একান্ন
এমপি ক্রিস্টোফার গানের বাড়ি থেকে বেরোবার আগে কাজে লাগবে ভেবে তার স্মার্টফোন সঙ্গে নিয়েছে রানা। ওটার ভেতরে সেভ করে রাখা আছে শার্লন হলের ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্কিটেকচারাল প্ল্যান। সুচারুভাবে দেখানো হয়েছে প্রাসাদের নিচের সমাধি। প্ল্যানটা মাথায় গেঁথে নিয়ে এ- মুহূর্তে পাতাল-সুড়ঙ্গ খুঁজতে রওনা হয়েছে রানা।
নকশা অনুযায়ী নিচতলায় আছে ওয়াইন-সেলার। ওটার ভেতরে ঢুকলে সামনে পড়বে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সেলারের কারুকাজ করা দরজাটা পেল রানা। তবে কড়ায় ঝুলছে লোহার ভারী তালা। ওয়ালথারের পাঁচটা গুলি খরচ করে ওটাকে বাতিল মালে পরিণত করল রানা। পিছিয়ে লাথি দিতেই ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজে খুলে গেল প্রাচীন দরজা। সেলারের ভেতরে ঢুকে পড়ল রানা। অন্ধকারে চিমসে বাজে গন্ধ। একটু দূরে থাকার কথা পাথুরে সিঁড়ি। ওয়ালথার কোমরে গুঁজে আধুনিক পিস্তলটা হাতে নিল রানা। জ্বেলে নিল ওটার ওয়েপন লাইট। সাদা আলোয় দেখল ঘরের চারপাশে প্লাস্টার ছাড়া ইঁটের ন্যাড়া দেয়াল। এখানে-ওখানে স্তূপ করা হয়েছে ওয়াইনের পুরনো বাতিল পিপে। ওকে দেখে প্রাণভয়ে সরসর করে ছুটে আবর্জনার ভেতরে ঢুকল এক ফুট দৈর্ঘ্যের ধেড়ে এক ইঁদুর।
অস্ত্র হাতে এগোল রানা, সতর্ক। ফ্ল্যাগস্টোনের মেঝেতে ওর চোখে পড়ল বহু মানুষের জুতোর ধুলোময় চিহ্ন। ওটা অনুসরণ করল রানা। সেলারের পেছন-দেয়ালের কাছে পেয়ে গেল সরু সিঁড়ি। পনেরো ধাপ নেমে সামনে পড়ল ধনুকাকৃতির এক খিলান। পিস্তলের আলোয় রানা পরিষ্কার দেখল খিলানে গথিক অক্ষরে লেখা: AVE SATANAS, DOMINUS ET MAGISTER TENEBRIS. অর্থাৎ : জয় হোক শয়তানের, অন্ধকারের প্রভু ও মালিক।
খিলান পেরোতেই নাকে এল অসুস্থকর, মিষ্টি দুর্গন্ধ। এ- বাড়িতে আগেও ওটা পেয়েছে রানা। তবে আরও কড়াভাবে এল ওটা একটু দূরের সুড়ঙ্গ থেকে। কুবাসটা বাসি রক্তের। কেমন যেন গুলিয়ে উঠল ওর গা। এখানে সত্যিই হয়তো নিয়মিত হাজিরা দেয় মৃত্যুদেবতা! সামনের নিকষ অন্ধকার চিরে দিল ওর হাতের উজ্জ্বল আলো। বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল রানা।
বহুদূরে গেছে সুড়ঙ্গ। দু’দিকের দেয়াল ও মেঝে মসৃণ, ছাত বৃত্তাকার। রানা বুঝে গেল, লেকের তলার এই পথ তৈরি করতে গিয়ে খরচ করা হয়েছে হাজার হাজার টন কংক্রিট। তাতে লেগেছে লাখ লাখ পাউণ্ড। মাঝে মাঝে দু’পাশে দরজা ও সরু প্যাসেজ। সেসব পেছনে ফেলে প্রধান সুড়ঙ্গ ধরে ছুটে চলেছে রানা। ক্রিস্টোফার গানের কাছ থেকে পাওয়া আর্কিটেকচারাল প্ল্যান অনুযায়ী প্রাসাদ থেকে সরাসরি লেকের তলা দিয়ে গেছে এই সুড়ঙ্গ, উঠেছে গিয়ে সরু এক শাফটে। ওটা ধরে এগিয়ে গেলে সামনে পড়বে জঙ্গলে ভরা দ্বীপ। বহু বছর ধরে অসংখ্য অসহায় মেয়েকে এ-পথে নিয়ে গিয়ে থঅথের মূর্তির সামনে খুন করা হয়েছে।
ছুটবার গতি বাড়ল রানার। কয়েক শ’ ফুট যেতেই দেখতে পেল, ছাতের ফাটল দিয়ে চুইয়ে নামছে ফোঁটা-ফোঁটা পানি। ওর বুঝতে দেরি হলো না, ও আছে এখন লেকের তলদেশে। একবার পুরনো কংক্রিট ধসে গেলে পঞ্চাশ হাজার টন পানির চাপে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হবে। অজান্তে দৌড়ের গতি আরও বাড়ল রানার। একটু পর ওর পিস্তলের আলো পড়ল সামনের নিরেট পাথুরে গাঁথুনির ওপরে। ওখান থেকেই ঢালু হয়ে উঠেছে সরু শাট্। তবে ওটা ধরে কিছুটা এগোতেই সামনে পড়ল সিঁড়ির ধাপ।
একেকবারে তিনধাপ করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল রানা। ওপর থেকে এল ফুরফুরে হাওয়া। সিঁড়ি বেয়ে উঠে সমতল জমিতে পৌছে গেল রানা। জায়গাটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ঘন ঝোপঝাড় ও কাঁটাগাছ। মাথার ওপরে পাতার ছাউনির ফাঁক গলে নেমে এসেছে চাঁদের আলো। সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে বেশি দূরে নয় থঅথের মূর্তি। কাছ থেকে ওটাকে দানবীয় বলেই মনে হলো রানার। থঅথের পায়ের কাছে শুকিয়ে যাওয়া রক্তে মাখা খয়েরি বেদি। হাত বেঁধে ওখানে বলি দিত অসহায় মেয়েদেরকে। সতর্ক পায়ে বেদির পেছনে পৌছে গেল রানা। এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে মৃতপ্রায় আগুন। পোড়া কাঠের ঝাঁজাল ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। ঝোপের পাশে মাথা-ভাঙা এক লাশ দেখল রানা। রামিনের গুলিতে মারা গেছে লোকটা। মৃতদেহ টপকে বেদির কাছে গিয়ে রানা দেখল, কবজির ফিতার জন্যে প্রায় ঝুলে আছে মেয়েটা।
ড্রাগস্ ও শকের প্রভাবে প্রায় অসচেতন। চোখের জল ও কালো ছাই মেখে মিষ্টি মুখটা যেন ভুতুড়ে। পাথরে গেঁথে দেয়া স্টিলের রিঙে বেঁধে রাখা হয়েছে মেয়েটার দু’হাতের ফিতা। লাল আলখেল্লা পরা লোকটার রক্তে ভেসে গেছে বেচারির মুখের একপাশ। সাদা গাউন এখন লাল ছিটায় ভরা। মেয়েটার কপাল ভাল যে এখনও বেঁচে আছে। পিস্তল কোমরে গুঁজে কসাইটার ড্যাগার মাটি থেকে তুলল রানা। বেদির দিকে ঝুঁকে কাটতে লাগল চামড়ার ফিতা। বারবার চোখ উল্টে যাচ্ছে মেয়েটার। তবুও দেখতে চাইছে রানাকে। অস্ফুট স্বরে কী যেন বলল। গলা চিরে বেরোল দুর্বল গোঙানি।
‘ভয় নেই,’ আশ্বস্ত করতে চাইল রানা। ‘তোমার আর কোন বিপদ হবে না।’
‘আমাকে… আপনি… মেরে ফেলবেন না তো?’
‘না, তুমি পুরো নিরাপদ। আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। তাই ভয় পেয়ো না।’
‘আ… আপনি কে?’
‘আমার নাম মাসুদ রানা। কথা বলতে কষ্ট হলে চুপ করে থাকো।’ কয়েক টানে ধারালো ড্যাগার দিয়ে মেয়েটার ডান কবজির চামড়ার ফিতা কাটল রানা। নিজের দেহের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করাল মেয়েটাকে। কাটতে লাগল বাম কবজির ফিতা। রক্ত ও চোখের জলে ভিজে গেছে বেচারির চুল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। রানা টের পেল, থরথর করে কাঁপছে সে। বিড়বিড় করে নিজের নাম জানাল: ‘আমি… জিনা… জিনা ওয়েস।’
‘একটু পর তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে নেব,’ বলল রানা। দ্বিতীয় ফিতা কাটা হলেই ওর গায়ে এলিয়ে পড়ল মেয়েটা। দু’হাতে ওকে ধরে ফেলল রানা। নরম সুরে বলল, ‘হাঁটতে হবে না। তোমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যাব।’
‘আপনি কি পুলিশ?’ বিড়বিড় করল জিনা।
‘তা নই, তবে তোমাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেব।’
‘ও… ওরা… আমাকে…’
‘জানি, দুশ্চিন্তা কোরো না। ওরা আর কখনও কারও কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’
বাম কাঁধে জিনাকে তুলল রানা। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পৌছে গেল সুড়ঙ্গের সিঁড়ির সামনে। হালকা-পাতলা মেয়ে জিনা, তবে ওকে বয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে বাহু ও কাঁধের পেশিতে টনটনে ব্যথা শুরু হলো রানার। নিজেকে মনে হলো হতক্লান্ত। টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নামল ঢালু শাফটে। ভাবছে, এরা হাতে পেলে ভয়ঙ্কর পরিণতি হতো জেসিকার। ভাবনাটা রাগিয়ে দিল রানাকে। আর ওই রাগ ওকে এনে দিল এগোবার মানসিক শক্তি।
শাট্ বেয়ে নেমে প্রধান সুড়ঙ্গ ধরে ছুটে চলল রানা। যত দ্রুত সম্ভব ওর পৌঁছে যেতে হবে প্রাসাদে। কিন্তু ফিরতি এই পথ যেন মাইলকে মাইল লম্বা! মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে ছুটতে গিয়ে এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছে ওর হাতের পিস্তলের আলো। ক্রমেই আরও ভারী হয়ে উঠছে জিনা। বেচারি হাত ফস্কে পড়ে যেতে পারে ভেবে শক্ত করে ওকে ধরল রানা। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেটা বোঝার সাধ্য হারিয়ে বসেছে প্রায়-অচেতন মেয়েটা। কাঁধে পড়ে আছে শিশুর মত। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। কিছুক্ষণ পর জিনাকে ফিসফিস করতে শুনল রানা, ‘বাচ্চা… শিশু… বাচ্চা…’
। এ-কথায় বড় একটা ঝাঁকি খেল রানা। জিনার কাছে জানতে চাইল, ‘কী বললে? আরেকবার বলো তো!’
ফিসফিস করল মেয়েটা, ‘বাচ্চা! শিশু! ওকে কাঁদতে… শুনেছি!’
বুকের রক্ত হিম হয়ে এল রানার। ‘তুমি এ কী বলছ? আরেকবার বলো তো!’
কড়া নেশায় অচেতন হয়ে যাচ্ছে জিনা। মুখে কথা নেই।
ড্রাগসের প্রভাবে মেয়েটা বোধহয় ভুলভাল বকছে, ভাবল রানা। কিন্তু সেটা যদি না হয়? মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকাল রানা। ‘জিনা! বাচ্চার ব্যাপারে কী যেন বললে?’
জবাবে বলল মেয়েটা, ‘ওরা খুন করবে বলে এনেছে।’
‘কোথায় রেখেছে?
‘সুড়ঙ্গের দূরে। আমি দেখেছি।’
‘আমাকে পথ দেখাও!’ জিনাকে কাঁধে নিয়ে আগের চেয়ে জোরে ছুটতে লাগল রানা। এদিকে-ওদিকে গিয়ে পড়ছে পিস্তলের আলো। সুড়ঙ্গের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে ওর পদশব্দ। ধুপধাপ করে পাঁজরে জোরে বাড়ি মারছে রানার অস্থির হৃৎপিণ্ড। বামে পড়ল অপেক্ষাকৃত সরু এক প্যাসেজ। ছুটতে ছুটতে ওটা পেছনে ফেলল রানা। কিন্তু তখনই বিড়বিড় করে বলল জিনা, ‘ওদিকে! ওখানে বাচ্চা!’
ঘুরে আবারও সরু প্যাসেজের মুখে ফিরল রানা। সুড়ঙ্গটা সরু ও নিচু। ভেতর থেকে ভক্-ভক্ করে আসছে বিশ্রী গন্ধ। একবার দম নিয়ে প্যাসেজে ঢুকল রানা। বিশ গজ যেতেই পিস্তলের আলোয় দেখল ডানের দেয়ালে পনেরো ফুট দূরে পর পর দুই দরজা। কাছের দরজাটা ভারী কাঠের। লোহার পাত দিয়ে মজবুত করা। প্রথম দরজা বাইরে থেকে বল্টু মেরে আটকানো। একটু দূরের ওক কাঠের দরজা চওড়া ও উঁচু। ওটাতে খোদাই করা আছে অদ্ভুত সব নকশা।
‘জিনা, কিছুক্ষণের জন্যে তোমাকে নামিয়ে দেব। বসে থাকতে পারবে তো?’
অনুনয় নিয়ে রানাকে বলল মেয়েটা, ‘আমাকে ফেলে চলে যাবেন না তো! আমার খুব ভয় লাগছে!’
‘কথা দিলাম, তোমাকে রেখে কোথাও যাব না।’ সাবধানে মেয়েটাকে মেঝেতে শুইয়ে দিল রানা। কয়েক পা গিয়ে বল্টু টেনে খুলল প্রথম দরজা। নাক কুঁচকে গেল ওর। ঘরের বদ্ধ পরিবেশে বোটকা গন্ধ। ঘরের ভেতরে আলো ফেলল রানা। মৃত্যুকূপের মত এমন কারাগার তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে আগেও দেখেছে ও। পাথুরে ছাতে বল্টু মেরে আটকে দেয়া হয়েছে লোহার পুরু পাত। ওটা থেকে ঝুলছে শিকল, শেষমাথায় হাতকড়া। চৌকি নেই যে শোবে বন্দি। বালতি নেই যে পায়খানা বা প্রস্রাব করবে। দেয়ালের পাশে শুকনো ঝুরঝুরে মাটি দেখে রানা টের পেল, ওগুলো আসলে কী। এজন্যেই এত তীব্র এ-ঘরের দুর্গন্ধ।
মেঝেতে স্তূপ হয়ে আছে মেয়েদের পোশাক। রানা বুঝে গেল, সাদা গাউন পরিয়ে খুন করতে দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার আগে এখানেই ছিল জিনা।
কারাগার থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরের দরজার সামনে থামল রানা। দ্বিতীয় দরজায় বল্টু নেই। লোহার বড় হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দিলে ঢোকা যাবে ঘরে। কবাট অদ্ভুত কারুকাজ করা। নকশাগুলো দেখে গলা শুকিয়ে গেল ওর। খোদাই করা হয়েছে অপদেবতা থঅথের প্রতিকৃতি। আরও আছে শিংওয়ালা মর্দা ছাগল। পিস্তলের আলোয় জ্বলজ্বল করছে ওটার রুবি পাথরের রক্তলাল দুই চোখ।
হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল রানা। তখনই শুনতে পেল দুর্বল স্বরে কেঁদে উঠেছে এক নবজাতক!