ছাব্বিশ
স্পেনের আলদারিসিন গ্রাম।
পাহাড়ি ঢালে ধীরে ধীরে নেমে আসছে লাল রঙের বেল জেট রেঞ্জার হেলিকপ্টার। একটু দূরেই পোড়া গাড়ি থেকে এখনও উঠছে মৃদু ধূসর ধোঁয়া। আগুনের হলকায় ছাই হয়ে গেছে আশপাশের ঝোপ। রোটরের জোরালো হাওয়ার দাবড়ি খেয়ে কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ল পুলিশের কর্ডন টেপসহ প্লাস্টিকের কয়েকটা খুঁটি। হলদে টেপ যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করা কোমর ভাঙা কোন ঢোঁড়া সাপ। রুক্ষ পাথুরে জমিতে হেলিকপ্টার নেমে আসতেই ওটার ভারী ওজন নিল দুই স্কিড। ককপিটের দরজা খুলে মাটিতে নেমে এল এক লোক। যান্ত্রিক ঘাসফড়িঙের ভেতরে রয়ে গেছে তার সহকারী ও পাইলট।
এখন বাজে সকাল সোয়া ‘আটটা। অথচ এরইমধ্যে মাথার ওপরে গনগনে আগুন ঢেলে চলেছে সোনালি সূর্য। যে-লোক হেলিকপ্টার থেকে নেমেছে, তার নাম ভ্লাদিমির ভোয়েভোদিন। গতরাতে বসের ফোন পাওয়ার পর দেরি করেনি রওনা হতে। প্রাইভেট এক জেট বিমান লণ্ডন থেকে তার সহকারী ও তাকে এনে নামিয়ে দিয়েছে য্যারাগোজায়। ওখানে অপেক্ষায় ছিল হেলিকপ্টারসহ দক্ষ পাইলট।
ঘুরন্ত রোটরের তলা দিয়ে এগোল ভ্লাদিমির। আগে রাশান মিলিটারির ফরেনসিক ফায়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিল সে। ফায়ার ব্রিগেড বহুক্ষণ আগে আগুন নিভিয়ে গেলেও প্রাচীন ভ্যানের কঙ্কাল থেকে এখনও বেরোচ্ছে হালকা ভাপ। গাড়ির ভেতর থেকে পোড়া লাশ সংগ্রহ করে মর্গে নিয়ে গেছে পুলিশের লোক। ভোরে খবর পেয়ে য্যারাগোজার মর্গে লাশ দেখতে গেছে ভ্লাদিমির। উঁচু পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মর্গের পরিচালকের তরফ থেকে কোন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে।
বরফ-ঠাণ্ডা ড্রয়ার টেনে লাশ বের করেছে মর্গের সহকারী। সে চাদর সরিয়ে দিতেই পরীক্ষা করেছে ভ্লাদিমির। বেশিরভাগ মানুষ পোড়া মৃতদেহের ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখলে বমি করবে,
কিন্তু সামান্যতম ভ্রুকুটি করেনি সে। মর্গ সহকারীকে বিদায় করে দিয়ে স্মার্টফোনে তুলেছে কিছু ফোটো। উলঙ্গ লাশের গায়ে কোন রোম নেই। পরনে আছে শুধু মচমচে ভাজা চামড়ার বুট ও বেল্ট। লাশ যে পুরুষমানুষের তা বোঝা গেছে যৌনাঙ্গ দেখে।
এখনও রিপোর্ট তৈরি করেননি স্থানীয় করোনার। অবশ্য ওটা না পেলেও চলবে ভ্লাদিমিরের। ভাল করেই বুঝে গেছে ট্রেতে শুয়ে থাকা লাশ মারা গেছে একাধিক গুলির আঘাতে। অন্তত দুটো বুলেট ফুটো করেছে তার বুক। কর্তৃপক্ষ রিপোর্টে বোধহয় উল্লেখ করবে: একাধিক গুলির মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে ভিক্টিমকে।
