ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

কিস্তিমাৎ

কিস্তিমাৎ

‘আপনাকে একটা বিষয় অবশ্যই ভাবতে হবে।’

‘কী বিষয়!’

‘আজ এক মাস হয়ে গেল, ভৈরববাবু নিরুদ্দেশ। তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘ব্যাপারটা দু:খের এবং উদ্বেগের। ভৈরব আমার বন্ধু; কিন্তু আমি কী করব বলুন! আমার কী করার আছে!’

‘দেখুন, সন্দেহটা কিন্তু আপনার দিকেই যাচ্ছে।’

‘আমার দিকে? আমি কী করেছি? জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষকে অদৃশ্য করে দিয়েছি?’

‘যদি বলি, তাই। নিরুদ্দেশ নয়, তিনি খুন হয়েছেন।’

‘এই সিদ্ধান্তে আসা গেল কী করে!’

‘ভৈরববাবু রোজ সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন, ঠিক কি না!’

‘অবশ্যই ঠিক।’

‘সেদিনও এসেছিলেন!’

‘এসেছিলেন এবং আমরা খেলায় বসেছিলুম। ভৈরবের হাত পাকা; কিন্তু সেদিন খুব অন্যমনস্ক ছিল। আজে বাজে চাল দিচ্ছিল। হঠাৎ উঠে পড়ে বললে, আমি যাই, আমার একটা কাজ আছে। চলে গেল।’

‘সে যায়নি। এই বাড়িতেই আছে; কারণ তার চটি জোড়া এখানেই পড়ে আছে। চলে গেলে চটি দুপাটি এখানে থাকত না।’

‘আমি আপনাদের বারবার বলছি, সে ভুল করে আমার চটি পরে চলে গেছে। সেদিন সে খুব আনমনা ছিল। আপনারা এই কথাটা বিশ্বাস করছেন না কেন?’

‘একটু অসুবিধে হচ্ছে।’

‘কী অসুবিধে?’

‘প্রমাণ করতে পারবেন না। এই চটিটা প্রমাণ হিসেবে এখানে পড়ে আছে। দ্বিতীয় চটিটা নেই।’

‘সেইটাই তো স্বাভাবিক। পরে চলে গেলে আর থাকবে কী করে!’

‘যদি বলি চটিটা আছে এবং আপনার পায়েই আছে।’

‘কী মুশকিল! এটা আর একটা।’

‘আজ্ঞে না, এটা ওইটাই। আপনার এক জোড়া চটিই ছিল, আর সেইটেই আছে। একই সঙ্গে দু-তিন জোড়া চটি কেনার মতো বেহিসেবি আপনি নন।’

‘খুনের তো একটা উদ্দেশ্য থাকবে। ভৈরবকে খুন করে আমার কী লাভ?’

‘অনেক লাভ, ভৈরববাবু আপনার জীবনের এমন একটা গুপ্ত কথা জানেন, যেটা কোনওক্রমে ফাঁস হয়ে গেলে আপনার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

‘আমার আবার গুপ্তকথা। আমার তো বিলকুল খোলা, গোপন তো কিছু নেই।’

‘বলে গেলুম, অনুসন্ধান করলেই জানতে পারবেন হয়তো। আচ্ছা এইবার আর একটা কথায় আসি, সেদিন আপনাদের দাবার আসরে, আপনি আর ভৈরববাবু ছাড়া তৃতীয় আর একজন ছিলেন।’

‘বোধহয় অদৃশ্য কেউ, কারণ আমরা কেউ তাকে দেখিনি।’

‘আপনারা না দেখলেও সেদিন টেবিলে যে অ্যাশট্রেটা ছিল সেটা দেখেছে। ওইতে তিন রকম ব্র্যান্ডের সিগারেটের টুকরো পাওয়া গেছে। আপনাদের দুজনের দুরকম, তিন নম্বরটা কার? একটু ভেবে দেখবেন। কাজটা একটু কাঁচা হাতে করে ফেলেছেন শ্যামলবাবু। চটি আর অ্যাশট্রেটা যে সাক্ষী হতে পারে প্রমাণ হতে পারে খেয়াল করেননি! অবশ্য এ কথাও ঠিক খুব পাকা অপরাধীও কোনও না কোনও প্রমাণ রেখে যাবেই যাবে। অনেক কেস তো ঘাঁটলুম। অনেককেই তেপান্তরে পাঠালুম।’

‘তেপান্তর নয় দ্বীপান্তর।’

‘ওই হল।’

‘তা আমি যদি খুন করেই থাকি, আমাকে অ্যারেস্ট করছেন না কেন?’

‘অধৈর্য হবেন না, ঠিক সময়েই হাতে বালা পরবেন। আগে ডেড বডি বের করে ফেলি।’

‘কোত্থেকে?’

‘কেন লজ্জা দিচ্ছেন! সবই তো জানেন আপনি! কাল সকালেই সব আসবে!’

‘কোথা থেকে তুলবে?’

‘স্যানেটারি পিট থেকে?’

‘অ্যাঁ সে কী! ভৈরব ওখানে আছে না কি!’

‘ও কি আর ইচ্ছে করে আছে, আপনার সুব্যবস্থায় আছে। আচ্ছা, তাহলে এখন যাচ্ছি। কাল সকালে রেডি হয়ে থাকবেন, সোজা থানা, সেখান থেকে লকআপে।’

‘যাচ্ছেন যান, কিন্তু ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি কে?’

‘ও আমাকে চেনেন না! তা চিনবেন কী করে, এটা যে আপনার প্রথম খুন! আমার নামে অপরাধীদের মুখ শুকিয়ে যায়। আমিই সেই ফেমাস ত্রিনয়ন। অবশ্যই ছদ্মনাম। এই দেখুন আপনার মুখ শুকোতে শুরু করেছে। ভয় পাবেন না। আমার হাতে যখন কেস পড়েছে মৃত্যু না হোক যাবজ্জীবন হবেই।’

কোথা থেকে এল এই ত্রিনয়ন! ভৈরবকে নিয়ে নানাকাণ্ড হচ্ছে ঠিকই, থানাপুলিশও হচ্ছে; কিন্তু ডিটেকটিভ আসে কী করে! ভৈরবের বড় ছেলে শঙ্করের কাণ্ড অবশ্যই। সব ব্যাপারে নাটুকেপনা। সে যাই হোক, মুখে যাই বলি, লোকটা মনে বেজায় ভয় ধরিয়ে দিয়ে গেছে। একা এত বড় একটা বাড়িতে থাকি। ত্রিভুবনে আমার কেউ নেই। পরামর্শ, উপদেশ সাহস কেই বা দেবে। আমাকে যে দেখাশোনা করে, হরিদা, আগে খুব সাহসী ছিল, এখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। সবেতেই ভয় পায়।

প্রথম হল চটি। সত্যই তো চটিটা ফেলে ভৈরব খালি পায়ে গেল কোথায়। একটা মিথ্যে কথা আমি সবসময় বলছি, সেটা হল, ভৈরব আমার জুতো পরে গেছে। সে তা যায়নি। আমাদের দুজনের পায়ের মাপ আলাদা। ভৈরবের পা ভৈরবের মতোই, বিশাল। ত্রিনয়ন এটা খেয়াল করেনি, অথবা করেছে, পরে কিস্তিমাতের চাল দেবে।

দ্বিতীয় হল, তৃতীয় ব্যক্তি। কথাটা ভুল নয়। ভৈরব আসার আগে এসেছিল। ঘন-ঘন সিগারেট খেয়েছিল। একেবারেই একজন অচেনা লোক। খুব চালিয়াত। খুব দামি নতুন একটা গাড়ি চেপে এসেছিল। ভৈরব আসার আগেই হাওয়া। রহস্যময় একটা লোক।

তিন নম্বর কথা হল, পিট। পিটের মধ্যে আছে ভৈরবের ডেড বডি।

এটা খুব সাংঘাতিক কথা। ওদিকটা ভারী নির্জন। একটু দূরেই বাউন্ডারি ওয়াল। তার পরেই বহুদিন বন্ধ হয়ে থাকা একটা কারখানা। ভুতুড়ে একটা জায়গা। রাতের দিকে ওখানে এমন সব কাজ হয়, যা ভালো নয়। ওই পিটের মধ্যে গভীর রাতে কেউ কিছু ঢুকিয়ে দিয়ে যেতেও পারে।

এই কথাটা মনে হওয়া মাত্রই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখন আমার কী করা উচিত। মনে শুরু হল বাদানুবাদ। ভেঙে দু-টুকরো হলুম। দুটো টুকরোয় তর্ক হচ্ছে।

‘বাঁচতে চাস তো তুইও নিরুদ্দেশ হয়ে যা।’

‘কোথায় যাব?’

‘যেখানেই হোক, দূরে কোথাও।’

‘ভয়ে পালাব?’

