ছেচল্লিশ
পরের রাত, মার্চের ঊনত্রিশ তারিখ।
সারে কাউন্টির নির্জন এক এলাকায় শার্লন হল।
বসন্ত-বিষুবের রাতের চেয়ে আজকের পরিবেশ থমথমে। কোথাও নেই একফোঁটা বাতাস। শার্লন হলের বিশাল ওক ও সিকেমোর গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। পূর্ণিমার মায়াবী চাঁদের বদলে আকাশে আধখাওয়া চাঁদ। সাদারঙের প্রকাণ্ড বাড়ি, সবুজ ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ লন ও গভীর লেকের টলটলে জলে পড়েছে আকাশ-প্রদীপের ম্লান আলো। শিকারের জন্যে চমৎকার এক রাত। বিশাল ওক গাছের মগডালে বসে শিকার ধরার জন্যে এদিকে-ওদিকে চোখ বোলাচ্ছে বড় দুটো পেঁচা। তাদের এলাকায় অন্য পেঁচা ঢুকলে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে মরণপণ লড়াই। অবশ্য আজ দুই পেঁচা ছাড়াও এই জঙ্গলে হাজির হয়েছে তাদের চেয়ে হাজার গুণ বিপজ্জনক ক’জন শিকারি।
এগারোটার পর শার্লন হলের চেকিং পয়েন্টে এল দামি সব গাড়ি। আমন্ত্রণপত্র দেখে নিয়ে ড্রাইভারদেরকে হাতের ইশারায় এগোতে বলল সিকিউরিটির লোকেরা। প্রাসাদের সামনে পৌঁছে আরোহীদের জন্যে গাড়ির পেছন-দরজা খুলে দিল ড্রাইভারেরা। নামকরা মানুষগুলো বিশেষ একটি দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেলে পার্কিংলটে গাড়ি রাখল তারা। নিজেরা গিয়ে ঢুকল দূরের লজ হাউসে। ওটা সাউণ্ডপ্রুফ করা, চারপাশে সার্ভেইলেন্স ক্যামেরা। রাতের অনুষ্ঠানের কিছুই জানবে না ড্রাইভার বা বডিগার্ডেরা। তাদের ধারণা: বিশাল সেই বাড়িতে গোপনে চরম অন্যায় করেন তাদের বসেরা। কর্মচারীরা পরস্পরকে চোখ টিপে হাসাহাসি করলেও কারও সাহস নেই যে অতি কৌতূহলী হবে। বাড়তি সময়টা সার্ভিস দেয়ার জন্যে তাদেরকে দেয়া হয় তিনগুণ টাকা। তা ছাড়া, লজ হাউসে রয়েছে বিশাল পর্দার কিছু টিভি। ওগুলোতে দেখা যায় দুনিয়ার যে-কোন সিনেমা, খেলা বা অনুষ্ঠান। সময় কাটাতে আছে পিনবল মেশিন, পুল টেবিল ও কমপিউটার গেম্স্।
এদিকে প্রাসাদের লবি পেরিয়ে মেম্বার্স লাউঞ্জে জড় হচ্ছে দ্য হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা। তাদের জন্যে বার-এ রয়েছে বিনা পয়সায় দামি শ্যাম্পেইন, ওয়াইন, জিন অ্যাণ্ড টনিক ও ভিন্টেজ উইস্কির আপ্যায়নের ব্যবস্থা। সদস্যরা ভালভাবেই চেনে পরস্পরকে। প্রত্যেকে এ দেশের সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী। রাজনৈতিক নেতা, হাই-কোর্টের বিচারক, নামি উকিল, সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট, ইণ্ডাস্ট্রি টাইকুন, করপোরেট বস, মিডিয়া মোগল থেকে শুরু করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি স্তরে যারা ভূমিকা রাখছে, শুধু তারাই সুযোগ পেয়েছে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার। ব্রিটেনের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, এরা একে অপরের শত্রু, অথচ এখানে এলে বিলাসবহুল সোফায় বসে ড্রিঙ্কের গ্লাস হাতে আপন ভাইয়ের মত হালকা মেজাজে গল্প করে তারা। জানে, এখানে সবাই তারা নিরাপদ। তাদের উদ্দেশ্য এক, কোথাও কোন বিভেদ নেই। হলরুমে এসে সবাই অপেক্ষা করছে, একটু পর শুরু হবে বিশেষ একটি অনুষ্ঠান। সেজন্যে উত্তেজিত হয়ে চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে তারা।
একটু পর রাত সাড়ে এগারোটায় চেক-পয়েন্টে পৌঁছে গেল তাদের শ্রদ্ধেয় গ্র্যাণ্ড মাস্টারের রোল্স রয়েস। ওটাকে এগিয়ে যেতে দিল সিকিউরিটি গার্ডেরা। নির্ধারিত সময়ে প্রতাপশালী সম্রাটের মত মেম্বার্স লাউঞ্জে পা রাখল ইমোজেন ব্যালার্ড। প্রশংসা করে কিছু না কিছু বলছে সবাই, তাই হলরুমে উঠল মৃদু গুঞ্জন। বহু বছর ধরে এই ক্লাবের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বৃদ্ধ গ্র্যাণ্ড মাস্টার। এখানে- ওখানে থেমে এর-ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিখাদ সোনার রাজসিংহাসনে গিয়ে বসল সে। বারটেণ্ডার তার হাতে তুলে দিল আর্মাও দে ব্রিগন্যাক ম্যাথিউসেলাহ্ শ্যাম্পেইনের সরু গ্লাস। এই মদের প্রতিটি বোতলের দাম বর্তমান বাজারে সাত হাজার পাউণ্ড। ওটা ছাড়া অন্য শ্যাম্পেইন মুখে তোলে না ক্লাব প্রেসিডেন্ট। সেটাও পান করে অতি সামান্য, কারণ ক্রমেই দুর্বল হয়ে গেছে তার যকৃৎ। খুবই দুঃখের কথা, নিজের প্রধান স্যাঙাতের এভাবে বুড়িয়ে যাওয়ার সমস্যাটা কোনভাবেই রোধ করতে পারেনি প্রভু শয়তান!
বরাবরের মতই ইমোজেন ব্যালার্ডের সঙ্গে শার্লন হলে এসেছে তার বিশ্বস্ত লেফটেন্যান্ট। তাকে নানান নামে চেনে অনেকে। তবে বেশিরভাগ সময় নিজের পরিচয় দেয় অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল বা অ্যালান শ’ হিসেবে। শখ করে তার দাদা নাম রেখেছিল রিপার ক্যাসিডি। সে বড় হওয়ার পর, খুব কম মানুষের সঙ্গেই আন্তরিকতা গড়ে উঠেছে তার। সবাই জানে, বহু বছর ধরে গ্র্যাণ্ড মাস্টারের ব্যক্তিগত সহকারি হিসেবে কাজ করছে সে। কারও কারও জানা আছে, আগে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসে স্পাই হিসেবে কাজ করত ক্যাসিডি। সরকারি দলের হয়ে একাধিক গোপন মিশনে খুন করেছে বিরোধী মতের ক’জন নেতাকে। যদিও দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আইরিশ মিলিশিয়া আইআরএ-র ওপরে। অশুভ ধর্ম থঅথের প্রধান যাজক ইমোজেন ব্যালার্ডের আদেশে সরকারি চাকরি ছেড়ে তার কাজে যোগ দেয় রিপার ক্যাসিডি। ক্লাবের প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি হিসেবে তার ক্ষমতা প্রচণ্ড। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর লোক বলে তাকে ভয় পায় না ক্লাবের সদস্যরা, এমন কেউ নেই।
গ্র্যাণ্ড মাস্টারের সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে হলরুমে চোখ বোলাচ্ছে রিপার ক্যাসিডি। কিছুদিন আগে ক্লাবে নতুন সদস্য গ্রহণের দায়িত্ব তাকে দিয়েছে ইমোজেন ব্যালার্ড। বর্তমান সদস্যদের হাঁড়ির খবরও ভাল করে জেনে নিয়েছে সে। গর্বের সঙ্গে বলতে পারবে, এরা নিজেদেরকে যতটা জানে, তার চেয়ে বেশি তাদেরকে চেনে সে। অবশ্য স্টিভ হ্যারিস কাণ্ডে এতদিনের আত্মবিশ্বাসে বড় চিড় ধরেছে ক্যাসিডির। এই ঘরেই প্রথমবার বুঝেছিল, কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটেছে লোকটার। তখন থেকেই তার ওপরে চোখ রেখেছিল ক্যাসিডি। অতিরিক্ত মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে হ্যারিস। রেগে গিয়ে ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। নিজের ভেতরে ছিল না সে। মাঝে মাঝে ভাইদের প্রতি প্রকাশ করত তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা। ক্যাসিডি ভেবেছিল, হয়তো রাজনৈতিক ব্যর্থতার জন্যে তিক্ত হয়ে গেছে লোকটার মন। কিন্তু পরে মনে হলো, কোন না কোন কারণে হ্যারিসের মধ্যে শুরু হয়েছে বিবেকের দংশন।
কিন্তু সেটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার!
ক্যাসিডি ভাবতে লাগল: তবে কি হ্যারিসের মনে আর বিশ্বাস নেই ভ্রাতসঙ্ঘের প্রতি? তখনও তাকে সাবধান করেনি ক্যাসিডি। বলেনি: ক্লাবের আইন ভাঙলে ভয়ঙ্করভাবে খুন হবে সে।
সতর্ক হয়ে গেল ক্যাসিডি। এর কয়েক দিনের ভেতরে নিজের লোক মারফত জানল- গোপনে ক্লাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর এক বই লিখছে হ্যারিস। নিজেকে খুব চালাক ভাবত সে। বিচ্ছিন্ন করেছিল বাড়ির ল্যাণ্ড ফোনের লাইন ও ইন্টারনেট। কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে ব্যবহার করত বার্নার ফোন। তবে ভাবতেও পারেনি, তার বাড়ি ও গাড়িতে ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা রেখে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি কথা শুনত ক্যাসিডি। হ্যারিস লণ্ডনের এক লিটারারি এজেন্সিতে বই প্রকাশের ব্যাপারে আলাপ করতেই ক্যাসিডি সিদ্ধান্ত নিল: এবার সময় হয়েছে লোকটার বাড়িতে আততায়ী পাঠিয়ে দেয়ার। স্থির করা ছিল হ্যারিস-হত্যার পর ওটাকে দেখানো হবে ডাকাতি হিসেবে। এবং এ-কাজে সেরা লোকটাকে পাঠিয়ে দেয় ক্যাসিডি। যদিও পরে জানা গেল, যাকে বিশ্বাস করে কাজ দিয়েছে, নিজেই সে চরম বেইমান!