আনমনে হেসেছে ভ্লাদিমির। স্প্যানিশ পুলিশ জানবে না, কেন খুন হয়েছে উইলবার ফক্স। বা কাজটা করেছে কে বা কারা। দু’হাতে রাবারের গ্লাভ্স্ পরে সাবধানে লাশের চোয়াল থেকে নকল দাঁতের পাটি নিয়েছে ভ্লাদিমির। ওগুলো সোনা ও টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি। এত আগুনেও অক্ষত। কিছু ছবি তুলে দাঁতের পাটি নিজের এভিডেন্স ব্যাগে রেখেছে সে। লাশের ঊরু থেকে স্ক্যালপেল দিয়ে কেটে নিয়েছে সামান্য আধপোড়া মাংস। লণ্ডনে নিয়ে ল্যাবোরেটরিতে পরীক্ষা করা হবে ডিএনএ। উঁচু মহলের ফোন পেয়েছে বলে এভিডেন্স সরিয়ে নেয়া হচ্ছে জেনেও টু শব্দ করবে না স্পেনীয় কর্তৃপক্ষ। কাজ শেষে মর্গ থেকে বেরিয়ে সহকারী ও পাইলটের কাছে ফিরেছে ভ্লাদিমির। পাইলটকে জানিয়ে দিয়েছে, এবার যেতে হবে সেই পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে খুন হয়েছে উইলবার ফক্স।
কয়েকবার পোড়া গাড়ি ঘুরে দেখে অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না ভ্লাদিমিরের। আগুন ধরেছে ফিউয়েল ট্যাঙ্কে। ভ্যানের সামনের কাঁচে বুলেটের ফুটো। লাশের বুকে বুলেটের একই আকারের দুটো গর্ত। পিস্তলের গুলি অন্তত .৩৮ ক্যালিবারের।
পিছিয়ে গিয়ে ডানের এক ঝোপের পাশে থামল ভ্লাদিমির। বুঝে নিল কতটা দূর থেকে এসেছে গুলি। ঝোপের পাশে পেল তামার চকচকে তিনটে শেল কেসিং। পেছনে খোদাই করা লেখা: .৩৮ ফেডারেল। একটা কেস শুঁকল সে। গুলি হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে। নিজের ব্যাগে প্রমাণ হিসেবে রেখে দিল গুলির তিনটে কেসিং।
ভ্যানের পাশে পৌঁছে খুলে নিল স্লাইডিং ডোর। পেছনের সিটে পেল গলে যাওয়া প্লাস্টিকের জেরি ক্যান। ওখান থেকে সরে ফিউয়েল ট্যাঙ্কের পাশে ঝুঁকে দেখল গাড়ির নিচে। ব্যাগ থেকে স্ক্যালপেল নিয়ে চেঁছে তুলল টাঙ্কির লালচে জং। এখন পর্যন্ত যা দেখেছে, তাতে সন্দেহ হওয়ার মত কিছু নেই।
আপাতত সন্তুষ্ট ভ্লাদিমির। হেলিকপ্টারের দিকে পা বাড়িয়ে পকেট থেকে বের করল স্মার্টফোন। ওর বস্ বলেছে, কাজ শেষ হলে দেরি না করে যেন ফোন দেয়।
ভ্লাদিমিরের কলের জন্যে অধীর অপেক্ষায় ছিল তার বস্। প্রথম ডায়ালেই ফোন ধরল সে। ‘কী বুঝলে?’
প্রাথমিক তদন্ত ভ্লাদিমিরের শেষ। নিচু গলায় বলল, ‘মিলে যাচ্ছে নকল দাঁতের পাটি। যদিও লণ্ডনে নিয়ে ল্যাবোরেটরিতে পরীক্ষা করাতে হবে। একই কথা লাশের টিস্যুর বিষয়ে। বুকে দুই বা তিনটে .৩৮ ক্যালিবারের বুলেটে মারা গেছে। দেখতে হবে বুলেট কেসিঙে কার আঙুলের ছাপ। ভাল হতো অস্ত্রটা হাতে পেলে।’
‘নিশ্চয় দেখবে রানারই আঙুলের ছাপ,’ বলল ভ্লাদিমিরের বস্। ‘ওগুলো অন্য কারও হওয়ার কথা নয়।’ ধৈর্য হারিয়ে এবার জানতে চাইল সে, ‘আরও পরীক্ষার আগে তোমার পেশাদারী মতামত জানাও।’
‘মাসুদ রানা কাজে ত্রুটি রাখেনি,’ বলল ভ্লাদিমির। ‘তবে একটা কথা।’
‘সেটা কী?’
‘খুব কাছ থেকে দেখেছি গাড়ির ফিউয়েল ট্যাঙ্ক। ওখানে ছোট একটা ফুটো আছে। চট্ করে কেউ বুঝবে না। হয়তো ট্যাঙ্ক থেকে বের করেছে অর্ধেক ফিউয়েল। ফুটো মেরামত না করা হলে গাড়ি দূরে যেত না। মনে হচ্ছে, দু’একদিনের ভেতরে স্টিলেটোর মত চোখা কিছু দিয়ে তৈরি করেছে ফুটো।’
‘কেন এটা করবে কেউ?’
‘হয়তো ক্যানে তেল ভরতে গিয়ে। গাড়ির সিটে ছিল পোড়া প্লাস্টিকের জেরি ক্যান। সেক্ষেত্রে ইঞ্জিন বন্ধ গাড়িতে আগুন দিয়েছে মাসুদ রানা। বুলেটের আঘাতে তৈরি হয়নি ‘বৈদ্যুতিক ফুলকি। লোকটাকে খুন করে তার গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে রানা।’
‘ওটা কেন করবে মাসুদ রানা?’
‘মৃতের পরিচয় গোপন করতে গিয়ে। বলছি না যে এমনই করেছে, তবে হতেও পারে।’
‘বুঝলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভ্লাদিমিরের বস্। ‘বেশিক্ষণ লাগবে না টিস্যু আর দাঁতের ডিএনএ-র রিপোর্ট পেয়ে যেতে।’
‘দাঁত কিছুই প্রমাণ করবে না,’ বলল ভ্লাদিমির। ‘বড়জোর বলা যাবে যে দু’পাটি দাঁত হাতে পেয়েছে মাসুদ রানা।’
‘কোথা থেকে ওগুলো পাবে সে?’
কাঁধ ঝাঁকাল ভ্লাদিমির। ‘হয়তো দিয়েছে কেউ। তার কাছে বাড়তি দাঁতের পাটি ছিল। এমনটা না-ও হতে পারে। যদিও ব্যাপারটা খুব সন্দেহজনক। আপনি তো ভাল করেই জানেন কার বিরুদ্ধে নেমেছি আমরা।’
কয়েক মুহূর্ত ভেবে তার বস্ বলল, ‘ঠিক আছে, গুড় ওঅর্ক, ভ্লাদিমির! স্যাম্পল নিয়ে লণ্ডনে ফেরো। টেস্ট করা হলেই সব বোঝা যাবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলে কল কেটে দিল ভ্লাদিমির।
.
লণ্ডনে নিজের অফিসে ফোন নামিয়ে রেখে সিটে হেলান দিল জড়লওয়ালা প্রৌঢ়। তাকে চেনে রানা . অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল নামে। কুঁচকে গেছে তার ভুরু। ভ্লাদিমিরের অনুমান সঠিক হলে সেটা বিপদের কথা। হয়তো রানার হাতে খুন হয়নি ফক্স। কাউকে গুম করে লাশটা গাড়িতে রেখেছে রানা। পরে আগুন দিয়েছে ভ্যানে। য্যারাগোজার মর্গে আছে অন্য কারও লাশ। সেক্ষেত্রে হয়তো ফক্সের সঙ্গে মিলে গোপনে কূটকৌশল করছে রানা। ভ্লাদিমির দাঁতের যে দুটো পার্টি নিয়ে ফিরছে, ওগুলো হয়তো রানা পেয়েছে ফক্সের কাছ থেকেই। ফক্স বেঁচে আছে, না মারা গেছে, সেটাও এখন অনিশ্চিত। খুব দ্রুত তাকে খুঁজে নিয়েছে রানা, এটা স্বাভাবিক নয়। ভাবতে গিয়ে প্রৌঢ়ের মনে হলো, হয়তো প্রথম থেকেই রানা জানত কোথায় আছে ফক্স। হয়তো যোগাযোগ ছিল দু’জনের। ফক্স জীবিত থাকলে রানা ও তার সামনে আছে দুটো পথ। এক: গাড়িতে অন্যের লাশ রেখে জেসিকাকে উদ্ধার করতে স্কটল্যাণ্ডে ফিরছে রানা। ওদিকে উধাও হয়েছে ফক্স। আর কখনোই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে। সভ্য সমাজ থেকে উধাও হওয়ার ট্রেইনিং আছে তার। অভাব নেই টাকারও। দুই: স্পেনে রানা হয়তো নিজের দলে টেনেছে ফক্সকে। সেক্ষেত্রে তারা হবে কঠিন প্রতিপক্ষ। যদিও এতজনের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না মাত্র দু’জন। জেসিকাকে ভালবেসে থাকলে রানা জানে, একটু এদিক- ওদিক হলে খুন হবে মেয়েটা। নাকি মানুষ হিসেবে তাকে ভুল চিনেছে সে? হয়তো বাঙালি যুবক ভয়ঙ্কর নির্মম ও নিষ্ঠুর!
অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে রানার। এ-মুহূর্তে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ভ্লাদিমির ফিরলে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বহুকিছু জানা যাবে। প্রথমবারের মত দ্বিধা এল প্রৌঢ়ের মনে। অবশ্য সেটা পাত্তা দিল না সে। ভাবল: উপায় নেই যে হামলা করবে মাসুদ রানা!
স্মার্টফোন দিয়ে সার্ভেইলেন্স টিমের সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ব্রায়ান্ট হার্ডস্টাফকে কল দিল সে। স্কটল্যাণ্ডে অপারেশনের সমস্ত দায়িত্ব তার। হার্ডস্টাফ ফোন ধরতেই বলল প্রৌঢ়, ‘ওদিকের খবর জানাও।’
‘সকালে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। এখন চলেছে অফিসে। আমরা তাকে চোখে চোখে রেখেছি।’
‘কাজে নামার সময় হয়েছে,’ বলল প্রৌঢ়। ‘প্রথম সুযোগে ওকে তুলে নেবে।’
এই নির্দেশ বিস্মিত করল না হার্ডস্টাফকে। ‘তুলে নিয়ে শেষ করে দেব?’
‘না, কোথাও আটকে রাখো। পরে জানাব কী করতে হবে।’
‘ঠিক আছে, যারা পিছু নিয়েছে, তাদের লিডারকে জানাচ্ছি।’
প্রৌঢ় জানে, জিম্মি করা হলে কিডন্যাপারদেরকে পরেও চিনবে মেয়েটা। হয়ে উঠবে একজন সাক্ষী। অবশ্য তাতে কোন সমস্যা নেই। তাকে বাঁচতে দেয়া হবে না। বাঁচবে না মাসুদ রানাও। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে একটা বিষয় ভালভাবেই বুঝে গেছে প্রৌঢ়— প্রয়োজনে যে-কাউকে খুন করা যায়। যদিও তার আগে বুঝে নিতে হয় নিজের ক্ষমতা আছে কি না। এবং এক্ষেত্রে কোনদিকেই কমতি নেই তার। বুকের শিরায় রণ- দামামা শুনল প্রৌঢ়। রানা ফাঁকি দেবে ভাবলে আবারও ভাবতে হবে ওকে।
‘অন্য যে বিষয় ঝুলে আছে, তার কী হবে?’ বলল হার্ডস্টাফ। ‘আপনি বললে সকাল সাড়ে এগারোটায় কাজে নামবে ওরা।’ বলছে সে স্টিভ হ্যারিসের সম্পর্কে। ফক্স হঠাৎ উধাও হওয়ায় খুন করা যায়নি লোকটাকে। ‘মনে হচ্ছে দেরি না করাই ভাল।’
‘ওদের জানিয়ে দাও, নির্বোধ এক গাধা বিদায় নিলে দুনিয়ার কোন ক্ষতি হবে না,’ বলল প্রৌঢ়।