অধ্যায় ১৬
ধানমণ্ডি লেকের এই প্রান্তটা এখন অনেকটা সুনসান। আর মাত্র আধঘণ্টা-তারপর এখানে পা রাখা দায় হয়ে যাবে। আড্ডা, গল্প, প্রেম-সব কিছুর জন্য উপচে পড়বে ভিড়। আরেক শ্রেণির মানুষ এখানে পা রাখবে। তাদের গল্পকার বা কবি কোটায় ফেলে দেওয়া যাবে অনায়াসে। গল্প খুঁজতে এখানে আসেন অনেকে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে অসংখ্য গল্প। কোনোটা কোনোটার চেয়ে কম আগ্রহোদ্দীপক নয়। এই মুহূর্তে লেকের কিনারা ধরে হাঁটতে থাকা সবুজ টিশার্ট আর হলুদ জামা পড়া ছেলে-মেয়ে দুটো অবশ্য আনকোরা কোনও গোত্রভুক্ত হবে। এদের মধ্যে প্রাণোচ্ছ্বলতা নেই।
“বাবার আচরণে কিছু মনে করবেন না। ভাইয়ার…” এক সেকেন্ডের জন্য যেন শক্তি হারালো মেয়েটি, তবে এক সেকেন্ডের জন্যই।”ভাইয়ার খুনিদের ধরা হোক তা বাবার চেয়ে বেশি আর কে চাইবে? তাদের বিচার হলে কি ভাইয়া ফিরে আসবে? আসবে না। এটা বাবা জানে, আমি জানি। কিন্তু তাই বলে কি ওদের ছেড়ে দেবো? অসম্ভব!”
শুনছে মুহিব। এমন এক পরিস্থিতিতে ভাইহারা বোনকে কি বলতে হয় তার জানা নেই। সান্ত্বনা সে দিতে পারে না। গল্প লিখার জন্য মানব মনস্তত্ব নিয়ে ক্রমাগত পড়াশোনা করতে হয় তাকে। ওর জানা আছে, প্রচণ্ড দুঃখবোধ যখন কাউকে আক্রান্ত করে, তার সঙ্গে এমন কারও সান্ত্বনা কার্যকর না যে সেই একই দুঃখবোধের অভিজ্ঞতা থেকে আক্রান্ত নয়। সাইকোলজি বলে এখানে যারা একই রকম অভিজ্ঞতাধারী তাদেরও উচিত “আপনার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি” ধরণের বাণীবর্ষণ না করা। কারণ, অন্য একজন ভাই হারানো বোন আর এই মেয়েটির দুঃখবোধ অবশ্যই আলাদা। এ এমন এক দুঃখবোধ, এমন এক অসহায়ত্ব, যার সরলীকরণ চলে না।
“তাহলে, আপনি চাইছেন আপনাদের পোর্টাল থেকে ক্রমাগত নিউজ করে যেতে? যতোদিন পর্যন্ত না প্রশাসন কাজটা করে দেখায়?” কাজের কথায় চলে এলো শিয়া, “চাইছেন অথোরিটিকে মিডিয়া প্রেশারে রাখতে?”
মাথা দোলালো মুহিব, “ক্যাম্পাস টুয়েন্টিফোর সেভেন আর কিছু করতে না পারুক, বার বার আমাদের ছেলেদের রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারবে। বার বার। পলিটিকাল কিছু সমস্যা আছে, তারা চাইবে এই মুভমেন্ট না হোক। তারা এটা চাইবেই।”
ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো শিয়া, থমথমে হয়ে এসেছে মুখ।
“আপনি কি করে জানলেন পলিটিকাল বাঁধা আসবে? ভাইয়াকে কি পলিটিক্সের সাথে জড়িত কেউ মেরেছে?”
সরাসরি তার দিকে তাকাতে পারলো না মুহিব। লেকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “ক্যাম্পাসে এধরণের কিছু ঘটানোর সাহস তাদেরই থাকে, যাদের ব্যাকআপ দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্ত পক্ষ পাশে আছে। আর এমন পক্ষ পলিটিক্স ছাড়া আসে না। প্রশাসনেরও ক্ষমতা নেই এতোটা বাড়াবাড়ি করার।”
চোখ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শিয়া। মনে হলো এতোটুকুই সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে এ বিষয়ে আর টানলো না। আস্তে করে বলল, “চলুন ওখানে বসি। চলাফেরা করতে করতে কথা বলা যায় না।”
আশেপাশে কেউ নেই, এমন একটা কোণে বসলো ওরা। ধানমণ্ডি লেকে চিরায়ত ব্যস্ততা। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতেছে কিছু গ্রুপ। ব্রিজের ওপর একটা মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে দিয়ে নানা ঢঙে নিজের ছবি তোলাচ্ছে। ওই ব্রিজেরই মাঝখানে ছোট্ট একটা ছেলে কালো এক কুকুরকে জড়িয়ে তার চোয়াল ধরে টেনে ফাঁক করার চেষ্টা করতে ব্যস্ত। ভালো পোষাক পরা কাউকে দেখলেই সে দৌড়ে গিয়ে তাদের কাছে টাকা চাইছে। প্রেমিকযুগলের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি—এদিকে অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ওখানকার ছেলেমেয়েদের জন্য প্রেম করার জায়গা হিসেবে এই লেকের পাড় খারাপ জায়গা না।
শামসভাইয়ের একমাত্র বোনটির সঙ্গে পরিচয়ের বেশিক্ষণ হয়নি। শিয়া ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রি, মুহিবদেরই ব্যাচে। ভাই হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে উদগ্রীব হয়ে আছে। শোকের চেয়ে তার মধ্যে ঘৃণাটাই বেশি দেখতে পেলো মুহিব। অথবা, শোকটুকুর পুরোটাই পরিবর্তিত হয়ে এসেছে প্রিয়জনের হত্যাকারীর প্রতি ঘৃণায়। বয়সে সে তরুণ, স্বভাবতই তার এতোবড় ক্ষতি যারা করলো তাদের কিছু ক্ষতি করাটাই এখন শিয়ার মূল লক্ষ্য।
বসার পর মেয়েটির প্রথম কথাটি শুনে মুহিব বুঝতে পারলো, চরিত্র নির্ণয়ে ভুল করেনি সে। গলা নামিয়ে শিয়া বলল, “যদি খুনির পরিচয় বের করতে পারেন, আমার কাছে প্লিজ যথাযথ প্রমাণ দিয়ে জানাবেন। কোন্ ধরণের প্রমাণের কথা বলছি বুঝতে পারছেন তো? যে ধরণের প্রমাণ আদালতে না টিকলেও চলবে। কেবল আমি যেন নিশ্চিত হতে পারি, খুনটা কে করেছে।”
মুহিবের মনে হলো কেউ ওর হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরেছে। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড জোরে ধুকপুক করতে শুরু করলো ওটা। ভয় হলো শিয়ার কানেও চলে না যায় ড্রাম বাজাবার মতো আওয়াজের ওই ধুকপুকানি। খুনটা কে করেছে তা মুহিবের চেয়ে ভালো আর কে জানে!
“আপনি কি চাইছেন আইনের বাইরে গিয়ে খুনির সঙ্গে বিষয়টার একটা ফয়সালা করতে?” একই রকম নিচু গলায় জানতে চাইলো মুহিব।
“হয়তো। আইনের বাইরে বা ভেতরে নয়, আমি চাই খুনির শাস্তি হোক। পরবর্তিতে আমাদের যেন না শুনতে হয় খুনির সঙ্গে সরকারদলের নেতাদের আঁতাত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ মুছে ফেলা হয়েছে, বা আদালতে উত্থাপনযোগ্য যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওরকম কিছু ঘটতে গেলে আমি অবশ্যই হস্তক্ষেপ করবো।”
একটু লম্বামতো, শীর্ণকায় মেয়েটির দিকে ভালোভাবে তাকালো মুহিব। কিশোরীর মতো মুখ, দেখে মনে হয় এখনও স্কুল পার করতে পারেনি। অথচ কি আত্মবিশ্বাসের সাথেই না বলছে, “আমি হস্তক্ষেপ করবো!
“খুনির ব্যাপারে শক্ত প্রমাণ পেলে আমি আপনাকে জানাবো।” তাকে আশ্বস্থ করলো মুহিব। সে যদি এখন মেয়েটিকে বলে, তোমার ভাইকে যখন ওরা জবাই করছিলো, আমি সেখানেই ছিলাম। ওখানেই আমি শুয়ে ছিলাম, একটা গোল্ডলিফের প্যাকেট হাতে জড়িয়ে। কাপুরুষের মতো আমি মিশে ছিলাম কনক্রিটের সাথে। লুকিয়ে ছিলাম যেন আমাকে খুনিরা দেখতে না পায়। প্রাণটা আমার বেঁচে যায়। আর তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ সবল একজন মানুষ ছিল তোমার ভাই, যার গলা চিরে দু’টুকরো হয়ে যায়নি এতটাই সুস্থ। যদি আমি তখন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম, আজকে হয়তো আমাকে এখানে আসতে হতো না।
হয়তো!
এই মেয়েটি কি তখন আজীবনের জন্য মুহিবকে ঘৃণা করবে না? তার ভাইয়ের সবচেয়ে দরকার যখন হয়েছিলো তখন সেখানেই ছিল অথচ তাকে সাহায্য করতে একটা আঙুলও নাড়ায়নি যে মানুষটা, তাকে কোন সুখে সাহায্য করবে সে? অথচ এই পরিবারটির সাহায্য না পেলে শামসভাইকে কেন হত্যা
করা হলো তা জানা যাবে না। তা জানতে না পারলে রেদোয়ান–তোফায়েলদের বিরুদ্ধে কিছু দাঁড় করানোর সম্ভাবনাও কমে আসবে।
কিছু সত্য থাকুক নাহয় গোপন।
নোটপ্যাড খুললো মুহিব, “শামসভাইয়ের ব্যাপারে কিছু তথ্য আপনার থেকে আশা করছি আমরা।”
তার দিকে তাকিয়ে আছে শিয়া, সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে দেখছে ছেলেটার প্রতিটি নড়াচড়া।
“উনার বন্ধুদের ব্যাপারে আপনি কি বলতে পারেন?”
একটু ভাবলো শিয়া, “কলেজের ফ্রেন্ডদের মধ্যে–”
“শুধু ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকুক আমাদের আলোচনা।” “তাহলে, জাকি ভাইয়ের কথা বলা যায়। ভাই একবার আমাদের বাসায় এসেছিলোও। ছিল এক সপ্তাহের মতো। জাকি ভাইকে আপনি চেনেন?”
“অবশ্যই। শেরে বাংলা হলে থাকেন।”
“জাকি ভাই ছাড়াও আরও কিছু ফ্রেন্ড ভাইয়ার ছিল। নির্ঝর ভাই, মঞ্জুর ভাই।”
মাথা দোলালো মুহিব। নির্ঝর আর মঞ্জুর জাকি গ্রুপেরই ছেলে। ”উনারা তো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। শামসভাইও কি—কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো শিয়া, “ভাইয়া কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল না।”
“থাকলেও সেটা অন্যায় কিছু না।” দ্রুত যোগ করলো মুহিব।
মাথা নাড়লো শিয়া, “আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার ভাই মনে করতো না এধরণের ছাত্র সংগঠনগুলো দিয়ে কোনো উপকার হচ্ছে কারও। দেশের রাজনীতিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত, জ্ঞানসম্পন্ন ছেলেরা নেই। ডিগ্রিধারী আছেন অনেকে, তবে ডিগ্রি দেখে তো আর ‘শিক্ষা’র অবস্থা বোঝা যায় না। আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন কোনধরণের শিক্ষার কথা আমি বলছি। মন্ত্রি মিনিস্টারদের বেফাঁস মন্তব্য তো আপনি খবরের কাগজ খুললেই পাবেন। বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে ওইসব মন্ত্রির কি লাভ হয়েছে? কিছু জিনিস আপনি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে শিখতে পারবেন না। এগুলো শেখানো উচিত ছিল ছাত্র সংগঠনে। ছাত্র রাজনীতির ফলাফল হিসেবে এধরণের মন্ত্রি নির্বাচন না হওয়া উচিত ছিল। তা কিন্তু হয়নি, কেবিনেট মেম্বাররা সবাই মার্কামারা। দূরদর্শিতা আসেনি, দেশে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তনই আসেনি রাজনৈতিক অঙ্গনে। তাহলে ছাত্র সংগঠন করে কি লাভ? সমস্যাটা নিশ্চয় ছাত্র রাজনীতি করার প্রক্রিয়াতেই, তাই না? এসব কারণে, আমার ভাই খুব সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলতো সবগুলো সংগঠনকে।”
শিয়ার কানে বেজে উঠলো শামসের একটা কথা।”বালটাও হইবো না এই ধরণের সংগঠন মংগঠন কইরা। সংগঠিত হইতে হইবো ভিন্ন ভাবে…” মুহিবও যেন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে। তার পরের প্রশ্নে সামান্য হলেও চমকে উঠলো শিয়া।
“ভিন্নধর্মি কোনো পলিটিকাল ভিশন কি তার ছিল? এমন কোনো ভিশন, যার সঙ্গে এই সময়ের কোনো রাজনৈতিক দলেরই যায় না?”
“এটা অপ্রাসঙ্গিক আলাপ। আমি এ বিষয়ে কিছু বলবো না।” শক্ত হয়ে বলল শিয়া।
মেয়েটা কিছু একটা লুকাচ্ছে, বুঝতে পারলো মুহিব। তবে সে শামস হত্যার তদন্তকারী অফিসার নয়। চাপ দিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার এখতিয়ার তার নেই। পরের প্রশ্নে চলে গেলো সামান্য বিরতি দিয়ে।
“ভাইয়ার সাথে কি কারও প্রেমের সম্পর্ক ছিল? আমরা আসলে ক্যাম্পাসে খোঁজ নিয়েছি। এমন কাউকে পাইনি এখনও।”
অবাক হলো মেয়েটা, “জাকি ভাই বলেনি?”
“জাকি ভাইয়ের ইন্টারভিউ নেওয়ার চেষ্টা করছে আমার কলিগ, শামীম। উনার শিডিউল পাওয়া যায়নি এখনও
“ভাইয়ার সাথে ওখানকার এক আপুর রিলেশন ছিল। ওদের ভার্সিটির না, একই শহরে থাকে। আপুটা অনেক ভালো। আমি অন্তত খুশিই ছিলাম ওদের ব্যাপারটা জেনে।” চোখ মুছলো শিয়া। এই প্রথমবার তার চোখে পানি দেখছে মুহিব।
“আপুর নাম?”
যদিও অপ্রত্যাশিত ছিল না, শিয়ার উত্তরটা বেশ চমকে দিলো মুহিবকে।”তূর্ণা।”