অধ্যায় ১
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন ধরণের মানুষ দেখা যায়। এক পক্ষ স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলে, আরেকপক্ষ চলে স্রোতের বিপরীতে এবং তিন নম্বর শ্রেণি হলো তারা, যারা একরকম গাছপাথর। স্রোত যেদিকেই যাক, তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আশা করা অবান্তর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষকে অনায়াসে তৃতীয় কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। এগুলো মুহিবের বিভাগীয় বন্ধু শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকারে প্রথম সপ্তাহেই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। শামীমের বড় ভাই ওদের আট বছরের সিনিয়র, এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাশ করেছেন। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন। ভদ্রলোক নিদারুণ এক পিএইচডি, অথচ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। স্বভাবতই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শামীমের জ্ঞান বেশি। মুহিব ওকে একরকম বিনা দ্বিধায় গুরু মেনে নিয়েছে।
“এক ধরণের খরগোশ দেখবি শিকারীর অবস্থান বুঝে ফেলে সহজে।” শামীম বলেছিলো ওকে, “দুই পা আগায়, তারপর নাকটাকে বাতাসের দিকে তাক করে রাখে এরা। গন্ধ বুঝে পরের দুই পা ফেলে। পিউর খাটাশ!”
খরগোশ কিভাবে খাটাশ হয় তা মুহিবের জানা ছিল না। সেই তর্কে না গিয়ে জানতে চেয়েছিলো, “তারমানে আমরা পরিস্থিতির গন্ধ নেবো এবং পা ফেলবো?”
“অবশ্যই। তাহলে দেখবি র্যাগও খাবি না, ঝামেলাতেও পড়বি না। ক্যাম্পাসে পলিটিকস খুব। ঝামেলায় পড়লে পার্টি করতেই হবে তোকে।”
“ঝামেলায় পড়ে যদি পার্টি না করি?”
শুষ্ক হাসলো শামীম, “মার খেয়ে ছাতু হয়ে যাবি। লাথি মেরে হল থেকে বের করে দেবে তোকে। ভাইয়া জানে এসব, নিজ চোখে দেখেছে।”
হিসাব মেলেনি অবশ্য মুহিবের, “হলে তো উঠতেই পারিনি আমরা এখনও। বের করবে কি করে?”
“সারাজীবন তো আর মেসে থাকবি না। হলে সিট খালি হলে উঠতে তো হবেই তোকে। গ্যাঞ্জাম করলে সিটই পাবি না হলে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে আর কয়দিন মেসে থাকবি?”
“তা অবশ্য ঠিক।” সেশনজট এবং রাজনৈতিক সিট দখলের ঐতিহ্য চালু থাকার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রই আড়াই বছরের আগে হলে সিট পায় না। এসব মুহিবের জানা হয়ে গেছে আগেই। মূল প্রসঙ্গে ফিরে গিয়েছিলো সে, “কিন্তু বাতাস থেকে গন্ধ নেওয়ার সাথে আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের গাছ-পাথর হওয়ার সম্পর্ক কি?”
“শস-স-স!” ঠোঁটের কাছে আঙুল তুলে চারপাশটা দেখে নিলো শামীম, গলা নামিয়েছে, “ক্যাম্পাসের মধ্যে বসে ভিসিকে নিয়ে এভাবে সরাসরি কথা বলবি না কখনও। ঝামেলায় পড়ে যাবি। আর ঝামেলায় পড়লে-”
“পার্টি করতেই হবে আমাকে।” মুখস্ত হয়ে গেছে মুহিবের।
“কারেক্ট!” ঘোষণার সুরে বলেছিলো শামীম, “তো, যেটা বলছিলাম। ওই লোকের গাছপাথর হওয়ার সাথে আমাদের সব ধরণের কার্যক্রমেরই সম্পর্ক আছে। একটা উদাহরণ দেই, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব দেওয়া আর প্রাক্তন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদকে সেই দায়িত্ব দেওয়া কি এক জিনিস?”
“না।”
“পার্থক্যটা আমাকে বল্!” রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো শামীম।
খানিক ভাবতে হয়েছিলো ওকে, “খালেদ মাহমুদ ভদ্রলোক এই দায়িত্ব পেলে সবকিছু বাই দ্য বুক চালানোর চেষ্টা করবেন। সাকিব আল হাসান হয়তো তেমনটা করবেন না।”
“কাছাকাছি গেছিস। আসল কথা হলো, ভিসির দায়িত্বে যে-ই আসুন না কেন, তিনি চেষ্টা করবেন ব্যকরণ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর। কিন্তু ভিসি নিজেই যদি গোঁড়া অনুসারী হয়ে থাকেন–
“কিসের গোঁড়া অনুসারী?”
“পূর্বসূরিদের, অবশ্যই। ভিসি যদি নিজেই পূর্বসূরি উপাধ্যক্ষদের চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করার মানসিকতা রাখেন, তাহলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ একরকম থাকবে। আর তিনি নতুনকে গ্রহণ করার মতো উদারতা দেখাতে পারলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ থাকবে আরেক রকম। পাশের বিশ্ববিদ্যালয়টিকেই দ্যাখ, কি দারুণ প্রগতিশীল ওরা, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটেছে সেখানে। আর আমাদের ক্যাম্পাসের দিকে তাকা। প্রতিবার ভিসি শব্দটা উচ্চারণ করার সময় ফিসফাস করা লাগছে।”
মুহিব সেদিন কিছু না বুঝেই মাথা দুলিয়েছিলো। সাকিব আল হাসান আর খালেদ মাহমুদ তো দুইজন ক্রিকেটার। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির আলাপে তাদের রূপক বানানো কেন? শামীমটা যে কি বাজে বকতে পারে!
দেড় মাস কাটানোর আগেই চোখ ফুটেছিলো ওর। অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলো ওদের ক্যাম্পাসটা আর কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। মুক্তচিন্তার চর্চার জন্য বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম সারাদেশে থাকলেও এই একটি ক্যাম্পাস ব্যতিক্রম।
ঘটনাগুলো আস্তে আস্তে চোখে পড়লো মুহিবের। ওদের ব্যাচেরই এক বন্ধু এইচএসসিতে পাওয়া বৃত্তির টাকা তোলার সময় কর্মচারি ঘুষ চেয়ে বসলো। সেই ঘুষের টাকা দিতে অস্বীকার করলো ছেলেটা, ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে উপাধ্যক্ষের কক্ষে কয়েকবার ঘুরপাক পর্যন্ত খেলো। লিখিত অভিযোগ করলো, মৌখিকটাও করতে কসুর করলো না। কিন্তু ওর এই ছটফটে অভিযান শেষ হলো নিজের ক্যাম্পাসের সিনিয়র সকল-কাজের-কাজি ভাইয়ের মহার্ঘ বাণীতে, “এইরকম কেস চল্লিশ বছর আগের থেকে হইতাছে। তুমি মিয়া নিজেরে কি ভাবতেছো আমি জানি না ভাই। নতুন আইসাই এলাকার নাক নকশা পাল্টায়া দিবা? বাব্বা!”
উপাধ্যক্ষের অতি জরুরি কাগজপত্রের মধ্যে একজন শিক্ষা শাখার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ হারিয়ে গেলো। ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তর ছাত্রদের নানারকম কল্যাণ, যেমন আইডি কার্ড সরবরাহ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দল প্রস্তুতকরণ, আইডি কার্ড হারানোর পর জিডিসহ অন্যান্য ফটোকপি গ্রহণ ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকার কারণে কোন এক সাধারণ মামুলি ছাত্র প্রশাসনের কর্মচারির হাতে দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের শিকার হলো তাতে মনোযোগ দিতে পারলো না।
শিক্ষকরা সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা তাদের নয়। অর্থাৎ চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় ছাত্রদের অন্যায়ের শিকার হতে দেখলে পাশে দাঁড়ানোর কথা তো ওয়ার্কলিস্টের কোথাও লিখিত ছিল না। কেন করবেন তাঁরা? কথাটায় যুক্তি আছে প্রচণ্ডরকম, এর ওপর আর কথা চলে না।
হতাশায় ডুবে থাকা বন্ধুটির একটি কথা মুহিবের কানে আজীবন লেগে থাকবে, “ভার্সিটি আমাদেরকে নিজেদের লোক বলে স্বীকারই করে না, দোস্ত। যে যার আখের গুছাতে ব্যস্ত এখানে।”
কেউ কেউ “সবখানেই এমনটা হয়। বুঝো না তোমরা, ভাবো এখানেই হচ্ছে এসব। কোন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব নেই?” ধরণের সবজান্তা বাণী প্রচার করে বিষয়টা কিছুদিনের মধ্যেই থিতিয়ে আনলো। এরপরই মুহিব লক্ষ্য করলো ‘সবখানে হয় না’ এমন কিছু অসঙ্গতি।
ওদের সেকশনের ইলোরা মেয়েটা যথেষ্ট আধুনিকা। সিটি কলেজের ছাত্রি, মুহিবের মতোই সরাসরি মফস্বল প্রবাসি। সাইক্লিং দারুণ করে, বাস্কেটবলও খেলে চমৎকার। ক্রিকেটেও ভালো। অথচ, সবার প্রথম ধাক্কাটা এলো এই মানুষটার ওপরই। লেডিস হল একটিই এখানে, সেটাও কায়দা করে মূল ক্যাম্পাস থেকে এতো দূরে বানানো হয়েছে যেন মেয়েরা এই দূরত্ব পাড়ি দিতে দিতেই চিকনী চামেলি হয়ে যায়। মেয়েদের মোটা হওয়া তো কোনো কাজের কথা না, সেজন্যই হয়তো ক্যাম্পাস গেট থেকে বরাবর এক কিলোমিটার দূরে মেয়েদের এই হল। ছোটো ক্যাম্পাস, টিচার্স কোয়ার্টার, ছেলেদের হল, কোনোটাই এক কিলোমিটার দূরে না হলেও মেয়েদের হল তেমন এক দূরত্বেই স্থাপিত। মেদ কমানো থিওরির জন্মটা ওখানেই। মাঝ থেকে রিকশাভাড়া দিতে দিতে ফতুর নারীকূল।
এতো দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার জন্য রিকশাভাড়া ঢালার মতো অযৌক্তিক কাজ ইলোরার মতো সাইক্লিস্ট কখনোই করবে না। সে তার সাইকেল নিয়ে নিয়মিত ক্লাসে আসতো, যেতো। তরুণ লেকচারার থেকে বুড়ো প্রফেসর পর্যন্ত চোখ কুঁচকে ইলোরার টাইট জিন্স, টিশার্টের সঙ্গে সাইকেলে ভ্রমণকে লক্ষ্য করতেন। বোমাটা ফাটলো ক্লাসরুমে।
মুহিবসহ ষাটজন উনিশ বছর বয়সের টিনএজার চোখ বড় বড় করে সেদিন শুনলো একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের আপত্তি।”বাঙালি মেয়ে এবং তাদের আচার-আচরণের সীমা–১০১” নামক কোনো কোর্স ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ছিল না। তবে সেদিন তারা ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের সঙ্গে এমন একটি ক্লাস করতে বাধ্য হলো। মেয়েদের কোন ধরণের জামাকাপড় পরে আসা উচিত না, কোন ধরণের কাজ করা উচিত না তা ওরা আগে তেমন জানতো না। ওই ক্লাসে এ ব্যাপারে শিখতে পারলো বেশ। শিখতে পারলো, ভদ্র ঘরের মেয়েদের আবার ক্রিকেট খেলার বাতিক কি? ক্রিকেট খেলবে পড়াশোনা না জানা মানুষ। সরকারি ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া হবু ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে ক্রিকেট খেলবে কেন?
স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর মুহিব আরও ভয়ানক অবাক হলো সহপাঠিদের মধ্যে এই অসভ্য শিক্ষকের বর্বর বক্তব্যকে সমর্থনের বহর দেখে। কি আশ্চর্য! যার যার নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। কিন্তু সেটা কি একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে এসে আলোচনা করার জায়গা?
ইলোরার চোখে পানি এসে গেছিলো এরকম ছোটোলোকি দেখে। করুণ একটু হেসে শুধু বলেছিলো, “দারুণ এক ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস করলাম আমরা, যা হোক।”
এই ঘটনার পর মুহিব প্রথম জানতে পারলো মেয়েদের হল সন্ধ্যা ছয়টার সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোলা হয় একেবারে ভোর ছ’টায়। মুরগির খামারের মতো।
ইলোরাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলো শামীম, “তোদের বারো ঘণ্টা তালাবন্দি করে রাখে?
কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলো ইলোরা, “রাখেই তো।”
“রাত দশটায় হল বন্ধ করলেও একটা যৌক্তিক কাজ হতো। সন্ধ্যা ছয়টা! কিভাবে থাকবি চার বছর?”
“আমাদের আগে চল্লিশ বছর ধরে থাকছে না মেয়েরা?” বাঁকা হাসি হেসে বলেছিলো ইলোরা। এই ক্যাম্পাসে ভুল ত্রুটি শুধরানোর কোনো উপায় নেই। প্রতিটা কথার শেষ কথা ওই একটা লাইন।
তোমাদের আগে চল্লিশ বছর ধরে হচ্ছে এরকম!
মেয়েদের মুরগির খোপের মতো বারো ঘণ্টা বন্দি করে রাখার পেছনের কারণটা ধরতে পেরে মুহিব স্রেফ বোকা বনে গিয়েছিলো। প্রশাসন নাকি মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য এমনটা করে থাকে। এটা ঠিক, শিক্ষক ও স্টাফদের বখে যাওয়া ছেলেরাও ক্যাম্পাসের মধ্যে থাকে, টিচার্স কোয়ার্টারে তাদেরই বসবাস। সুযোগ পেলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রিদের টিজও করে বটে। বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের এক মেয়ের ওরনা ধরে স্টাফের গুণধর পুত্রের টানাহ্যাঁচরার রসালো খবর তো আর কারও অজানা নয়। এই শিক্ষক ও স্টাফদের বীর্যফসল এই সকল বীরপুরুষদের ঠেকিয়ে রাখা তো দূরহ কাজই বটে। সেজন্য আইনের প্রয়োগের দরকার কি? মেয়েদের সন্ধ্যা থেকে বন্দি করে রাখলেই চলে। মশার ভয়ে মশারিতে ঢোকার উদাহরণ দিয়েও একজন বর্ষীয়ান শিক্ষক ক্যাম্পাসে হাসির পাত্র হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অন্যায়গুলো কেমন করে শেকড় গজিয়েছে তা বুঝতে এক সেমিস্টারও প্রয়োজন পড়লো না ওদের। ক্যাম্পাসের ভেতরেই ছুরিবিদ্ধ হলো সিভিলের আসাদ। দুষ্কৃতকারীরা তার মোবাইল মানিব্যাগ নিয়ে চম্পট। এই ঘটনাটির জন্য সরাসরি প্রশাসনের গাফলতিকে দায়ি করে ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিক্রেট গ্রুপে পোস্ট লিখলো আসাদের রুমমেট জাহিদ। নিরাপত্তা ব্যবস্থার এমন হেলাফেলার পেছনে স্টাফদের সন্তানদের অপরাধে জড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা সবারই চোখে আটকাচ্ছে, রীতিমতো ওপেন সিক্রেটটাই কেউ মুখ ফুটে বলার সাহস করতো না। সাহস দেখিয়েই ফেঁসে গেলো জাহিদ ছেলেটা।
“সিনিয়র ভাই’রা ক্যাম্পাসের ভেতরে নিজেদের হলে ডেকে আনলো ছেলেটাকে। তারপর ঘণ্টা কয়েক ধরে ওকে খুব ভালোমতো বুঝিয়ে দেওয়া হলো, নাক টিপলে যাদের দুধ বের হয়ে যায়, তাদের মুখে বেশি কথা মানায় না। বন্ধুকে ছুরি মারা হয়েছে, তাতে কি এমন হয়েছে? গত চল্লিশ বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। অতীতে যখন ছুরি মারা হয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রিরা হাসিমুখে, যাকে বলে বুক চিতিয়ে ছুরি খেয়েছে। এটা নিয়ে হই হট্টগোলের এমন কি আছে এটাই তো স্পষ্ট না। তাছাড়া, স্টাফদের ছেলেরা একটু বীরবীর্য হয়েই থাকে। বিশেষ করে চল্লিশ বছর ধরে যে স্টাফগুলো এখানে কর্মরত, তাদের ছেলেরা তো এই ক্যাম্পাসেই বড় হয়েছে। তাই না? স্থানীয় ছেলেরাই তো তাদের বন্ধু। তোমরা এসেছো চার বছরের জন্য, চার বছর পর চলে যাবে। স্থানীয়দের সাথে ঝামেলার কি আছে? বীরবীর্য এই ছেলেগুলো যদি সুন্দরিদের ওরনা ধরে একটু টানই দেয়, তোমাদের চার বছরের অতিথিদের কাউকে একটা দুটো ছুরি বসিয়েই দেয়, এতো হাঙ্গামার কি আছে? বিদেশি বোতল কেনার জন্য টাকার প্রয়োজন তো হয়, মুফতে কেউ দেয় কি ও জিনিস? এসব নিয়ে এতো হট্টগোলের কি প্রয়োজন ছিল কোনো? ফেসবুকে এসব নিয়ে লেখার দরকারটা কি? এই মুহূর্তে ওই নোংরা পোস্টটা ডিলেট করে দিলেই পারো।
জাহিদ ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে এসেছিলো ওখান থেকে। হাসপাতালে ছিল মুহিবরা, ছুরিবিদ্ধ আসাদকে সঙ্গ দিচ্ছিলো। পুরো ঘটনা ওদের খুলে বলতেই শামীম শব্দ করে হাসলো, “আরে ‘০৫ ব্যাচের এক শিক্ষক তোর পোস্ট দেখে ক্ষেপে গেছে। লোকাল ছোকরা। নিজে তো টিচার, কিছু বলতে পারে নাই, জুনিয়রদের দিয়ে বলাইলো আরকি। পোস্ট ডিলিট করেছিস?”
রাগে কথাই বলতে পারলো না জাহিদ। মাথা নড়িয়ে কেবল নিশ্চিত করলো ব্যাপারটা।
মুহিব মনে করার চেষ্টা করলো, আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু ছুরিকাহত হওয়ার পর ছাত্রছাত্রিরা পথে নামা দূরে থাকুক, ফেসবুকে প্রতিবাদও করতে পারে না। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা টাইট জিন্স পরলে সেটা ক্লাস লেকচারের প্রসঙ্গ হয়ে যায়। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন জড়িয়ে থাকা অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়। কিন্তু এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে দেখতে পেলো না সে।
একদম প্রথম সপ্তাহে শামীম কিভাবে চল্লিশ বছর পুরোনো মানসিকতার একজন উপাধ্যক্ষকে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার জন্য দায়ি করেছিলো মনে পড়ে ওর। কিন্তু জানে, এ বিষয়ে আলোচনার কোনো জায়গা নেই।
কারণ, এখানে যা তারা দেখছে, সবকিছুই চল্লিশ বছর ধরে এভাবেই হয়ে আসছে! আগামি চল্লিশ বছর ধরেও এমনটা হোক, তাই চাইছে সবাই। পরিবর্তন, নতুন কিছু করা এখানে ভয়াবহ অশ্লীল এক শব্দ!