৮
এরই মধ্যে কীর্তিহাটের ম্যানেজার নায়েব এসে এত্তেলা পাঠিয়েছিল। শব্দকল্পদ্রুমখানা সরিয়ে রেখে রায় বলেছিলেন, আসতে বল।
ঘোষাল-নায়েব এসে বসে বলেছিল—কি হল?
রায় বললেন—শীলেদের সঙ্গে মহিষাদলের একটা মিটমাট হচ্ছে।
—মিটমাট হচ্ছে? বিস্মিত হলেন ঘোষাল। মিটমাট হবার তো কথা নয়। মহিষাদলে ওরা ক্রোক পরোয়ানা নিয়ে গেলে শীলেদের লোকের তো প্রাণ যায় যায় হয়েছিল। গড়ের দরজা বন্ধ করে ভিতরে লোকজন তৈরী রেখেছিল। জোর করে ঢুকলে একটি প্রাণীকে ফিরতে হত না। কালেক্টার-সাহেবকে মেদিনীপুর থেকে এনে তাঁকে নিয়ে ঢুকেছিল। শীলদের এক ছেলে বলছিলেন, ভগবান এসে বললেও মিটমাট করব না।
বীরেশ্বর বললেন, সে হয়তো জেদের মুখে সে সময় বলে থাকবেন ওঁরা। কিন্তু পরে ওঁরা বুঝেছিলেন। মহাজনী ওঁরা করেন, ব্যবসা ওঁদের। কিন্তু হাজার হলেও মতি শীল মশায়ের বংশ। তিনি সামান্য অবস্থা থেকে বড় হয়েছিলেন। দান-ধ্যানে সদাশয় লোক। তাঁর বংশ তো!
—তোমাকে, মানে—মনবুঝানো কথা বলে নি তো?
—না। আমি ওঁদের বাড়ী যাই নি। ওঁরা আমাকে বলেন নি। বললেন স্বয়ং রাজাবাহাদুর রাধাকান্ত দেব। তাঁর খবর মিথ্যে হতে পারে না। নিজে সঠিক না জেনে কথা বলবার লোক নন তিনি।
—হ্যাঁ, তা নন। ঘোষাল চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে বসে রইল। রায় বুঝলেন-মহিষা- দলের প্রতি ঘোষালের এ বিরাগ আপোসের সংবাদে সন্তুষ্ট হয় নি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঘোষাল বললেন, তা হলে আমি চলে যাই আজই। তা ভালই হল। রবিনসন পাচ্ছে না! সেই ভয়টাই আমার ভয়।
জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রায় বললেন, কাল সকালে যাবেন। এখন জল- ঝড় কালবৈশাখীর সময়। এই বিকেল মাথায় করে যাওয়া ঠিক হবে না। আর কথাও কিছু আছে।
ঘোষাল বললে, সেটা এই সময় হওয়াই ভাল নয়? মানে সন্ধ্যার সময় তো—।
সন্ধ্যার সময় সোফিয়াকে নিয়ে মজলিশের কথা ইঙ্গিতে বললেন ঘোষাল। বীরেশ্বর বললেন, তাই হোক। বসুন। মহিষাদলের কথাটাই আগে বলে নিই। রাজাবাহাদুর বললেন, মিটমাটের শর্ত অনুযায়ী এখন এক লাখ দিতে হবে, বাকী টাকার জন্যে কিস্তিবন্দী হবে। ওঁরা হয়তো আপাততঃ টাকার জন্যেও বটে, আর নিয়মিত খাজনা পাবার জন্যেও বটে—কিছু-কিছু লাট পত্তনী বিলি করতে পারেন।
একটু থেমে ভাবলেন রায়। সম্পত্তিতে তাঁর আকর্ষণ নেই। কিসের আকর্ষণ? ভবানী নেই। সন্তান নেই। কিসের জন্য, কার জন্যে সম্পত্তি? সব ভেঙে-চুরে বিলিয়ে দিয়ে যেতে পারলে তাঁর তৃপ্তি! বিমলাকান্তের সন্তানের জন্যে, বংশের জন্যে। ভাবলে পাথরে মাথা ঠুকে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয় তাঁর। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। সে দীর্ঘনিঃশ্বাসে মুখ তুলে তাকালেন ঘোষাল। কিন্তু বলতে কিছু সাহস করলেন না।
বীরেশ্বর নিজেই বললেন, সম্পত্তিতে আমার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে হয় না কিনতে। কি হবে সম্পত্তি বাড়িয়ে? তবু—
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তবু ভূমি বিশেষ করে এখন জমিদারী স্বত্বের ভূমি একরকম রাজত্ব। ও পরহস্তগত হলে সহজে পাওয়া যাবে না। আগের কাল নেই যে, জবরদস্তি করে, গায়ের জোরে দখল করা যায়। যতক্ষণ বেঁচে থাকতে হবে, ততক্ষণ মান-সম্মানের জন্যও করতে হবে। কিনতে বা পত্তনী নিতে হবে। নেওয়া উচিত।
ঘোষাল বললে—তা আর বলতে? তা ছাড়া মা-লক্ষ্মী একরকম যেচে আসতে চাচ্ছেন। ‘যাচা কনে, কাচা কাপড় আর বাছাই ভূমি’ এ পেয়ে ছাড়লে ঠকতে হয়।
—হ্যাঁ। দেখুন, ওঁরা কোন্ কোন্ সম্পত্তি পত্তনী বিলি করবেন। যা দেবেন আমরাও নিতে প্রস্তুত জানিয়ে দেবেন। বরং একদিন নিজে যাবেন। আপনি ওঁদের সম্পত্তির বিবরণও সব জানেন। বোধ হয় বৃদ্ধির আয়ও আছে, ঠকতে হবে না।
—তা আছে। যথেষ্ট আছে। খাজনা ওদের কমই বটে। টাকায় টাকা বাড়লেও বেশী হবে না। হ্যাঁ, এবার আমি মহলে মহলে ইস্তাহার পাঠিয়েছি, এবার শতকরা সিকি বৃদ্ধি দিতে হবে। কোন আপত্তি শোনা হবে না। দক্ষিণের জমিদারেরা তামাম বছরে দুবার-তিনবার ‘মাঙন’ আদায় করছে। হয় মেয়ের বিয়ে, নয় ছেলের পৈতে, নয় শ্রাদ্ধ। সুলতানপুরের বাবুরা তো বাড়ী করবার জন্যে ‘মাঙন’ নিয়েছে। গতবার নিয়েছে, এবারও নেবে। আমাদের মাঙন একবার কালীপূজোর সময় মায়ের নামে। বিয়েতে দুবার মাঙন আদায় হয়েছিল, সে বিমলা-মার বিয়ের সময় একবার, তোমার বিয়ের সময় একবার। সে ধর, অনেককাল আগের কথা। ওই জগন্নাথপুরে জমিদার খাজনা বাকীর দায়ে জেলে গেল। সেরেস্তা থেকে গারদ মাঙন আদায় হল। আমাদের সে সব নেই। মায়ের কি ইচ্ছা তিনিই জানেন, রায়বাড়ীতে বংশবৃদ্ধি নেই। অন্নপ্রাশন, পৈতে, বিয়ে এ সব তো নেই। তা বলে আমরা প্রাপ্য পাব না কেন? এত বড় এস্টেট, চলবে কি করে? কোম্পানীর বন্দোবস্তে মৌজা-লাটের ডৌল আদায়ের দশ ভাগ কোম্পানীর ঘরে দিয়ে এক ভাগ জমিদার পায়। তা কতটুকু? আমি ভেবেছি, এবার সিকি বৃদ্ধি করব।
রায় বললেন, বাবার আমলে একবার বৃদ্ধি হয়েছে। অবশ্য তা অনেক দিন হল।
ঘোষাল বাধা দিয়ে বললে—সেটাকে বৃদ্ধি আমি বলব কেন? সেটা তো লিমিটেশান এ্যাক্ট বাবদ খাজনা বাকী থাকলে সিকি ধরাটা আমাদের প্রাপ্য। সুদ। আগের কালে তামাদি ছিল না। কোম্পানী তামাদি আইন করে ওটা চালালে। বৃদ্ধি আলাদা ব্যাপার। আমরা বিনা কারণে বৃদ্ধি চাচ্ছি না। দেশের জিনিস-পত্তরের দাম বাড়ছে। ধানের দর বাড়ছে। তা ছাড়া আমরা নদীর ধারে বাঁধ দিয়েছি, মাঠে পুকুর কাটিয়েছি, আমরা বৃদ্ধির হকদার।
বেশ তা করুন। কিন্তু তার আগে কালেক্টারকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। মেদিনীপুরে উকীলবাবুকে বলুন, একটু খোঁজ-খবর ভাল করে রাখতে; মানে চাঁদা-টাদার কথা উঠলে চাঁদাটা যেন সকলের আগে আমাদের দেওয়া হয়। বড়দিনে ভেট-টেটগুলো বেশ ভাল করে দেওয়া হয়। নইলে ও বেটারা পিছনে লাগবে। এতবড় মানুষ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁর সঙ্গে প্রজার লাগল ঝগড়া, কালেক্টর বেটা লাগলে প্রজার হয়ে ঠাকুরমশায়ের পিছনে। জানেন তো?
—হ্যাঁ, তা জানি বৈকি। তবে তোমার একটু যাওয়া দরকার, মধ্যে মধ্যে সেলাম-টেলাম দেওয়া কথাবার্তা বলা, এ হলে আর কোন গোলমাল থাকে না!
—আচ্ছা এবার গিয়ে মেদিনীপুর যাব। আপনাকে বলেই রাখি, একটা ইস্কুল ওখানে করবার ইচ্ছে আছে। বিদ্যেসাগর মশায় একদিন বলছিলেন, আজ আবার দেবমশায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হল। সব জমিদারই কিছু কিছু এসব কাজ করছে। আমাদের কিছু না করাটা খুব ভাল দেখাচ্ছে না। ইতিমধ্যে আপনি মেদিনীপুরে হেডমাস্টার রাজমোহন বসুর সঙ্গে দেখা করবেন। বলবেন, আমরা একটা এম-ই স্কুল দিতে চাই। উনি যদি কি ভাবে কি করা উচিত পরামর্শ দেন তো উপকৃত হব, কৃতজ্ঞ থাকব।
নায়ের গিরীন্দ্র ঘোষাল বললে, তাহলে একটা মাঙনও ধরব এবার।
—বেশী হবে না?
—না না। প্রজার কাছে না নিলে রাজা পাবে কোথা? সে আমি সব ঠিক করব, কোন চিন্তা তুমি করো না! তাহলে কাল প্রত্যুষেই চলে যাব আমি। আমি একবার কালীঘাট ঘুরে আসব। এতদূর এসেছি মাকে প্রণাম করে আসি। এতবড় তীর্থ।
নায়েব চলে গেলেন।
চাকর এসে ঘরে ঢুকল, তার হাতে ট্রের উপর বোতল গ্লাস। এসে সে টেবিলের ওপর রাখলে। হুজুর আজ সকাল থেকে এ দ্রব্য ছোঁন নি। সেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন, ফিরেছেন বারোটার সময়, তারপর ফিরে এসে থেকে এক মোটা বই নিয়ে পড়ছেন, দেখছেন। এর জন্য হুকুম করেন নি। তারপর এল কীর্তিহাটের নায়েব ম্যানেজার। তাঁকে কাকা বলে হুজুর খাতির করেন। সে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েই আছে সেই থেকে। এবার সে নায়েব চলে যেতেই ঢুকল ঘরে। তার সঙ্গে আরও খবর আছে। বউবাজার থেকে সোফিয়া বাঈয়ের বাড়ী থেকে লোক এসেছে। বলছে জরুরী খবর।
রায় বোতল গ্লাস দেখে তৃষ্ণার্ত অনুভব করলেন নিজেকে। বোতলটা খুলে পানীয় ঢাললেন গ্লাসে।
চাকর বললে, বউবাজার থেকে বাঈ-সাহেবের বাড়ী থেকে লোক এসেছে।
এ সময় সোফিয়ার লোক? মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল তাঁর।
টাকা? অথবা। অথবা আর কি হতে পারে? টাকা। অথচ মনটা তাঁর এখন যেন অন্যরকম হয়ে আছে। যে রকমটা সাধারণত হয় না। রাজাবাহাদুরের বাড়ী থেকেই মন যেন জলের ঘূর্ণির মত ঘুরছে। নিচে থেকে ঘুলিয়ে ভেসে উঠছে অতীতকালের কথা। সে কথা তিনি শুধু মদ খেয়ে ভুলে থাকেন। ভবানী!
সামনের ছবিটার দিকে তাকালেন তিনি। অয়েল পেন্টিংটা যেন জীবন্ত। শখ করে বিয়ের বছর-দেড়েক পর তিনি সাহেব চিত্রকরকে দিয়ে এ ছবি আঁকিয়েছেন। নিজে বসে থাকতেন, ভবানীর পাশে, সাহেব ছবি আঁকত ভবানীকে দেখে। তাঁর নিজের ছবিও আঁকিয়েছিলেন। সেটা আছে নিচের মজলিশের ঘরে। এ ছবিটা এখানেই আছে গোড়া থেকে। এই ঘরেই তিনি সে সময় ভবানীকে নিয়ে বসতেন। সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিতেন। ভবানী গান গাইত, তিনি বাজাতেন। তারপর এইখানেই সোফিয়াকে নিয়ে তিনি মজলিশ করতেন। ছবিটা রেখেছেন, সরাননি, আক্রোশবশে। মনে মনে বলেন, দেখ, তুমি দেখ! মনে মনে যেদিন অতীত মনে পড়ে যায়, এবং ছবির দিকে তাকান, সেদিনও বলেন, আবার হঠাৎ যেদিন ছবির দিকে চোখ পড়ে, সেদিনও অতীত কথা মনে হয়, সেদিনও বলেন, এবং সোফিয়াকে টেনে নেন কাছে।
কত দিন উম্মত্তের মত সোফিয়াকে দুই হাতের উপর ছোট্ট মেয়েটির মতো তুলে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিয়ে খেলা করেন, আর বলেন, দেখ-দেখ। ছবির মুখ যেমনকার তেমনি থাকে, তাতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বীরেশ্বর। মদের ঘোরে পরিপূর্ণ অবয়বের ছবিখানা তাঁর কাছে জীবিত ভবানী বলেই মনে হয়।
সোফিয়াও গুণবতী, সোফিয়া ভবানীর থেকে অনেক সুন্দরী। সেকালের নেকী বাঈজী, বিখ্যাত বাঈজী ছিল। সোফিয়া হয়তো তেমনি বিখ্যাত হতে পারত। কিন্তু সেও বীরেশ্বর রায়ের প্রেমে পড়েছে। সে তাঁকে সত্যই ভালবাসে। নিজেকে বলে আমি হুজুরের বাঁদী। হুজুরের পায়ের আওয়াজ আমার কলিজায় পাখোয়াজের বোল বলে।
সে কথা বিশ্বাস করেন রায়। কিন্তু তবু আজ এই সময়টিতে তাঁর ভাল লাগল না সোফিয়ার লোকের সঙ্গে কথা বলতে। এ মাসের টাকা এখনও পায় নি সোফিয়া, দেওয়া হয় নি। কালই ভেবেছিলেন দেবেন। টাকাটা কাল সকালেই হেরম্ব ঘোষ জমা করে দিয়ে গেছে। কিন্তু কাল ওই পাগলা তান্ত্রিক সব ভণ্ডুল করে দিয়ে চলে গেল। এমন ভয় পেলে সোফিয়া যে থরথর করে কাঁপছিল সে। চোখের ভয়ার্ত দৃষ্টি মনে পড়ছে রায়ের। তাড়াতাড়ি পাল্কী ডেকে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, টাকাটা দেবার কথা তাঁর মনেই হয় নি।
হাজার হলেও তওয়াইফ, কসবী। নিজেকে বেচেই সে খায়, সঞ্চয় করে; দুনিয়াতে ওই তার সান্ত্বনা, ওতেই তার সুখ; টাকা ভুলতে সে পারে না!
বীরেশ্বর বললেন—ডাক তাকে!
লোকটা এসে তাঁকে নিচু হয়ে কুর্নিশের ভঙ্গিতে সেলাম করে দাঁড়াল।
রায় বললেন—কি খবর? রূপাইয়া?
লোকটা আবার সেলাম ঠুকে বললে—জনাবালীর মেহেরবানীতে বাঈয়ের খানাপিনা- আরাম সব কিছু চলে। বহুৎ জরুরৎ হয়ে গেছে—রূপাইয়ার, কেও কি কাল রাত থেকে বাঈয়ের খুব বুখার। একদম বেহোঁস! বাঈয়ের বুড়ী আম্মাজান হেকিম ডেকেছিল, দেখে গেছে সে। বলে গেল কি—বুখারে ভুগবে মনে হচ্ছে। আম্মাজানের হাতে রূপাইয়া নাই। তা আম্মা বললে, তুই যা বসীর, রাজাসাহেবের কাছে, রূপাইয়া নিয়ে আয় আর খবর ভি দিয়ে আয়, কি সোফিয়ার ভারী বুখার! যা করতে হয় করতে বল।
সবিস্ময়ে রায় বললেন—একদম বেহোঁস? এমন বুখার?
—জী হুজুর!
—হুঁ! কেমন হেকিম ডেকেছিলে? বড় কেউ, না, যেমন-তেমন একটা কেউ?
—ভাল হেকিম সে বটে। কিন্তু বড় কেউ নয়। তবে—
—কি তবে?
—বাঈ বুখারের ঘোরে বিড় বিড় করে বকছে। বলছে, হুজুর কাল সেই হিন্দুসাধুর কথা! আমি শুনেছি। মাফি কিয়া যায় হজরৎ। মাফি কিয়া যায় বলছে। মধ্যে মধ্যে চিল্লাচ্ছে, মর যাউঙ্গী ময় মর যাউঙ্গী! আম্মাজানকে কাল বাঈ বলেছিল, এখানকার সব বাত। আম্মা ভাবছে, হেকিম দেখে গিয়েছে, গিয়েছে। এখন সেই সাধুর দরবারে গিয়ে পড়বে। তা তার পাত্তা-উত্তা তো কুছ মালুম নেহি, মালুম জরুর হুজুর-বাহাদুরের আছে। আম্মাজান সে আর্জিও জানিয়েছে রাজাসাহেবের কাছে, কি সেই হজরতকে বলে-কয়ে যদি নিয়ে আসেন!
বীরেশ্বর বললেন, ও সাধুর পাত্তা মেলে চৌরিঙ্গীর ময়দানে। তা দেখব আমি। বুঝেছ। আর রূপাইয়া নিয়ে যাও, এখন একশ নিয়ে যাও। আমি একবার না হয় যাব বাঈসাহেবার বাড়ী। সমঝা?
সেলাম করে বসীর বলল, হাঁ হুজুর। বিলকুল সব সমঝা গিয়া। বসীর চলে গেলে বীরেশ্বর রায় নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, সোফিয়াকে অভিসম্পাত দিয়ে গেল পাগল? না? না, কিছু দেখে যেন ভয়ে পালিয়ে গেল?
***
সুরেশ্বর বললে, পড়তে পড়তে আমার ক্লান্তি আসছিল সুলতা। হয়তো তোমারও ক্লান্তি আসছে শুনতে শুনতে। আমি বুঝতে পারছিলাম না, বীরেশ্বর রায় যিনি স্মরণীয় ঘটনাই শুধু লেখেন তিনি ওই সোফিয়ার অসুখের খবরের মত খবরও লিখেছেন কেন? ওই পাগল নিয়েই বা এতখানি লিখেছেন কেন? নাস্তিক বীরেশ্বর রায়। অবশ্য নাস্তিক হওয়া সেকালে সোজা কথা ছিল না। কারণ কালটার উদয়াস্ত আস্তিকতার মধ্যে। সেকালের বাতাসে শুধু অক্সিজেনই ছিল না, তার সঙ্গে আস্তিক্যবাদও ছিল। তবু বীরেশ্বর রায় নাস্তিক হতে চেষ্টা করেছিলেন। পৃথিবীর ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি জীবনে সবকিছুর উপর বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। তাঁর স্মরণীয় ঘটনার বিবরণের মধ্যে প্রশ্ন থাকত না। একটা সিদ্ধান্ত করে তাতে তিনি পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছেন। আজ তাঁর স্মরণীয় বৃত্তান্তের মধ্যে এত প্রশ্নচিহ্ন কেন?
এবার তার যেন একটা উত্তর পেলাম!
স্মরণীয় বৃত্তান্তে একটা ছত্র পেলাম এবার! আজকার দিনটি আমার এ পর্যন্ত জীবনের মধ্যে বোধ হয় সর্বোত্তম বিস্ময়ের দিন! Greatest surprise —শব্দ ব্যবহার করে তৃপ্ত হন নি, লিখেছেন- It is something more than surprise—যার কোন উত্তর আমি খুঁজে পাই নি! আমি ভেবে পাই নি, রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুরের মত বিস্ময়কর মানুষ কেমন করে হয়? বিপুল সম্পদ, কলকাতার সমাজে এত সম্মান, এত পাণ্ডিত্য, সে মানুষ এমন বিনয়ী মিষ্টভাষী মধুরপ্রকৃতির কেমন করে হয়? বিমলাকান্ত-সে কেমন করে আমার সম্পর্কে এত প্রশংসা করে যায়! বিমলাকান্ত সম্পর্কে বুঝতে পারি, হয়তো সে অতিকুলীন, অতিজটিল। কিন্তু সত্যই কি তাই? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না, মনে হচ্ছে এটা একটা প্রশ্নই। আমি যে উত্তরটা বের করেছি, সেটা ঠিক নয়।
এই প্রশ্নের একটা ছোঁয়াচ যেন সংক্রামক ব্যধির মতো আমাকে আক্রমণ করেছে। প্রশ্ন জাগছে, এত দিন যা ভেবে এসেছি, তাও কি তবে সত্য নয়?
মিথ্যাও তো বলতে পারব না! আমার চোখের ভ্রান্তি হতে পারে। ভ্রান্তি কি সকলের চোখেই হয়েছে?
মনে পড়ছে, কাঁসাইয়ের ওপারে মহিষাদলের রাজাবাহাদুরের এলাকায় ‘সতীঘাট’। আমার জন্মের কিছুকাল পরে সতীদাহ প্রথা উঠিয়ে দেবার পরও গর্গ-বংশের এক রাণী সতী হয়েছিলেন। সে বিবরণ শুনেছি।
কীর্তিহাটে ভবানীর চিতায় যদি তেমনি সতীঘাট হত? কাঁসাইয়ের ঘাটের কাছের দহটায় যদি ভবানীর দেহটা ভেসে উঠত, তবে আমি একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করে নাম দিতাম দেবীঘাট। কিন্তু কোথায় গেল দেহটা? বিচিত্র ব্যাপার, জয়নগরে লোক পাঠিয়ে তার বাপকেও পাই নি। তার বাপ চলে গেছেন কলকাতায়। আজও পর্যন্ত ফেরেন নি। তারপর খবর পেয়েছি, চলে গেছেন কাশী। দেশে কয়েকদিনের জন্য ফিরে বিষয়ের ব্যবস্থা করে কাশী চলে গেছেন।
আজ রাজাবাহাদুর বললেন, বিমলাকান্তের এক ভগ্নীর কথা। কে সে ভগ্নী? তার কোন ভগ্নী ছিল বলে তো শুনি নি! কে সে?
এত প্রশ্নের উত্তর একটি উত্তরে মেটে।
ভবানীর মৃতদেহটা কোথায়?
জানতে পারলে নতুন জীবনে বাঁচতে পারি আমি। আমার সমস্ত সম্পদ দিয়ে অনেক কাজ করি। সর্বাগ্রে একটা ইস্কুল করি। দীঘি কাটাই। পুরাণের অনুবাদ প্রকাশ করে বিলি করি।
সারাটা দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এই ভাবনা ভাবলাম। দিনে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। না ভবানীকে নয়। সোফিয়াকেও নয়। স্বপ্ন দেখেছি একটি অবগুণ্ঠিতা নারীকে, তার মুখ কিছুতেই খুলতে পারলাম না। সন্ধ্যায় ছাদের উপর পায়চারি করছিলাম, আর ওই স্বপ্নের কথাই ভাবছিলাম। কে?
এর আগে পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে কখনও এত চঞ্চল হই নি। হঠাৎ মনে পড়ল সোফিয়ার কথা। গাড়ী জুততে বললাম। কথা দিয়েছি, যেতে হবে। আজ যেন সোফিয়ার আকর্ষণটাও কত দুর্বল হয়ে গেছে। মনকে প্রশ্ন করলাম, সোফিয়া পুরনো হয়েছে?
না। কোন নতুন নারীর মুখও তো মনে পড়ছে না। মনে হচ্ছে, এই ধরনের দিন-যাপন ধারার উপরেই একটা বিতৃষ্ণা অনুভব করছি।
নারীর মুখ মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরকে। কি প্রতিষ্ঠাময় জীবন। কত সম্মান। কত আনন্দ রাজাবাহাদুরের। কত সম্ভ্রম ওই মানুষটির। এইরকম জীবনের আকর্ষণেই যেন সোফিয়ার উপর আকর্ষণ চলে গেছে।
ওঃ, এমন জীবনই তো আমি চেয়েছিলাম একদিন। ঘর-সংসার, সন্তান-সন্ততি। বিশাল জমিদারী। দেশময় ছড়িয়ে-পড়া নাম। দান-ধ্যান। উৎসব। কীর্তি। এইসব নিয়ে কতই না কল্পনা করেছিলাম।
আজ তার বদলে আমি কোথায় চলে এসেছি। ওঃ—অনেকদূর। অনেকদুর। তার কারণ, ওই একটি নারী।
বীরেশ্বর রায় সোফিয়াকে দেখে শঙ্কিত হয়েছিলেন। সোফিয়ার গায়ের উত্তাপ বেশী না হলেও সম্পূর্ণরূপে বিকারগ্রস্ত। চোখদুটো ঘোর লাল। আর বিড় বিড় করে প্রলাপ বকে যাচ্ছে।
বসীর যা বলেছিল ঠিক তাই। মৃদু কণ্ঠস্বর, আধখানা-আধখানা কথা, কান পেতে শুনলেন বীরেশ্বর। তার মধ্যে বার বার শুনলেন, মাফি মাংতি হুঁ-জেরৎ মাফি মাংতি। মধ্যে মধ্যে ভয়ার্তের মত চীৎকার করছে।
সোফিয়ার আম্মা বললে—হেকিম আজ দু-দুবার এসেছিল। সে বলছে—মগজমে খুন চড় গিয়া হোগা।
মাথায় রক্ত চড়েছে। কথাটা মনে লাগল বীরেশ্বরের।
সোফিয়ার আম্মা বললে-জোঁক ধরাতে বলছে। মাথায় জোঁক ধরালে রক্তটা টেনে বের করে নেবে। কিন্তু এ বিশ্বাস হচ্ছে না আমার বাবুসাহেব। আমি তাকে কালকের সেই সাধুর কথা বলেছি। তা শুনে সে ভড়কে গেছে। বলে গেছে—মালুম হোতা কি তুমি যা বলছ, তাই ঠিক। বিড় বিড় করে বলছেও তাই। তুমি দেখ সন্ধান কর—সে হিন্দু ফকিরকে খুঁজে তাকে গিয়ে পহেলে ধর। যদি তাতেও কিছু না হয়, তখন জোঁক ধরাব। আগে তাই দেখ। নয়তো বড় মসজিদে গিয়ে কোন মুসলমান ফকিরকে ধর, সে যদি এর কোন কাটান দিতে পারে। বাবুসাহেব, সোফিয়া তোমারই বাঁদী হয়ে আছে, মেহেরবানি করে সেই হিন্দু সাধুর পাত্তা লাগাও। তাকে তুমি ধর। নইলে সোফিয়া হয়তো বাঁচবে না। আমি একজন ওঝা ডেকেছিলাম বাবুজী, সে বলে গেছে—উ হিন্দু ফকিরের দুটো জিন আছে, একটা মর্দানা একটা ঔরং, সেই ঔরৎটাকে সোফিয়ার কন্ধাপর চড়িয়ে দিয়েছে।
চোখ থেকে তার জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে কথা শেষ করলে সে, ওঝা বললে, ঔরৎ জিন বহুৎ জোরদারণী। সে ওই হিন্দু ফকিরের হুকুম ছাড়া নড়বে না।
বীরেশ্বর রায়ের মনে পড়ল কালীপ্রসন্ন সিংহকে। এই মানুষটিকে তাঁর ভারী ভাল লাগে, তাঁকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। তাঁর থেকে বয়সে ছোট। এখনও বয়স অল্প, কুড়ি পার হয়নি। এরই মধ্যে সত্যকারের বিচক্ষণ বিদ্বান হয়ে উঠেছেন। রসিক কৌতুকপরায়ণ, কুসংস্কার থেকে মুক্ত। ইংরিজী-জানা হালের মানুষ। তিনি সেদিন গল্প করেছিলেন—এক খুব আধুনিক কালের পরিবার, যাঁরা ব্রাহ্ম হয়েছেন, তাঁদের বাড়িতে একটি মহিলা অসুস্থ হয়েছিলেন। ডাক্তার-বৈদ্যরা কি অসুখ বুঝতে পারেনি। শেষে ওঝা এনেছিলেন তাঁরা, ঝাড়ফুঁক করে সে ভাল করে দিয়েছে মহিলাটিকে।
গল্পটি বলে সিংহ বলেছিলেন—দেখুন, রায়মশায়, কোটা সত্যি কোন্টা মিথ্যে, এ বুঝে ওঠা খুব কঠিন। শেক্সপীয়র বলে গেছেন—there are more things in heaven and earth—কথাটা কি এতবড় কবি মিথ্যেই লিখে গেছেন?
সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই ভাবছিলেন। সোফিয়ার মুখে একটা মর্মান্তিক যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে। নিষ্ঠুর যন্ত্রণা হচ্ছে তার।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে রায় ঠিক করলেন, পাগলকে খুঁজে তিনি যেমন করে হোক বের করবেন। এবং নিয়ে আসবেন।
পাগলের নিজের যন্ত্রণার কথাও মনে পড়ল। নিজের হাতে গলা টিপে ধরে বলে—ছাড়, ছাড়, ছাড়। আঃ-আঃ-আঃ! কখনও কখনও নিজের হাত কামড়ে ধরে রক্ত বের করে ফেলে তবে শান্ত হয়।
সোফিয়ার আম্মা বললে—বাবুসাহেব!
বীরেশ্বর বললেন-আমি তাকে যেখান থেকে পারি নিয়ে আসছি বাঈসাহেবা, তুমি ভেবো না। আমি এখান থেকেই তার খোঁজে বের হবো।
.
রাত্রিদুপুর পর্যন্ত রায় ঘুরেছিলেন চৌরিঙ্গীর ময়দানে। সন্ধ্যেবেলা তিনি একলা নন, আরও অনেক লোক রাণী রাসমণির গঙ্গার ঘাটে যাবার রাস্তাটার উপর দাঁড়িয়েছিল, তারাও খুঁজছিল সাধুকে। একজন বলেছিল—তাহলে সাধুবাবা আজ কালীঘাট তরফে গিয়ে পড়েছে। শুনে বীরেশ্বর গাড়িতে এসে উঠে বলেছিলেন—চলো কালীঘাটে।
কালীঘাট গিয়েও কোন সন্ধান মেলেনি। তারাও সাধুকে জানে, সাধু এদিকে এসে কখনও দাঁড়ায় না; ছুটতে ছুটতে আসে, এসে থমকে দাঁড়ায়, তারপর হঠাৎ ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে উত্তরমুখে ছুটে পালায়। মধ্যে মধ্যে নিজের গলা টিপে ধরে, বলে- ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে। আঃ-আঃ—। কিন্তু সে তো আজ দু-তিনদিন আসেনি!
রায় আবার ফিরেছিলেন। গঙ্গার ধারের নতুন রাস্তা ধরে গোটা ময়দানটাকে বেড়ে ঘুরে বেরিয়েছিলেন। মধ্যে মধ্যে গাড়ী থেকে নেমে কান পেতে শুনেছিলেন কোন কথায় সাড়া উঠছে কিনা।
আগের দিন ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টি যথেষ্ট হয়েছিল। চৌরিঙ্গীর পাশের ময়দানটা তখনও পর্যন্ত কাদা-কাদা হয়ে আছে, মধ্যে মধ্যে ঘাসের তলায় খালে জল জমে রয়েছে; বারকয়েক এইরকম জলের তলায় পড়লেন রায়। পোশাক-পরিচ্ছদের তলার দিকটা কাদায় ভরে গেল। জুতোজোড়াটা কাদার-জলে ভিজে ভারী হয়ে উঠল—তবুও তিনি খুঁজলেন। ওসব দিকে তাঁর খেয়ালই ছিল না।
রাস্তাঘাট সব নির্জন হয়ে গেছে। একেবারে জনশূন্য বললেই চলে। যানবাহন, পাল্কি-ডুলী, গাড়ী-ঘোড়া একখানাও চলছে না। চৌরিঙ্গীর ধারের বাগানওয়ালা সায়েবসুবার বাড়ীর ফটকে আলো জ্বলছে কোম্পানীর নিয়মানুসারে। এদিকে এখন রাস্তার ধারে আলোও হয়েছে। তাও তেল ফুরিয়ে কতকগুলো নিভে গেছে। কতকগুলো মিট্মিট্ করছে, আর কিছুক্ষণ পরেই নিভবে। গোটা ময়দানে শুধু ঝিঁঝির ডাক বেজে চলেছে, মধ্যে মধ্যে প্যাঁচা ডাকছে। বাদুড় উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। ঘাসের মধ্যে সাপের মুখে ধরা ব্যাঙ কাতরাচ্ছে। দুবার শেয়ালেরা সমবেত চীৎকার করে ক্ষান্ত হয়েছে। আর মশা ভনভন করছে কানের পাশে।
সম্ভবত একটা বেজে গেছে। রায় কোচম্যানকে বললেন—আবদুল!
আবদুল চুপচাপ কোচবক্সে বসে ছিল। মধ্যে মধ্যে হাত নেড়ে, চাপড় মেরে মশা তাড়াচ্ছিল। সহিস চারজন রাস্তার ধারে বসেছিল একটা মশাল নিভিয়ে; তারাও মশা তাড়াচ্ছিল আর ভাবছিল—কতক্ষণে রায়হুজুর ক্লান্ত হয়ে বলবেন- চলো, ঘুমাও গাড়ী। হয়তো বা মনে মনে কটুকাটব্যও করছিল। এরই মধ্যে বীরেশ্বর ডাকলেন—আবদুল, আব চলো ঘর।
শুনামাত্র সহিসরা নিভন্ত মশালগুলো জ্বলন্ত মশাল থেকে জ্বালিয়ে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল।
বীরেশ্বর রায় কেমন একটা শূন্য মন নিয়েই বাড়ি ফিরছিলেন। মধ্যে মধ্যে চকিতের মত বিস্মিত প্রশ্ন মনে জাগছিল- পাগল গেল কোথায়?
গাড়ী চৌরিঙ্গী ধরে এসে রাণী রাসমণির বাড়ির রাস্তায় ডানদিকে মোড় ফিরে পুবদিকে খানিকটা এসে দক্ষিণমুখে মোড় নিল।
মানুষ সব ঘুমিয়ে গেছে। কয়েকটা পথের কুকুর শুধু তারস্বরে চীৎকার করছে। মনে হচ্ছে যেন কিছু দেখেছে।
রায় জিজ্ঞাসা করলেন- আবদুল, কুত্তারা এমন চিল্লাচ্ছে কেন?
কুকুরের ঝগড়ার সুর এ নয়। সমবেতভাবে কিছুকে আক্রমণের সুর। কিছু দেখেছে ওরা। বলেই রায় গাড়ীর দরজা থেকে মুখ বাড়ালেন। দেখলেন, একটা অর্ধ-উলঙ্গ লোক ভ্রূক্ষেপহীন ভাবে গাড়ীর সামনে খানিকটা আগে চলেছে, তার পিছনে কুকুরগুলো চীৎকার করে তাকে অনুসরণ করছে। রায়ের চিনতে ভুল হল না।—এই তো সেই পাগল! এই তো!
পাগল তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। চীৎকার করে উঠল—রায়বাবু! রায়বাবু।
বাড়ির ফটকের দারোয়ান ভিতর থেকে কি বলছে। কিন্তু পাগল চীৎকার করেই চলেছে—রায়বাবু—রায়বাবু!
সেই মুহূর্তেই গাড়ীখানা গিয়ে ফটকের সামনে দাঁড়াল। মশালধারী সহিস হাঁকলে—দারোয়ানজী।
দারোয়ান গাড়ীর শব্দ পেয়ে দরজা খুলছিল কিন্তু তার আগেই রায় গাড়ী থেকে নেমে পড়লেন। এবং পাগল সাধুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন —কোথায় ছিলে তুমি? কোথা থেকে এলে?
—কে? রায়বাবু? তুমি রায়বাবু?
—হ্যাঁ। কিন্তু কোথায় ছিলে তুমি? আমি তোমাকে সারা ময়দান খুঁজে এলাম কালীঘাট পর্যন্ত।
পাগল অস্থিরভাবে বললে—দক্ষিণেশ্বর। দক্ষিণেশ্বর। সেখানেও ঢুকতে পারলাম না। সেই—সেই—সেই পথ আগলালে। সেই —।
—কে? কে পথ আগলালে? কি বল তুমি?
—যে পথ আগলায়। কালীঘাট আগলায়, কামাখ্যায় আগলেছিল—সেই। সেই—। যার ছবি তোমার ঘরে আছে। তোমার ঘরে!
রায় চমকে উঠলেন। বললেন-কোন্ ছবি? কি বলছ তুমি?
—ওই যে, যে-ছবি দেখে কাল পালিয়ে গেলাম। সেই ছবিটা, সেই ছবিটা একবার দেখাবে? একবার দেখাবে?
রায় স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পাগল বললে, একবার। একবার দেখাও, একবার-
-–ও ছবি যার, তুমি তাকে চেন?
—চিনি না? সর্বনাশী ছলনাময়ী, মোহিনীরূপে ভয়ানক মেয়ে—ওঃ-ওঃ! বলেই সে আপনার গলা টিপে ধরলে! নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করতে লাগল এবং চীৎকার করতে লাগল—ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে। ওরে বলতে দে। দিবিনে?
বিচিত্র পাগলামী পাগলের। নিজেই টিপছিল নিজের গলা, এবার গলা টিপেধরা হাতের একটা হাত নিজেই কামড়ে ধরলে।
রায় টেনে তার হাতদুখানাকে ছাড়িয়ে দিলেন। ওদিকে ফটক তখন খুলে গেছে। গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, তাঁকে অতিক্রম করে ঢুকতে পারছে না। রায় পাগলের হাত ধরে টেনে হাতার ভিতরে ঢুকলেন। বললেন-এস।
পাগল বললে—কোথায়?
—ছবি দেখবে বলেছিলে? এস, ছবি দেখবে এস।
—ছবি? দেখাবে? দেখাবে?
—এস।
কৌতুহলের আর অন্ত ছিল না বীরেশ্বর রায়ের।
ঘরের ছবির সামনে পাগলকে দাঁড় করিয়ে দিলেন রায়। দেখ। চাকরকে বললেন—একটা মশাল জ্বেলে আন। ধর সামনে। সহিসদের মশাল নিয়ে আর বরং। জলদি যাবি।
চাকরটা ছুটে গিয়ে মশালটা নিয়ে এল। রায় মশালটা তার হাত থেকে নিয়ে নিজে তুলে ধরলেন ছবির সামনে। চাকরটাকে বললেন—তুই যা ঘর থেকে
একদৃষ্টে পাগল ছবিটা দেখতে লাগল।