কিলিং মিশন – ৫৩

তেপ্পান্ন

পারতপক্ষে কথা বলছে না রানা, ফক্স ও ওয়াকার। ওরা জানত এমন একসময় আসবে, যখন চরম নিষ্ঠুর হতে হবে ওদেরকে।

বহুদিন ধরে ওয়াকারকে চেনে রানা। জনি চিরকাল ধরেই নীতিবান মানুষ। কারও প্রতি অন্যায় করার মানসিকতা ওর নেই। সবসময় থেকেছে সত্যের পথে। এদিকে বছরের পর বছর ধরে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ করেছে হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা। অবশ্য সেজন্যে তাদের পঞ্চাশজনেরও বেশি লোককে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা জনির পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু আজ এদের কারণে অবোধ এক নিষ্পাপ শিশু খুন হতো ভেবে পাথরের মত কঠিন হয়ে গেছে ওর মন।

ওদিকে গত ক’বছর পেশাদার খুনি হিসেবে মানুষ খুন করেছে ফক্স। এ-কাজে অভ্যস্ত। নরপশুগুলোকে খুন করতে গিয়ে হাত কাঁপবে না ওর।

জেসিকা বারবার বলে, সবার উচিত আইনের পথে হাঁটা। কিন্তু গত ক’দিন মনের সঙ্গে লড়ে শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রানা, ভালর জন্যেই নরকের কীটগুলোকে বিদায় করতে হবে এই পৃথিবী থেকে। এদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে কোনভাবেই উপকার হবে না সমাজের।

বাস্তবতা জানে রানা। দ্য হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদেরকে পুলিশে দিলে একদিনও হাজতবাস করবে না তারা। ব্রিটেনের বিত্তশালীরা সেটা হতে দেবে না। চারপাশ থেকে এদেরকে ঘিরে রেখেছে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির দুর্ভেদ্য দেয়াল। আইনের পক্ষের লোকেরা শত শত মিথ্যা কথা বলে তাদেরকে রক্ষা করবে। যতধরনের কেলেঙ্কারির কথাই প্রকাশ করা হোক, দু’চারদিনের ভেতরে তাদের মহান সব কীর্তির নিচে চাপা পড়বে সব। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুক্ত-মানুষ হিসেবে আদালত থেকে বেরোবে এরা। নতুন করে আবারও গুছিয়ে নেবে হ্যাভোক ক্লাব। আগের মতই খুন হবে নিরীহ মানুষ। বদলে যাবে না আসলে কিছুই।

সত্যটা জানে রানা। তাই হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদেরকে খুন করতে গিয়ে ওর মনে কোন অপরাধবোধ কাজ করবে না। তবুও কেমন যেন খচখচ করছে বিবেক বুকের ভেতরে!

এবার নরপশুগুলোকে গুলি করে খুন করতে হবে। যখন- তখন হাজির হতে পারে পুলিশ। কাজেই দেরি করার কোন উপায় নেই।

খুন করলেই হবে না, নানাভাবে প্রচার করতে হবে: এরা ছিল সমাজের নোংরা কীট!

সত্যি কথাই বলেছে গ্রেগ ডিলান। মানুষের কাছে প্রকাশ করে দিতে হবে এদের নোংরা চরিত্র। বুঝিয়ে দিতে হবে সমাজের ভিত্তি যারা তৈরি করেছে, প্রথম থেকেই তাদের অনেকে ছিল শয়তান-পূজারী। হোঁচট খেয়ে হতভম্ব হবে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সমাজের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে তো লড়তেই হবে!

‘তোমরা তৈরি?’ শুকনো গলায় বলল রানা।

পাথরের মত চেহারা করে বলল জনি। ‘আমি তৈরি!’

‘কাজ তো কাজই,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ফক্স।

যার যার অস্ত্র চেক করল ওরা।

ভোজকক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল রানা।

ওর হাতে উদ্যত অস্ত্র দেখে কয়েক পা পিছিয়ে গেল ক্লাবের সদস্যরা। পঞ্চাশজনের বিরুদ্ধে ওরা মাত্র তিনজন। ওদের গম্ভীর চেহারা দেখে ক্লাব সদস্যরা বুঝে গেছে, এবার কী ঘটতে চলেছে তাদের ভাগ্যে। শেষবারের মত মুক্তি পাওয়ার জন্যে হুড়মুড় করে দরজার দিকে এগোল তারা। যারা লড়াই করে মরতে চায়, তারা অন্তত পুরুষমানুষ। কিন্তু ক্লাবের একজন সদস্য নেই যে কি না সাহস করে লড়বে। এরা আসলে নর্দমার নোংরা কেঁচো। ভাবছে, লোভ দেখিয়ে কোন চুক্তির বলে পেয়ে যাবে বাঁচার সুযোগ।

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ফক্স।

পিছিয়ে গিয়ে ওদের দিকে ভীত চোখে চেয়ে রইল লোকগুলো। কয়েক মুহূর্ত পর ভিড় থেকে কাঁপা গলায় একজন বলল, ‘আমাদের কাছে তোমরা আসলে কী চাও?’

‘আগে বলো ব্যালার্ড আর লিয়োনেল কোথায়,’ বলল রানা।

‘তোমরা বলছ ইমোজেন ব্যালার্ড ও রিপার ক্যাসিডির কথা,’ কে যেন বলল। ‘তারা তো অনুষ্ঠানের আগেই চলে গেছে।’

‘তা হলে ওটা লিয়োনেলের সত্যিকারের নাম,’ বলল ফক্স।

চা’ওরা কোথায় গেছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানি না,’ বলল ক্লাবের আরেক সদস্য।

‘এখন কোথায় আছে তারা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আমার জানা নেই!’

‘কিন্তু বহুকিছুই তোমরা জানো,’ স্মার্টফোন হাতে বলল ওয়াকার। ‘এক এক করে সব খুলে বলবে। স্বীকারোক্তি দেবে!’ ভিডিয়ো রেকর্ড করতে শুরু করে ক্যামেরা তাক করেছে তাদের দিকে।

‘আমাকে বাঁচতে দিন, স্বীকারোক্তি দেব!’ ফাটা গলায় বলল একজন। ‘আমি থঅথের ধর্মের অনুসারী! আমি…’

‘অ্যাই, চোপ!’ ভিড় ঠেলে এল মোটা এক টাকমাথা লোক। রাগে-ক্ষোভে লালচে হয়েছে তার মুখ। সবার উদ্দেশে আঙুল তুলে নাচাল। ‘এদেরকে কিছুই বলবে না!’ রানার দিকে ঘুরে তাকাল মোটকু। ‘যদি ভেবে থাকো যা-খুশি করবে, তো তোমরা আছ বোকার স্বর্গে। তোমরা গাধা নাকি? মিডিয়া চালায় কারা? কারা লেখে দৈনিক পত্রিকায়? এই আমরাই তো বলে দিই পাবলিক কী খবর গিলবে! তোমরা যা-খুশি বললেও, সবই প্রমাণিত হবে মিথ্যা হিসেবে। ষড়যন্ত্রের থিয়োরি হিসেবে তোমাদের প্রতিটি কথা উড়িয়ে দেয়া হবে। সবাই ধরে নেবে ঘৃণা থেকে এসব বলেছ। কেউ পাত্তা দেবে না তোমাদের একটা কথাও। কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না তোমরা!’

‘আমি এত নিশ্চিত নই,’ শুকনো গলায় বলল ফক্স।

‘বরং আমাদেরকে ছেড়ে দাও। বড়লোক করে দেব। ভাবতেও পারবে না শত কোটি পাউণ্ড পেলে মনের ভেতরে কেমন ফুর্তি আসে!’

ভিড় ঠেলে বেরোল আরেক লোক। ‘এত টাকা হাতে পেলে কী করতে পারবে, একবার কখনও ভেবে দেখেছ?’

‘তোমরা ভাবছ টাকা দিয়ে আমাদেরকে কিনে নেবে, তাই না?’ তিক্ত স্বরে বলল ওয়াকার। রেকর্ড করছে ভিডিয়ো। মেয়েদেরকে তুলে আনলে সেজন্যে কিডন্যাপারদেরকে কত টাকা দাও তোমরা? আজ যাকে খুন করতে চাইলে, তার জন্যে কত খরচ করেছ? কত টাকা লেগেছে নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করতে?’

‘জিজ্ঞেস করুন নিজের মেয়েকে খুন করতে দেয়ায় কত নিয়েছে ক্রিস্টোফার গান!’ বলল ফক্স, ‘এটাও জানতে হবে, স্টিভ হ্যারিসকে খুন করতে কত খরচ করেছে গ্র্যাণ্ড মাস্টার ইমোজেন ব্যালার্ড! নইলে তো বই লিখে তার বারোটা বাজিয়ে দিত সে!’

‘মর্, ঘেয়ো কুকুরের বাচ্চারা!’ তীব্র ঘৃণায় কপালের শিরা ফুলে উঠল মোটকুর। ‘নরকের লেলিহান আগুনে সেদ্ধ হবি! গুঁড়ো হবে হাড়! আঁধারের প্রভু, চিরঞ্জীব শয়তান তোদেরকে চরম শাস্তি দেবেন!

ক্যামেরা চলছে বলে লোকটাকে বেধড়ক পিট্টি দিল না রানা। আরও তিক্ত হয়েছে ওর মন।

কিন্তু তখনই হঠাৎ করে বদলে গেল পরিস্থিতি।

প্রাসাদের ছাত টপকে এল এক হেলিকপ্টার। আওয়াজ এত বেশি যে বোঝা গেল খুব কাছে’ নামবে। থরথর করে কাঁপছে ভোজকক্ষের জানালা-দরজা। লেক পেরিয়ে শার্লন হলের পাশের মাঠে নামতে শুরু করেছে যান্ত্রিক ফড়িঙ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *