বায়ান্ন
বিশাল ঘরে পা রেখে শীতল অনুভূতি হলো রানার মনে। বুঝে গেছে, এটা অশুভ গোপন মন্দির! অপদেবতাকে তুষ্ট করতে চুরি করে এনে নিষ্ঠুরভাবে এখানে হত্যা করা হয় নিষ্পাপ শিশুদেরকে!
দেয়ালের ব্র্যাকেটে হিসহিস শব্দে জ্বলছে মশাল। ওগুলো থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে কটুগন্ধ। হলদেটে কাঁপা আলোয় রানা দেখল, মন্দিরের মেঝে সাদা মার্বেলের। মাঝে বিশ ফুট বৃত্তাকার লাল রঙের একটি অংশ। দরজার মতই ওখানে অদ্ভুত নকশা। লাল বৃত্তের মাঝে ছোট আরেক বৃত্তাকার অংশে রুপালি হোল্ডারে জ্বলছে কালো মোমবাতি- ঘিরে রেখেছে নিচু এক বেদি। ওটা খয়েরি হয়ে গেছে শুকনো রক্তে। বেদির ওপরে রাখা আছে রুপার তৈরি ছোট এক পানপাত্র। পাশেই ধারালো ড্যাগার। ওটার হ্যাণ্ডেল আইবিসের মাথার আকৃতির। কালো মোমবাতির আলোয় রুপার মত ঝিকঝিক করছে ড্যাগার।
হতবাক হয়েছে রানা অন্য কারণে। আবর্জনায় ভরা পাথরের কালো এক টেবিলের ওপরে ছোট এক খাঁচার ভেতরে শুয়ে আছে দুধের এক শিশু!
জীবনে বহুবার মর্মান্তিক সব ঘটনা দেখেছে রানা। কিন্তু আজ চাক্ষুষ করছে সেসবের চেয়েও খারাপ কিছু। রানা বুঝে গেল, আজ রাতে দ্বীপে মেয়েটাকে বলি দেয়ার পর চরম নারকীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ইমোজেন ব্যালার্ড। জিনাকে খুনের মাধ্যমে শুরু হতো বিশেষ পৈশাচিক উৎসব। শয়তানের অশুভ পাতাল-মন্দিরে খুন হতো এই দুধের শিশু। রুপালি পানপাত্রে ওর রক্ত ঢেলে ঢকঢক করে পান করত ক্লাবের বিশিষ্টজনেরা। ভাবত: শিশুটাকে হত্যা করেছে বলে অপদেবতা থঅর্থ ও অন্ধকারের প্রভু শয়তানের কাছে আরও প্রিয় হয়ে উঠবে তারা!
‘তোরা অমানুষ!’ বিড়বিড় করল রানা। ওর কথায় যেন সায় দিল মশালের হলদেটে দুলন্ত শিখা। কয়েক পা গিয়ে টেবিলের সামনে থামল রানা। কাঁপা হাতে খুলল খাঁচার ঢাকনি। সাবধানে তুলে নিল উলঙ্গ শিশুটাকে। পিচ্চির বোধহয় খিদে লেগেছে, হাত-পা নাড়ছে। বয়স হবে বড়জোর দু’সপ্তাহ। রানার দিকে চেয়ে হাতদুটো মুঠো করে চ্যাঁ করে কেঁদে উঠল। বাচ্চাটা কোথা থেকে এল, ভাবছে রানা। হয়তো অবাঞ্ছিত জন্ম, তাই ওকে ফেলে গেছে ওর মা। অথবা কিডন্যাপ করা হয়েছে কোথাও থেকে। আবার এমনও হতে পারে, ওকে দান করেছে হ্যাভোক ক্লাবের কোন সদস্য- সন্তানের চেয়ে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তার কাছে ঢের বেশি আকর্ষণীয়। ঘটনা যা-ই হোক, জিনার মত পিচ্চিটাকেও এখন নিরাপদে কোথাও সরিয়ে নিতে হবে। প্রাণ থাকতে ওদের ক্ষতি হতে দেবে না রানা। বাচ্চাটাকে বুকের ওপরে শুইয়ে অশুভ মন্দির থেকে বেরিয়ে এল। হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদের প্রতি মনে জ্বলছে তীব্র ঘৃণা।
ড্রাগসের কড়া প্রভাব ও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে বলে প্যাসেজের মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে জিনা। রানা বুঝল, এবার মেয়েটা আর বাচ্চাটাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে ওর। পিচ্চিকে সাবধানে মেঝেতে রেখে ঝটপট নিজের শার্ট খুলল রানা। শার্টে গিঁঠ মেরে তৈরি করল ছোট্ট এক হ্যামকের মত দোলনা। হাত গলিয়ে ওটা ঝুলিয়ে নিল বুকের সামনে। মেঝে থেকে নিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিল পিচ্চিটাকে। একহাতে এমনভাবে ধরেছে, যাতে পড়ে না যায়। এবার ডানহাতের জোরে জিনাকে বাম কাঁধে তুলল ও। প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে মনে হলো, পেছনে রেখে যাচ্ছে সাক্ষাৎ নরক!
পিস্তলের আলোয় প্রধান সুড়ঙ্গ ধরে প্রাসাদ লক্ষ্য করে ছুটে চলল রানা। পাতাল-সমাধির ভীতিকর অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে কিছুক্ষণের ভেতরে প্রাসাদের সরু সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল।
.
রানার জন্যে ভোজকক্ষের বাইরে অপেক্ষা করছে জনি ওয়াকার। তার ধারণা ছিল, বন্ধুর সঙ্গে থাকবে দ্বীপের সেই মেয়েটা। কিন্তু বন্ধুর বুকে ঝুলন্ত শিশুটাকে দেখে কপালে উঠল ওর দু’চোখ। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, ‘হায়, ঈশ্বর!’
‘বাচ্চাটাকে এরা খুন করত,’ বলল রানা।
চট করে একটা চেয়ার নিয়ে এল ওয়াকার। রানার কাঁধ থেকে নিয়ে ওখানে জিনা ওয়েসকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। নিজের কাঁধে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ওয়াকারের হাতে বাচ্চাটাকে দিয়ে গিঁঠ খুলে শার্ট পরল রানা। দুধের বাচ্চা বমি করে দিয়েছে শার্টে। বুকের কাছ থেকে টক দইয়ের গন্ধ পেল রানা। বিন্দুমাত্র ঘৃণা এল না ওর মনে। মৃদু হেসে একবার দেখল পিচ্চিটাকে।
‘তুমি আবার এসব কবে শিখলে?’ পিচ্চি বেশ নড়ছে, বেকায়দাভাবে ওকে ধরেছে ওয়াকার। দুর্ধর্ষ গোয়েন্দার চোখে-মুখে এখন অসহায় ভাব। ওর পেটে ছোট্ট একটা লাথি দিল পিচ্চি। বিড়বিড় করল ওয়াকার, ‘আগে কখনও এদের এত কাছে আসিনি।
‘আমিও না,’ স্বীকার করল রানা।
‘কিন্তু আমরা এবার ওকে নিয়ে কী করব?’
ঘুমন্ত জিনাকে দেখল রানা। ‘প্রথম সুযোগে এদেরকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেব। পরে পৌছে দেব পুলিশের কাছে।’
ভোজকক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ল ওয়াকার, ‘রামিন! রোল্স রয়েসটা নিয়ে এসো!’ তরুণের দিকে চাবির গোছা ছুঁড়ল ও।
হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদেরকে আটকে রাখার কাজ পেয়ে খুশি নয় রামিন। ঘর থেকে বেরিয়ে পিচ্চিকে দেখে হাত থেকে রাইফেল নামিয়ে রাখল। ওয়াকারের কাছ থেকে এমনভাবে বাচ্চাটাকে নিজের কাঁধে নিল, যেন সারাজীবন ধরে এই কাজই করে চলেছে। রানার মনে পড়ল, চাকরিতে যাওয়ার আগে নিজেদের পিচ্চি মেয়েটাকে রামিনের কাছে রেখে যেত ওর দূর সম্পর্কের চাচা-চাচী। দুর্ধর্ষ স্নাইপারের শার্টের কাঁধ চুষে খেতে শুরু করেছে লালচে পিচ্চি, চোখে- মুখে ভীষণ বিরক্তি।
‘ব্যাটা এত বিরক্ত কেন?’ বিড়বিড় করল ওয়াকার। ‘চায়টা কী?’
‘ওর শীত লাগছে,’ বলল রামিন। ‘কম্বল বা গরম কিছু এনে দিন। ওটা দিয়ে গলা পর্যন্ত মুড়িয়ে রাখতে হবে।’
মিনিট পাঁচেক পর বাড়ির উঠনে চাকার কর্কশ আওয়াজ তুলে থামল ক্রিস্টোফার গানের রোদ্ রয়েস। ততক্ষণে ভোজকক্ষের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়েছে রানা, ফক্স, ওয়াকার ও ডিগবার্ট। ভেতরে বন্দি হয়ে চিৎকার জুড়েছে ক্লাবের সদস্যরা। দরজা পিটাচ্ছে কেউ কেউ। চেয়ার আছড়ে জানালা ভাঙতে চাইছে কয়েকজন। কিন্তু নিরেট দরজা বা লোহার পাত বসানো জানালা ভেঙে বেরোবার উপায় কারও নেই। রানা আর ওর বন্ধুরা জিনাকে তুলে দিল গাড়ির পেছনের সিটে। পিচ্চির মাথা কাঁধে রেখে প্যাসেঞ্জার সিটে বসল রামিন। ড্রাইভিং সিটে উঠল ডিগবার্ট। ভ্যান যেখানে লুকিয়ে রেখেছে, ওখানে পৌঁছে গাড়িটা নিয়ে রওনা হবে ওরা। আগেই স্থির করা আছে পরে কোথায় দেখা হবে ওদের। রানাদের কাজ শেষ হলে, শার্লন হলের কাছে ক্রিস্টোফার গানের রোল্স রয়েস পাবে পুলিশের লোক। মাথা চুলকে ভাববে- মৃত এমপির গাড়ি এখানে এল কী করে? তার চেয়েও বড় সমস্যায় পড়বে শার্লন হলে ঢুকে একগাদা লাশ পেলে।
‘যাক, রওনা হয়েছে,’ রোল্স রয়েসটাকে চলে যেতে দেখল ওয়াকার।
রামিনের কাছে জিনা ও পিচ্চি সম্পূর্ণ নিরাপদ, মনের ভেতরে অদ্ভুত স্বস্তি পেল রানা। এবার শার্লন হলে নতুন করে যে খুনের ঘটনা ঘটবে, মেয়েটা সেটা দেখুক, সেটা চায়নি ও।
এবার রানা, ফক্স ও ওয়াকার নামিয়ে দেবে হরর এই নাটকের যবনিকা।
‘বস্, আসুন, কাজটা শেষ করি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ফক্স।