এরপর কেউ যেন থঅথের ধর্ম ও হ্যাভোক ক্লাবের বিরুদ্ধে খারাপ কিছু করতে না পারে, তাই ভাইদের ওপরে নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে ক্যাসিডি। এ-মুহূর্তে এক এক করে প্রত্যেকের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সে। বিশ্লেষণ করছে তাদের দৈহিক ভাষা ও আচরণ। হ্যারিসকে খুন করার আগেই দ্য হ্যাভোক ক্লাবের সবাইকে সন্দেহের আওতায় এনেছে সে। অবশ্য কারও মধ্যে অস্বাভাবিক কোন আচরণ ধরা পড়েনি। সামনের অনুষ্ঠানের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা। প্রথম অনুষ্ঠানে যে পূজা হবে, সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে ফুর্তিতে আছে সবাই। এমনই হওয়ার কথা, আনমনে হাসল ক্যাসিডি। তারা দেখবে সুন্দরী এক মেয়ের বুকের তাজা রক্ত ছিটকে পড়ছে অপদেবতার পায়ে। এরচেয়ে উত্তেজনাময় দৃশ্য কমই আছে পৃথিবীতে। আর এরপর ক্লাবের বিশেষ সভ্যদের জন্যে রয়েছে গ্র্যাণ্ড মাস্টারের সেরা চমক। কেউ ওই পূজা দেখলে কখনও ভুলবে না। লেকের তীরে যেটা হবে, ওটা স্রেফ প্রাথমিক সদস্যদের জন্যে। যুবতী মেয়ের রক্ত ঝরার পর ক্লাবের ইনার কমিটির সদস্যরা হাজির হবে বাড়ির নিচের সমাধিতে। তখনই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। বহুবার ওটা দেখার পরেও বারবার উত্তেজিত বোধ করে ক্যাসিডি। যদিও গভীর রাতে দারুণ মজা হবে জেনেও এ-মুহূর্তে ফুর্তি লাগছে না তার। কেন যেন কু ডাকছে মন। গত ক’দিনে বিমর্ষ হয়ে গেছে সে। প্রথমে স্পেনের সেই লাশের ডিএনএ টেস্ট করে জানা গেল, সে আসলে উইলবার ফক্স নয়। মনে যে আশঙ্কা ছিল, সেটাই সত্যি হলো। ভ্লাদিমির যে দাঁতের পাটি আনল লণ্ডনে, পরীক্ষা করে দেখা গেল সত্যিই ওটা ফক্সের। তখন মেনে নিতে হলো, ফক্সকে খুন না করে তার সঙ্গে জোট বেঁধেছে মাসুদ রানা। ক্যাসিডি ভেবেছিল জালে ভালভাবেই আটকে নিয়েছে বাঙালি যুবককে। কিন্তু পরে বুঝল, ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে বাদামি কুকুরটা।
এরপর এল আরও দুঃসংবাদ।
স্কটল্যাণ্ডে খুনি দলের সবাইকে বোকা বানিয়ে কারা যেন নিয়ে গেল জেসিকা থমসনকে। স্বয়ং শয়তান বলতে পারবেন এমন কাণ্ড কীভাবে ঘটল। ক্যাসিডি ধরে নিত, মেয়েটাকে সরিয়ে নিয়েছে রানা ও ফক্স। কিন্তু প্রায় একইসময়ে হ্যারিস মারা যাওয়ার পর ভিডিয়োতে দেখা গেল সেই বাড়িতে গেছে তারা। জায়গাটা স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ড থেকে বহুদূরে। এতে ক্যাসিডি বুঝে গেল, জেসিকাকে সাহায্য করেছে রানার এক বা একাধিক বন্ধু। এটা মেনে নিতে হলো, যে-কোন সময়ে এবার ক্লাবের সদস্যদের ওপরে প্রতিশোধ নিতে শার্লন হলে হাজির হবে এসএএস ফোর্স থেকে প্রশিক্ষিত রানা ও ফক্স।
জানা গেল রানার হাতে আছে হ্যারিসের ল্যাপটপ। ওটায় আছে বেইমানটার লেখা বইয়ের পাণ্ডুলিপি। হারামজাদা বোধহয় বুদ্ধি করে এনক্রিপ করেছিল ফাইল। সেক্ষেত্রে ওটা পড়তে পারবে না রানা। হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের সমাজে ছড়াতে পারবে না কুৎসা। আরও কিছু বিষয় অজানা, তাই দুশ্চিন্তায় আছে ক্যাসিডি। কারা যেন গোপনে কাজ করছে রানা ও ফক্সের পক্ষে। রানা যেহেতু একইসঙ্গে দুই জায়গায় থাকতে পারবে না, তাই বোধহয় বন্ধুদের সহায়তা চেয়েছে. সে। ফ্রান্সে যারা রানা এজেন্সিতে কাজ করে, তারাই হয়তো সরিয়ে নিয়েছে জেসিকাকে। ফ্রান্সেও চোখ রেখেছে ক্যাসিডির লোক। কিন্তু তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, ওই দেশ থেকে ব্রিটেনে পা রাখেনি রানা এজেন্সির কেউ।
নাকি বড় কোন ভুল হচ্ছে তার?
প্রশ্নগুলোর কোন জবাব নেই বলে চরম দুশ্চিন্তা বোধ করছে ক্যাসিডি। বুঝে গেছে, যে-কোন সময়ে মাসুদ রানার তরফ থেকে আসবে হামলা। অর্থাৎ, দ্য হ্যাভোক ক্লাবের কেউ এখন আর নিরাপদ নয়।
‘মরুক ওর বোন,’ তিক্ত মনে ভাবল ক্যাসিডি। ‘প্রথমেই উচিত ছিল কুত্তীটাকে মুঠোর ভেতরে নেয়া।’ এখন বারবার তার মনে হচ্ছে, রানার কথা শুনে বোধহয় গা ঢাকা দিয়েছে মেয়েটা। নিজের তৈরি নিখুঁত বাড়ি ধসে গেলে যেমন লাগে প্রকৌশলীর, সেভাবে বিমর্ষ বোধ করছে ক্যাসিডি।
মনের ভেতরে এসব ঘুরছে বলে গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে অনুরোধ করেছিল, বাতিল করা হোক ক্লাবের এবারের অনুষ্ঠান। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি বুড়ো। মাথা নেড়ে বলেছে, ‘অনুষ্ঠানে সম্মান দেখানো হবে বিশেষ এক সদস্যকে। থঅথ যদি জানেন মাত্র দু’জন লোকের ভয়ে কাপুরুষের মত আমরা আত্মগোপন করেছি, তা হলে কী মনে করবেন তিনি?’
বুড়োর আপত্তির কারণটা ভাল করেই জানে ক্যাসিডি 1 বেশি দিন বাঁচবে না সে। এটাই হয়তো শেষ বছর, যখন বার্ষিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে। ক্যাসিডির মনের খবর ভাল করেই জানে সে। সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে ঘরে চোখ বোলাচ্ছে ক্যাসিডি। তার বাহুতে হাত রেখে মৃদু হাসল গ্র্যাণ্ড মাস্টার। ঠোঁট ফাঁক হতেই বেরিয়ে এল সাপের বিষদাঁতের মত চোখা, ছোট একরাশ ধূসর দাঁত। খসখসে গলায় বলল বুড়ো, ‘ভয় পেয়ো না। আমরা জিতব, কারও সাধ্য নেই যে আমাদের গায়ে টোকা দেবে।’
কথাগুলো বলা হয়েছে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে। কয়েক ঘণ্টা আগে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও ক’জন সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়েছে ক্যাসিডি। এ- ছাড়া, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ভিআইপিদের জন্যে এনেছে বারোজনের পেশাদার সশস্ত্র ক্র্যাক টিম। আগে তারা ছিল সিআইডি ও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অপারেটিভ। সবাই থঅথ ধর্মে দীক্ষিত। এখন হ্যাভোক ক্লাবের ছোট কিছু পদে চাকরি করছে। প্রাণ থাকতে, দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে না কেউ।
জেসিকাকে কিডন্যাপ করতে স্কটল্যাণ্ডে গিয়েছিল পেশাদার কয়েকজন খুনি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে তারা শার্লন হলে। তাদেরকেও লাগিয়ে দেয়া হয়েছে সিকিউরিটির কাজে। বিপদ এলে তারা সরিয়ে নেবে গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে। এ দলের প্রধান হচ্ছে ক্যাসিডির ঘনিষ্ঠ সহচর ব্রায়ান্ট হার্ডস্টাফ। হলরুমের সদর দরজার কাছে তাকে দেখে হাতের ইশারায় ডাকল ক্যাসিডি। ষাঁড়ের মত মুগ্ধো লোকটা হাজির হতেই ভিড় এড়িয়ে তাকে নিয়ে ঘরের দূরের কোণে গেল সে। জানতে চাইল, ‘সব ঠিক আছে তো?’
‘সেক্টর সিক্সে ঝামেলা করছে ক্যামেরা। সব চেক করতে আমার দু’জনকে পাঠানোর পর ওরা রিপোর্ট দিয়েছে। ওটা বড় কোন সমস্যা নয়।’
শার্লন হলের একটু দূরের জঙ্গল ছয় নম্বর সেক্টর। ‘ক্যামেরাগুলো মেরামত করতে বলো,’ বলল ক্যাসিডি।
‘বেশ, বলছি। এদিকে শার্লন হলে চলে এসেছেন সম্মানিত সদস্যরা। আপনারা এবার অনুষ্ঠান শুরু করতে পারেন।’
‘সদস্য তালিকা আমার কাছে দাও,’ বলল ক্যাসিডি।
পকেট থেকে নিয়ে তার হাতে ছোট ট্যাবলেট ডিভাইস দিল হার্ডস্টাফ। সদস্যরা চেক-পয়েন্ট পেরিয়ে গেলে প্রত্যেকের জন্যে লেখা সংখ্যা কমপিউটারে তুলেছে সিকিউরিটি গার্ডেরা। কেউ না এলে সহজেই সেটা বোঝা যেত। দেখা গেল, অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি স্টিভ হ্যারিস। এ- ছাড়া, ঠিক সময়ে পৌছে গেছে সবাই। বিপদ হবে ভেবে সবধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে ক্যাসিডি। তালিকা দেখে মুখস্থ করেছে চুয়ান্নজন সদস্য ও তাদের অতিথিদের নাম। যেমন: তার মনে আছে এস. এইচ. এম. ৩৭২৭৩ হচ্ছেন পররাষ্ট্র অফিসের প্রধান স্যর হ্যারি মর্গ্যান। সি. এ. এইচ. ৪৭৩১৮ হচ্ছেন কমাণ্ডার অ্যারন হিউবার্ট। তিনি ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের অ্যান্টি-টেরর টাস্ক ফোর্সের চিফ। সি. জি. ৯০৯৫১ হচ্ছেন এমপি ক্রিস্টোফার গান। শেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি।
…কিন্তু এক মিনিট!
আবারও হলরুমে চোখ বোলাল ক্যাসিডি। একটু পর কুঁচকে গেল তার দুই ভুরু। নতুন করে চেক করল তালিকা।
‘এই তালিকা ঠিক আছে তো?’ হার্ডস্টাফকে বলল সে।
‘আমি নিজে দেখেছি। কোথাও কোন ত্রুটি পাইনি।’
‘রেকর্ড অনুযায়ী রাত এগারোটা চার মিনিটে চেক-পয়েন্ট পেরিয়ে গেছেন সি. জি. ৯০৯৫১। হাজির হয়েছেন ঊনত্রিশ মিনিট আগে।’
তালিকায় চোখ বোলাল হার্ডস্টাফ। ‘তাই তো দেখছি। কিন্তু তাতে সমস্যা কোথায়?’
‘সি. জি. ৯০৯৫১ মানেই এমপি গান। এসেছেন প্রায় আধঘণ্টা আগে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তিনি কোথায়?’ তাকে ভাল করেই চেনে ক্যাসিডি। সবসময় সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে ভালবাসে সে। এই বাড়িতে এলে জটলা করে তাকে ঘিরে রাখত সবাই। সবার মুখে থাকত তার প্রশংসা।
হলরুমে চোখ বুলিয়ে ক্যাসিডির মতই ভুরু কুঁচকাল হার্ডস্টাফ। ‘ঠিকই বলেছেন। আমি তো তাঁকে দেখছি না!’
‘তোমার লোকদের বলো বাথরুম চেক করতে, বলল ক্যাসিডি। ‘হয়তো অসুস্থ বোধ করছেন তিনি।’
শার্টের কলারের ভেতরে রাখা তারের শেষমাথায় ছোট্ট রেডিয়োতে দলের উদ্দেশে বলল হার্ডস্টাফ, ‘এক্ষুণি বাথরুম চেক করো। ওখানে কাউকে না পেলে আমাকে জানাবে।’
এদিকে হলরুমে ক্রিস্টোফার গানকে কেউ দেখেছে কি না, সেটা জিজ্ঞেস করছে রিপার ক্যাসিডি। কিন্তু কেউ দেখেনি বিখ্যাত এমপিকে।
হলরুম ত্যাগ করল ক্যাসিডি। করিডরে এসে ফোন বের করে ডায়াল করল গোপন নম্বরে। ভ্রাতৃসঙ্ঘের প্রত্যেককে বলা আছে, বিশেষ একটি মোবাইল ফোন যেন তারা সর্বক্ষণ সঙ্গে রাখে। এটা কঠোর আইন। এতে ভুল হলে চলবে না। যখন-তখন ক্লাব সদস্যকে যেন ফোনে পান গ্র্যাণ্ড মাস্টার। আইনটা ভাঙলে ধরে নেয়া হবে, জেনেবুঝে তাঁর প্রতি চরম বেয়াড়াপনা করা হয়েছে।
ক্রিস্টোফার গানের কাছে ফোন দেয়া হলেও সেটা রিসিভ করল না কেউ। অত্যন্ত বিশ্বস্ত সদস্য সে। থঅথ ধর্মের সত্যিকারের অনুগত ভক্ত, নইলে নিজের মেয়েকে অপদেবতার কাছে বিসর্জন দিত না। তার মত ভাল ক্লাব-সদস্য ফোনে সাড়া দিচ্ছে না মানেই বড় ধরনের কোন গোলমাল আছে।
কয়েকবার বেজে ফোন কেটে যেতেই গলা শুকিয়ে গেল ক্যাসিডির। এদিকে তার পাশে পৌঁছে গেছে হার্ডস্টাফ। ‘তাঁর রোল্স রয়েস পাওয়া গেছে কার পার্কিঙে। তবে বাথরুম বা অন্য কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
‘সবসময় দু’জন বডিগার্ড সঙ্গে রাখেন,’ বলল ক্যাসিডি। ‘লজ হাউসে খোঁজ নাও। তারা হয়তো কিছু বলতে পারবে।’
মৃদু মাথা দোলাল হার্ডস্টাফ। ‘এখনই দেখছি।’
অধৈর্য হয়ে করিডরে পায়চারি করতে লাগল ক্যাসিডি লজ হাউসের সিকিউরিটি চিফের সঙ্গে কথা বলল হার্ডস্টাফ। ‘আরে না, আমি কি ওই শালাদের নাম জানি নাকি? ওদের যে-কোন একজনকে ফোনে দাও। এটা খুব জরুরি।’
অপেক্ষা করল ক্যাসিডি ও হার্ডস্টাফ। কয়েক মিনিট পর লাইনে এল সিকিউরিটি চিফ। তার কথা শুনে ধমকে উঠল হার্ডস্টাফ, ‘আরে, গাধা, ওরা তোমার ওখানে নেই বললেই হলো? নিশ্চয়ই আছে! ওদের মালিকের গাড়ি তো পার্কিং লটে!’
‘কী বলছে ও?’ জানতে চাইল ক্যাসিডি।
ফোন কেটে বলল হার্ডস্টাফ, ‘ওদেরকে দেখেনি কেউ। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না! ক্রিস্টোফার গান, তাঁর দুই বডিগার্ড আর ড্রাইভার এখানে না এসে থাকলে, কে এল ওই রোল্স রয়েসে চেপে?’
হার্ডস্টাফকে কড়া চোখে দেখল ক্যাসিডি। বুঝে গেছে, খুব খারাপ কিছু না হলে বিকল হতো না জঙ্গলের ক্যামেরা! তার মনে হলো, বড় ধরনের বিপদে পড়েছে তারা। যে-কোন সময়ে হামলা হবে হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যদের ওপরে। চাপা স্বরে বলল ক্যাসিডি, ‘হার্ডস্টাফ, শুরু হয়ে গেছে ওদের আক্রমণ!’