অধ্যায় ২০
ডেস্কটপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো মুহিব। কানে বাজছে লিনকিন পার্কের “ক্যাসল অব গ্লাস”। ঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। যে কোনো ব্যাচেলরও এখানে পা রাখতে লজ্জা পাবে। ছয় ফিট বাই সাত ফিট ঘরটার ভেতরে ঠেসেঠুসে আটানো হয়েছে একটা খাট, একটা টেবিল, কাপড়ের একটা র্যাক। খাট আর র্যাকের মাঝে চেপে নিজের ট্রাংকটা ঢুকিয়েছে মুহিব। সেই সাথে দরজার পেছনের হুকে ঝোলানো আছে রাজ্যের কাপড়। রেহাই পায়নি ছোটখাটো গড়ণের খাটটাও। ওপরে চাপানো হয়েছে অন্তত বিশ কেজি ওজনের পোষাক আর বই। নিচের দিকে আটকে আছে একটা প্রশস্ত লেপ। গরমে জড়োসরো হয়ে যাওয়া এই মুহূর্তে ওই লেপের দরকার কি তা জানতে চাইলে মুহিবও উত্তর দিতে পারবে না। ঘরের সবচেয়ে ভীতিকর দৃশ্যটা দরজার একটু পেছনের দিকে। পুরাতন একটা হেডফোনের বাক্স কেটে বানানো হয়েছে অ্যাসট্রে। তাতে জমে আছে রাজ্যের সস্তা সিগারেটের ফিল্টার। একেকটার দাম তিন টাকা। ফিল্টার উপচে পড়ছে ছাই। মেঝেতে ভর্তি হয়ে আছে ধুলো আর ছাইয়ে। বাইরে যাওয়ার স্যান্ডেল পরেই ঘরের মধ্যে মুহিবের বিচরন। খাটে ওঠার সময় খানিকটা পা মুছে ওঠে কেবল। ঘরের কোথাও নেই ভেন্টিলেটর, জানালাগুলো বন্ধ। তার মধ্যেই নির্বিকারভাবে একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে মুহিব। এই ঘরে পা রাখলে কয়লা খনির শ্রমিকদেরও ফিট লেগে যাওয়ার দশা হতে পারে!
মিউজিক ট্র্যাকটা শেষ হতে কানের মধ্যে নেমে এলো এক সেকেন্ডের নীরবতা। তা ভেদ করেই দরজা ধাক্কানোর শব্দটা কানে এলো ওর।
কেউ একজন প্রচণ্ড জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে!
ডান হাতে কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বাম হাতের এক মোচড়ে দরজার পাল্লা খুলে ফেললো ও। সাত ফিট দৈর্ঘ্যের ঘরে কষ্ট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা পর্যন্ত যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। একেবারে হাতের কাছেই মনের মতো দরজা! দরজার ওপাশে শামীমের ব্যস্ত মুখটা দেখা গেলো।
“মাল খেয়ে টাল হয়ে আছিস নাকি? শালা, কতোক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি, কোনো খবরই নাই!”
বিনয়ের হাসি মুখে ফোটালো মুহিব, “সরি দোস্ত, লিখছিলাম।”
ডেস্কটপের দিকে তাকিয়ে সাদার ব্যকগ্রাউন্ডে কালো অক্ষরে ভরে থাকা ফাইলটার দিকে তাকালো শামীম, “গল্প?”
“কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “উপন্যাস।”
পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো শামীম, “সাবাশ। ইদানিং ফেসবুকে তোর লেখায় ভালো রেসপন্স দেখি। এক-দেড় হাজার করে লাইক পাচ্ছিস। রহস্যটা কি?”
প্যাকেটটা খুলে দেখলো মুহিব, মাত্র দুটো গোল্ডলিফ পড়ে আছে ভেতরে। ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টরা প্যাকেট ধরে সিগারেট কেনে না। একটা দুটোই কেনে। দোকানদার মামারা বহনের সুবিধার্থে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলে তাতে করে তারা সিগারেট বহন করে। সেই সঙ্গে একটা আলাদা ভাব আসে, “প্যাকেটে করে খাচ্ছি!” মাথা নেড়ে একটা সিগারেট ধরালো মুহিব
“থ্যাংকস, দরকার ছিল সিগারেটটা। ব্রেন স্টর্ম চলছে।” চোখ টিপে বলল সে।
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।” অবশিষ্ট সিগারেটটাও ধরিয়ে ফেললো শামীম, “অ্যাশট্রেটা দে।”
হেডফোনের বাতিল প্যাকেটটা (অ্যাশট্রে) তার দিকে বাড়িয়ে ধরতে প্রায় আঁতকে উঠলো সে, “এটার কি হাল রে ভাই! কেওক্রাডং থেকে হইতেছে হিমালয়। তাও ফালাস না ক্যান এগুলা?”
“ফেলবো।” এতটুকুই বলল মুহিব, “আর ফেসবুকে রাইটিংটা এমন সিরিয়াস কিছু না। ওয়ার্ম আপ চলছে। মানুষ পছন্দ করছে দেখতেই পাচ্ছিস। লাইক আনার জন্য আমি কিছু করি না। কাউকে লিংক-ফিংকও দেই না। এমনিতেই একজন দুইজন করে কানে কানে ছড়িয়েছে ব্যাপারটা। অনেকে আমার গল্প পড়ে মজা পায়। তারাই পড়তে আসে।”
“গল্প তো অনেকগুলো লিখে বসে আছিস। এতোগুলো ওয়ার্ম আপ? কোন একটা প্রকাশনীতে ট্রাই কর।”
মাথা নাড়লো মুহিব, “স্কিলসেট দোস্ত। ওই পর্যায়ে আমি এখনও যাইনি। যখন যাবো, আমাকে প্রকাশনীগুলোই খুঁজে নেবে।”
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে কথাটা শুনলো শামীম, “এটা বাংলাদেশ। ওভাবে কাজ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে, চেষ্টা করে যা। এইসব ব্যাপার আমার চেয়ে তুই-ই ভালো বুঝবি।”
মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের ফাইলটা মিনিমাইজ করলো মুহিব, “আমার রাইটিং নিয়ে তো আর কথা বলতে আসিস নাই। কাহিনী কি হইছে বল।”
উত্তর দেওয়ার আগে সিগারেটে বড় করে টান দিলো শামীম, এটা তার সাসপেন্স ধরে রাখার নিজস্ব কৌশল। নাটুকেপনায় শামীম সেরা, ড্রামা কিং!
“আজকে বিকালে ওদের দুইজনকেই বের করতে পারছি।”
“লিটু আর ইলোরাকে?”
“ইয়াপ, বেইবি!”
“লিটুর সাথে একটু আগেও দেখা হলো আমার’
“জানি, তার পর পর ফোনে ওর সাথে কথা বলেছি। বহুত মারপ্যাচ কাটিয়ে বের করার জন্য রাজি করতে পারলাম।”
হাসলো মুহিবও, “জোস। সাবাশ। দুই প্রেমসাধক। ডুমুরের ফুল! একটা চোখের নিচে কালি ফেলে দিচ্ছে, আরেকটা বন্ধুদের ভুলে বসে আছে। ক্লাস মিস দিচ্ছে দুইটাই। আজকে বিকালে কি বানানোটা যে বানাবো শালাদের। লিটু হারামজাদা তো পাশের ঘর থেকেই দেখা করতে আসে না। প্রেমের ওপর পিএইচডি চালাচ্ছে, এতো ব্যস্ত।”
“আস্তে, আস্তে।” হাত তুলে তাকে থামালো শামীম, “ভালো খবর আরও বাকি আছে হে বন্ধুবর।
“খুব ভালো মুডে না থাকলে শামীমের কণ্ঠে এতো বিশুদ্ধ উচ্চারণ শোনার উপায় নেই। চেয়ার ঘুরিয়ে তার দিকে বসলো মুহিব, চোখে প্রশ্ন।
