অধ্যায় ৪৫
অফিসটা বিশাল। মেহগনি কাঠের টেবিলের ওপর সুসজ্জিত রাজ্যের অফিস ম্যাটেরিয়াল। টেবিলে একটু কোণ করে বসিয়ে রাখা ল্যাপটপটা স্যামসাংয়ের নতুন একটা মডেল। কাগজের মতো পাতলা ডিসপ্লে, সব মিলিয়ে মাত্র আধ–কেজি ওজন। অফিসগামী কর্মকর্তা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টেবিলের অপরপ্রান্তে বসে থাকা মানুষটাও তার ল্যাপটপের মতোই চটপটে দেখতে। শীর্ণকায়, লম্বা, ঋজু দেহ। চুলগুলো রেশমি, ওয়াক্স করে এলোমেলো করে রাখা।
এই সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নেতা।
ফাহাদ হিল্লোল। বর্তমানে অনেকে তাকে ‘ফাদার’ হিল্লোল বলে ডাকেন, খুবই নীতিসচেতন একজন মানুষ। পিতৃপ্রদত্ত নামের মাঝে একটা ‘পাটোয়ারি ছিল, সম্ভবত ‘আনকুল’ হওয়ার কারণে ঝেড়ে ফেলেছেন। রাজনীতির মাঠে জনগণের মন কিভাবে কাজ করে তা জানতে হয়। সিডনির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এটা পাওয়া গেছে মানুষের মন নাম ধরেই আগে অপর কোনো ব্যক্তির গুণবিচার করে। নাম যদি হয় ‘কিশোর কুমার’ তো মানুষ আগেই ধরে নেবে এটা কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক, অপরিপক্ক মানসিকতার লোক হবে। অথবা ‘লস্কর পাশা’ নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যে কেউ ধরে নেবে মানুষটা বসায়ি। নাম টপকে কেবল কাজের জন্য প্রশংসা কুড়ানো সহজ কাজ নয়। বার বার নিজেকে প্রমাণ করে দেখাতে হয় সেজন্য। তবে আগেই যদি কেউ নিজের নাম থেকে ‘আনকুল’ অংশগুলো ঝেড়ে ফেলে, মানুষ সরাসরি কাজের জন্যই বিচার করবে তার। ফাহাদ হিল্লোল সেই সুযোগটাই নিয়েছেন। নাম থেকে পাটোয়ারি সরিয়ে নিজেকে ‘হিল্লোল’-এ পরিণত করেছেন। অল্পবয়সে রাজনীতির মাঠে তার সাফল্যের পরিমাণ কম নয়। তার প্রভাবের গণ্ডি বর্ডার ছাড়িয়ে বাইরেও সমুজ্জ্বল, এর একটা নিদর্শন হিসেবে বলা চলে সিনিয়র নেতাদের টপকে সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে মনোনীত হওয়া। সমালোচকদেরও মধ্যেও একটা বিষয়ে মতৈক্য দেখা যায়, ‘ফাহাদ হিল্লোল ২০৫০-এর বাংলাদেশের সম্ভাব্য একজন প্রধানমন্ত্রী’। যে দেশে আঠারো কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটিই রাজনীতিবিদ পরিচয় দেন, সেখান থেকে সেলেব্রিটি পলিটিশিয়ান বেরিয়ে আসা কঠিন। এই কঠিন কাজটি হিল্লোল সম্পন্ন করেছেন।
ভদ্রলোকের জনপ্রিয়তার কারণ অনেকগুলো। অনেকে এগিয়ে রাখবে তার বাগ্মীতাকে। আগুন ঝড়ানো বক্তব্য রাখতে পারেন তিনি। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এমন বাগ্মিতা এদেশে দেখা যায়নি। সুবক্তা তিনি সন্দেহ নেই, দেশে রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো যেখানে বিভিন্ন ট্রল পেজে স্থান করে নিচ্ছিলো সেখানে মানুষ আগ্রহ নিয়ে তার বক্তৃতা শোনে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত, শ্রেণিভেদে সবাই তার বক্তব্যের প্রশংসা করেন। ইউটিউবে তার যে বক্তৃতাগুলো আপলোড করা হয়েছে, কোনোটারই দশ লাখের কম ভিউ নেই। প্রচুর শেয়ার হয়, কারণ সেগুলো আসলেই কোয়ালিটি ম্যাটেরিয়াল। শেয়ার করার মতোই জিনিস। এমনকি বিরোধীদলও তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত মাটি খুঁজে পায়নি আজ পর্যন্ত।
দ্বিতীয়ত, ভদ্রলোকের সততা। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার যে দৃষ্টিকটু কাজটি এদেশের রাজনীতিবিদেরা সচরাচর করে আসছেন তাতে তিনি বিশ্বাস করেন না। হিল্লোলের জনপ্রিয় এক বক্তব্যের একাংশে তিনি বলেছিলেন, “লেখকরা যদি চাকরি-বাকরি করে বই লিখতে পারেন, গায়করা যদি চাকরি-ব্যবসা করে গান গাইতে পারেন, গান লিখতে পারেন, রাজনীতিবিদেরা কেন তা পারবেন না? আমরা তো পুলিশ ফোর্স নই যে এটা আমাদের চাকরি। শিল্পীদের মতো আমরাও সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি মাত্র। আমাদের কাজটিকে এর থেকে কম বা বেশি করে দেখার সুযোগ নেই। আমার পেশা রাজনীতি নয়, পেশায় আমি একজন সাধারণ সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার মাত্র। ভিডিও গেম বানিয়ে পেট চালাই।”
“সাধারণত সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের অফিসটি অবশ্যই অসাধারণ। একমাত্র বাংলাদেশি ভিডিও গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা-গেমস’ আন্তর্জাতিক মহলেও সাড়া ফেলেছে। তাদের একজন অফিসারের অফিস এমন হওয়াই মানানসই।
হিল্লোলের জনপ্রিয়তার পেছনে তৃতীয় যে কারণটাকে অনেক মনস্তত্তবিদ দেখে থাকবেন, তা অবশ্যই ভদ্রলোকের প্রেজেন্টেশন। সবসময় ঝাঁ চকচকে পোষাক পরে থাকেন তিনি। ফর্সা চেহারায় আভিজাত্যের একটা ভাব আছে, যার পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকেও যে কেউ বুঝতে পারবে এই মানুষটা গুরুত্বপূর্ণ। পুরু কাঁচের চশমাটি তার চেহারায় তারল্য আনতে পারতো, তবে ঘটেছে উল্টোটা। তাকে দেখে রাশভারি প্রফেসরও মনে হয় না, আবার একেবারে সস্তা কৌতুক পরিবেশন করার মতো ব্যক্তিত্বও যে তিনি নন তা বেশ বোঝা যায়। কিছু কিছু চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখকরা যেমন অদ্ভুত কিছু শব্দ গুচ্ছ যেমন ব্যবহার করেন, “তার অবয়ব থেকে ব্যক্তিত্বের ছটা যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিলো!”
এই মুহূর্তে শিয়া প্রবল ব্যক্তিত্বের ছটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রি-খ্যাত জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাটি উষ্ণ আর ঝলমলে হাসি হাসলেন, “বসুন, প্লিজ। হ্যাভ আ সিট!”
বিশাল ডেস্কের অপর প্রান্তে বসলো শিয়া। হিল্লোলের পেছনের দেওয়ালটা পুরোপুরি কাঁচের। ঠিক যেন তার প্রথম “অ্যাসাইনমেন্ট”-এর মন্ত্রিটির বাসভবনের মতো। নস্টালজিয়ায় হারিয়ে যাচ্ছিলো শিয়া, জোর করে বাস্তবে ফিরে এলো।
“তাসমিম তাবাসসুম শিয়া। আপনি তো ঢাকেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, আমার অনেক ইচ্ছে ছিল ওখানে পড়ার। আপনাদের প্রতি আমার ঈর্ষাটা বেশ প্রবল।” ‘ফাদার’ হিল্লোলের পড়াশোনা দেশের প্রখ্যাত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
“একসময় আমারও ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার।” মৃদু হেসে বলল শিয়া, “আপনি হয়তো এখন বলবেন নদীর এপাড় কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস-”
“ঠিক তাই, একদম তাই।” তর্জনী ঝাঁকিয়ে তাকে সমর্থ দিলো হিল্লোল।”আমি ভাবিনি আপনার সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হবে।” সত্য কথাটাই বলল সে। ভাইয়ার খাতা থেকে ‘ফাদার’ হিল্লোলের নাম আর ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার পাওয়ায় দারুণ চমকে গিয়েছিলো শিয়া। তার অফিসের নাম্বার খুঁজে বের করা সহজ ছিল। সহজ ছিল না সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আদায় করা। সুরেলাকণ্ঠি পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট তাকে প্রথমে না-ই করে দিয়েছিলো। ঘণ্টা খানেক পর মেয়েটি ফোন করে আবার জানিয়েছিলো, হিল্লোল স্যার দেখা করতে রাজি হয়েছেন। এটা একটা আশাব্যঞ্জক ফলাফল।
“আমার সেক্রেটারির কথায় কিছু মনে করবেন না।” ঝানু রাজনীতিবিদ ঠিক ধরে ফেললেন কি বলতে চাইছে শিয়া।”প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আমার সাথে দেখা করতে চান। প্রাথমিকভাবে সবাইকে না করে দেওয়ার জন্যই ওকে রাখা হয়েছে। তাই বলে যেন ভাববেন না আমি জনগণ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। আমার ওয়েবসাইটে পার্সোনাল মেইল করার অপশন রাখা আছে। যে কেউ আমাকে সেখানে মেইল করে রাখতে পারেন, চাইলে নাম পরিচয় গোপন করেও তারা যোগাযোগ করতে পারেন। এবং প্রতিদিন রাতে আমি একটা করে ঘণ্টা ঐ মেইল পড়ার কাজে দেই। কাজেই আমি জনগণের কথা শুনি, সবাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কেবল সামনাসামনি সবাইকে সময় দেওয়াটা সম্ভব যে নয় তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।”
শিয়া এমনিতেও কিছু মনে করেনি। একজন সেলেব্রিটি রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো এমনই হওয়ার কথা। চাইলেই তো আর যে কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারে না। তবে রাজনীতিবিদেরা সাধারণত এতো কৈফিয়তের ধার ধারেন না। ফাদার হিল্লোলের এই বিনীত ভঙ্গিটা ভালো লাগার মতো। শিয়া এখন জানে কেন এই দেশে তার এতো ভক্ত।
“ঠিক আছে, স্যার। আমি বুঝতে পেরেছি।”
“ব্যাখ্যাটা আপনাকে দিচ্ছি তার কারণও আছে, মিস শিয়া। আমি একটি দলের সমর্থনে রাজনীতি করি ঠিক, তাই বলে নেহায়েত অন্ধ নই। রাজনীতিতে যারা নেমেছেন তাদের কাছে সাধারণ মানুষ যেন সহজে যেতে পারে সেই দিকটা দেখা উচিত। বিরোধী দল তো বটেই, আমার নিজের সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছেও সাধারণ মানুষ কিন্তু সহজে ঘেঁষতে চান না। আগে দিন ছিল অন্যরকম। মানুষ মানুষের সঙ্গে আলাপ করতো হয় চিঠিতে নয়তো সামনাসামনি। সামনাসামনি সবার সঙ্গে দেখা করা এমনিতেও অসম্ভব, আর চিঠি তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন ইন্টারনেটের যুগ। চাইলে সবাই ঘরে বসে মুহূর্তের মধ্যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। এটা যদি আমরা ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে রাজনীতিতে কেন আনবো না? আমি হয়তো প্রথম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জনতার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি, তবে আশা করবো আমিই শেষ নই।”
ভ্রুজোড়া কুঁচকে যাওয়া থেকে অনেকটাই নিজেকে বাধ্য করে আটকে রাখলো শিয়া। ফাদার হিল্লোলকে এদেশি রাজনীতিবিদদের সবগুলো দোষ ধরতে না পারলেও একটা-দুটো তো ধরেছেই। যেকোনো বিষয়ের মধ্যে রাজনীতির প্রেক্ষাপট টেনে আনার এই দোষটা অবশ্য ক্ষমার যোগ্য, কারণ হিল্লোল ঠিক উগ্র নন এ বিষয়ে।
“প্রতিদিনের ভিজিটরদের লিস্ট সেক্রেটারি মেয়েটা আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। আপনার ব্যাপারটা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম আপনাকে যেন ইনভাইট করা হয়।”
বিস্মিত হলো শিয়া, “কেন?”
“শামসুর রহমানের বোন আপনি। আপনার ভাইয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে তা নিয়ে আমি খুব, খুব দুঃখিত প্রসঙ্গটা কিভাবে তুলবে তা নিয়ে খুব বেশি ভেবে আসেনি শিয়া। তবে কথা ওঠায় একরকম স্বস্তি অনুভব করলো সে।
“আপনারা একজন আরেকজনকে চিনতেন?”
“শামস একবার আমার অফিসে এসেছিলেন। বসেছিলেন ঠিক যেখানে আপনি বসেছেন।” উত্তরটা এভাবেই দিলো হিল্লোল, “আমার কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। অথচ এই একটা ক্ষেত্রে আমি সাহায্য করার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেলো।”
হিল্লোলকে দেখে বেশ ব্যথাতুর মনে হচ্ছে এখন। খুঁটিয়ে তার চেহারার প্রতিটা ভাঁজ লক্ষ্য করলো শিয়া। শঠতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না সেখানে। হয় তিনি প্রচলিত গল্পগুলোর মতোই পরিপাটী সৎ একজন মানুষ, নয়তো তুখোড় অভিনেতা।
“আপনার সঙ্গে তার দেখা করার উদ্দেশ্য কি ছিল তা কি ভাইয়া জানিয়েছে?”
এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়ার আশা করেনি শিয়া, তবে তাকে আরও একবার বিস্মিত করে দিয়ে উত্তরটা দিলেন ফাদার হিল্লোল, “শামস আমার কাছে এসেছিলো একটা অভিযোগ নিয়ে। আমাদের সংগঠনের কোনো এক ছাত্র নেতার প্রতি নাকি তার অভিযোগ। অভিযোগের স্বপক্ষে তার কাছে নাকি প্রমাণও ছিল।”
“প্রমাণ?”
“একটা ভিডিও ক্লিপ। আমি তার অভিযোগ একারণেই গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলাম। জনতার কাছে ওপেন থাকার একটা সমস্যা হলো প্রতিদিন আপনার কাছে কেউ না কেউ অভিযোগ তুলবে, আর সেই অভিযোগের তীর থাকবে আপনারই সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি। বেশিরভাগই ভুয়া অভিযোগ। তবে এমন নয় যে অভিযোগে সত্য হলে আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেই না। গত কয়েক মাসে অনেক নেতাকর্মী সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, এসব খবর বিরোধী দল ঘেঁষা সংবাদমাধ্যমগুলোতে খুব ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়। আমার প্রতি অনেকে অসন্তুষ্ট যে নন তেমনটাও নয়। তবে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করার শিক্ষা আমি নেইনি।”
“ক্লিপটা কি আপনি দেখেছেন?”
মাথা নাড়লেন ফাদার হিল্লোল, “তিনি সঙ্গে ওটা নিয়ে আসেননি। আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি প্রথমে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন আমাকে বিশ্বাস করা চলে কি না। এটা খুবই যুক্তিযুক্ত একটা আচরণ। আমি তার জায়গায় থাকলেও হয়তো এমনটাই করতাম।”
মাথা দোলালো শিয়াও। এমন একটা বিষয় নিয়ে ভাইয়া ঘাটাঘাটি করছিলো যেটা তার প্রাণের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিপদের সম্ভাবনা কতোখানি তা ভাইয়া ভালো করেই জানতো। এমন একটা পরিস্থিতি হ্যান্ডল করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা গ্রহণে তার কার্পণ্য করার কথা না। ভাইয়াকে শিয়া যতোটুকু চেনে তাতে সঙ্গে করে ভিডিও ক্লিপ না নিয়ে আসাই তার সঙ্গে যায়। এবং ক্ষমতাসীন একটি দলের ছাত্রনেতার নামে অভিযোগ করার জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ হতে পারতো এই জেনারেশনেরই একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তা নিয়ে আলোচনা করা। সৎ, দুর্নীতির প্রশ্নে আপোষহীন কারও সঙ্গে। যিনি নিজের দলের ভেতরের কারও দুর্নীতির প্রমাণ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেন তেমন কারও সঙ্গে–ফাদার হিল্লোলের মতো কারও সঙ্গে।
“তারপর?” জানতে চাইলো শিয়া।
মাথা নিচু করলেন হিল্লোল, ব্যথাতুর দৃষ্টিটা আবারও ফিরে এসেছে তার মুখমণ্ডলে।”তারপর আমি জানতে পারি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একটা ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটে গেছে।”
“আপনি পুলিশকে এটা জানাননি? ভাইয়া যে আপনার সঙ্গে এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসার পর খুন হয়ে গেলো, তা কি জানিয়েছিলেন তাদের?” অজান্তেই কর্কশ হয়ে উঠলো শিয়ার কন্ঠস্বর
“অবশ্যই। অবশ্যই জানিয়েছিলাম। ওদের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছি, থানায় গিয়ে দিয়ে এসেছি। এটা আমার দায়িত্ব বলেই মনে হয়েছিলো।” মুখ তুলে তাকালেন তিনি, “তবে এতে করে খুনিকে ধরার কোনো বিশেষ অগ্ৰগতি আনতে তারা পারেনি। কাজেই আমি ভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে স্টেট ইউনিভার্সিটির খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। সবখানেই আমার কম-বেশি প্রতিপত্তি আছে।”
“আপনার সোর্স কিছু জানাতে পারলো?”
দুই পাশে মাথা নাড়লেন হিল্লোল, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো একেকটা দুর্গ। এটা নিশ্চয় জানেন, ভাইস চ্যান্সেলরের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে এমনকি পুলিশের গাড়িও ঢুকতে পারে না? হলগুলো আরও দুর্ভেদ্য। ইনফরমেশনের ব্যাপারটাও অনেকটা তেমন। এমন না যে কিছুই শুনতে পাবেন না, প্রচুর গল্প শোনা যাবে। এর মধ্যে কতোটা সত্য আর কতোটা মিথ্যে তা বের করাই কঠিন। আমিও এমন কিছু গল্প শুনেছি।”
“সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ছিল কোন গল্পটা?”
“শামস আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যাপারটা তার বন্ধুদের কাউকে কাউকে জানিয়েছিলো নিশ্চয়। ওদের ক্যাম্পাসে বিষয়টা ছড়িয়ে যায়। বিরোধীদলের কিছু ছেলে তার থেকে ভিডিও ক্লিপটা কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো, আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারণার একটা বড় অস্ত্র হিসেবে এটা কিন্তু কাজ করতো। তবে শামস ঐ তথ্য রাজনৈতিক কোনো কারণে ব্যবহার করার পক্ষে ছিল না, সে চেয়েছিলো ন্যায়বিচার। কাজেই এটা নিয়ে বিরোধীদলের সঙ্গে তার একটা দ্বন্দ্ব লেগে যায়।”
“আপনি বিশ্বাস করছেন এমন একটা দ্বন্দ্ব থেকেই আমার ভাইকে খুন করে ফেলা হয়েছে?”
“আমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছি কেবল। বিরোধীদলের কাজ হোক বা আর কারও, আমার মনে হয় তারা ঐ ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করতে পারেনি।”
নাক কোঁচকালো শিয়া, “আর যদি কাজটা বিরোধী দলের না হয়? যদি স্টেট ইউনভার্সিটির কোনো সরকারপক্ষের ছাত্রনেতারই কাজ হয় ওটা? নিজের কুকাজ গোপন করতে আমার ভাইকে মেরে ফেলে তার থেকে ভিডিও ক্লিপ কেড়ে নিয়েছে, এমনটাই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে আমার।”
ভ্রু কুঁচকে গেছে হিল্লোলের, “আমাদের কেউ? না না, তা সম্ভব না।
“কেন?”
“অকাজ-কুকাজ করে ফেলার মতো নেতা-কর্মী যে আমাদের নেই তা কিন্তু বলছি না। তারা আছে। তবে তাদের প্রতিটা অকাজের বিবরণ আমাদের হাতে চলে আসে। আগে অথবা পরে। আপনার ভাইয়ের ঘটনাটা অনেক বড় একটা ঘটনা। এটা আমাদের কেউ ঘটালে ফাঁস হয়ে যেতো নিঃসন্দেহে।”
“কিভাবে? তারা তো চাইবে এটা যেন কেন্দ্রীয় কোনো নেতার কানে না যায়।”
হাসলেন হিল্লোল, “রাজনীতির ভেতরের নোংরামি আপনি হয়তো বিশদ জানেন না। বড় ধরণের অন্যায় হলে আমাদের কানে সেটা কিভাবে চলে আসে বলুন তো? অপরাধী নিশ্চয় বিবেকের দংশনে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের ফোন দিয়ে স্বীকারোক্তি দেয় না?”
“গোয়েন্দা বাহিনি?”
সশব্দে হাসলেন হিল্লোল, “প্লিজ! গোয়েন্দা বাহিনী পুষবো আমরা? যারা প্রতিটা সাংগঠনিক অফিসের খবর নেবে? এটা কি সম্ভব?”
“তাহলে আপনাদের কানে কিভাবে আসে?”
“অপরাধীর খুব কাছের বন্ধুই তা প্রতিবার ফাঁস করে দেয়। আমাদের দলের কর্মী কিংবা ভালো কোনো পদ না পাওয়া নেতারাই এসব করে থাকে। কোনো এক কর্মী দেখবেন আমার অফিসে ফোন করে তার বন্ধুর করা কুকর্মের বিস্তারিত বর্ণনা দিলো। এতে ঐ বন্ধু নেতাজী বহিষ্কৃত হবে সংগঠন থেকে। আর এদিকে সততার সঙ্কটে আমরা কাকে বেছে নেবো নেতৃত্বের জন্য? যে হিরোটি ফোন দিয়ে তারই নেতাকে ফাঁসিয়ে দিলো, তাকেই তো? মাঝ দিয়ে এরা নেতা-টেতা হয়ে যায়। অন্তত ভালো একটা পদ তো বাগাতে পারে। এটা তাদের লাভ, এটুকুর জন্যই নিজেদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বাঁধে না ওদের। বাঙালির জন্য আবার গুপ্তচর লাগে নাকি? এরা নিজেরাই নিজেদের কথা ফাঁস করায় ওস্তাদ। শোনেননি? বাঙালিদের নরকে দরজায় পাহারা থাকবে না।”
“এমন কি হতে পারে না, এবার যে কাজটা করেছে তার এমন কোনো বিশ্বাসঘাতক বন্ধু নেই?”
মাথা নাড়লেন রাজনীতিবিদ-কাম-সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, “হতেই পারে না। আমার পলিটিকাল ক্যারিয়ারের দুই দশকে এমন চরিত্রের দেখা একবারও পাইনি। ক্ষমতার লোভ যে কি ভয়ানক জিনিস তা আপনি জানেন না মিস শিয়া।”
“তবে অন্তত আপনি কনভিন্সড যে এই কাজটা আপনার দলের কেউ করেনি?”
“বাতাসে তেমন গন্ধই পাওয়া যাচ্ছে।”
“এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, স্যার। আপনার সময়ের জন্য ধন্যবাদ।” ওঠার উপক্রম করলো শিয়া, হাসলো একটু, “আপনি এতোটা ফ্রেন্ডলি হবেন, তা আশা করিনি। ভেবেছিলাম রাজনীতিবিদেরা গম্ভির হয়ে থাকেন।”
ডেস্ক ঘুরে এসে তার সঙ্গে হাত মেলালেন হিল্লোল, “কথা বলে ভালো লাগলো। আপনি এখানে সব সময়ই আমন্ত্রিত। আরও একবার, আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে আমি দুঃখিত। খুনিরা যেন ধরা পড়ে যেজন্য যা করা লাগবে আমি করবো, কথা দিচ্ছি।”
মাথা দোলালো শিয়া, “থ্যাংক ইউ, স্যার।“
দরজার কাছে প্রায় পৌছে গেছে ও, পেছন থেকে আরও একবার ডাক পড়লো, “মিস শিয়া?”
ঘুরে তাকালো ও, “ইয়েস?”
“ঐ মেমরি কার্ডটা যদি হাতে পান, আমার কাছে চলে আসবেন সরাসরি। ওটা থেকে হয়তো খুনিদের আইডেন্টিফাই করা যাবে। আপনাকে আমি সবরকমের সহযোগিতা করবো। উঁচুমহলে আমার চেনা অনেক লোক আছে। আপনি একা নন এটা মনে রাখবেন। আমি আছি।”
থমকে গেলো শিয়া, মেমরি কার্ড! ভাইয়া কি ক্লিপটা কিসের মাধ্যমে পেয়েছে তা জানিয়েছে? একটা ভিডিও পেন ড্রাইভে থাকতে পারে, পোর্টেবল হার্ডডিস্কে থাকতে পারে, গুগল ড্রাইভেও রেখে দেওয়া যায়। এতো থাকতে মেমরি কার্ডের কথা তিনি কেন বলতে গেলেন?
সন্দেহের লক্ষণ দেখালো না শিয়া, মাথা দোলালো কেবল, “শিওর।”
দরজা বন্ধের শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে একটা আইফোন বের করলেন ফাদার হিল্লোল। নির্দিষ্ট নাম্বারটা ফোন রিসিভ করেই বিনীত সালাম দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে হুঙ্কার দিলেন তিনি, “সালাম চোদায়ো না! শামসের বোনটা তোদের হোগায় লাইগা গেছে। বালের একটা কাম করছো আর সেইটার খেসারত দিতে হইতেছে আমারে। মাগি আমার অফিস পর্যন্ত এসে গেছিলো।”