অধ্যায় ২৬
ফোনটা যখন আসে, রেদোয়ান তখন পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে। মাজহার ভাই চেয়েছিলেন আজকের সভায় তার উপস্থিতি থাকুক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় মূল্যায়ন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে সেখানে। এইধরণের সভাগুলো মূলতঃ কর্মিদের লাগাম কতোটুকু টানা হবে আর কতোটুকু ছাড়া হবে তারই নির্ধারক। গত কয়েকমাসে সংগঠনের নাম ডোবাতে কোন কোন কর্মির ভূমিকা কতোখানি সেদিকেও সতর্ক এক দৃষ্টি রাখা হয় কেন্দ্র থেকে। মাঝে মধ্যে এধরণের বেপরোয়া কর্মিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ঠিক যাচ্ছে না। এধরণের মিটিংয়ে আমন্ত্রণ পাওয়া ছাত্রসংগঠনের কারও জন্য সুখের কোনো ঘটনা নয়। গত কয়েক মাসে ক্যাম্পাসের সব “মেস-আপ”-এর দায়িত্ব নেওয়ার সভা এটি। এবং যেমনটা আশঙ্কা করেছিলো, শামস হত্যার বিষয়টা সেখানে উঠে এসেছে। এটা এমন একটা প্রসঙ্গ যেটা সরাসরি অগ্রাহ্য করতে পারে না রেদোয়ান। কেন্দ্রে জানাতে পারে না এ বিষয়ে তার কোনো ‘ধারণা নেই’, সেক্ষেত্রে সংগঠনে উপযোগিতা হারাতে পারে সে। ক্যাম্পাসের ভেতরে কোন ‘কাজ’টা কে করলো তাই যদি না জানা থাকে তাহলে এতোগুলো টাকা ঢালার মানে কি কেন্দ্রের?
“এ ধরণের প্রশ্নবাণ যে আসবে সে বিষয়ে ওদের কারোই সংশয় ছিল না। তোফায়েলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে বলেছে, “যতো দোষ, নন্দ ঘোষ। তাই কি না?”
দোষ যে সব নন্দ ঘোষের এটা রেদোয়ানও জানে। এখানে সে তেমনটাই বলেছে। সব দোষ বিরোধীদলীয় ধর্মভিত্তিক সংগঠনের। রেদোয়ানরা নির্দোষ এবং জমজম কূপের পানি দিয়ে ধোয়া তুলসীপাতা। তাদের কোনো দোষ নেই। ঐ ধর্মভিত্তিক সংগঠনই তো ছুরি ব্যবহার করে নরহত্যা করে, এই খবর দেশের কারও জানতে কি বাকি রয়েছে? নেই তো। তাহলে শামস হত্যার পেছনে যে বিরোধীদলই জড়িয়ে আছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ কি কারও মনে থাকতে পারে?
দুই বছর আগেই হলগুলো খুঁজে খুঁজে সেই সংগঠনের প্রতিটি সদস্যকে চিহ্নিত করে মেরেধরে হল থেকে বের করে দিয়েছিলো ওরা। এমন এক তল্লাসী আবারও চালাতে বলা হয়েছে অফিস থেকে। কোনোভাবেই যেন বিরোধীদলের ছাত্রসংগঠন এখানে পা ফেলতে না পারে! দিনে রাতে জঙ্গিবিরোধী মিছিল করে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত রাখা হচ্ছে। রক্ত হিম করা সব স্লোগান গলার রগ ফুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ নিরীহ ছাত্রদের ওপর গলাবাজি করা, ক্ষমতায় না থাকা বিরোধীদলের ছাত্রনেতাদের পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে হাত-পা ভাঙা এইসব সরকারদলীয় নেতারা সত্যিকারের জঙ্গির সামনে পড়লে একজনেরও প্যান্ট শুকনো থাকবে না। পেছনে সাপোর্ট থাকলে রাজপথ সবাই কাঁপাতে পারে। তবে শেষ কথা হলো কেন্দ্র আপাতত এমন উত্তরে সন্তুষ্ট হয়েছে। সন্তুষ্ট হওয়ার পেছনে রেদোয়ানের রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় বাবা এবং বাবার দিকের আর সব আত্মীয়ের ভূমিকা থাকতে পারে, তবে পেছনের কারণ খতিয়ে দেখাটা এখন তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার নয়।
তোফায়েলের ফোনটা রিসিভ করার সময় মনটা ভালোই ছিল রেদোয়ানের। ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে কেন্দ্রকে সন্তুষ্ট রাখতে পেরেছে, আজকের জন্য তার কাজ সফলভাবে শেষ। ভেবেছিলো তোফায়েলকে নিয়ে মাউরা ইউসুফের বারে যাবে আজ। অনেকদিন মেয়ে শিকারে বেরুনো হয় না। গত দুটো বছর এই নেশাই ওদের সবচেয়ে বেশি টেনেছে, বিদেশি মদের সাথে নরোম মাংসের নেশা। অথচ ফোন রিসিভের পর বন্ধুর কণ্ঠ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হলো, আজকে মনে হয় আনন্দ-ফূর্তি করা হবে না আর।
“ক্যাম্পাসে ফিরে আয়। কুইক।” ব্যস্ততার সাথে বলেছিলো তোফায়েল। বিপদের গন্ধ পেয়েছিলো রেদোয়ান, “কি হইছে?”
“ঝামেলা হইয়া গেছে। বিশাল ঝামেলা। এইখানে চইলা আয়। ফোনে কওয়ার মতো কেস না এইটা।”
“বিষয়টা কি নিয়া তা তো কইবি?”
কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করলো তোফায়েল, এতোটুকুই রেদোয়ানের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে তুললো। পৃথিবীর সব বিখ্যাত বন্ধুত্বগুলোর তুলনায় তার সঙ্গে তোফায়েলের বন্ধুত্ব বেশিদিনের নয় হয়তো, তবে এ কয় বছরে এই ছেলেকে কখনও ইতস্তত করতে দেখেনি সে।
“শামসের ঘটনাটা।” প্রায় ফিসফিস করে বলল তোফায়েল, “একটা প্যাঁচ খায়া গেসে।”
চমৎকার মেজাজটা এই একটা উত্তরই খাপ্পা করে দিলো। গলার রগ ফুলিয়ে জানতে চাইলো রেদোয়ান, “এই কথা আমারে আইসা কইতাছো তুমি এখন, মাগির পুত! এইদিকে সব ঠিক ঠাক কইরা ফালাইছি আর তুমি ঐদিকে প্যারানয়েড হইয়া আছো! কোনো প্যাঁচ খাওনের ব্যাপারই ঐখানে নাই।”
ফোনের ঐপ্রান্তে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে তোফায়েল, যেন ফাঁদে আটকা পড়েছে কোনো জন্তু।
“একজন উইটনেস ছিল।”
“রেদোয়ানের চোখও বড় বড় হয়ে গেলো বিস্ময়ে, “ক্যামনে সম্ভব সেইটা?”
“ছিলো। ক্যামনে সম্ভব সেইটা জানি না। তুই ক্যাম্পাসে ফিরা আয়। এইসব নিয়া বিস্তারিত আলাপ আছে।
ফোন পকেটে রেখে লম্বা পায়ে নিজের মোটরবাইকটার দিকে এগিয়ে যায় রেদোয়ান। অল্পতে চটে যাওয়ার বদনামটা সে মুফতে পায়নি তা বোঝা গেলো বাইকের স্ট্যান্ডে লাথির প্রচণ্ডতা দেখে। এলাকায় উপস্থিত অনেকেই একটুখানি আতঙ্ক আর অনেকখানি বিরক্তি নিয়ে তাকালো উদ্ধত যুবকের দিকে। তাদের থোরাই কেয়ার করে বাইকে চেপে বসে তীব্র গতিতে ক্যাম্পাসের দিকে ছুটলো সে।
ঠোঁটের ফাঁক থেকে একজোড়া শব্দ বের করে দিলো এরই ফাঁকে, “মাগির পুতেরা!”
*
বিশাল ড্রইংরুমটায় পা রাখতেই সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ এসে ধাক্কা দেয় জাকির নাকে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপূর্ব সুন্দরি মেয়েটির চোখ থেকে চোখ সরে যাওয়ার মতোই মাতাল করা ঘ্রাণ, তবে জাকি চোখ সরালো না।
“ভেতরে বসো।” একটু সরে জায়গা করে দিলো তূর্ণা।
ড্রইংরুমটি কোনো সৌখিন মানুষের রুচির ওপর গড়ে উঠেছে এই উপসংহারে সহজে পৌছে যেতে পারলো জাকি। স্ফটিকের আসবাব দিয়ে সাজানো ঘরটা প্রথম নজরে মনে হয় হীরে দিয়ে তৈরি। দৃষ্টিনন্দন চিত্রকর্মের পাশাপাশি স্টাফ করা জন্তুর মাথা পর্যন্ত ঝুলছে দেওয়াল থেকে
তূর্ণার বাবা সফল একজন বসায়ি। এই মফস্বলে ব্যবসা শুরু করেও যে কোটিপতি হওয়া যায় সেটা তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। যখন হোম ডেলিভারি সার্ভিসের আইডিয়াটা এই মফস্বলে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন তখন কতো লোক কতো কথা শুনিয়েছিলো। সদ্য বিবাহিত তরুণ তখন ওয়াহিদ ফেরদৌস। ডেলিভারি সার্ভিস থেকে সরাসরি ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পে চলে যান তিনি, সেখান থেকে ইম্পোর্টের বিজনেস। আজকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে তার চার চারটি শিল্প কারখানা। আলিশান ড্রইংরুমের প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জাকি।
বিশ বছর পর জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে!
খানিক বাদেই ফিরে এলো তূর্ণা। ট্রে-তে সামান্য কিছু নাস্তা হোমমেড, সঙ্গে দুই মগ কফি। কফির মগটা তুলে নিলো জাকি। অযথাই ব্যাকব্রাশ করা মাথায় হাত বোলালো, সুদর্শন মুখটায় এখন বিভ্রান্তির ছাপ।
“শামসের ব্যাপারে খবর নিচ্ছে দুটো ছেলে।” শান্ত গলায় বলল তূর্ণা।
কফির মগে এখনও শান্তভাবেই চুমুক দিচ্ছে জাকি, “শামসের ব্যাপারে অনেকেই খোঁজ নিচ্ছে।”
মাথা নাড়লো তূর্ণা, “এরা আলাদা না হলে তোমাকে ডেকে এনে কফি অফার করার দরকার হতো না।”
স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো জাকি। অনেকটা সিরিয়াস হয়ে এসেছে তার মুখভঙ্গি, “বলে যাও।”
“ওরা ওঁকে শুঁকে শামসের মার্ডারের সাথে তোমার সম্পর্কটা বের করে ফেলেছে।” ঠাণ্ডা গলায় বলল তূর্ণা, “বুঝতে পারছো কোন ধরণের সমস্যায় পড়ে যাচ্ছো তুমি?”
কফির মগের কাছে মুখ নিয়েও থেমে গেছে জাকি, “তুমি নিশ্চিত ওরা সবটা জেনে গেছে?”
“বিস্তারিত না। তবে সম্পর্কটা ধরে ফেলেছে, বললাম না? একদম ঠিক জায়গায় টোকা দিয়েছে ওরা। একটু তলা খুঁড়লেই তোমাদের গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।”
“ওরা তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলো?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি ওদের আমার ব্যাপারে হিন্টস দিয়েছো?” রাগত গলায় জানতে চাইলো জাকি।
তূর্ণা উঠে দাঁড়ালো এবার। স্টাফ করা হরিণের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপর শান্তভঙ্গিতে তাকালো অতিথির দিকে, “তোমার ব্যাপারে পুরোটা যদি খুলে বলি, ওদের কাছে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তারপর ওরা তোমার লাইফটা হেল করে দেবে। ক্যাম্পাস মিডিয়ার হয়ে কাজ করছে তারা, এখনও মনে হয় জানে না এটাকে জাতীয় দৈনিকে নিয়ে যাওয়ার মতো করে খবর করে ফেলা যায়। আমি যদি ওদের কাছে মুখ খুলতাম, এতোদিনে তোমার বাসার চারপাশে মিডিয়ার লোকজন বসে থাকতো।”
“তা ঠিক।” আবারও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিলো জাকি, ‘ধন্যবাদ তোমাকে।”
“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, জাকি। শামসের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলে তুমি, নয়তো আমি নিজেই মিডিয়ার কাছে যেতাম। এমনটা করতে আমি চাইনি মনে করছো? চেয়েছি। তোমার ক্ষতি হোক এমনটা শামস কখনোও চাইতো না। আমি কিভাবে করি কাজটা?”
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালো জাকি, “তোমার প্রতি সেজন্য কৃতজ্ঞ। আমি জানি কি ক্ষতিটা করেছি…এটা ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ যদি পেতাম!”
“এসব ছেঁদো কথা বলে শামসকে তো ফিরিয়ে আনতে পারবে না। ছেলে দুটোকে কি করবে দেখো। বন্ধুকে বাঁচাতে পারোনি, অন্তত নিজেকে বাঁচাও।”
দরজা পর্যন্ত ওকে এগিয়ে দিলো তূর্ণা। চৌকাঠে একটা হাত রেখে সামান্য নিচু হয়ে মেয়েটির চোখে চোখ রাখলো জাকি, “ওদের দুইজনের নাম তুমি জানো।”
মাথা দোলালো তূর্ণা, “মুহিব আর শামীম। মেকানিকালের দুটোই। ওয়ান-টু।”
মাথা দোলালো জাকি। এদের সে চেনে। ওদেরই একজন বন্ধু, ওয়ান–টু’র সিভিলের ছাত্র লিটু গত এক মাস ধরে হসপিটালাইজড। মুহিব-শামীম বন্ধুর জন্য টাকা তোলায় লিড রোল পালন করছে। লিটুর অসুস্থতায় ক্যাম্পাস আলোড়িত। মুহিব-শামীম এখন সেই সূত্রে পরিচিত নাম। এমন কেউ বাকি নেই যাদের দরজায় টোকা দেয়নি তারা, পেছনে নিয়ে গেছে বাহিনি। সেই সঙ্গে রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একাকার করে ফেলেছে। ওদের সম্পর্কে দূর থেকে দেখে জাকির ধারণা হয়েছিলো একটা কিছু ধরলে এরা তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। অসুস্থ লিটুর এমন দুটো বন্ধু আছে দেখে একরকম স্বস্তিও পেয়েছিলো, অন্তত ঐ নব্বই লাখ টাকা এরা যে করেই হোক তুলে আনবে।
এই মুহূর্তে স্বস্তির ঠিক বিপরীত অনুভূতি হচ্ছে জাকির। ছেলেগুলোর লেগে থাকার স্বভাব তার জীবনটা বরবাদ করে দেবে। এমনটা হতে দেওয়ার মানুষ জাকি নয়।
হাত বাড়িয়ে তূর্ণার গাল ছুঁয়ে দিলো সে, “টেক কেয়ার। আমি ওদের ব্যাপারটা দেখছি।”
তাদের সঙ্গে কি করা হবে তা এরই মধ্যে সে ঠিক করে ফেলেছে। কাজটা অন্যভাবে করতে পারলে জাকির ভালো লাগতো অবশ্যই, তবে এখন আর কিছু করার নেই। নিজেদের দুর্ভাগ্য ঐ ছেলে দুটো নিজেরাই ডেকে এনেছেন।
*
সশব্দে তোফায়েলের রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো রেদোয়ান। ঘরের ভেতরটা ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরেই সিগারেট খাচ্ছে তোফায়েল তাহলে। বিচলিত হয়ে একটার পর একটা সিগারেট ধরানোর অভ্যাস তোফায়েলের অনেকদিনের। তবে এতো বড় সমস্যা রেদোয়ান আগে কখনও দেখেনি যেটা সমাধানের জন্য পুরো ঘরটা ধোয়াচ্ছন্ন করে ফেলতে হয়। একটা চেয়ার টেনে খাটের কাছে নিয়ে বসলো সে।
“লাইটার দে।” সমস্যার প্রসঙ্গ না তুলে এটাই দাবি করলো রেদোয়ান। খুব শান্ত ভঙ্গিতে সিগারেটটা ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের পা দুটোকে মাটি ছাড়া করলো সে।”তারপর? এতো ঘাবড়ে গেছিস কেন? উইটনেসের ব্যাপারটা নিয়ে আমি আসার সময় ভেবেছি। আমার মনে হয় না সেখানে কারও থাকা সম্ভব ছিল। তোর সাথে যে-ই ব্যাটাই যোগাযোগ করে থাকুক সে একজন ফ্রড। কোনো কারণে অন্ধকারে ঢিল মেরেছে, সেই ঢিল লেগে গেছে। আর কিছু না।”
“‘মাগির পুতে আর ঘোড়া ডিঙ্গাইতে পারবো না। ঘাস খা, মাগির পুত।’” ক্লান্ত স্বরে বলল তোফায়েল, “মনে পড়ে?”
একটু হাসলো রেদোয়ান, “না। এটা কি আমিই বলছিলাম?”
সোজা হয়ে বসলো তোফায়েল, “ইউ ইডিয়েট! শামসের গলা কাটার পর এইটাই বলসিলি তুই! ঠিক এই বাক্যটাই। আমার স্পষ্ট মনে আছে।”
“কুল ডাউন।” একটা হাত তুলে বন্ধুকে শান্ত করার ভঙ্গি করলো রেদোয়ান, “আমারই মনে নাই, তোর কি করে মনে থাকে? এই বাক্যটাই তাহলে বলেছে ঐ ব্যাটা?”
মাথা নাড়লো তোফায়েল, “তুই তখন টাটকা রক্তের গন্ধে পাগল, তোর মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার এসব ঘটনা মনে থাকে। তুই ঠিক এটাই বলেছিলি। বলে লাথি মেরেছিলি হারামজাদার বুকে।”
চুপ করে বসে থাকলো রেদোয়ান। খতিয়ে দেখছে সম্ভাবনা।
“তুই এমন জোরে চিৎকার করেও বলিসনি কথাটা। অর্থাৎ যে উইটনেস এখন ঝামেলাটা করছে, সে খুব কাছেই ছিল। যতোটা কাছে থাকলে মানুষ চেনা যায় ততোটা কাছে। সে জানে আমি ওখানে ছিলাম। সে জানে তুই ওখানে ছিলি। হয়তো রেজা আর মৃদুলকেও চিনে ফেলেছে সে। ফাক ম্যান, এইটা একটা বিশাল ঝামেলা হয়ে গেলো।”
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করলো রেদোয়ান। এখনও তার মাথায় বিষয়টা ঢোকেনি, মাঝ দিয়ে মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সময় আবার নিয়ন্ত্রণ হারাবে এই আশঙ্কায় সে পায়চারি শুরু করেছে। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। রেদোয়ানের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে এটা একটা বিপদের সূচনা।
“শালার পরিচয় আমরা জানি না?”
মাথা নাড়লো তোফায়েল, আবারও।”শালা না। এক শালী ফোন করেছিলো আমাকে। তোর ঐ কথাটা বলেই ফোন কেটে দিয়েছে। কল ব্যাক করেছিলাম, ফোন বন্ধ।”
“অপারেটর থেকে ফোনটা ট্রেস করানোর ব্যবস্থা কর। থানায় একবার রিকুয়েস্ট করলেই করে দেবে।” চটজলদি একটা সমাধান এনে ফেলেছে লক্ষ্য করে খুশি হলো রেদোয়ান, “নাম আর লোকেশন তো পাওয়া যাবে। সব সিম এখন বায়োমেট্রিক না? আর নাম ঠিকানা পেয়ে গেলে শালীকে তুলে নিয়ে কোন এক লাভ-প্যাডে নিয়ে সপ্তাহখানেক লাগিয়ে গুম করে ফেলবো। খেল খতম।”
মাথা নাড়লো তোফায়েল, “বিষয়টা তুই এখনও হাল্কাভাবে দেখছিস। আমরা পুলিশের কাছে এখন যাবো না। যাওয়াটা বোকামি হবে।”
“কেন?”
“কারণ, আমরা ঐ সিমের ঠিকানা খুঁজছি একটা খুনের আলামত গোপন করার জন্য। আর ঠিকানাটা পেয়ে যাওয়ার পর কি করবো? ঐ ঠিকানাধারীকে খুন করে ফেলবো। এটা দোস্ত বেশি রিস্কি। পুলিশকে এর মধ্যে জড়ানোই যাবে না।”
“চুদলাম না পুলিশ-”
“জানি, তোর বাপের একটা সুনাম আছে। পেছনে পুরা ফ্যামিলি দাঁড়িয়ে
আছে তোর। আমারও অনেক জানাশোনা আছে। তবে সবক্ষেত্রে গায়ের জোরে পার পাওয়া যায় না। রাজনীতির মাঠ থেকে এটুকু অন্তত শিখতে পেরেছি আমি। কিছু সময় পিছিয়ে আসতে হয়। আর এটা তেমন এক সময়। আমাদের এখন পিছিয়ে আসতে হবে।”
প্রচণ্ড ক্রোধে এখন অন্ধকার দেখছে রেদোয়ান। তোফায়েলের ছোট্ট ফ্রিজার থেকে একটা বিয়ারের বোতল বের করে আনলো সে। অর্ধেক বোতল মেরে দিয়ে মনে হলো মাথা খানিকটা ঠাণ্ডা হয়েছে। আবারও চেয়ারে ফিরে এলো সে, আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে।
“ওকে, আমরা এখন নাহয় পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু ঐ মাগি চায় কি? সে কি আমাদের সত্যি ওখানে দেখেছে? নাকি তার কোনো ছেলে ভাতার দেখেছে, এখন ঐ মেয়েকে দিয়ে বলাচ্ছে? ঐ ছেলেকে হয়তো আমরা চিনি। সেজন্য কোন এক মাগি ভাড়া করে কথা বলার কাজটা করিয়ে নিচ্ছে দ্যাখগে। অতো রাতে ঐ এলাকায় মেয়ে থাকে না।”
তোফায়েল একমত হলো, “এটা একটা ভালো সম্ভাবনা। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই, আমাদের হাত-পা বাঁধা। অপেক্ষা করতে হবে। তবে মেয়েটা এখনও পুলিশের কাছে যখন যায়নি, আশা করি তার মধ্যে আইনী কোনো উদ্দেশ্য নেই। টাকা পয়সা হয়তো চাইবে।”
“চায়া দেখুক খালি একবার!” দাঁতে দাঁত চেপে বলল রেদোয়ান, “ঐ সুযোগেই মাগির লোকেশন বের করে ফেলমু। ওরে ধইরা আইনা ছিড়া ফালামু একদম। ব্ল্যাকমেইলের আগে তার ভাবা উচিত ছিল। মাগি, রেদোয়ানরে চেনে নাই….”
হঠাৎ করে ছুটে এলো রাগের তীব্র ঝলক। চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এখন রেদোয়ান। হাতে ধরা বিয়ারের বোতলটা গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারলো দেওয়ালের দিকে।
বিকট শব্দে ভেঙে খান খান হয়ে গেলো বোতলটা।