“তূর্ণা আপুর সাথে দেখা হচ্ছে আজকেই। আলমগির ভাই কনফার্ম করেছেন। আমার সাথে আপুর কথাও হয়েছে। নিজের পার্সোনাল নাম্বার উনি দিলেন। ফাইনালি শামসভাইয়ের কেসটায় আমরা আরেকটু আগাতে পারবো হয়তো।”
মুহিব-শামীম যেখানে থাকে সেখানে সময় ধীরে চলে এমনটা তাদের ঘোরতর শত্রুও বলতে পারবে না। কাজেই বিকালটা চলে এলো খুবই দ্রুত। পাশের ঘর থেকে লিটুকে বের করে আনাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তখনও ফোনে কথা বলছিলো সে, শ্রাবন্তীই হবে। নিচে নেমে আজিজ মামার দোকানে বসে আরেকটা সস্তা সিগারেট আর চা শেষ করে নদীর দিকে রওনা দিলো ওরা তিনজন। পথে ক্যাম্পাসের পেছনের গেট থেকে তুলে নিলো ইলোরাকে
নৌকায় ওরা চারজন ছাড়া ছিল শুধু মাঝি। বাতাসে সবার চুল উড়ছে। উঁচু কিন্তু যাচ্ছেতাই গলায় গান ধরেছে শামীম-ও মাঝি নাও ছাইড়া দে, পাল উড়াইয়া দে…
মুহিবের সস্তা জোকসে হাসছে লিটু। ইলোরা যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে দুইপাড়ের উঁচু চর দেখতে ব্যস্ত। একটা ভ্রু উঁচু করে তার দিকে তাকালো মুহিব, নীল আকাশের পটভূমিতে চমৎকার দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। তোফায়েলের সাথে তাকে কল্পনা করার চেষ্টা করলো সে, খুব কঠিন হলো কাজটা। যেন নিষিদ্ধ সম্পর্কের ছবি ভেসে উঠেছে মনের পর্দায়। জোর করে নদীর স্রোতে মন ফিরিয়ে নিয়ে গেলো ও। দূরে চকচক করছে টহলদার বিজিবির স্পিডবোটগুলর একটা। কাছেই বর্ডার হওয়ায় এদিকে বিজিবির স্পিডবোটের নজরদারি কড়া। তাদের চোখ এড়িয়ে শহরের ভেতর এতো শত কেজি গাঁজা কি করে ঢুকে যায় সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। সরকারি দুই বিশ্ববিদ্যালয় বা স্থানীয় যে কোনো কলেজের একটা ছাত্রও পাওয়া যাবে না যাকে প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গাঁজার ধোঁয়া বুকের ভেতরে নিতে হয়নি। নদীর মাঝে জেগে থাকা বিশাল চরটা ধীরে ধীরে কাছে চলে আসছে। বেশ শক্ত ভাবেই ধাক্কা খেলো গলুই। কেঁপে উঠলো সবাই, শামীমের গলা চিরে বের হওয়া আতঙ্কিত চিৎকারটা অবশ্য একেবারেই কৃত্রিম।
একে অন্যকে তাড়া করতে করতে চরের পাড় ধরে আরও সামনে এগিয়ে গেলো ওরা। চরটা হয়ে গেছে স্থায়ী, নৌকার একটা ঘাটও গড়ে উঠেছে রাতারাতি। ওখানে বসার বা আলাপ করার জায়গা নেই। এবরোথেবরো জমিতে এর মধ্যে চাষও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক করে বললে এমনটা চলছে গত কয়েক বছর ধরে। নদীতে পানি না থাকার পেছনে ভারতের বাঁধের দায় দিয়েই সাধারণ মানুষ খালাস। পলি জমে নদীতে হাঁটু পানি, তবে সীমান্তের ওপাড়ে বাঁধটার সবগুলো গেট খুলে দেওয়া হলে মফস্বল শহরটার বেশ কিছু অঞ্চল ডুবে যেতে বেশি সময় নেয় না। খালি মতো জায়গাটায় বসতে বসতে এসব নিয়েই কথা হচ্ছিলো ওদের মধ্যে। তারপর বেশ খানিকটা সময় নীরবতা। সশব্দে বয়ে চলা বাতাস, নিস্তব্ধতা, সামনে দৃষ্টিনন্দন বিকেল বেলার আলোয় বয়ে চলা নদী-কোনো বিশেষ আলোচনাই এখানে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। উদাস হয়ে যেতে হয়।
