অধ্যায় ১৯
“কনফ্লিক্ট।” গম্ভির মুখে বললেন হাকারবিন, “আপনারা এই আইডিয়ার সাথে কম-বেশি পরিচিত আছেন। ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবনে এর প্রভাব আপনারা দেখে থাকবেন, তেমনটাই রয়েছে কর্মক্ষেত্রে। এটাই ওয়ার্কপ্লেস কনফ্লিক্ট। ম্যানেজমেন্টে এর বিশেষ গুরুত্ব আছে।”
উদাস ভঙ্গিতে হাতের বইটা লেকচার টেবিলের ওপর রেখে দিলেন তিনি ক্লাসরুমের সবাই আগ্রহের সাথে তার দিকে তাকিয়ে আছে, লক্ষ্য করলো মুহিব। এমন দৃশ্য দুটো বা তিনটে ক্লাস ছাড়া দেখা যায় না। রবিনস্যার, পারভেজ স্যার, তরুণ স্যার। এদের ক্লাসে কেউ বেঞ্চের তলায় মোবাইল রেখে গেম খেলে না, টেবিলে মাথা রেখে ঘুমায় না, এমনকী লেকচার না শুনেও মনোযোগ দেওয়ার ভান করে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন কিছু প্রিয়মুখ থাকে, যাদের ক্লাসে ছেলেমেয়েরা শেখার আগ্রহ নিয়েই শেখে।
“কনফ্লিক্টের একটা উদাহরণ দিতে পারেন কেউ আমাকে?” কপালের বলিরেখার নিচ থেকে একজোড়া সুতীক্ষ্ণ চোখ পালাক্রমে ওদের সবার দিকে তাকালো। যথারীতি অনেকগুলো হাত আকাশে উঠে গেছে। হাকারবিনের ক্লাসে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আগ্রহি স্টুডেন্টের অভাব হয় না। শাহাবুদ্দিন স্যারের ক্লাসে এমন দৃশ্য কল্পনাতেও আনা সম্ভব না। পার্থক্যটা তারা জানে, শিক্ষকবৃন্দ জানেন বলে মনে হয় না।
হাকারবিন যে কোনো ধরণের প্রশ্নকেই “এনকারেজ” করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্য শিক্ষকগণ এতোটা উদার মনোবৃত্তির নন। তারা প্রশ্ন করার আগেই জানিয়ে রাখেন, প্রশ্নটিকে হতে হবে “র্যাশনাল”, কোনো ধরণের স্টুপিড প্রশ্ন যেন তাদের করা না হয়। একজন ছাত্র প্রশ্ন করার আগে কি করে বুঝবে কোন প্রশ্নটা “র্যাশনাল” হবে আর কোন প্রশ্ন “স্টুপিড”? ঘাড়ে একাধিক মাথা না থাকার কারণে প্রশ্ন বা উত্তর পর্ব থেকে সবাই সযত্নে নিজেদের গুটিয়ে রাখে। ক্লাসের ভালো সিজিপিএধারীরা শিক্ষকের প্রিয়পাত্র, তারাই কেবল কথা বলে যায় অনর্গল। জমে থাকা প্রশ্নদের একাংশ ঝেড়ে ফেলার জন্য হাকারবিনদের মতো ক্লাসে অনেকগুলো হাত ওপরে ওঠে। সবাইকে সুযোগ দেওয়া অবশ্য সম্ভব হয় না।
“মি. অনিক। প্লিজ।” অনিকের দিকে তাকিয়ে বললেন হাকারবিন।
”কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস।”
ইতিহাস আর ভূগোল নিয়ে অনিকের আগ্রহ প্রফেসরেরও জানা আছে। তিনি এই উদাহরণটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিলেন, “আ ডিসেন্ট এক্সাম্পল, মি. অনিক। সেই তেরো দিনের চরম অবস্থা। আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক দাঙ্গা বেঁধে গেলো কি না তাই নিয়ে পৃথিবী ছিল উৎকণ্ঠিত। কেনেডি আর ক্রুশ্চেভ। আমেরিকা তাদের মিসাইলগুলো রেখেছিলো তুর্কি আর ইতালিতে, যেখান থেকে তারা চাইলে রাশিয়াকে যে কোনো সময় হিট করতে পারবে। স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া কিছু মিসাইল এনে রাখতে চেয়েছিলো কিউবাতে। কিউবার মাত্র নব্বই মাইল দূরে ফ্লোরিডা। আমেরিকা যখন দেখলো রাশিয়াও তাদের ল্যান্ডে নিউক্লিয়ার মিসাইল মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরবর্তি মিসাইলগুলো যেন কিউবাতে না পৌঁছায় সেজন্য অবরোধ দিলো তারা। তেরো দিনের আলোচনার পর ঠিক হয় রাশিয়া তাদের সব মিসাইল খুলে নিয়ে যাবে, আমেরিকাও ইতালি আর তুর্কি থেকে তাদের মিসাইল সরিয়ে নেবে।” ক্লাসের দিকে তাকালেন তিনি, “বিশদ আলোচনা করছি, কারণ এই ঘটনার সাথে আপনাদের অনেকে পরিচিত না হয়ে থাকতে পারেন। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসের কথা এসব। তো আমার যেটা প্রশ্ন, মি. অনিকের উদাহরণ থেকে আপনারা কি বুঝতে পারলেন?”
হাত তোলার ঝামেলায় গেলো না বিশালবপু ফাহাদ। সরাসরি উত্তর দিলো সে, “কনফ্লিক্টের জন্য প্রয়োজন অন্তত দুটো পক্ষ।”
“এক্সেলেন্ট। আর কেউ? হ্যাঁ, মিস তিন্নি?”
শীর্ণকায় তিন্নির গলা থেকে যন্ত্রণা দেওয়ার মতো চিকণ কণ্ঠটা বের হয়ে এলো, “দুটো পক্ষের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে মেনে নিবে না। মানে স্যার তাদের সিদ্ধান্তকে। আমেরিকা যদি বলতো ইটস ওকে, বোমাই তো মারবা বড়জোর, আনো তোমাদের মিসাইল। তাহলে তো আর কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস ঘটে না।”
তিন্নির বলার ধরণে অনেকে হেসে ফেললো। হাসলেন হাকারবিনও, “ঠিক। এখানে আমি একটা বিষয় যোগ করবো, কনফ্লিক্টের জন্য যে কারণটা দরকার তা বাস্তবও হতে পারে, কাল্পনিকও হতে পারে। যেমন যদি আমরা ফলাফল দেখি, রাশিয়া কখনও আমেরিকায় নিউক্লিয়ার বোমা মারেনি। অথচ তারা ঝগড়াটা করলো এই মিসাইল পড়ার সম্ভাবনা নিয়েই। অর্থাৎ কোনো বাস্তব উপাত্ত নেই ইতিহাসে, এমন এক কাল্পনিক ভয়কে কেন্দ্র করে কনফ্লিক্ট বাঁধতে পারে। তবে বেশিরভাগ সময় ভয়টা কাল্পনিক হলেও তা বাস্তবে রূপান্তরিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ বা সম্ভাবনা থাকে।”
আগ্রহ নিয়েই ছেলেমেয়েরা তার কথা শুনে যাচ্ছে। ম্যানেজমেন্টের মতো একটা বোরিং কোর্স সম্ভবত হাকারবিনের জন্যই কোনোভাবে করা যাচ্ছে।
“তবে, আমরা এখন আমাদের কোর্সের দিকে মনোযোগ নিয়ে আসবো।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনফ্লিক্ট হলো এই একই জিনিস, দুটো পক্ষের মধ্যে কোনো কাল্পনিক বা বাস্তব কারণ নিয়ে গ্যাঞ্জাম বেঁধে যাওয়া। এই দুই পক্ষ যে কোনো পক্ষেরই হতে পারে। অর্থাৎ চাকরিজীবির সাথে চাকরিজীবির লাগতে পারে, চাকরিজীবির সাথে চাকরিদাতারই লেগে যেতে পারে আবার চাকরি যারা দেয় তারাও একে অন্যের সাথে লড়াই করতে পারে। একই কোম্পানির ক্ষেত্রে বলছি আমি সংজ্ঞাটা। এর ফলাফল কি ঘটে?”
নির্দিষ্ট উত্তর খুঁজছে ছেলেমেয়েরা, এবার সাথে সাথে কেউ উত্তর দিলো না। মুচকি হাসলেন হাকারবিন, “রাশিয়ার কার্যক্রম আমেরিকা মেনে নেয়নি। তাই তারা কি করেছিলো?”