‘বুঝছ না কেন? তুমি একটা চক্রান্তের শিকার হতে চলেছ। অন্যের অপরাধের সাজা তোমাকে ভোগ করতে হবে। এটা একটা বিরাট প্ট।’

‘ভৈরবকে মেরে কার কী লাভ?’

‘বোকা! ভৈরবকে মারা নয়, তোমাকে সরানোটাই চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য।’

জামাটা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লুম। আমিও একজনের সাহায্য নেব। বদমাইশের বদমাইশি আমি শেষ করে দেব। বাড়ির বাইরে পা রাখতে গিয়ে মনে হল, আমার ওপর নজর রাখা হয়েছে, কোথায় যাচ্ছি, না যাচ্ছি! সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এসে আমি প্রীতপালকে ফোন করলুম। আমার খুব বন্ধু। আর্মিতে ছিল। ব্রিগেডিয়ার। এখন নিজেই একটা এজেনসি করেছে। সিকিউরিটি ইন্টারন্যাশনাল। খুব নাম।

প্রীতপাল বললে, ‘কেসটা একটু গড়বড় মনে হচ্ছে। তুই বাড়িতে গেড়ে বসে থাক। বেরোবি না কোথাও। আমি আসছি।’

প্রীতপালের আসল নাম প্রীতি পাল। আর্মিতে থাকার সময় ছোট হয়ে প্রীতপাল।

চান করে, খাওয়াদাওয়া কোনও রকমে শেষ করলুম। একটা বেজে গেল। কিছুই ভালো লাগছে না। আর কতক্ষণই বা! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে ভাগ্যের চাকা ঘুরছে। এরই মাঝে একবার পিটটার কাছে ঘুরে এলুম। ম্যানহোল কভারটা তো ঠিকই রয়েছে। একটা মানুষকে ঢোকাতে হলে চাড় দিয়ে খুলতে হবে। সেই খোলার তো একটা চিহ্ন থাকবে। সেসব কিচ্ছুই নেই। কে আমাকে বোকা বানাতে চাইছে? উদ্দেশ্যটাই বা কী! ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হতে লাগল, সত্যিই আমি খুন করিনি তো! হয়তো তখন একটা ঘোরে ছিলুম। গল্পে পড়েছি, কখনও কখনও দুষ্ট আত্মা স্বাভাবিক মানুষের ওপর ভর করে, তারপর তাকে দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করিয়ে নেয়। সেইরকম কিছু হয়নি তো!

ভাবতে ভাবতে যখন প্রায় পাগলের মতো অবস্থা, তখন গেটের দিক থেকে ভীষণ একটা গোলমালের শব্দ কানে এল, প্রবল বচসা হচ্ছে হরিদার সঙ্গে। একেবারে সামনে না গিয়ে আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখলুম, এক বৃদ্ধ, প্রায় জড়ভরত, সে ভেতরে আসতে চাইছে, হরিদা কিছুতেই ছাড়ছে না। বৃদ্ধ বলছে, ‘আমার মেয়ের অসুখ, বাঁচবে না, আমি শুধু একবার তোমার বাবুর সঙ্গে দেখা করব। সাহায্য-টাহায্য কিছুই চাই না, শুধু একটা ঠিকানা চাই। তুমি কেন বাপু এমন করছ! আমি চোর, না গুন্ডা!’

আমি চেঁচিয়ে বললুম, ‘হরিদা আসতে দাও।’

বৃদ্ধ ঠুকঠুক করে বৈঠকখানায় এসে সোফায় বসে পড়লেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, ‘দরজাটা দিয়ে দে।’

আরে! এ যে প্রীতপাল। কী সাংঘাতিক মেকআপ! গলার স্বরও পালটে ফেলেছিল। মুখে একটা পাতলা রবারের মুখোশ সাঁটা ছিল। সেটা খুলে ফেলে বললে, ‘একেবারেই ধরতে পারিসনি! একশোতে একশো পেলুম।’

‘অবশ্যই। গলার স্বরটাও বদলে ফেলেছিস।’

‘ট্রেনিং, ভাই ট্রেনিং। এক কাপ রেড টি আপাতত।’

‘চল, ওপরে গিয়ে বসি। এ ঘরটা তেমন নিরাপদ নয়।’

‘না, দোতলায় হবে না, কারণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দূর থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। ফোনে যেটুকু বলেছিস তাতে মনে হচ্ছে, সব দিক থেকে তোকে নজরে রাখা হয়েছে।’

‘কেন? সেইটাই তো বুঝতে পারছি না।’

‘আমার প্রশ্নের উত্তর দে ঝটপট। ওই ভৈরবের সঙ্গে তোর কত দিনের আলাপ!’

‘আমার বাল্যবন্ধু।’

‘এই বিষয় সম্পত্তি কার নামে আছে?’

‘এইটাতেই একটু গোলমাল আছে।’

‘কী রকম?’

‘ভৈরবের ছোট বোনকে আমার বাবা ভীষণ ভালোবাসতেন। খুব ইচ্ছে ছিল আমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলে এই পরিবারে আনার। আমি রাজি হয়নি। এই নিয়ে আমার সঙ্গে তিক্ততা। বাবার অসুখের সময় সে দুহাতে সেবা করছিল। বাবা একটা উইল করে সব প্রপার্টি তাকে দান করে গেলেন। শর্ত রইল, যতদিন আমি আছি ততদিন আমার ভোগ দখলে থাকবে। যদি আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দি, বা মারা যাই তখন সব চলে যাবে ওর হাতে বা ওর বংশধরদের হাতে।’

‘সেই মেয়ের বিয়ে হয়েছে?’

‘না।’

‘না কেন?’

‘বলতে পারব না!’

‘ওই তৃতীয় ব্যক্তিটি কে?’

‘একজন প্রাোমোটার। আমাকে প্রায় বছরখানেক ধরে উত্যক্ত করছে, এটা ছেড়ে দিন, মোট টাকা দেব। আমি রাজি হইনি। পরে ভৈরবকে দিয়েও প্রেসার দিচ্ছিল। শেষ সেদিন ভৈরব খেলতে খেলতে উঠে চলে গেল, ভীষণ অন্যমনস্ক, সেদিন ও যেন কিছু একটা বলতে চাইছিল আমাকে।’

প্রীতপাল, হুম বলে একটা শব্দ করল। চুমুকে চুমুকে লাল চা খেল। একটা প্যাড টেনে নিয়ে ডট পেন দিয়ে কী সব আঁকিবুঁকি করল। এদিকে বেলা পড়ে আসছে। হঠাৎ তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘পেয়েছি, প্ল্যান ইজ ক্লিয়ার।’

‘পিটটা একবার খুলে দেখলে হয় না।’

‘পাগল হয়েছিস। ওখানে কিসসু নেই। ভৈরব বেঁচে আছে, তবে আজ রাতেই সে খুন হবে। শুধু তাই নয়, আজকের রাতটাও তোর পক্ষে বিপজ্জনক। আমি বলে যাচ্ছি, কী কী হবে, ভৈরবের ছোট বোন তোর কাছে আসবে। এসে কান্নাকাটি করতে থাকবে দাদার জন্যে। ইতিমধ্যে ভৈরব খুন হয়ে চলে আসবে যথাস্থানে। কাল সকালে সেই ব্যাটা ত্রিনয়ন আসবে তার বাহিনি নিয়ে। ভৈরবকে বাঁচাতে হবে। উই মাস্ট সেভ হিম। আর এই কুচক্রীদের সাজার ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘ভৈরব আছে কোথায়?’

‘একটু ভাবতে দাও, একটা ওমলেট পাঠাও।’

প্রীতপাল চোখ বুজিয়ে বসে আছে। রাত এল বলে। বাইরেটা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। অপরাধ না করেও আমি বসে আছি অপরাধীর মতো। প্রীতপাল হঠাৎ লাফিয়ে উঠল তড়াক করে। আমি আমার মতো করে বলে ফেলেছি, ‘আচ্ছা কিছু দিনের জন্য সরে পড়লে কেমন হয়?’

‘ইডিয়ট! তাহলে ভৈরব মরবে এবং তুমিও মরবে। এবং এই সম্পত্তি ওদের দখলে চলে যাবে।’

‘তাহলে?’

‘পাঁচিল টপকাতে পারবি?’

‘পাঁচিল?’

‘ইয়েস পাঁচিল।’

বাড়ির সমস্ত আলো নিবিয়ে দেওয়া হল। হরিদা বসে রইল অন্ধকারে ভূতের মতো। প্রীতপাল হরিদাকে বললে, ‘শোনো যেকোনও সময় একজন মহিলা আসবে। তুমি বলবে, বাড়ির আলো চলে গেছে, বাবু মিস্ত্রি ডাকতে গেছে। যদি বসতে চায়, বলবে, পরে আসবেন। তুমি খুব সাবধানে থাকবে, গেটের বাইরে যাবে না, যদি কেউ এসে বলে, তোমার বাবুর বিপদ হয়েছে, তাহলেও না।

আমাদের পোশাক এখন প্রায় মিলিটারিদের মতো। পায়ে স্নিকার শু। বাগানের পেছনের পাঁচিলের ধারে চলে এসেছি। বড় বড় গাছ। ওপারে সেই ভুতুড়ে কারখানা। অন্ধকার। জনপ্রাণী আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।

প্রীতপাল পাঁচিলের মাথায়। তার কাছে সহজ ব্যাপার। আমি কোনও ক্রমে উঠলুম। খুব সাবধানে ওপাশে এক লাফ। ঝোপঝাড়ের মধ্যে। সাপ থাকলেও থাকতে পারে। ইঁদুর, ছুঁচো আছেই।

অন্ধকারে হায়নার মতো এগোচ্ছি সন্তর্পণে। খালি পিপে। ফেলে দেওয়া বয়লার। অকেজো ট্রাক। ভাঙা মোটর গাড়ি। কারখানার শেড। যন্ত্রপাতির ভূত। এগোতে এগোতে প্রীতপাল হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। ভাঙা একটা ম্যাটাডরের আড়ালে আমরা গুঁড়ি মেরে বসলুম। খুব অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ আসছে। সামনেই গোডাউন। সেইদিক থেকেই আসছে গুঞ্জন। প্রীতপাল রিভালভারটা বের করে হাতে নিল। কানে কানে বলল, ক্রাউচ।’

গোডাউনের পেছন দিক। গরাদ বসানো জানলা। পাল্লা নেই। ভেতরে মোমবাতি জ্বলছে কেঁপে কেঁপে। ক্যাম্পখাটে চাদর চাপা একজন মানুষ। ষণ্ডা মার্কা দুটো লোক মেঝেতে বসে আছে। হিন্দিতে কথা বলছে।

‘দশ বাজে তক খতম হো যায়েগা।’

‘ক্যায়সে?’

‘য্যায়সে হোতা হায়!’

ফিসফিস করে বললুম, ‘অ্যাকসান!’

‘নট নাও। ওয়েট।’

প্রীতপাল ম্যাটাডরের তলায় শুয়ে মোবাইল ফোনে কাকে কি আদেশ করল বোঝা গেল না। অন্ধকারে আমিও ঘাপটি মেরে বসে আছি! অনেকটা পরে প্রায় মধ্যরাতে মেন গেট দিয়ে একটা গাড়ি ঢুকল। হেডলাইট, ব্যাকলাইট, ইনডিকেটার লাইট সব নেবানো। ভয়ঙ্কর এক দানবের মতো ঢুকছে। ইঞ্জিনের চাপা গড়গড়। গাড়িটা থামল। চারটে লোক নেমে এল। গোডাউনের দরজা খুলে ঢুকে গেল ভেতরে। মোট ছজন হল। আমরা মাত্র দুজন।

প্রীতপাল ঘড়ি দেখল। আমাকে বলল, ‘তুই ওই জানলায় থাক। ঘাবড়াসনি। তুই এই যন্ত্রটা হাতে রাখ। মাঝে মাঝে এই বোতামটা টিপবি। এটা সিগন্যাল। আরও এক ডজন লোক আসছে। সিগন্যালটা তাদের জন্যে।’

সিগারেট কেসের মতো চ্যাপ্টা একটা যন্ত্র আমার হাতে। টিপের মতো লাল একটা আলো জ্বলছে। প্রীতপাল অন্ধকারে নেকড়ে বাঘের মতো এগিয়ে গেল।

ভেতরে আর একটা বাতি জ্বলছে। একজন খাটিয়ার চাদরটা সরাতেই চমকে উঠলুম। ভেবেছিলুম ভৈরবকে দেখব। কোথায় ভৈরব। এ তো ভৈরবের বোন। ছ’জনের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে একটা ইনজেকসান ফুঁড়ে দিলে। কণিকা উঠে বসল। যে এতক্ষণ নেতিয়ে পড়েছিল সে চনমন করে উঠে বসল।

একজন অন্ধকার থেকে এগিয়ে এল, দলিলের মতো একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললে, ‘ভালোয় ভালোয় সইটা করে দাও, তা না হলে ওই যে তোমার দাদা, খতম হো যায়েগা।’ এইবার ভৈরবকে দেখতে পেলুম। স্ট্রেচারে পড়ে আছে। অর্ধমৃত। প্রীতপালকে দেখতে পাচ্ছি না। ছায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলেও আর একজনকে চিনতে পেরেছি, সে হল ওই ত্রিনয়ন।

কণিকা উত্তেজিত গলায় বললে, ‘সই আমি করব না, মেরে ফেলতে হয় মেরে ফেল।’

‘মারব কেন? তোমাকে সারাজীবন পঙ্গু করে ফেলে রাখব, আর তোমার দাদার ছাল ছাড়াব, একটু একটু করে মেরে ফেলব। আর যাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো, তার গলায় পরাব ফাঁসির দড়ি।’

দুজন স্ট্রেচারটা ধরাধরি করে সামনে নিয়ে এসে ধপাস করে মাটিতে নামাল। কোনও দয়ামায়া নেই। ভৈরবকে দেখে কষ্ট হচ্ছে। সেই সুন্দর চেহারা নেই। একটি কঙ্কাল। এত রাগ হচ্ছে মনে হচ্ছে ঘরে ঢুকে সব ক’টাকে মেরে পাটপাট করে দি।

দলের পাণ্ডা জিগ্যেস করলে, ‘ওদিকের খবর কী!’

‘বাড়ি অন্ধকার। পোল থেকে ফিউজ উড়ে গেছে। মেকানিক ডাকতে গেছে।’

‘পালায়নি?’

‘না ওস্তাদ।’

‘মরবে। মরতে ওকে হবেই। নাও দিদিমনি সই করো। কেন অশান্তি করছ।’

কণিকা কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ছ’টা লোক রাগে মাটিতে পা ঠুকল। আর ঠিক সেই সময় আমার হাতের যন্ত্র বিপবিপ করে উঠল।

হঠাৎ একটা কাপড়ের দলার মতো কী ঝপাস করে বাতি দুটোর ওপর এসে পড়ল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আমার চারপাশ দিয়ে কারা যেন ছুটে চলে গেল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে।

বন্ধু প্রীতিপালের কঠিন মিলিটারি গলা শোনা গেল, ‘যে যেখানে আছো সেইখানে থাকো। নড়ার চেষ্টা করলেই মাথার ঘিলু বের করে দেব। তোমরা ঘেরাও।’

লম্বা লম্বা গোটাকতক টর্চের আলোয় ঘর নীল। সেই আলোয় প্রীতপালের বারোজন লোক যেন বারোটা পাথরে কোঁদো মূর্তি। এতটা হবে ওই ছ’টা বদমাইশ বুঝে উঠতে পারেনি।

প্রীতপাল মোবাইল ফোনে বলছে, ‘সান্যাল মুভ ইন। ফ্রন্ট গেট। গোডাউন অ্যাট দি ব্যাক সাইড।’

পুলিশের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হল সেই ভুতুড়ে পরিবেশ।

একটা নয় দুটো ভ্যান। ফোর্স নামছে। সান্যাল বলছেন, ‘ওয়েল ডান প্রীত।’

সবক’টাকে ভ্যানে পুরে গাড়ি বেরিয়ে গেল। অন্ধকারে আকাশের আলোয় আমরা কয়েকজন। কণিকা এগিয়ে এসে বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। আমারও কান্না পাচ্ছে। অকারণে কণিকাকে আমি একদিন খুব কষ্ট দিয়েছি। আমি একটা অমানুষ বটে! কণিকা কত রোগা হয়ে গেছে!

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রীতপালের কম্যান্ড, ‘অনেক পাকামো করেছ, এইবার পিতার ইচ্ছাপূরণ করে দুজনে এক হও!’

আগে আগে স্ট্রেচারে চলেছে ভৈরব। পেছনে আমরা। আমার কাঁধে প্রীতপালের হাত। কণিকার কাঁধে আমার হাত।

চলে যাওয়ার আগে প্রীতপাল হেঁকে বলে গেল, ‘গাধা! নিমন্ত্রণ পত্রটা যেন আমরা পাই। আমাদের ফুল টিম। বরযাত্রী এবং বউভাত দুটোই।’

ভৈরব ইতিমধ্যে হরিদার হাতের কফি খেয়ে একটু চাঙ্গা হয়েছে। সে হাসতে হাসতে বললে, ‘দেখলি পাঁঠা! একেই বলে দাবার চাল! কিস্তিমাৎ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *