অধ্যায় ৩৯
টেবিলে কফির মগটা নামিয়ে রাখলো শিয়া। আড়চোখে একবার দেখলো মুহিবকে। প্রথম দেখায় তাকে যেমনটা মনে হয়েছিলো সে ধারণা থেকে এরপরের প্রতি সাক্ষাতে সরে আসতে হয়েছে তাকে। যেদিন প্রথম এই ড্রইংরুমে পা পড়েছিলো তার, বাবার সঙ্গে আলাপ করতেই ব্যস্ত ছিল তখন সে। মানুষ হতাশায় গলা পর্যন্ত ডোবে, শিয়া তখন হতাশায় একেবারে চুলের টিকি পর্যন্ত ডুবে গেছে। ভাইয়ার মৃত্যু সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না, মেনে নেওয়ার মতো ব্যাপার তো ছিল না আর। তবে কেউ খুনিদের ব্যাপারে নিজে থেকে কিছু করার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়নি। সবাই ছেড়ে দিয়েছিলো ‘পুলিশের ওপর। পুলিশ খুনি গ্রেফতার করবে, তারপর সেই খুনিকে আদালতে উত্থাপন করা হবে, আদালতের রায় হয়, পাল্টা আপিল হবে, আর এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। এক একটা প্রক্রিয়ার মাঝে বছর থেকে যুগ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। এবং এতো কিছুর পরও খুনি বেকসুর খালাস হয়ে যেতে পারে। এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ইচ্ছে শিয়ার ছিল না। সে চাইছিলো একটা কিছু করতে। মুহিব সেই কিছুটা করার প্রথম ধাপ। অথচ তাকে স্রেফ একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে শিয়ার যোগাযোগ কলেজ জীবন থেকেই। ভাইয়াও তাদের সাথে ছিল। শামস প্রায় চার বছর তাদের সঙ্গে থাকে, অবশেষে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ছেড়ে দেয় পার্টি। ভাইয়ার একটা কথা এখনও কানে বাজে ওর। শামস বলেছিলো, “আমার ভিউপয়েন্টে বেশ কয়েকটা সমস্যা ছিল, বুঝলি? পার্টি ছেড়ে দিচ্ছি এমন কিছু সমস্যা সমাধানেই। ভার্সিটিতে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড যে, জাকির কথা তো বলেছি আগেও, ও আমার দর্শনই পাল্টে দিয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক রাস্তা নয়।”
শিয়া জানতে চেয়েছিলো পার্টি কি সেও ছেড়ে দেবে কি না। মাথা নেড়েছিলো শামস, “আমার দর্শন দিয়ে তো আর তোর জীবন চলবে না। তুই ওদের সাথে থাক। রাজনীতিটা বোঝ, পরে যদি কোনো উপলব্ধি হয় গোঁড়ামি না করে নিজের বুদ্ধি আর বিবেককে আগিয়ে রেখে সিদ্ধান্ত নিবি।
শামসভাই কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে ডানপন্থি কোনো দলে ঢুকে গেছিলো তাও না। বিষয়টা আশ্চর্যের, তিন তিনজন রুমমেট সক্রিয় সদস্য হওয়ার পরও সে ভার্সিটিতে রয়ে গেছিলো “নন-পলিটিকাল” ইমেজ নিয়ে। শিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলো, “ওদের পথটাও ঠিক সঠিক নয়। সিস্টেম চেঞ্জ করতে হলে তার ভেতরে থেকেই ঠিক করতে হয় আমি জানি, কিন্তু সবখানে যে গোড়াতেই গলদ রে।”
অসম্ভব ট্যালেন্টেড একটা মানুষ ছিল, দারুণ বিচক্ষণও। সেজন্যই হয়তো জাকিদের সঙ্গে মিলেছিলো ভালো। কিছু কিছু জায়গায় মতবিরোধ থাকলেও ওরা তো একই ছাঁচে গড়া। অতিসাধারণ, কিন্তু কি অসাধারণ!
মুহিবের মধ্যে এই বিষয়টা সে লক্ষ্য করেছে। একেবারেই গোবেচারা ধরণের একটা ছেলে, মিশলে মনে হয় গল্পের বই আর পড়ার বই ছাড়া আর কিছু পড়েনি কখনও। কিছু করেওনি, বড়জোর পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলেছে। ডালভাত জীবন যাকে বলে। এই ছেলে নিশ্চয় কোনো ছেলের সাথে মারামারিতেও জড়ায়নি। অথচ এই নিরীহদর্শন ছেলের ভেতরে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি আছে, নিজেকে দেখেই বোঝে শিয়া।
কয়েক মাস হয়েছে, পার্টি তাকে অনুশীলন সমিতির জন্য বাছাই করেছে। নিজের আগুনটাকে তখন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা শিখেছে সে, চিনেছে অন্যদের আগুন চিনতে। মুহিবের ভেতর আগুন আছে। সব সময় নিজেকে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলার কারণে যদিও তা খালি চোখে সব সময় ধরা পড়ে না।
“কি হয়েছে আজ তোমাদের?” ওদের সামনে একটা সোফায় বসে পড়ে জানতে চাইলো শিয়া, “নিজেদের মধ্যে নেই একজনও।”
সচকিত হয়ে কফির মগটা টেনে নিলো মুহিব, “লিটুকে ইন্ডিয়া নিয়ে গেলো আজ।”
“ওহ, তোমার ঐ বন্ধুটার ব্যাপারে আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত। এতো অল্প বয়সে এসব কেন হতে হবে আমি বুঝি না। আমার হিসাব মেলে না।” বিষণ্ন মুখে বলল শিয়া, “তোমরা এতো কিছুর পরও ভাইয়ার ব্যাপারে ভাবছো দেখে ধন্যবাদ। তবে চাইলে পরেও কাজটা করতে পারি আমরা।”
শিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা আগের চেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে ওদের। একে অপরকে আপনি থেকে তুমিতে নিয়ে এসেছে ওরা। এমনকি শামীমকে চমকে দিয়ে তাকে সে রাতে মারার জন্য দুঃখপ্রকাশও করেছে শিয়া। মুহিবকে তার নিষ্ক্রিয় ভূমিকার জন্য ক্ষমা করতে মাসখানেক মতো লাগলেও সেটা করতে পেরেছে! এই মুহূর্তে বাড়িতে কেউ নেই। রেগুলার চেকআপের জন্য মাকে নিয়ে বাইরে গেছেন বাবা। সময়টা এভাবেই ঠিক করেছে শিয়া, বাবা-মার উপস্থিতিতে সবকিছু নিয়ে কথা বলা যাবে না।
“না।” শামীম বলল, “আমরা এটা নিয়ে আজই কাজ শুরু করবো। তোমার জন্য বিষয়টা আরও কঠিন। শামসভাই তোমার আপন ভাই। কাজেই, তুমি রেডি থাকলে আমরাও রেডি। মেমরি কার্ড নিয়ে মুহিবের একটা থিওরি আছে। ওটা নিয়ে কথা বলার জন্যই এসেছি আমরা আজ।”
মাথা দোলালো মুহিব, “আমি এটাকে বলি ওয়াইল্ড হাঞ্চ। জেনে থাকবে, টুকটাক লেখালেখি করি আমি। আগামি বইমেলায় আমার একটা উপন্যাসও প্রকাশ পাচ্ছে লাইটহাউজ পাবলিকেশন্স থেকে।”
ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো শামীম, “লাইটহাউজ! ওরা তো নামকরা প্রকাশনী! উপন্যাস বের করে ফেলবে তোর, আমাকে আগে জানাসনি তো!”
হাত উড়িয়ে তার কথাটা উড়িয়ে দিলো যেন মুহিব, “আমি জেনেছি কয়েকদিন হলো। চারপাশে যা চলছে এর মধ্যে এটা নিয়ে আলাদা উচ্ছ্বাস দেখানো যায় নাকি? প্রসঙ্গে ফিরে আসি। শিয়া, যেটা বলছিলাম, আমি ওয়াইল্ড হাঞ্চের ক্ষেত্রে জানা তথ্যগুলোকে সাজিয়ে নেই। সেখান থেকে অজানা ঘটনাগুলোর একটিমাত্র সংস্করণ আলাদা করে লিখে ফেলি, যেটা সবচেয়ে যৌক্তিক। এমনটা আমাদের তদন্তে এর আগেও কাজে এসেছে। তূর্ণা আপুর কথা বলেছিলাম না? তাকে যথেষ্ট চমকে দিতে পেরেছি আমরা প্রথম সাক্ষাতেই, অথচ ঐ মুহূর্তে আমরা কিচ্ছু জানতাম না। সবই আন্দাজে বলতে হয়েছে, আমার ওয়াইল্ড হাঞ্চের ওপর ভিত্তি করে। সেখান থেকে জাকি গ্রুপের টনক নড়তে তো তুমি নিজ চোখেই দেখলে। আমি এখানে একই পদ্ধতি আবারও প্রয়োগ করতে চাইছি।”
“ওকে।” এতোটুকুই বলল শিয়া, প্রক্রিয়াটা একবার বলাতেই বুঝতে পেরেছে।
“প্রথমে, আমরা কি কি জানি?” একটা নোটবুক বের করে শিয়ার দিকে নির্দিষ্ট পাতাটা খুলে ঠেলে দিলো সে, “তোফায়েল প্রথম বর্ষেই ক্যাফেটেরিয়ায় জাকির গায়ে হাত তোলে। দুই বছর পর একদিন মাতাল হয়ে জাকি তার দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে বের হয় এর প্রতিশোধ নিতে। তোফায়েলকে বেশ জখম করে তারা, তারপর নেশা কেটে যেতে থাকলে প্যানিকড হয়ে বিষয়টাকে ছিনতাইয়ের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। মোবাইল মানিব্যাগ নিয়ে ওরা চলে আসে নিজেদের রুমে। সেখানে ছিল চতুর্থ রুমমেট শামস। অনেকদিন ধরেই তার ফোনে মেমরি কার্ড ছিল না। রুমমেটরা মেমরি কার্ডটা ফেলবে না রেখে দেবে তা নিয়ে আলোচনা করছে যখন, সে ওটা চেয়ে বসলো। পরবর্তিতে শামসভাই মেমরি কার্ডটায় এমন কিছু আবিষ্কার করলেন যা খুবই সেনসিটিভ। হয়তো তোফায়েলের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেওয়ার মতো কিছু। হয়তো তোফায়েল এখানে কোনো ইস্যুই না, হয়তো সংগঠনের ভাবমূর্তি চরমভাবে মুখ থুবড়ে পড়বে এমন কিছু সেখানে ছিল। যেহেতু ঐ মেমরি কার্ড আমাদের কাছে নেই আমরা সেটা জানতে পারবো না।”
কফিতে চুমুক দেওয়ার জন্য একটু থামলো মুহিব। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে অনেকটাই।
“ফ্যাক্টসে আসি, শামসভাই সেন্সিটিভ একটা মেমরি কার্ড হাতে পেলেন। কিন্তু তিনি এ নিয়ে রুমমেটদের সাথেও আলোচনা করলেন না। অন্য কোনো চ্যানেল দিয়ে চেষ্টা করছিলেন নিশ্চয়। খাদ্যমন্ত্রির সাথে আপনাদের আত্মিয়তার সম্পর্ক আছে?”
মাথা দোলালো শিয়া, “বড়দাদা বলে ডাকি আমরা উনাকে। আমার দাদার কাজিন হন সম্পর্কে। বড়দাদা খুব ক্ষেপে আছেন এই ঘটনার কারণে, তবে ক্ষমতা তেমন প্রয়োগ করতে পারছেন তাও না। তিনি বিরোধী দলের হয়ে রাজনীতি করেন।”
এই তথ্যটা মুহিবের জানা আছে। মন্ত্রির নাতি খুন হলেই যে পুলিশ বাহিনি ছুটে দ্রুত তদন্ত করবে তা সব সময় সত্য নাও হতে পারে, এই ঘটনা থেকে এই দিকে দৃষ্টি খুলেছে ওদের।
“সেক্ষেত্রে উনি বাদ। আমার ওয়াইল্ড হাঞ্চ অনুসারে শামসভাই সরকারি দলের কোনো নেতার সঙ্গে মিটিং করেছিলেন কিংবা করার চেষ্টা করেছিলেন।”
“এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”
“রেদোয়ান সেই রাতে একটা কথা বলেছিলো।” মৃত ব্যক্তির বোনের সামনে তার ভাইয়ের মৃত্যুকালীন স্মৃতি মনে করা কেমন অস্বস্তির কাজ মুহিব হাড়ে হাড়ে টের পেলো, “ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার কথা। এর অর্থ একটাই হতে পারে। তাদের সংগঠনের সিনিয়র কারও সঙ্গে কনসাল্ট করার চেষ্টা করেছিলেন শামসভাই।”
মাথা দোলালো শিয়া, “মেমরি কার্ডের কন্টেন্ট নিয়ে?”
“অবশ্যই। বিবাদ যেহেতু ওটা নিয়েই। কিন্তু সংগঠনের বিষয় তো জানো, একজনের সাথে গোপনে আলাপ হলেও তা সব সময় গোপন থাকে না। শামসভাই রাঘব বোয়ালদের সাথে যোগাযোগ করছেন, তা কোনোভাবে তোফায়েলরা জেনে ফেলে। কাজেই, তারা নিজেদের চামড়া বাঁচানোর জন্য যা করার করে।”
শামীম এবার গলা মেলালো, “প্রথমে তারা নির্ঝরের গাড়ি দেখে নিশ্চিত হয় কাজটা কাদের। তারপর নির্ঝরকে তুলে নিয়ে যায় – কাজটা সহজ ছিল। নির্ঝরকে হারিয়ে জাকি যখন দিশেহারা, তোফায়েল তাকে নিজের ডেরায় ডেকে নেয়। তারপর কৌশলে নিশ্চিত হয় জাকি কতোটুকু জানে।”
“অ্যাপারেন্টলি,” নিজের নিয়ন্ত্রণে গল্পটাকে নিয়ে এলো মুহিব, “জাকি কিছুই জানতো না। কাজেই খুব সহজেই কাজটা উদ্ধার করে ফেলে সে। জাকিকে অজ্ঞান করে তার আঙুলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে ফোন আনলক করে শামসভাইকে মেসেজ পাঠায়। নির্ঝর ভাই যে উধাও তা শামসভাইও জানতেন, জাকি ভাইয়ের ইমার্জেন্সি মেসেজ পেয়ে একদমই অবাক হওয়ার কথা না তার। তবে তিনি জানতেন না মেশিন শপের পেছনে জাকি ভাই থাকবে না। সেখানে অপেক্ষা করবে তোফায়েলের গ্রুপ।”
কফির মগে আরেকবার লম্বা চুমুক দিলো মুহিব। বলতে শুরু করলো তারপর, “কাজেই, শামসভাই আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। জাকি ভাই সঙ্গে থাকলে চিন্তার কিছু থাকেও না আসলে। একাকি ওখানে পৌছে তবেই বুঝতে পারলেন একটা ফাঁদে পা দিয়েছেন।”
“পয়েন্টটা কি তোমার?” প্রায় ধমকে উঠলো শিয়া।
সেই রাত নিয়ে আলোচনা হলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না তার, এটা মুহিব লক্ষ্য করেছে। অল্পতেই ধৈর্য হারায়, রেগে ওঠে। এটা স্বাভাবিক, মুহিব চেষ্টা করলো দ্রুত তার কথা শেষ করতে।
“এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি কি করতাম? আমার সাথে আছে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ডেয়ারিং ছেলে জাকি। কাজেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে আমার চিন্তা নেই। আমার চিন্তা দুটো : নির্ঝর এবং মেমরি কার্ড। নির্ঝরের সঙ্গে তোফায়েল গ্রুপের সমস্যা নেই। অর্থাৎ তাকে ব্যবহার করে জাকিকে চাপ দিলেও একই সংগঠনের সদস্য হওয়ার সুবাদে সত্যিকারের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। বাকি থাকলো কি? মেমরি কার্ড। একমাত্র ভালনারেবল সাবজেক্ট!”
“মুহিব বলতে চাইছে শামসভাই মেশিন শপে সেদিন গেছিলেন ঠিকই,” শামীমের মতো ড্রামা কিং-ও এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, “কিন্তু মেমরি কার্ড ছাড়াই!”