চার
প্যারিসের উপকণ্ঠে চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে নেমে লং-স্টে কার পার্ক থেকে ফোর-রানার টিআরডি অফরোড প্রিমিয়াম টয়োটা গাড়িটা সংগ্রহ করে ঝড়ের বেগে নরম্যাণ্ডির উদ্দেশে রওনা হয়েছে মাসুদ রানা। তবে সেটাও কয়েক ঘণ্টা আগের কথা।
এখন নেমে এসেছে রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। গরম পড়েছে ফ্রান্সে। আকাশে নানান রঙ-বেরঙে ঝিকমিক করছে হাজারো কোটি নক্ষত্র। রানা এজেন্সির পুরনো দোতলা বাড়ির প্রশস্ত উঠানে পৌছে রানা দেখল, নিচতলার জানালায় হলদে আলো। ওর বুঝতে দেরি হলো না, কিচেনে আছে রামিন রেজা ও জনি ওয়াকার- অপেক্ষা করছে ও ফিরলে একসঙ্গে ডিনার সেরে নেবে।
অবসর পেলে ওখানে আড্ডা জমায় ওরা। রামিন রেজার মুখোমুখি চেয়ারে বসে একের পর এক ওয়াইনের বোতল সাবড়ে দেয় ওয়াকার। মৃত্যুর আগে মা নিষেধ করেছিলেন বলে নেশাদ্রব্য ছুঁয়েও দেখে না রামিন। তবে জরুরি কোন অ্যাসাইনমেন্টে ড্রিঙ্ক করতে বাধ্য হলে, সেটা অন্য কথা।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে ঢুকল রানা। কিচেন থেকে এল জনি ওয়াকারের হাঁক: ‘রানা, পৌঁছে গেছ? আমি কিন্তু আমার পাইলটের লাইসেন্সটা পেয়ে গেছি!’
‘ভেরি গুড! আমি দোতলায় যাচ্ছি।’ কিচেনের দিকে না গিয়ে সিঁড়ির দিকে চলল রানা। অস্থির লাগছে মন। বুঝতে পারছে, ওর কারণে মস্ত বিপদে পড়েছে জেসিকা।
‘মাসুদ ভাই, আপনার সময় কেমন কাটল?’ টেবিল ছেড়ে কিচেনের দরজায় থেমে জানতে চাইল রামিন। মুখ-হাত ধুয়ে আসুন। ডিনার রেডি।’
সিঁড়ি থেকে ঘুরে তাকাল রানা। ‘আমার খিদে নেই, রামিন। তোমরা খেয়ে নাও। শাওয়ার নেব।’
রামিনের পাশে এসে থেমেছে ওয়াকার। আগে ছিল ব্রিটিশ নেভির চৌকশ অফিসার। পরে পাকা গোয়েন্দা। ওর কাছ থেকে কিছু গোপন করা খুব কঠিন কাজ। একপাশ থেকে রানার মুখ দেখেই কেন যেন সন্দেহ জেগেছে ওর মনে। নিচু গলায় বলল, ‘তুমি ঠিক আছ তোঁ, রানা?’
‘ঠিক আছি,’ সহজ সুরে বলতে চাইল রানা।
‘আমার তো তেমন মনে হচ্ছে না,’ চাপা স্বরে বলল ওয়াকার।
‘একটা কাজে জড়িয়ে গেছি, আর কিছু না,’ সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ঢুকল রানা। ডাইনিং স্পেস পার করে বেডরুমে ঢুকে বিছানার ওপরে রাখল ওর ব্যাগ। ওয়ারড্রোব থেকে নতুন পোশাক নিয়ে ঢুকে পড়ল বাথরুমে। পোশাক ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল শাওয়ারের নিচে। কল ছেড়ে দিতেই বরফ-ঠাণ্ডা জলস্রোত ভিজিয়ে দিল ওকে। মাথা থেকে দূর করতে চাইল সব দুশ্চিন্তা। তবে তাতে কোন লাভ হলো না। অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেলের কথা থেকে বুঝতে পেরেছে, প্রথমে উইলবার ফক্সকে খুঁজতে হবে লণ্ডনে। এবং এ-কাজে দেরি করা চলবে না।
শাওয়ার সেরে ভদ্রস্থ হয়ে বেডরুমে ঢুকল রানা। দেরি না করে বিছানার পাশে নিচু টেবিল থেকে ল্যাণ্ড ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল বিসিআই অফিসে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কাছে।
খুট করে একটা আওয়াজ হওয়ার পর ওদিক থেকে এল গম্ভীর কণ্ঠ, ‘হ্যালো?’
‘স্যর, আমি রানা,’ শুকনো গলায় বলল রানা।
নীরবে পেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ, তারপর বললেন বিসিআই চিফ, ‘নিশ্চয়ই জরুরি কোন কারণে ফোন করেছ?’
‘জী, স্যর।
‘বলো।’
ঢোক গিলল রানা। ‘কিছু দিনের জন্যে আমার ছুটি দরকার, স্যর।
কয়েক মুহূর্ত পর এল প্রশ্ন: ‘কত দিনের জন্যে?’
‘তা এখনও জানি না। তবে পনেরো দিনের বেশি লাগবে না বলেই মনে হচ্ছে।’
‘ঠিক আছে। সোহেলকে বলব ছুটি দেয়ার ব্যাপারে।’
‘জী, স্যর।’
‘বড় কোন বিপদ হলে দেরি না করে জানাবে।’
‘জী।’
‘সতর্ক থেকো। দরকার হলে তোমাকে যেন ফোনে পাই।’ কেটে গেল বিসিআই চিফের ফোন।
রিসিভার ক্রেডলে রেখে দ্রুত হাতে ট্র্যাভেল ব্যাগ নতুন করে গুছিয়ে নিল রানা। বিছানার পাশের দেয়ালে রয়েছে ছোট এক সিকিউরিটি সেফ। আসলে ওটার জন্যে আবারও ফিরতে হয়েছে ওকে। নইলে চলে যেত লণ্ডনে। সেফ খুলল রানা। নিচের তাকে আছে ম্যাগাযিন ভরা দুটো পিস্তল, দুটো বার্নার ফোন, বিশ হাজার ইউরো আর ম্যানিলা এনভেলপের ভেতরে তিনটে নকল পাসপোর্ট।
বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর স্পেশাল ইফেক্ট ডিভিশনের সহকারী শাহিন মাদবরের তৈরি পাসপোর্ট তিনটে এনভেলপ থেকে ঝেড়ে বিছানায় ফেলল রানা। প্রথম পাসপোর্টে ওর নাম গুন্থার ফিসবউম। দ্বিতীয়টাতে ডেভ ক্রোকেট। তৃতীয়টায় ও জ্যাকো জেনিংস। পাসপোর্ট তিনটে বহুবার ব্যবহৃত। ভিসার স্ট্যাম্প দেখলে যে-কেউ বুঝবে, দুনিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়ায় এই লোক। জ্যাকো জেনিংসের পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। অন্যদুটো সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। নিজের পাসপোর্ট আর জেনিংসেরটা বালিশের পাশে ফেলে অন্যদুটো ব্যাগে পুরল রানা।
মোবাইল ফোন ট্রেস করা হচ্ছে, তাই ওটা আর কোন কাজে লাগবে না। প্রিয় বন্ধু সোহেলকে জানিয়ে দিতে হবে এরপর থেকে কোন্ মোবাইল ফোনে ওকে পাবেন বিসিআই চিফ। বাতিল দুটো পাসপোর্টের পাশে মোবাইল ফোন রেখে দিল রানা। সেফ থেকে নিল বার্নার ফোন দুটো। নগদ টাকায় ভিন্ন নামে কেনা হয়েছে ওগুলো। খুঁজলেও মালিকের হদিস পাবে না কেউ। এই দুই মোবাইল ফোনের নম্বর জানে শুধু ওর বন্ধু সোহেল, জনি ওয়াকার ও ছোট ভাই রামিন রেজা। তবে বোমা মারলেও ওদের পেট থেকে কিছু বেরোবে না।
এবার আগ্নেয়াস্ত্রের দিকে মন দিল রানা। প্রথমটা নাইন এমএম পিএক্স৪ স্টর্ম কমপ্যাক্ট ক্যারি। ওটার জন্যে দু’বাক্স বুলেট নিল রানা। অন্যটা ওর প্রিয় .৩৮ ওয়ালথার পিপি। লক্ষ্যভেদ করে নিখুঁতভাবে। পিস্তলদুটো হাতে নিয়ে দ্বিধায় পড়ল রানা। সমস্যা হচ্ছে বেসামরিক বিমানে করে পিস্তলসহ সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া। একবার গন্তব্যে পৌঁছে গেলে অবশ্য সংগ্রহ করে নিতে পারবে অস্ত্র। যদিও সেই পিস্তল হয়তো পছন্দমত হবে না। দক্ষ যোদ্ধা উইলবার ফক্স। খালি হাতে তাকে খুঁজতে যাওয়া হবে চরম বোকামি।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে রানা স্থির করল, লণ্ডনে যাবে গাড়ি চালিয়ে। গাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে রাখবে পিস্তলদুটো। সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ায় অস্ত্রদুটো এবং তিনটে করে ম্যাগাযিন প্যান্টের পকেটে পুরল রানা।
এবার অর্থনৈতিক বিষয়। উইলবার ফক্সকে খুঁজতে গিয়ে ‘কত টাকা খরচ হবে তা জানা নেই। ব্যাগে তেরো হাজার ইউরো রাখল রানা। অন্য সাত হাজার ইউরো গেল ওর ওয়ালেটে। ব্যাঙ্ক নোট রাখতে গিয়ে ওয়ালেট থেকে বিছানায় পড়ল ভাঁজ করা এক ছবি। ওটা তুলে দেখল রানা। জানুয়ারি মাসের রোদেলা এক দিন। জেসিকা আর ওর পেছনে তুষারে ছাওয়া পাহাড়। পাশেই লক আরডাইক। সেলফি তুলেছিল জেসিকা। রানা নরম্যাণ্ডিতে ফিরলে ই-মেইল করে পাঠিয়ে দিয়েছিল ছবিটা। অফিসের প্রিন্টার ব্যবহার করে ৪x৬ সাইযের প্রিন্ট বের করেছে রানা। তারপর থেকে ওটা ছিল ওর ওয়ালেটে।
হাস্যরতা জেসিকার মিষ্টি মুখটা দেখে কেন যেন হাহাকারে ভরে গেল রানার বুক। হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে বুঝে গেল, বিপজ্জনক জীবনে মেয়েটাকে জড়িয়ে নিয়ে মস্ত ভুল করেছে ও। সেজন্যে হয়তো যে-কোন সময়ে খুন হবে বেচারি। ওর মত বিপজ্জনক কাউকে ভালবাসে বলেই হয়তো বাঁচবে না জেসিকা
দেয়াল-আয়নায় নিজের তিক্ত চেহারা কয়েক মুহূর্ত দেখল রানা। নিজের প্রতি জন্মে গেল একরাশ ঘৃণা। কোমর ঘুরিয়ে ডানহাতে প্রচণ্ড ঘুষি বসিয়ে দিল আয়নার বুকে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচ। ওর হাত ফস্কে মেঝেতে পড়েছে ছবিটা। মুঠোর দিকে তাকাল রানা। দরদর করে ঝরছে রক্ত।
খবরদার, রাগ নিয়ন্ত্রণ করো, নিজেকে ধমক দিল রানা। জেসিকাকে বাঁচাতে হলে ঠাণ্ডা রাখতে হবে মাথা!
বিশ্রীভাবে কেটে গেছে মুঠোর ত্বক। জ্বলছে, সেই সঙ্গে ব্যথা। বিছানার চাদরে হাতের রক্ত মুছে জ্যাকেট পরে নিল রানা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট ছেড়ে।
যত দ্রুত সম্ভব আবারও ওকে ফিরতে হবে লণ্ডনে।