“এটা একটা গ্র্যান্ড রিইউনিয়ন পার্টি।” অবশেষে প্রসঙ্গটা তুললো মুহিব, সিগারেটের আনকোরা প্যাকেটটা খুলতে খুলতে।”এখানে দুইজন নতুন
প্রেমে পড়া মানুষ আছে, তাদের হাতের কাছে পাওয়াটা আগের মতো সহজ কোনো ব্যাপার না। উপলক্ষ্যের প্রয়োজন।”
লজ্জিত একটা হাসি ফুটে উঠলো লিটুর ঠোঁটে, “দোস্ত, আর লজ্জা দিস না। গত কয়েকদিন কি চাপটা যে গেলো। ঘর থেকে তেমন বের হওয়াই হচ্ছে না। টিউশনি, সিভিলের রিপোর্ট লিখা-বুঝিসই তো। এবার দুইটা পাঁচশ’ পৃষ্ঠার রিপোর্ট আছে।”
প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে নিলো শামীম, ইলোরাকে অফার করতেই বিনা বাক্যব্যয়ে ওটা তুলে নিলো সে। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে সিগারেটে আগুন ধরালো শামীম। চরের প্রবল বাতাসে মাত্র একটা ম্যাচের কাঠি খরচ করে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ কঠিন কাজ। তবে অসাধ্য যে নয় তারই প্রমাণ রাখলো যেন সে।
“প্রাক্তন মেয়রের মেয়ের সাথে প্রেম, অ্যাঁ? বাসায় জানে?” চোখ টিপলো শামীম, “জানলে মেয়রসাহেব তোর কি খবরটা যে করবে দেখতেই পাবি। এখনকার মতো ওড়াওড়ির সময় আর পাবি না। ক্যাডারদের মার খেয়ে ছাতু হয়ে যাবি যখন-তখন এই আমরাই তোকে নিয়ে হাসপাতালে যাবো। একটু বুঝে শুনে, হুঁ?”
আবারও খানিকক্ষণ চুপ করে নদী দেখা।
এবারের নীরবতা ভাঙলো ইলোরা, “তোফায়েলের সাথে আমার সম্পর্কটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না।”
নড়ে চড়ে উঠলো সবাই। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বিতর্কিত সম্পর্কগুলোর একটা কোনটা, কেউ যদি জানতে চায় ওদের তিনজনই ইলোরা-তোফায়েলের দিকে ইঙ্গিত করবে। বেশ কয়েক সপ্তাহ ওরা চারজন একসাথে বসেনি, অনেক কিছুই তাদের অজানা। ইলোরার কর্মকাণ্ড অস্পষ্ট, বাইরে থেকে যা দেখা যায় তাতে করে অন্তত তোফায়েলের সাথে তাকে আঠার মতো লেগে থাকার দৃশ্যটাই প্রকট।
“ছেলেটা আমাকে চায়। কী হিসেবে চায় তা এখনও বুঝতে পারছি না।”
কাঁধ ঝাঁকালো মুহিব, “ছয়টা রেপ কেস ঝুলে আছে যার মাথায় সে তোকে আর কিভাবে চাইতে পারে? তোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি মাথা ঢোকাবো না কখনোই। কিন্তু আমি শুধু বলছি তোকে সেফটিটা এনশিওর করে যা করার করতে।”
“কোনোটাই প্রমাণ হয়নি। রাজনীতিতে নানা রকম শত্রু থাকে।
“হুঁ। তোফায়েলের বাড়াচোষা বন্ধু রেদোয়ান যে সবগুলো সেক্টর থেকে সমানে টাকা তোলে, সেটাও তো রাজনীতির মাঠে অন্যান্য শত্রুদের দেওয়া অপবাদ!” তিক্ত কণ্ঠে বলল মুহিব, ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ডরকম ফুঁসছিলো সে।
হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলো শামীম, “তোর কি মনে হয়? তোফায়েল তোকে ভালোবাসে?”
“তেমনটাই সে প্রমাণ করতে চায়।” একটু হাসলো ইলোরা, “অনেকবার একাকি থেকেছি আমরা। তেমন কিছু করার চেষ্টা করেনি সে, যাতে করে বিশ্বাস হারানো যায়। মানে খুব বেশি কিছু… “
কাঁধ ঝাঁকালো শামীম, “খুব বেশি কিছু আর কম কিছুর ফারাকও অনেক আছে দেখা যায়। তাহলে সম্পর্কটা মোটামুটি এগিয়েছে তোদের।”
মাথা নাড়লো ইলোরা, “তা বলবো না। আমি তার ভেতরের মানুষটাকে জানতে চাইছি।”
মুহিবের সিগারেটটা নিয়ে নিলো লিটু, “এটা তোর সেশনাল (ল্যাব ক্লাস) না যে একটু নেড়েচেড়ে দেখলি আর রেখে দিলি। এটা একটা জলজ্যান্ত মানুষ। সম্ভবত ক্যাম্পাসের সবচেয়ে ডেয়ারিং লোকটার সাথে তুই দেখাদেখির পর্ব চালাচ্ছিস। তোর দেখাদেখি শেষ হয়ে গেলেই যে তারও দেখাদেখি শেষ হবে তা ভাবিস না।”
আজকের দিনে প্রথমবারের মতো হাসির দেখা পাওয়া গেলো ইলোরার মুখে, “তেমনটা আমি ভাবিও না। আমি জানি তোরা আমার সেফটি নিয়ে ভাবিস, তবে আমার ধারণা নিজেকে রক্ষা করার যোগ্যতা আমার আছে।”
উপস্থিত সবারই এর উল্টোটা ধারণা, তবে মুখে প্রকাশ করলো না তাদের কেউ। মুহিব চুপচাপ ইলোরার সিগারেটটা দখল করলো কেবল। আবারও ফিরে এসেছে নদীর তীরের সহজাত নীরবতা।
এবারের সেশন ভাঙলো লিটু, “আমার আর ইলোরার ব্যাপারে তোদের অভিযোগের সীমা নেই। বিষয়টা আমরা বুঝতে পারি, ইদানিং একটু অস্বাভাবিক আচরণ আমরা করছি।”
“অস্বাভাবিক’ শব্দটা এতো জোর দিয়ে উচ্চারণ করলো যে প্রায় ব্যাঙ্গের পর্যায়ে চলে যায়।”আমি অস্বীকার করবো না যে আমরা তেমনটা করিনি। তবে তোদের মধ্যেও প্রবল একটা ঢাক ঢাক গুড় গুড় আমি অন্তত খেয়াল করেছি।”
একটা হাত তুললো ইলোরা, “আমি এই ব্যাপারে লিটুর সাথে আছি। কিছু একটা করছিস তোরা। আমাদের ইচ্ছে করে গোপন করছিস বিষয়টা, আমরা জানি। অন্তত আমি জানি।”
“কিভাবে জানিস?” হাসিমুখেই চ্যালেঞ্জ করলো মুহিব, স্পষ্টতই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে।
“মুহিব আর শামীম, গত কয়েকদিন আমাকে অনেকগুলো মিথ্যে বলেছিলি তোরা। অহেতুক মিথ্যে বলার মানুষ তো না তোরা!”