“অবরোধ।” মুখস্ত বলে দিলো অলিখিত ইতিহাসবিদ অনিক।
“চমৎকার, একদম ঠিক জায়গায় টোকা দিয়েছেন, মি. অনিক!” উচ্ছসিত কণ্ঠেই বললেন হাকারবিন, “ইন্ডাস্ট্রিতে যখন এমন কনফ্লিক্ট লাগে তখনই শ্রমিক ধর্মঘট, অবরোধ আর মিছিল চলে। স্ট্রাইক, লক-আউট র্যালি…যেমন আপনাদের পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনের কথাই ধরেন…”
ক্লাসে একটা হাসির রোল উঠলো। সেমিস্টার ফাইনাল পেছানোর সময় কোমর বেঁধে প্রশাসনিক ভবনে ভিড় করে ওরা অভ্যস্ত। একটা হলেও সেমিস্টার ফাইনাল তাদের পেছানো লাগে প্রতিবার।
“আপনারা বলেন পরীক্ষা একটা পেছানো হোক, প্রশাসন বলে ‘না।” অর্থাৎ আপনারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেটা প্রশাসন মানেনি। কাজেই চাপ প্রয়োগ করতে কিছু একটা করছেন ছাত্রপক্ষ। মিছিল হোক, ক্লাস বর্জন হোক। এটাও ওয়ার্কপ্লেস কনফ্লিক্টের একটা ভালো উদাহরণ। আগামীতে আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ কোম্পানিগুলোতে ঢুকে যাবেন। আপনাদের নিচে অনেক শ্রমিকরা কাজ করবেন, তাদের নানা রকম দাবি দাওয়া থাকবে। সবগুলো যে বৈধ কারণের ওপর দাঁড়াবে তেমন না। অনেক সময় দেখবেন তাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে এই আন্দোলন করছে। অবশ্যই অবৈধ আয়ের উৎস।” চোখ টিপ দিয়ে বললেন তিনি, “তবে কারণটা বৈধ হোক আর অবৈধ, আন্দোলন শুরু হলে, শ্রমিকরা ধর্মঘটে নামলে আপনি এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইবেন। শ্রমিক ছাড়া তো আর কারখানা চলবে না।”
“যেমন ছাত্রছাত্রি ছাড়া চলবে না বিশ্ববিদ্যালয়।” মুহিব বলে উঠলো।
“এক্সাক্টলি। এটা একটা কারণ, আপনাদের আন্দোলন প্রশাসন বরাবরই মেনে নেয়। তবে এর পেছনে আরও বড় কারণ থাকে, মিউচুয়াল অ্যাগ্রিমেন্টের বাপারে আসলে সবাইকে দেখতে হয় সবার ভালো। প্রশাসনের হাতেও চাপ প্রয়োগের অসংখ্য অপশন থাকে, যাদের অনেকগুলো আপনাদের ওপর নির্দয়ের মতো খাটানোও হয়ে থাকে, তবে দীর্ঘসূত্রিতায় কেউ যেতে চান না…”
হাকারবিনের লেকচার মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে চোখ। ক্লাসের দিকে সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে তাকালো মুহিব। ইলোরার সিটটা ফাঁকা। লিটুকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দু’-একদিনের মধ্যে এদের সাথে একবার দেখা না করলে আর হচ্ছে না, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে।
*
তোফায়েলের সাথে ইদানিং রেদোয়ানের দেখা হয় কালেভদ্রে। পানাসক্ত দুই অবিবাহিত যুবককে যেসব জায়গায় একত্রে দেখা পাওয়ার আশা করা যায় সেসব জায়গায়-যেমন ইউসুফ’স বার। ইউসুফের এই বার কিভাবে লাইসেন্স পেয়েছে সে ব্যাপারে কারও সন্দেহ বিশেষ নেই, মেয়রের বন্ধুদের মধ্যে অত্যন্ত পছন্দের লোক এই ইউসুফ। আগে খুন খারাবী করতো। লোকে তাকে ডাকতো “মাউরা ইউসুফ”। খুন খারাবীর লাইন ছেড়ে যদি দোস্ত ভালো পথে আসতে চায়, কোন বন্ধু না করতে পারে? মেয়রসাহেবও পারেননি। তাছাড়া, কথায় আছে, বারটেন্ডার কখনও নিজের বারের মদ খায় না। সেই সূত্রে ইউসুফ নিশ্চয় এখন পানাসক্তি কমাবে। এক ঢিলে দুই পাখি মরলে বারের লাইসেন্স জোগাড় করে দিতে সমস্যা কি? শহরের দ্বিতীয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত বার এটা। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য অভয়ারণ্য। একটা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র হলেই চলে। প্রমাণ মিলে যাবে বয়সের, যদিও ছুঁচলো দাঁড়িতে ছেলেছোকরাদের দেখলেই বোঝা যায় বয়স ঠেলেঠুলে পনেরোও পার হয়নি। তাতে ইউসুফের কিছু আসে যায় না। এর চেয়ে কম বয়সে সে মানুষ মেরে হাত লাল করেছে, এরা সেখানে মাল খেয়ে চোখ লাল করবে। বহুত বড়িয়া!
রেদোয়ান তরলের দোষে সামান্য দোষযুক্ত। জড়ানো গলায় বলল, “আজকে না হলে চলতেছে না ব্যাটা। কাউন্টারের দিকে দ্যাখ, রাতের মজা উসুল। পাছাটা সেই।”
ঘোলাটে চোখে কাউন্টারের দিকে তাকালো তোফায়েল। লাল স্কার্ট পরে ওখানে উবু হয়ে আছে এক তরুণী। এই পোড়া শহরে ব্যবসার স্বার্থে বড় বড় শহর থেকে কিছু মানুষ আসে। তারা মফস্বলের ‘খ্যাত’ মনোভাব ধারণ করে না। মজা করার উৎস কম বেশি পাওয়া যায়। তাদের বেশিরভাগের বয়সটা একটু বেশি হয়। জীবনের চাপে পিষ্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিংবা হ্যান্ডলার। রাতটা এখানে সব সময়ই নবীন। বাইরের অতিথিদের কেউ বারে না এলে লোকাল মেয়ে দিয়ে কাজ হয়ে যায় ওদের। অনেকদিনের অভ্যাসে শেষ নেশাটা মেয়ে ছাড়া হয় না। কাউন্টারের মেয়েটা তোফায়েলকে আরেকটু পরিস্কার দেখতে সাহায্য করলো। অল্পবয়সী মেয়ে এখানে তেমন আসে না। লাল চোখে রেদোয়ানের দিকে তাকালো সে, “ভালো জিনিস।”
গ্লাসে টোকা দিলো রেদোয়ান, “ওইটাই বলার চেষ্টা করতেছি তোরে। একটা কথা তো চাইরবার না কইলে বুঝোস না, মাগির পুত। ম্যানেজারকে ডাক্। মাউরা ইউসুফ, মাউরাচোদা ইউসুফ।” গলা তুলে দুইবার ডেকে খানিকক্ষণ নিজে নিজেই হাসলো রেদোয়ান, “মালটা দিয়েছে সেই, কড়া!”
গ্লাস নিয়ে টলতে টলতে মাউরা ইউসুফের চেম্বারের দিকে হাঁটা দিতে ধরেছিলো মাতাল বন্ধু, এক হাতে তাকে ধরে থামিয়ে দিলো তোফায়েল,
“সব ব্যবস্থা করা আছে বন্ধু। সব ব্যবস্থা করা আছে।”
বারের দোতলাটা হোটেল। আধঘণ্টা পর সেদিকে এগিয়ে চললো ওরা দুইজন। তোফায়েলের বাহুতে প্রায় ঝুলে আছে তখন লাল-স্কার্ট। খিলখিল করে হাসছে। বিদেশি পানির দোষ কিছুটা যে সেই হাসিতে নেই তা নয়, একই কথা খাটতে পারে মেয়েটির ভাঁজে ভাঁজে সেঁটে থাকা রেদোয়ানের চকচকে দৃষ্টির বেলায়। তবে আজ রাতে যা ঘটবে তার দায় অ্যালকোহলের ওপর চাপানো যাবে না। লক্ষ বছরের আদিম প্রবৃত্তির ওপর আসতে পারে সেই দায়ভার।
আর, সভ্যতার সবগুলো পাঠ ভুলতে বসা দু’জন ভয়ংকর যুবকের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর।