অধ্যায় ২৪
সুভাষের গাড়ির ভেতরটা শীতল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মিতসুবিশির এসইউভি, ফোর হুইল ড্রাইভ এই গাড়িতে নিরাপত্তার দিকটাই সবার আগে দেখা কিংবা দেখানো হয়েছে। অন্তত বিজ্ঞাপনে ভালো ভূমিকা রেখেছে বিষয়টি। সাধারণ মানুষ ফুয়েল ইকোনমি কিংবা এগজস্টের ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে ভাবে না। তারা ব্লুটুথে কি কি ফিচার পাচ্ছে আর কয়টি এয়ারব্যাগ দেওয়া হয়েছে তা নিয়েই মাথা ঘামায়। সাতটি এয়ারব্যাগ খদ্দেরদের সন্তুষ্ট করেছে নিঃসন্দেহে, এদেশে ভালোই বিক্রি হয়েছে মডেলটি। তবে এই মুহূর্তে ভিন্ন ধরণের নিরাপত্তা নিয়ে এই বিশেষ এসইউভির আরোহিরা উদ্বিগ্ন। গিয়ার লিভারের ওপর পড়ে আছে বক্ষাবরণ, ড্রাইভিং সিটে মেয়েদের হলুদ এক ফতুয়া।
হিংস্র এক প্রাণির মতো সুভাষের বুকের ওপর চেপে বসলো শিয়া। ঠাণ্ডা দু-হাতে ছেলেটার রোমশ বুক চেপে ধরলো। নিচ থেকে সমান আগ্রহে তার স্তন নিয়ে গবেষণা করছে সুভাষ, এক হাতে ওকে ধরে রেখে অন্য হাতে ঘাড় পেঁচিয়ে কাছে টেনে আনলো মেয়েটিকে। গভির, উষ্ণ আর দীর্ঘ চুম্বনে হাঁপিয়ে উঠলো ওরা। সুভাষের শরীর বেয়ে নিচের দিকে শিয়ার একটা হাত নেমে গেলো। শক্ত করে সঙ্গির সুগঠিত পুরুষাঙ্গটি ধরে তাকে আর্তনাদ করতে বাধ্য করলো সে। পরের চাপা চিৎকারটি অবশ্য ভেসে এলো শিয়ার মুখ থেকে-সুভাষের আঙুলগুলো তার স্পর্শকাতর ত্বকগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। খানিক বাদেই আঙুলের জায়গা দখল করলো গরম জিহ্বা।
“তুমি অসম্ভব ভালো পারো…” হাঁপাতে হাঁপাতে স্বীকার করলো শিয়া।
পরবর্তি বিশটা মিনিট কিভাবে পেরিয়েছে ওদের কেউ বলতে পারবে না। গাড়ির ভেতরের পরিবেশ এখনও ঠাণ্ডা, তার মধ্যেই নানা রকম মিষ্টি গন্ধের মধ্যে নগ্নদেহে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা, ঘেমে একাকার।
“রাতে আমার সাথে থাকো।” শিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল সুভাষ। জবাবে প্রেমিকের কান চেটে দিলো ও, “সম্ভব না। কারণটা তো জানোই।”
প্যাসেঞ্জারস সিটে ঝুলে আছে সুভাষের প্যান্ট আর রিভলভারের বেল্ট। সন্তর্পণে অস্ত্রটার নলের ওপর হাত বুলিয়ে দিলো শিয়া। গাড়ির ভেতর কোনো আলো নেই, টিন্টেড উইন্ডোর ফাঁক গলে সন্ধ্যার আবছা আলো এসে প্রতিফলন ঘটাচ্ছে সিলিন্ডারে।
এসইউভির ভেতর খুব বেশি জায়গা নেই। এর ভেতরেই খানিক কসরত করে পোষাক পরে নিলো ওরা। সুভাষের উরুজোড়ার দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসে গলা জড়িয়ে ধরলো শিয়া, কোমরে অনুভব করছে বলিষ্ঠ হাত দুটো। কাঁধ ছাড়িয়ে নিজের আঙুলে সুভাষের শোল্ডার হোলস্টারের স্ট্র্যাপ অনুভব করলো ও। তারপরই কামড়ে ধরলো ঠোঁটজোড়া।
দু-হাতে শিয়ার গাল ধরে চুম্বন পর্ব শেষ করলো সুভাষ। একে অন্যের চোখের তারায় অপলক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটির অবিন্যস্ত চুল খালি হাতেই আঁচড়ে দিলো, নাকের ডগা আলতোভাবে স্পর্শ করলো, কানের পাশের তিলটা ছুঁয়ে দিলো। হাসলো শিয়া, প্রতিবারই কোনো মিশনে যাওয়ার আগে এমনটা করে এই ছেলেটা। এর একটা কারণ হতে পারে, প্রতিবার মিশনে যাওয়ার অর্থ এক মাস গায়েব হয়ে থাকা। পার্টির প্রটোকল। বাড়তি সতর্কতার দরকার আছে।
প্রেমিকের বুকে বুক মিশিয়ে তার কানের ওপর নিঃশ্বাস ফেললো শিয়া, “সফল হয়ে ফিরে এসো।”
“তা হবো। সামনের বার তোমাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য বলবো সেন্ট্রালে।”
কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করলো শিয়া, “পাগল হয়েছো! মিশনে কখনোই কাপল পাঠাবে না সেন্ট্রাল।”
“আরে তুমিও দেখছি সুখেন্দুদার মতো বলছো। আবেগ ইত্যাদির জায়গা মিশনে নেই, প্রেমে আছে। তাই দুটোকে এক করা যাবে না, ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের একটা সুবিধার জায়গা আছে।” চোখ টিপলো সুভাষ।
“সেন্ট্রাল জানে না আমরা প্রেম করছি।” একটু হাসলো শিয়া “তাদের জানার দরকারও নেই এখন।“
সুভাষের চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে দিলো শিয়া, “কিন্তু এই প্রটোকলের দরকার আছে। আমাদের অ্যাসেটদের একজনও জেল খাটছে না। খুব কম অ্যাসেটের নাম আছে পুলিশের কাছে। আমাদের ফেরারির জীবন যাপন করতে হয় না, আর সবার মতোই স্বাধীন আর মুক্ত এখনও আমরা। এমনটা সম্ভব হয়েছে সেন্ট্রালের প্রটোকল মেনে। ওটা আমাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য।”
১৬২
ওর নাক টিপে দিলো সুভাষ, “খানিক অ্যাডভেঞ্চারের দরকার আছে জীবনে। মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিছু তো আর করছি না। চলো, ডিনার সেরে নেই। তারপর রওনা দেবো।”
সুভাষ কোনদিকে রওনা দেবে তা শিয়া জানে। একজন মানুষকে হত্যা করতে যাবে সে, গুপ্তহত্যা। অতর্কিতে আক্রমণ করে টার্গেটকে হত্যা করবে সুভাষ, ভয়ঙ্কর এই কাজটি করার সময় তার মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না। অথচ ছেলেটি মোটেও ভয়ঙ্কর কোনো মানুষ নয়। তেইশ বছর বয়সীদের মধ্যে এমন নরোম মন-ই বরং কম দেখা যায়। রাস্তায় একটা আহত বেড়াল দেখলেও সে তার যত্ন না নিয়ে এক পা নড়তে পারে না। বন্ধুদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় সে, সত্যি সত্যি তাকে রেগে যেতে দেখেছে এমনটা কেউ কখনও মনে করতে পারে না।
সুভাষকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চেনে শিয়া, এক বছরের সিনিয়র ছেলেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে। লম্বা একহারা গঠনের কারণে ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চেনা যায়। প্রথম বর্ষে দূর থেকে কয়েকবার তাকে সে দেখেছিলো, তবে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করেনি কখনও। ভাজা মাছ উল্টে খেতে না জানা ব্যক্তিত্ব প্রেমিক হিসেবে শিয়ার প্রথম পছন্দ নয়। বরং ঝামেলার সঙ্গে আকর্ষণ যাদের, তাদেরই ভালো লাগে ওর।
অথচ ওদের দেখা হয়ে গেলো ‘অনুশীলন সমিতি’তে। কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ একটি সেল, স্রেফ গুপ্তহত্যার দিকটি দেখার জন্যই অনুশীলন সমিতি গঠিত হয়ে এসেছে সব সময়। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে অনুশীলন সমিতি প্রথমবারের মতো গঠন করা হয়, মাঝে শত চড়ায় উত্তায় পেরিয়ে অসংখ্য দল অসংখ্য মতবাদ ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে আজকের এই দিনেও কিছু ধারণা রয়ে গেছে চিরতরুণ হয়ে। ভিন্ন দলের হয়ে কাজ করা তরুণদেরও সেই পুরোনো ঐতিহ্যবাহী নাম ধরে সদস্য হতে হয়েছে অনুশীলন সমিতির। সুভাষের পাশেই ট্রেনিং নিয়েছে শিয়া, প্রেমেও পড়েছে তখনই।
একবার জানতে চেয়েছিলো, “সমিতিতে আসার পর কখনও খারাপ লাগেনি?”
নিরীহ হাসিটা তখনও লেগে ছিল তার মুখে, “না। দেশের জন্য করছি।”
শান্ত, কোমল মনের এক তরুণ হলেও দেশের জন্য খুন করতে হাত কাঁপে না সুভাষের। বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার একমাত্র উপায় সশস্ত্র সংগ্রাম। রক্তাক্ত বিপ্লব। পার্টির সঙ্গে এই বিশ্বাস নিয়েই যুক্ত হয়েছে সুভাষ, একই কারণে তাদের সঙ্গে রয়েছে শিয়া। তবে সুভাষের প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যেতে হয়েছিলো সেদিন তাকে।
“তোমার লেগেছে?” একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে জানতে চেয়েছিলো সুভাষ, “মানে, জানতে চাইছি অনুশীলন সমিতিতে আসার পর কখনও খারাপ লেগেছে তোমার?”
ডিনার শেষে বাড়ি ফিরে এলো শিয়া। মা বাড়িতে এসেছেন এক মাস মতো হয়েছে। ভাইয়ার ব্যাপারে কোন কথা সেদিন থেকে বলেননি। মায়ের পরিবর্তনটা ভালো না খারাপ তা ওরা জানে না। একদম হুট করেই শামসভাইকে নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা। যেন ওরকম কোনো ছেলেই ছিল না তাঁর, নিজের ক্যাম্পাসে খুন হয়নি ওরকম কেউ। ছেলের অস্তিত্বকে সাময়িক সময়ের জন্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করছেন তিনি। শিয়ার বাবা এ নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনা করেননি। তিনি আতঙ্কের সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
নিজের ঘরে এসে ভ্যানিটি ব্যাগটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেললো ও। ডেস্কটপটার কাছে গিয়ে লাথি দিয়ে পাওয়ার সুইচ অন করলো। ওয়ালপেপারে ভেসে উঠলো শামসের হাসি হাসি মুখের একটা স্থিরচিত্র। এই ছবিটা খাগড়াছড়িতে তোলা। পেছনের জলাধারের নাম মাতাই পুখিরি। শামসের চুল, টিশার্ট ঘামে ভেজা অথচ চোখজোড়া প্রাণচঞ্চল। মুখের সঙ্গে চোখ দুটোও হাসছে তার। ভাইয়ের হাসি শিয়ার জন্য ঈর্ষাকাতর হওয়ার কারণ ছিল। বান্ধবিরা সব সময় বলেছে শিয়ার হাসিটা কেমন যেন মেকি। চোখ হাসে না। এতোদিন তাদের কথা পাত্তা দেয়নি সে, শামসভাই মারা যাওয়ার পর থেকে মনে হয়েছে খুব একটা ভুল কিছু তারা বলেনি।
ভাইয়ের ছবিটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্রাউজার খুলে জ্যাকোবিনের হোমপেজটা খুললো শিয়া। ঠোঁটের কোণে সাময়িকভাবে লেগে থাকলো মৃদু একটা হাসি। ওর লেখা “ Within and Against Capitalism” আর্টিকেলটা এডিটর’স চয়েজ হিসেবে হোমপেজে শোভা পাচ্ছে। বামপন্থী লেখকদেরই প্রাধান্য এখানে। শন পেটির লেখা “হাও টু উইন মেডিকেয়ার ফর অল” আর্টিকেলটা পড়লো। ম্যাড়মেড়ে। বিরানব্বইয়ের পর এ নিয়ে আলোচনা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে। নানা রকম শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক চাল দেওয়ার আলোচনা করেছেন লেখক। এমনকি জনগণকে লংমার্চে নামার আহ্বান জানিয়েছেন। যেন এতে করে সবার জন্য চিকিৎসা সুরসুর করে চলে আসবে। বুর্জোয়া সরকার সাধারণ মানুষের কথা ভেবে কোনোকালেই কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি
দাঁতে দাঁত চেপে একটা সিগারেট ধরালো সে। বাসায় সিগারেট খাচ্ছে এটা জানলে বাবা আর মা দু’জনই ঝামেলা করবেন, তবে রাত তিনটার আগ পর্যন্ত সিগারেট খাওয়া চলে। এটা ওর নিজের প্রটোকল, নিজের নিরাপত্তার জন্য। দরজা সারা রাত বন্ধ থাকে। রাত আটটার আগে খোলে না ও। ধোঁয়ার গন্ধ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পাঁচ ঘণ্টা অনেক দীর্ঘ সময়।
ইনফিনিট থট, লেনিন’স টুম্ব, মার্ক্সিজম টুডে ধরণের কয়েকটি বামপন্থি সাইটে ঢুঁ মারতে মারতে খেয়াল করলো চারটা সিগারেট খাওয়া হয়ে গেছে। পোষাক খুলে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখলো শিয়া। তারপর চোখ পড়লো বড় বিছানাটির দিকে, আজ সেখানে সুভাষকে নিয়ে আসতে পারলে ভালো হতো। আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়লো সে।
কমোডে বসে শাওয়ারের ঠাণ্ডা-গরম পানি পড়া দেখছে, হাতের কাছে স্মার্টফোনটা বেজে উঠলো তাকে চমকে দিয়ে। সিগারেটে আরেকবার টান দিয়ে ফোনটা তুলে নিলো শিয়া। নম্বরটি মোটেও অপরিচিত নয়, তবুও রিসিভ করতে দ্বিধা হলো।
সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য!
“বলুন, মি. মুহিব।” ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল শিয়া, “আশা করি আমার জন্য ভালো কোনো খবর আছে।”