লিটুও তাল মেলালো, “সেদিন দেখেছি আজিজ মামার চায়ের দোকানে বসে গুজগুজ করছিস। মানে, শামীম আমাদের মেসের দিকে এসেছিলি I মুহিব আমার পাশের ঘরেই থাকে, অথচ আমাকে ডাকিসনি। এমনটাও তোদের থেকে নতুন। অর্থাৎ এমন কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলি যা আমাকে জানাতে চাইছিলি না।”
“তুই-ই বা আমাদের দূর থেকে দেখে চলে গেলি কেন? কাছে এসে একটাবার দেখা করে গেলে কি তোর ইগোর এইডস হইতো, হারামজাদা?” রণমূর্তি ধারণ করলো শামীম এবার। মাথা নাড়লো মুহিব, প্রসঙ্গ এড়ানোর চেষ্টাগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ হবে এখানে। আজকে ওরা একে অন্যের ব্যাপারে যথেষ্ট না জেনে চর থেকে নামবে না।
“ইলোরাই কিভাবে নিশ্চিত করে বলছে আমরা মিথ্যে বলেছি? চলমান লাই ডিটেক্টর নাকি তুই?”
শামীমের প্রশ্নবাণকে একটা হাত তুলে ঠেকালো মুহিব, “এনাফ। এসব এড়িয়ে যাওয়ার টেকনিক আমরা বাইরের যে কারও সাথে করতে পারি, শামীম। ফ্যামিলির সাথে না। ওদের আমরা সত্যটা বলবো।”
বিস্মিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো শামীম, “কিন্তু তুই রিস্কটা বুঝতে পারছিস?”
মাথা দোলালো মুহিব, “অবশ্যই। কিন্তু ইলোরা আর লিটুও তা বুঝতে পারবে তা আমি আশা করছি।” ওদের দিকে ঘুরে তাকালো সে, “জানতে চাইছিস আমাদের রাখ ঢাকের ব্যাপারটা? আমি বলছি। ক্যাম্পাস-টোয়েন্টি ফোরসেভেনের হয়ে আমি আর শামীম কাজ করছি। কোন কাজটা আশা করি বুঝতে পারছিস? শামসভাইয়ের মার্ডার কেসটা।”
নরোম হয়ে এসেছে ইলোরার গলা, “আমার এমনটা মনে হয়নি এমনও না। তবে আমাদের লুকানোর কি আছেরে ভাই। আমরা কি মাইক নিয়ে রাস্তায় নেমে যাবো নাকি? তোফায়েল কোনভাবে কানেক্টেড?”
মুচকি হাসলো মুহিব, “একেবারে জায়গামতো টোকা দিয়েছিস দেখা যাচ্ছে। তোফায়েল ভাইকে আমি এখনই কানেক্টেড বলবো না। তবে নিতান্ত গাধা পর্যায়ের কেউ না হলে এটা সহজেই বুঝতে পারার কথা সযে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতার অজানা কিছু ক্যাম্পাসে ঘটে না।”
“সেটাও আমি অস্বীকার করছি না। তবে কাজটার সাথে তোফায়েল জড়িত কি না তা আমি জানতে চাইছি। একটা ক্রাইম ঘটার পর তা না দেখার ভান করা এক জিনিস। আর তাতে অ্যাক্টিভলি পার্ট নেওয়া আরেক জিনিস।”
এবার ক্ষেপে উঠলো শামীম, “তোর কথাটার ব্যাখ্যা দেই তাহলে আমি? তোফায়েল একটা ক্রাইম করলে সে দোষী। আর সে একটা ক্রাইম চোখের সামনে হতে দেখার পরও সে ব্যাপারে কিছুই না করলে ইটস কমপ্লিটলি ওকে। এটাই তো বোঝাতে চাইছিস?”
হতাশার একটা ভঙ্গি করলো ইলোরা, যেন একেবারেই বোঝাতে পারেনি সে নিজের বক্তব্য। তার অভিব্যক্তি পরিবেশের কোনো পরিবর্তন অবশ্যই আনলো না। একইভাবে মাথা নাড়ছে লিটুও। তবে এই হতাশা ইলোরার প্রতি। ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া একটা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তার এমন লঘু মনোভাব সে আশা করেনি।
“বাদ দে।” আবারও শান্তিচুক্তিতে এগিয়ে এলো মুহিবই।”এখনও আমাদের হাতে কারও দিকেই আঙুল তোলার মতো তথ্য নেই। হতে পারে এটা তোফায়েল গ্রুপের কাজ। হতে পারে জাকি গ্রুপের। থার্ড পার্টিও থাকতে পারে। নিশ্চিত না জেনে কাউকে দোষারোপ করা তো উচিত না।”
সামান্য সামনে ঝুঁকে এসে অনেকক্ষণ ধরে না টান দেওয়া সিগারেটটা নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেললো সে, “আমার মতামত যদি জানতে চাস তবে বলবো, এসবের সাথে তোফায়েলের কোনো সম্পর্ক সম্ভবত নেই। বরং জাকি ভাইয়ের আচরণ আমার কাছে বেশি রহস্যময় মনে হয়েছে।” আর কেউ না জানলেও অন্তত মুহিব জানে মিথ্যেটা বলতে ওকে নিজের সাথে কি পরিমাণ যুঝতে হলো।
“আমাদের বলবি ব্যাপারটা?” লিটু জানতে চাইলো এবার। ইলোরার দিকে তাকাচ্ছে না সে-ও।
“কি জানতে চাস?” একরকম আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই জানতে চাইলো শামীম আবারও হাত তুলে তাকে শান্ত হতে ইশারা করলো মুহিব। লিটু অবশ্য শামীমের ভঙ্গির দিকে খেয়াল করছে না। সে তার প্রশ্ন করে ফেলেছে, “এ কয়দিন তোরা কি কি জানতে পারলি এই ব্যাপারে অর সামথিং লাইক দ্যাট।”
কাঁধ ঝাঁকালো শামীম, সাহায্যের আশায় মুহিবের দিকে তাকালো সে।
তার দিকে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকানোর ঝোঁকটা অনেক কষ্টে সামলালো মুহিব, ইলোরা সরাসরি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। লিটুর দৃষ্টিকেও অন্তর্ভেদী বলা চলে। পাথরের মতো নির্বিকার মুখেই উত্তরটা দিলো সে, “সংক্ষেপে বলি। জাকি গ্রুপের সাথে তোফায়েলের গ্রুপের যে সমস্যা আছে সেটা তোদের অজানা থাকার কথা না।”
মাথা দোলালো তিনজনই।
“সেটা একটা ব্যাপার। অনেক আগে কী হয়েছে না হয়েছে তা আমরা বাদ দিতে পারি চাইলে, যদিও দিচ্ছি না। অনেক সময় পুরনো রেষারেষি অনেক ঘটনার জন্ম দেয়। বিশ বছর পরও পরিকল্পিত প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে এমন ঘটনা কি ঘটেনি? ঘটেছে। তবে আমি আসবো রিসেন্ট কিছু ব্যাপারে। তোরা কি জানিস শামসভাইয়ের মার্ডার যখন হলো জাকি ভাইকে ক্যাম্পাসে কয়েকদিন দেখা যায়নি? তাহলে তিনি তখন কোথায় ছিলেন?”
কাঁধ ঝাঁকালো ইলোরা। বোঝা গেলো যথেষ্টরও বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনছে সে।
“এটা একটা প্রশ্ন, তবে খুব গুরুতর কিছু না। তবে তোরা কি আরও একটা বিষয় জানিস, শামসভাইয়ের মার্ডারের কিছুদিন আগে জাকি-গ্রুপের সাথে তোফায়েল-গ্রুপের লেগে গিয়েছিলো? এবারেরটা বেশ সিরিয়াস! আমি শুনেছি…যার কাছ থেকে শুনেছি সে খুবই রিলায়েবল সোর্স, কাজেই প্ৰতিবাদ করার চেষ্টা করিস না লিটু! আমি শুনেছি ঘটনাটা ঘটার আগে তোফায়েল জাকিকে তুলে নিয়ে গেছিলো। জাকি ভাইকে তোফায়েল একদফা বানিয়েছে, পুরাই মার্ডারাস! জাকি ভাইয়ের মাথায় পাগড়ির মতো বিরাট ব্যান্ডেজ লাগাতে হয়েছিলো। কেউ কি বাইরে জাকি ভাইকে দেখেছিলি ঐ ঘটনার পর পর?”
“না তো মনে হয়। মনে করতে পারি না।” লিটু উত্তর দিলো।
“দেখিস নি। মনে করার কিছু নেই, তোফায়েল জাকিকে মেরে হসপিটালে পাঠিয়েছিলো। ওরকম চেহারা নিয়ে বের হওয়া যায় না। ঘটনাচক্রে আমি আর শামীম জাকি ভাইকে ওই অবস্থায় দেখে ফেলি। এর পরই প্রথমবারের মতো আমরা সিদ্ধান্ত নেই ক্যাম্পাস টুয়েন্টিফোর সেভেনের হয়ে ঘটনাটা খতিয়ে দেখবো। তাছাড়া আমি ওখানে ছিলাম। ঘটনাটা আসলে কি হয়েছিলো আমার জানার একটা আলাদা আগ্রহ আছে। জানি…” হাত তুলে লিটুকে আগেই থামিয়ে দিলো মুহিব, “জানি আমার জন্য এটা কোনো ফরজ কাজ না। কিন্তু ইউ গট টু ডু হোয়াট ইউ গট টু ডু। এটার শেষ না দেখে আমি শান্তি পাবো না।”
কিছুক্ষণের জন্য আবারও নীরবতা। এতোক্ষণ মুহিব যা বলেছে তা হজম করার চেষ্টা করছে ওরা দুইজন। শামীমকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে এখন। খুব বেশি বিস্তারিত বলার দরকার পড়েনি ওদের। তাই গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্যও ফাঁস করতে হয়নি। মুহিব যা বলেছে তা ক্যাম্পাসে কান পাতলেও শোনা যাবে, যেভাবে ওরা শুনেছে। শামসভাইয়ের পরিবার বা তূর্ণার ব্যাপারটা ছিল গোপনে রাখার মতো, এটুকু মুহিব ঠিকমতো করতে পেরেছে। গোপন রাখতে হতো রেদোয়ান-তোফায়েলের সংশ্লিষ্টতাও।
নীরবতা এবার ভাঙলো ইলোরা, “তোদের কনক্লুশনটা কি? জাকিকে কোনো কারণে তোফায়েলদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, আর এর পেছনে শামসের হাত ছিল? সেজন্য শামস-জাকির সম্পর্ক আর আগের মতো ঘনিষ্ঠ ছিল না। জাকির অজান্তেই ক্যাম্পাসে শামসের প্রোটেকশন উঠে গেছে?”
“অজান্তে?” লিটুর গলাটা বোকা বোকা শোনালো।
“শামসের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো দিক থেকে সাপোর্ট সরিয়ে ফেলতে পারে জাকি। হয়তো ব্যাপারটার তাৎপর্য সে বুঝতে পারেনি তখনও। যখন বুঝেছে ততোক্ষণে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে। হতে পারে না এমন?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মুহিব। ইলোরা তার নারীবৃত্তীয় একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে ফেলেছে। সে এখন কল্পনার ওপর ভিত্তি করেই একটার পর একটা থিওরি দিয়ে যাবে। নিশ্চিত করে কিছু বলার দরকার পড়ছে না মুহিব বা শামীমকে।
“হতে পারে’ তো অনেক কিছুই। সবগুলো সম্ভাবনা একে একে বলে যাক ইলোরা। নিশ্চিন্ত মনে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরালো মুহিব। দূরে সূর্যের আলো ধাতব পৃষ্ঠে লেগে প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। বিজিবির স্পিডবোটগুলো খোলা নদীতে ঘুরে ফিরে টহল দিয়ে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে-মেয়েদের কল্পনাশক্তির মতোই।