1 of 2

কিলিং মিশন – ২০

বিশ

গঞ্জালেসের বগলে দু’হাত ভরে লাশটা নিয়ে পাথুরে ঢালু জমি বেয়ে নেমে চলেছে রানা। মৃতদেহের দুই গোড়ালি তুলে ধরেছে ফক্স, ওর কাঁধে ঝুলছে হোল্ডঅল। একটু পর চাঁদের আলোয় ওরা দেখল, আগের জায়গায় রয়ে গেছে মাযদা ভ্যান।

‘ওটার ভেতরে লাশ রাখবেন, নাকি বাইরে?’ গাড়ির পাশে পৌছে জানতে চাইল ফক্স।

‘বসিয়ে দেব স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে ড্রাইভিং সিটে,’ বলল রানা। ‘যাতে মনে হয় পালিয়ে যাচ্ছিলে, আর সেই সময়ে তোমাকে গুলি করে মেরেছি।’

‘বাহ্! তা হলে এভাবেই আমি খুন হলাম!’

ড্রাইভারের দরজা খুলে কাত করে গঞ্জালেসের অর্ধেক দেহ ভেতরে গুঁজল ওরা। গাড়িটার নাক ঘুরে প্যাসেঞ্জার সিটে গিয়ে উঠল রানা। ভেতরে টেনে নিল লাশটাকে। সোজা করে বসিয়ে দিল সিটে। গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল ভ্যানের পেছনে। চাকার ছয় ইঞ্চি ওপরে ফিউয়েল ফিলার ক্যাপ। ওটা মুচড়ে খুলে গর্তের কাছে নাক নিল রানা। পুরনো ভ্যানের ইঞ্জিন চলে ডিযেলের বদলে পেট্রলে। সহজ হয়েছে ওর কাজ। ডিযেলের চেয়ে বহুগুণ বেশি দাহ্য তরল পেট্রল।

ভ্যানের বনেটের পনেরো গজ সামনে গিয়ে থামল রানা। ঘুরে পিস্তল তাক করল উইণ্ডশিল্ডের দিকে। ভ্যান থেকে কয়েক গজ দূরে সরে গেছে ফক্স। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে বীভৎস চেহারার লাশ। উইণ্ডশিল্ড লক্ষ্য করে পর পর পাঁচটা গুলি ছুঁড়ল রানা। পরের তিন গুলি বিধল বনেট ও রেডিয়েটরে। কেউ এলে বুঝে নেবে, ছুটন্ত ভ্যানের সামনে থেকেই এসেছে একরাশ গুলি। বেল্টে পিস্তল গুঁজে ড্রাইভারের দরজার পাশে গিয়ে থামল রানা। তিনটে গুলি লেগেছে গঞ্জালেসের বুকে। অবশ্য আগেই লাশ হয়ে গেছে বলে ক্ষত থেকে বেরিয়েছে সামান্য রক্ত। তাতে বড় কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ভ্যানের ব্যাক-ডালায় নীল রঙের পাঁচ লিটারের প্লাস্টিকের পেট্রল ক্যান পেল রানা। ঝাঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে কিছুই নেই। ক্যান হাতে ফিরল গাড়ির পাশে। ভ্যানের বডির সঙ্গে বল্টু দিয়ে লাগানো আছে তেলের ভারী ট্যাঙ্ক। ওটার তলা দিয়ে ইঞ্জিনে গেছে ফিলার টিউব তোবড়ানো ট্যাঙ্ক ও চেসিস লালচে মরিচায় ভরা। পুরনো গাড়ি এতই অযত্নে রাখা হয়েছে, ওটাকে বাতিল মাল বললেও দোষ ধরবে না কেউ। স্টিলেটোর ডগা দিয়ে খুঁচিয়ে ট্যাঙ্কের মাঝে একটা ফুটো করল রানা। ঝরঝর করে পেট্রল পড়তেই ছোট্ট ফুটোয় ধরল ক্যানের মুখ। একটু পর ট্যাঙ্কে করা ফুটো থেকে নিচে নেমে গেল পেট্রলের স্তর। ততক্ষণে প্রায় ভরে গেছে প্লাস্টিকের ক্যান।

আবারও ভ্যানের সামনে ফিরে মাটিতে নামিয়ে রাখল ক্যান। খুলে নিল ড্রাইভারের দরজা। হাতল ঘুরিয়ে নামিয়ে দিল কাঁচের জানালা। একবার দেখে নিল গঞ্জালেসের লাশ। পথের ধারে শুকনো এক ডাল দেখে ওটা নিয়ে এল। ছোরা দিয়ে কাটল লাশের শার্টের একফালি কাপড়। ওটা পেঁচিয়ে নিল ডালের মাথায়। পেট্রলে ভরা ক্যানের ভেতরে চুবিয়ে দিল কাপড়ের টুকরোসহ ডাল। এবার ওটা সরিয়ে রেখে ক্যান কাত করে পেট্রল ঢালল লাশের কোল, বুক ও মাথায়।

একটু দূর থেকে রানার কাজ দেখছে ফক্স। নিচু গলায় বলল, ‘অর্থাৎ, ঘটনা এরকম— আপনি গুলি করেছেন আমাকে। তখন সিনেমার গাঁজাখুরি দৃশ্যের মত দপ করে আগুন ধরেছে পুরনো এই ভ্যানে।’

‘আরও বাস্তব দৃশ্য চাইলে বসে পড়ো ড্রাইভিং সিটে, প্রস্তাব দিল রানা। ‘আমার কোন আপত্তি নেই।’

মাথা নাড়ল ফক্স। ‘যা করেছেন, তা তো করেইছেন। তাই বলে আপনার পরিচালনায় কখনও অভিনয় করব না!’

গাড়ির ভেতরে খালি ক্যান রেখে ধুম শব্দে ড্রাইভারের দরজা বন্ধ করল রানা। পকেট থেকে বের করে জ্বেলে নিল, লাইটার। আগুন ধরিয়ে দিল ডালে পেঁচানো পেট্রলে ভেজা কাপড়ে। দপ্ করে জ্বলে উঠেছে লকলকে নীল শিখা। খোলা জানালা দিয়ে জ্বলন্ত ডাল লাশের কোলে ফেলল রানা। কয়েক মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে গেল লেলিহান আগুন। চিড়চিড় শব্দে পুড়ছে ড্রাইভিং সিটে ক্ষত-বিক্ষত লাশ। গনগনে তাপ এড়াতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘চিরকাল সুখে থেকো, প্রিয় উইলবার ফক্স!’

‘কে জানত এভাবে মরব!’ বলল ফক্স, ‘সত্যিই খুব দুঃখজনক!’

একটু পর আগুন ধরে গেল ফিউয়েল ট্যাঙ্কে। ওটা ফাটতে পারে ভেবে গাড়ি থেকে দূরে সরে গেল ওরা। একটু আগেও রাতের বাতাসে ছিল বুনো ফুলের মিষ্টি সুবাস, এখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে জ্বলন্ত রাবার ও পোড়া মাংসের বিশ্রী দুর্গন্ধ। আগুনে ভরা গাড়িতে আটকা পড়লে কী ধরনের পরিণতি হয় মানুষের, আগেও দেখেছে রানা। একসময় নিভে যাবে আগুন। ভ্যানের ভেতরে থাকবে রোমহীন, মচমচে লাশ। কারও সাধ্য নেই বুঝবে দেখতে কেমন ছিল মানুষটা! তবে এই লাশের মুখের টাইটেনিয়াম ও সোনার দাঁতের পাটি বলে দেবে সে আসলে কে।

‘বিশ্রী কাণ্ড করলেও এতে কাজ হবে বলেই মনে হচ্ছে,’ মন্তব্য করল ফক্স।

‘আমার এই বিশেষ দক্ষতায় তুমি তা হলে খুশি?’ বলল রানা।

‘কিন্তু আপনার কাছে আমি দুই পাটি দাঁত পাই।’

‘আমি মরলে আমার দুই পাটি দাঁত তোমাকে নিতে দেব।’ এবার হয়তো কয়েক দিন বাড়তি সময় পাব, ভাবছে রানা। দু’চার মাইলের ভেতরে অনেকেই দেখেছে গাড়ির আগুন। একটু পর এখানে পৌঁছে যাবে গ্রামের মানুষ। লোভে পড়ে লাশের মুখ থেকে দুর্মূল্য দাঁতের পাটি চুরি করবে কেউ, এমন সম্ভাবনা খুব কম। তা ছাড়া, বেশিক্ষণ লাগবে না পুলিশের লোকেদের পৌঁছে যেতে। গঞ্জালেসের লাশ মর্গে নেবে তারা। খবর পেলে সেখানে যাবে লিয়োনেলের লোক। অথবা ক্ষমতাবলে মর্গ-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাশের ব্যাপারে দরকারি সব তথ্য জেনে নেবে।

ট্র্যাক যেন করতে না পারে, তাই লিয়োনেলের দেয়া স্মার্টফোন অফ করে রেখেছে রানা। এবার ওটা চালু করল। ডিভাইসে জিপিএস লোকেশন তুলে কয়েক অ্যাঙ্গেল থেকে সংগ্রহ করল পোড়া ভ্যানের ছবি। হাওয়ার প্রবাহ অন্যদিকে সরে যেতেই নাক চেপে ধরে কাছ থেকে নিল বিদগ্ধ লাশের ফোটো, তারপর অফ করে দিল স্মার্টফোন।

হোল্ডঅলসহ টয়োটা অফরোড প্রিমিয়ামে উঠেছে ফক্স। একটু পর ওর পাশে ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে চলল ঝোড়ো বেগে। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেল আলদারিসিন গ্রামে। পরিচিত পরিবেশ পেছনে চলে যেতে মন খারাপ করে ওদিকে চেয়ে রইল ফক্স, কী যেন ভাবছে।

দু’ঘণ্টা পর ফ্রান্সের সীমান্ত পেরিয়ে নির্জন এক পথের ধারে গাড়ি রাখল রানা। স্মার্টফোন চালু করে কল দিল লিয়োনেলের নম্বরে। মাত্র একবার ডায়াল হতেই ওদিক থেকে ধরল কেউ। গম্ভীর, ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ অচেনা: ‘মাসুদ রানা? কী বলবে বলো।’

রাত বাজে তিনটে, অথচ জেগে আছে কেউ। ‘আপনার বকে বলুন, ফক্স এখন আর জগতে নেই,’ বলল রানা, ‘ই- মেইল করে ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।’

অন্যপ্রান্তে চুপ করে থাকল লোকটা

কল কেটে সিকিয়োর ই-মেইলে জিপিএস লোকেশন ও ছবি পাঠিয়ে দিল রানা। মেসেজ পৌঁছে যেতেই স্মার্টফোনের এসডি কার্ড সরিয়ে ঘন ঝোপে ফেলল ডিভাইসটা। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল। ভাল করেই জানে, আর পিছাতে পারবে না। জেসিকা আর নিজেদেরকে বাঁচাতে হলে খুন করতে হবে একদল নরপশুকে।

প্রায় নিঃশব্দে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে অফরোড গাড়ি।

রানার নাকে এসে যেন লাগল পোড়া লাশের বিশ্রী দুর্গন্ধ। সামনে ওঁৎ পেতে আছে হিমশীতল মৃত্যু। তবে বেঁচে থাকলে যেভাবেই হোক কিলিং মিশনটা শেষ করবে রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *