1 of 2

কুকুরদল – ২৭

অধ্যায় ২৭

শুন্য রাস্তায় দু-হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলো শামীম। উদগত হাইটা চেপে রাখতে পরিশ্রম করতে হলো তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে সামান্য পেছনে তাকিয়ে বন্ধুকে দেখলো, মোবাইলে কি যেন টাইপ করতে করতে সিগারেট টানছে মুহিব। শামীমকে ঘুরে তাকাতে দেখে সামান্য হাসলো। গতি বাড়িয়ে তাকে ধরে ফেললো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।

“ইলোরাকে জানিয়ে রাখলাম আমরা কোথায় আছি।” সিগারেটটা বন্ধুর হাতে তুলে দিলো সে, “জায়গাটা আমার কাছে খুব একটা সুবিধের মনে হচ্ছে না।”

হলদে আলো চারপাশে, তার মধ্যে নিঃসঙ্গ পতাকার মতো দুলছে এক হলুদ ব্যানার।”সুন্দর ও দ্রুত হাতের লেখা, ছবি আঁকা” লেখা একটা বড় হলুদ ব্যানার। রাস্তাঘাটে একটা মানুষও নেই, অথচ রাত খুব বেশি হয়েছে এমন না। সাড়ে বারোটা বাজে। ঢাকা শহরের জন্য এটা তেমন কোনো রাতই নয়। বড় একটা মিষ্টির দোকান কাছেই, তবে বন্ধ। প্রায় সবগুলো দোকানই বন্ধ এদিকে। দূরে একটা মুদির দোকান খোলা দেখা যাচ্ছে। ঢাকার সবখানে যেখানে প্রাণচাঞ্চল্য,পূর্ব নয়াপাড়ায় এমন নিস্তব্ধতা থাকবে কেন?

“তুই শিওর শামসভাইয়ের বোন এখানে দেখা করতে বলেছিলো?”

মাথা দোলালো মুহিব, “শতভাগ।”

“বয়স কেমন মেয়েটার?”

কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “আমাদের ব্যাচের

“এই বয়সী একটা মেয়ে এতো রাতে এমন নির্জন একটা জায়গায় দেখা করতে চেয়েছে? তুই কি ওর সাথে কথা বলেছিস ফোনে? নাকি টেক্সট পেয়ে চলে এসেছিস?”

সঙ্গির প্রশ্নবাণে কিছুটা বিরক্ত দেখায় মুহিবকে, “আমাকে কি তোর বলদ মনে হয়? কথা হয়েছে। এটা কোনো ফাঁদ না।”

ওরা আজ সারাদিন যমুনা ফিউচার পার্কে ক্যাম্পেইন করেছে। টাকা ভালোই উঠেছে। একদিনে তিন লাখ তুলে ফেলেছে ওদের বিশ জনের স্বেচ্ছাসেবী দলটা। কর্তৃপক্ষ ওদের একদিনের জন্য ফান্ড রেইজিং পারমিশন দিয়েছিলো, সুযোগটার ব্যবহার তারা সর্বোচ্চভাবে করার চেষ্টা করেছে। রোজ রোজ কাগজের ঠোঙা নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের চারপাশে এবং ভেতরে ঘোরাফেরা করার অনুমতি মিলবে না। সঙ্গত কারণেই প্রবল ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। তবে শরীরের নিষেধ না মেনে ওরা এই রাতে এখানে, বিছানায় নয়।

মুহিবের ফোনে আলো জ্বলে উঠলো। একটা ইনকামিং কল। একবার ডিসপ্লে দেখে কলটা রিসিভ করলো ও, “হ্যালো।”

“ডানে তাকান।” শিয়ার পরিচিত কণ্ঠটা কানে এলো স্পষ্টভাবে।

সেদিকে তাকাতেই মেয়েটিকে দেখতে পেলো ওরা। ডানদিকে চলে গেছে একটা সরু গলি। তার মাঝামাঝি কটকটে হলুদ ফতুয়া পরে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী অবয়ব। শুন্য রাস্তা, একাকি নারীর ছায়া সব মিলিয়ে কেমন যেন অতিপ্রাকৃত এক আবহ তৈরি করেছে দৃশ্যটি। শামীমের মেরুদণ্ড শিরশির করে উঠলো। মুহিবের অবশ্য কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সঙ্গিকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যাচ্ছে সে। অগত্যা লম্বা পায়ে বন্ধুর পাশে চলে এলো শামীমও

“কাজের কথায় আসি।” ওরা পৌঁছে যেতে যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল শিয়া, “আপনাদের তথ্য অনুসারে আমার ভাইকে খুন করেছে যে তার নাম রেদোয়ান, সরকারি ছাত্রদলের পদ অধিষ্ঠিত নেতা। ঠিক কি না?”

“ঠিক।” নিষ্কম্প কণ্ঠে বলল মুহিব।

“আপনি কতোভাগ নিশ্চিত?”

এক সেকেন্ড ভাবলো মুহিব, শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত যেন। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই অবশ্য ভেবেছে সে, তবুও দ্বিধাবোধ হলো। সামান্য ঝাঁকালো কাঁধ, যেন পুরোনো কোনো ক্ষতের আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে চাইছে।

“আমি ওখানে ছিলাম।” নিচু গলায় অবশেষে স্বীকার করলো সে, “শামসভাইকে ওরা যখন মেরে ফেললো, আমি ওখানেই ছিলাম। ব্যাপারটা আমি নিজের চোখে ঘটতে দেখেছি।”

শিয়ার মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তন হলো দেখার মতো। শক্ত কঠিন মুখটা থেকে প্রথমেই সরে গেলো বিশ্বাসের যতো ছাপ। যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়েছে মেয়েটি। পরক্ষণেই জ্বলে উঠলো চোখ, নতুন আগুনে। এই আগুন ক্রোধের।

ছিটকে সামনে এসে মুহিবের কলার চেপে ধরলো শিয়া, “হোয়াট?”

তাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো মুহিব, বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য চট করে সামনে এগিয়ে এলো শামীম। পরমুহূর্তে যা ঘটলো তা প্রত্যক্ষ করার জন্য ওদের দু’জনের কেউ প্রস্তুত ছিল না।

মুহিবের কলার ধরে রেখেই বাম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো শিয়া। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে দিয়েছে ডান পায়ের হিল। নিখুঁত এক বৃত্তচাপ এঁকে শক্ত নর্থসাইড ফ্রস্টি স্নো বুটটা দড়াম করে আছড়ে পড়লো শামীমের বুকে।

শামীমের প্রথম অনুভূতিটা হলো বায়ুশুন্যতার। এক মুহূর্ত আগেই জীবন ধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় যে বস্তুটার উপস্থিতি সে টের পায়নি, এই মুহূর্তে তার অভাব প্রচণ্ডভাবে বোধ করতে শুরু করেছে ফুসফুস। সামান্য কিছুক্ষণ পর আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো সে। আঘাতের প্রচণ্ডতায় ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেছে প্রতিটি কণা বাতাস। তবে উপলব্ধিটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পিঠের কাছে তীক্ষ্ণ এক যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার দেখলো সে। আর কিছু বোঝার আগে লক্ষ্য করলো রাস্তা উঠে এসে ওর হাতের সাথে লেপ্টে গেছে। এতোক্ষণ পর এলো ব্যথাটা। পাজরের কাছ থেকে সুতীক্ষ্ণ এক ব্যথার অনুভূতি যেন সটান উঠে গেলো মস্তিষ্কের দিকে।

মুহিব কেবল দেখলো শিয়ার ভয়ানক লাথিতে শামীমের শরীরটা খেলনা পুতুলের মতো ছিটকে পেছনের বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে পিঠের ওপর ভর দিয়ে বাড়ি খেলো, তারপর ছুঁড়ে মারা কলার খোসার মতোই ধপ করে আছড়ে পড়লো সে রাস্তায়। এর পর নিজেকে শুন্যে আবিষ্কার করলো সে। ভাতৃহত্যার শিকার মেয়েটি দু-হাতে তার কলার ধরে একরকম ছুঁড়ে মেরেছে তাকে! আর কিছু ভাবার সময় হলো না, নিজেকেও শামীমের মতো রাস্তায় আবিষ্কার করলো সে। চোখের সামনে পরিস্কার দেখতে পেলো হেঁটে চলা পিঁপড়েদের একটা লাইন আস্ত মানুষের পতনের সঙ্গে এলোমেলো হয়ে গেছে। ছোটাছুটি করে তারা লাইনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে।

মুখ তোলার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে মাথার তালুতে ধাতব কিছুর স্পর্ষ টের পেলো সে। ঝুঁকিটা নিয়ে ওপরে তাকালো মুহিব।

শ্যামা সুন্দরি মেয়েটির নাকের ফুটো দুটো চোখে পড়ার মতো ফুলে উঠেছে। শরীরের সবটুকু শক্তি খাটিয়ে শ্বাস নিচ্ছে সে। দুই দুইজন যুবককে মার্শাল আর্টের সাহায্যে শুইয়ে ফেলার ক্লান্তিতে, না প্রবল ক্রোধে? হাতের দিকে চোখ পড়তে মুহিব উত্তরটা পেয়ে গেলো, পরিশ্রম এর পেছনে দায়ি নয়। নাক বোঁচা কুৎসিত চেহারার এক রিভলভারটা সরাসরি ওর কপালে চেপে বসেছে। শিয়ার আঙুলগুলো শক্ত হচ্ছে ট্রিগারের ওপর।

চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিব। আশ্চর্যের বিষয়, জীবনের শেষ মুহূর্তে স্মৃতিগুলো সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো না তার। পাঁপড়ি নেমে আসতে চোখে পড়লো কেবল সেই চিরায়ত অন্ধকার, যে কোনো সময় চোখ বন্ধ করলে যেমনটা দেখা যায়।

শুধুই অন্ধকার।

*

রেলক্রসিং ধরে একটু ভেতরে রেললাইনের ওপর বসে আছে ওরা দু’জন। শামীম পাঁজরের ওপর ধরে আছে আইসিক্রিমের একটা বাটি। মুহিব এখনও কপাল ডলছে। ওখানেই শক্ত করে চেপে বসেছিলো রিভলভারের নল।

ওদের সামনে লাইন থেকে সামান্য নিচে এক পায়ের ওপর ভর দিয়ে অন্য পা একশ মিটার স্প্রিন্টের প্রস্তুতির মতো করে সামনে বাড়িয়ে রাখা মেয়েটির দিকেই বিস্মিত দৃষ্টি। টাইট জিন্স আর নর্থসাইড বুটে সুগঠিত পাজোড়া এই অন্ধকারেও ফুটে উঠেছে অন্যরকম আকর্ষণ নিয়ে। রিভলভারটা এখন দেখা যাচ্ছে না। কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে হয়তো, মেয়েদের লুকানোর অনেক জায়গা থাকে।

“এখন আমরা কি করবো?” দীর্ঘ নীরবতাটা ভাঙলো মুহিব।

“খানকির পোলারে খুন করে ফেলবো!” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শিয়া, “আমি আগেও আপনাকে বলেছিলাম, কারা কাজটা করেছে তা জানতে পারলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাবেন। আমার আদালতের জন্য বসে থাকার ইচ্ছে নেই। নাকি ঐ মোটা মাথাটা দিয়ে এতোটুকু বুঝতে পারেননি?”

মুহিব এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। এখনও ওর মোটা মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। সেদিন এই মেয়েকে ফোন করে রেদোয়ানের নাম বলে দেওয়া কতোটা যুক্তিপূর্ণ কাজ হয়েছে তা ভেবে দেখলো। একদমই যুক্তিসঙ্গত হয়নি।

“কাজটা ওরা কেন করেছে? আমার ভাই কি ক্ষতি করেছিলো তাদের?” এবার শামীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো মেয়েটা।

মাথা নাড়লো শামীম। কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও শক্তি পাচ্ছে না। বুক চিনচিন করছে। পাঁজড়ের একটা হাড়ে হলেও চিড় ধরেছে হয়তো। এরকম আঘাতের পর চিড় ধরার অধিকার পাঁজরের হাড় রাখে।

“আমরা জানি না এখনও।” শামীমের মাথা নড়ানোর অনুবাদ ভাষায় করলো মুহিব।

“ফাক ইউ!” ধমকে উঠলো শিয়া, “বালটা ছিঁড়েছো এতোদিন ওখানে বসে? একটা মার্ডারের উইটনেস হয়েছো, সেইটার পেছনের কারণটাও বের করতে পারো নাই!”

“আমরা চেষ্টা করছি…”

“বালটা করছো!” আরেকবার ধমকে উঠলো শিয়া।

মাথা নিচু করে স্বল্পপরিচিত মেয়েটির গালাগাল হজম করলো মুহিব।”কারণটা আমাকে জানা লাগবে।” ক্লান্ত ভঙ্গিতে ওদের পাশে রেল লাইনের পাশে বসে পড়তে পড়তে বলল শিয়া, “আমাকে জানতেই হবে।”

এবার মাথা দোলালো শামীম। সম্মতিসূচক ইঙ্গিত। তার দিকে ফিরেও তাকালো না মেয়েটা। মুহিব কপালের ঘাম মুছলো কেবল।

“আমি আপনাদের ইউনিভার্সিটিতে আসছি। এই সপ্তাহেই আসছি।” শিয়ার গলা এখন অনেকটাই নরোম। তুমি থেকে আপনিতে উঠে এসেছে সম্বোধন। সম্ভবত প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে একটা হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে না পারার যৌক্তিকতাটা তার মগজে এতোক্ষণে ঢুকেছে।

“আপনি কষ্ট করে আসবেন তার দরকার পড়বে না। আমরা কারণটা বের করবো।” থেমে থেমে উচ্চারণ করে শামীম বলল।

“আমার কি দরকার আর কি দরকার না তা নিয়ে জ্ঞান দেবেন না। এরকম লোক আমার খুব অপছন্দের। আপনাদের ক্যাম্পাসে যাওয়াটা আমার খুবই দরকার। আমার ভাইয়ের সাথে কি ঘটেছে তার তলা খুঁড়ে আমি বের করে আনবো। এই কাজ আমি এক মাসের মধ্যেই করে দেখাবো।”

শিয়ার কথার প্রতিবাদ করার সাহস উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলীর মধ্যে কারোই ছিল না।

“যে নাম্বারে ফোন করে ঐ কথাটা বলতে বলেছিলেন সেটাই কি রেদোয়ানের নাম্বার? “

মাথা নিচু করেই উত্তর দিলো মুহিব, “না, তার বন্ধু তোফায়েলের, রেদোয়ান যে কাজটার সাথে জড়িত তা সে জানে।”

“গুড। রেদোয়ানের নাম্বারটা সেভ করা আছে? থাকলে এখনই দেবেন।” মোবাইল বের করলো মেয়েটা

আইসক্রিমের বাটি নামিয়ে রেখে নিজের ফোন অন করে নাম্বারটা বলল শামীম।

“গ্রেট। ঐ কথাটার অর্থ কি ছিল?”

মুহিব চোখ তুলে তাকাতে পারছে না, “রেদোয়ান ওটা বলেছিলো ক্রাইম সিনে।”

অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শিয়া, “আর আপনি আমাকে সেই বাক্যটা বলতে বাধ্য করেছেন?”

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো মুহিব। একটু হেঁটে গিয়ে শিয়ার মুখোমুখি থামলো।

“আপনার জন্য কাজটা কঠিন হবে আমি জানি। কিন্তু সত্যটা বের করতে হলে আপনার সহযোগিতা আমাদের দরকার। আপনিও জানেন সত্যটা জানা আপনার ব্যক্তিগত কারণে কতোটা প্রয়োজন। এই কাজে আমরা বেশি মানুষ নিয়ে নামতে পারবো না। পুরো ব্যাপারটা জানে কেবল চারজন মানুষ।”

“আরেকজন কে?”

“আমাদের এক বান্ধবি।”

“তাকে দিয়েও আপনারা ফোন করাতে পারতেন। আপনাদের আইডেন্টিটি ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না। আমাকে কেন ব্যবহার করলেন?”

“প্রথমত, আমার মনে হয়েছে আপনি আমাদের কাজটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চাইবেন। আপনাকে ছাড়াই যদি আমরা সবটা করে ফেলি, মানসিক শান্তি পাবেন না। তাই আপনার জন্য সুইটেবল কাজগুলো আপনাকেই করতে দেবো।”

মুখ বাঁকালো, “হাল্কা পাতলা কাজগুলো, তাই তো? যেমন একজন মাদারচোতকে ফোন করে একটা বাক্য উচ্চারণ করে ফোন রেখে দেওয়া। যাকগে, প্রথমত দিয়ে কারণ ব্যাখ্যা যখন করেছেন, দ্বিতীয়ত কি?”

“দ্বিতীয়ত,” ঢোক গিললো মুহিব, “আমাদের বান্ধবি খুনির বন্ধু তোফায়েলের গার্লফ্রেন্ড। তার গলা সে অবশ্যই চিনে ফেলবে।”

মুহিবের পায়ে লাথি মারতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলো শিয়া, “ইউ ফাকস! তোমাদের সাথে তোফায়েলের সম্পর্ক দেখি খুবই কাছের। আমার সাথে তোমরা দেখা করতে আসো কোন সাহসে!”

আইসক্রিমের বাটিটা ফেলে দিয়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়ালো শামীমও, “কারণ, আমরা চাইছি এখন তোফায়েলের কাছে ঘেঁষতে। ইলোরা খুব বেশি জানে না। তোফায়েলের জড়িত থাকার ব্যাপারটা তাকে আমরা একেবারেই জানতে দেইনি। কারণ, হারামজাদার সাথে আমাদের যোগাযোগের একটা চ্যানেল থাকলে পরে কাজে আসতে পারে। সেই চ্যানেল হলো আমাদের বান্ধবি। একটু থেমে যোগ করলো সে, “আপনি কি বুঝতে পারছেন, শামসভাইয়ের কেসটা আমরা কতোটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি? আমাদের প্রিয় একজন মানুষকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছি এখানে আমরা।”

“এক মুহূর্ত ওদের দুইজনের দিকেই তাকিয়ে থাকলো শিয়া। তারপর লাইন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে-ও। রাস্তার দিকে হেঁটে চললো কোনো কথা না বলে। বোকার মতো তার পেছন পেছন হাঁটতে হলো দুই বন্ধুকে।

রাস্তায় উঠে এসে একবার থামলো সে, বুকে হাত বেঁধে ওদের দিকে ফিরলো।

“আমরা এখন বিদায় নেবো। কয়েকদিনের মধ্যেই আপনাকে আমি ফোন দিচ্ছি।” মুহিবকে উদ্দেশ্য করে বলল শিয়া, “আপনাদের শহরে যাচ্ছি আমি 1 তার আগ পর্যন্ত, ফোন কলের দরকার পড়লে জানাবেন।”

“আমাদের আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার ছিল।” তাড়াতাড়ি বলল শামীম, “হারামজাদাদের আমরা ব্ল্যাকমেইল করতে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে একটা নিশ্ছিদ্র প্ল্যানের দরকার আছে। আমরা বসতাম, তবে ভাবলাম আপনাকে নিয়ে বসাটা উচিত। সেজন্যই মূলতঃ আজকে দেখা করার সময় আমাকে নিয়ে এসেছে মুহিব।”

বাঁ হাতের মাঝের আঙুলটা তুলে ওদের দেখিয়ে দিলো শিয়া, “আপনাদের খেলাধূলোর মাঝে আমি নেই। কি বালছালের পরিকল্পনা করতে চান তা নিজেরা সারুন। আমি যখন আসবো তখন আপনাদের ড্রাইভিং সিট থেকে নামিয়ে দেবো। আমার নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা আছে। আমার মনে হয় না ব্ল্যাকমেইলের টোপ ফেলে আপনারা কিছু উদ্ধার করতে পারবেন। ওসব বাদ দিন।”

এই মুহূর্তে নৈরাশ্যবাদীর এক মূর্তমান প্রতিমা যেন মৃত শামসের ছোটোবোন। শামীম কিছু একটা বলতে চাইছিলো, তবে তাকে চোখের ইশারায় নিষেধ করে দিলো মুহিব। আজকে একদিনের জন্য যথেষ্ট ধাক্কা দেওয়া হয়েছে মেয়েটাকে। এ নিয়ে পরে কথা বললে ভালো কিছু আসতে পারে, তবে এখন গুঁতোগুঁতি করলে ক্ষতি ছাড়া লাভের সম্ভাবনা কম

শিয়া এরই মধ্যে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা হ্যান্ডশেক নয়, বিদায় সম্ভাষণ নয়। ওদের ওপর প্রচণ্ড রেগে আছে মেয়েটি, খুব সম্ভব। ফেরার সময় চুপচাপ হাঁটলো ওরাও। মাঝে মাঝে বুক ডলছে শামীম।

মেইন রোডে উঠে মুহিব বলল, “এবার মনে পড়েছে। পূর্ব নয়াপাড়া রেল ক্রসিং।”

“সেখানে কি?” বিভ্রান্ত হয়ে গেলো শামীম।

“আমরা ওখানেই ছিলাম একটু আগে। ওদিকটা রাতে বেশ চুপচাপ হয়ে যায়। হন্টেড মিথ আছে ঐ রেলক্রসিং নিয়ে। রাতে নাকি কোন অশরীরি নারীমূর্তি দেখা যায় সেখানে।”

“থাক। আর নারীমূর্তি দেখে কাজ নাই।” গোমড়া মুখে বলল শামীম পাঁজর ডলছে এখনও। হেসে ফেললো মুহিব।

“মেয়েটাকে জাজ করিস না। আমি যদি শুনতাম আমার ভাইকে জবাই করার সময় কাছেই কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো, ওকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করছিলো না, তাকে হয়তো মেরেই ফেলতাম। এধরণের তথ্য হজম করা খুব কঠিন হওয়া স্বাভাবিক। আমি বা আমরা অনুভব করতে পারবো না রে। আমাদের তো কেউ খুন হয়ে যায়নি।”

“শামসভাই আমাদের ক্যাম্পাসেরই বড়ভাই।” মনে করিয়ে দিলো শামীম

“কিন্তু পরিবারের কেউ তো না।”

মুহিব কি বোঝাতে চেয়েছে তা ধরতে পারলো শামীম, “তা ঠিক।“

বন্ধুর একটা হাত নিজের কাঁধের ওপর তুলে নিলো মুহিব, “আমার ওপর ভর চাপিয়ে দে খানিকটা। তোর পাঁজর মনে হয় ফেটেছে। কালকে এক্সরে করতে হবে।”

অন্য সময়ের মতো প্রতিবাদ করলো না শামীম। ব্যথায় এখনও চোখে অন্ধকার দেখছে সে। বিড়বিড় করে বলল, “যাই বলিস না কেন, লাথিটা বেড়ে কষেছে। কপাল খারাপ যে এখানে ভিক্টিম আমি নিজেই। দর্শনীয় এক লাথি ছিল মনে হলো।”

এক মুহূর্ত পর শুন্য রাস্তা কাঁপিয়ে হাহা করে হেসে উঠলো ওরা দুইজনই। সিটি কর্পোরেশনের এক মহিলা রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছিলো। ওদের হাসির শব্দে বিরক্ত হলো খুব। মাতাল ভেবেই ঘাঁটালো না খুব সম্ভব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *