপনি আমাদের পুরোটা খুলে বলতে পারেন। আমরা শামসভাইয়ের মার্ডারটা খতিয়ে দেখছি, অনেক কিছুই জানি আমরা। আপনি যদি তথ্য সাহায্য দিয়ে উপকার করেন, ঐ বানচোতটাকে আমরা কফিনের ভেতর একেবারে গজাল দিয়ে গেঁথে ফেলতে পারবো হয়তো।”
আরও কিছুক্ষণ নিজের নখের মধ্যে মূল্যবান কোনো ধাতু খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেলো তূর্ণা। মেয়েদের এই ভঙ্গিটা ছেলেরা অনায়াসে বুঝতে পারে। কোনো মিথ্যে বলে ধরা পড়ে গেলে ওরা এমনটা করে।
অবশেষে যেন দীর্ঘ এক যুগ পর মুখ তুললো তূর্ণা।
“মুহিবের ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক। আমার মনে হয় লেগে থাকলে ও অনেক নামকরা লেখক একদিন হবে।”