ষোলো
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল রানা, তারপর স্মার্টফোনটা ধরিয়ে দিল ফক্সের হাতে। ডিভাইসটা অফ করে পাউচে পুরে হোল্ডঅলে রাখল যুবক। নিচু গলায় বলল, ‘এবার তো দেখলেন সবই।’
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘মেনে নিতে কষ্ট হয় যে নিজের চোখে এসব দেখেছ।’
‘তাই আসলে,’ বলল ফক্স। ‘তবে ওটা হরর কোন সিনেমা ছিল না। বুঝতে পারছি আপনার কেমন লেগেছে। চরম অশুভ একদল অমানুষ তারা। অথচ, আগে ভাবতাম আমার চেয়ে মন্দ কেউ পৃথিবীতে নেই। বিক্রি করে দিয়েছি আত্মা। কিন্তু সে-রাতে বুঝলাম, এখনও মানুষ হওয়ার সুযোগ আছে আমার। শেষমেশ হয়তো মাফ পাব স্রষ্টার কাছ থেকে। এরপর ওই এলাকা থেকে বেরিয়ে প্রথম সুযোগে পালিয়ে এসেছি এই দেশে।’
চুপ করে আছে রানা।
‘আপনি কি ভাবছেন এরা করছিল শয়তানের পূজা?’ কাঁধ ঝাঁকাল ফক্স। ‘হয়তো তা-ই। নইলে মাথায় ছাগলের শিং কেন? সবার মুখে মুখোশ, পরনে আলখেল্লা। এমনি এমনি তো আর মহাবিষুবের রাতে অদ্ভুত ভাষায় প্রার্থনা করে না। জবাই করল বেচারি মেয়েটাকে। দেবতার দেহ মানুষের মত, অথচ মাথা পাখির। কী জানি, ওটা আসলে কোন্ ধর্ম!’
‘ওই মূর্তি থঅথের,’ বলল রানা। ‘কালো জাদুর জন্যে ইংরেজি ক্যালেণ্ডারে বিশেষ এক রাত মার্চের বিশ তারিখ।’
‘কীসের মূর্তি বললেন?’
‘থঅথ। মিশরীয় প্রাচীন এক অপদেবতা। জ্ঞান, লেখালেখি ও জাদুটোনার অদ্ভুত গুণের মালিক।’
‘আপনি এসব জানলেন কীভাবে?’
‘অবসরে সামান্য পড়াশোনা করেছি,’ বলল রানা।
‘কিন্তু মানুষ খুন করবে মিশরীয় অপদেবতার জন্যে? এটা কেন?’
‘থঅর্থ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানি না, স্বীকার করল রানা।
নীরবতা নেমেছে পাহাড়ে। আগের মতই দূরে চেয়ে আছে ফক্স। কিছুক্ষণ পর জানতে চাইল রানা, ‘সে-সময়ে ওখানে গিয়েছিলে কেন? ওই দলের সঙ্গে যোগাযোগ হলো কীভাবে?’
ব্যাখ্যা দিল ফক্স: ‘আগেই জেনেছেন, একজনকে খুন করতে ওখানে গেছি। গ্রামে সম্ভ্রান্ত লোকটার ছিল চমৎকার বাড়ি। আমাকে বলা হয়েছিল, সন্ধ্যার দিকে তাকে ওখানে একা পাব। সহজে খুন করতে পারব। কিন্তু তখন ওই বাড়িতে এল তার তৃতীয়পক্ষের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী, তাদের দুই বাচ্চা আর এক বুড়ি আয়া। একটু পর বিদায় নিয়ে চলে গেল সুন্দরী মহিলা। বাড়িতে রয়ে গেল বাচ্চাদুটো ও আয়া। আমি আর ওদের সামনে লোকটাকে খুন করতে পারলাম না।’
বাচ্চা, মহিলা বা অসহায় কারও ক্ষতি করে না ফক্স, মনে পড়ল রানার।
‘আমি অপেক্ষায় থাকলাম,’ আবারও শুরু করল ফক্স, ‘প্রথমে ভাবলাম কয়েক ঘণ্টা পর বিদায় নেবে বাচ্চাসহ আয়া। কিন্তু সেটা আর হলো না। নয়টার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লোকটা। পিছু নিলাম গাড়িতে করে। জানতাম না কোথায় চলেছে। একবার ভাবলাম, পথে সুযোগ পেলে খুন করব। কিন্তু সেই সুযোগ আর এল না।’
ফক্স চুপ হয়ে যাওয়ায় বলল রানা, ‘তুমি বলতে থাকো।’
‘দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল। সারে কাউন্টির গভীরে পৌঁছে ঢুকে পড়ল বিশাল এক এস্টেটে।’ হোল্ডঅল দেখাল ফক্স। রানা বুঝল স্মার্টফোনের ভিডিয়োর কথাই বলছে যুবক।
‘ওই এস্টেট আসলে কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।
‘নাম শার্লন হল। গিল্ডফোর্ড থেকে কয়েক মাইল দূরে। লোকটা প্রিমিয়ো নিয়ে ঢুকে পড়ল এস্টেটে। আরও এগিয়ে গাড়ি রেখে আবার ফিরলাম ওখানে। দেয়াল টপকে ঢুকলাম জঙ্গলে। চেক-পোস্টের দিকে গিয়ে দেখি, দামি সব গাড়ি এসে থামছে সিকিউরিটির লোকেদের পাশে। বুঝে গেলাম, পার্টি হচ্ছে বড়লোকদের জন্যে। সবাই হয়তো ভিআইপি। আর তখনই দেখলাম তাদের দু’জনকে।’
‘কাদের কথা বলছ?’
‘শোফার চালিত রোলস রয়েসে চেপে এল। সামনের চাকা দেখতে গিয়ে ড্রাইভার দরজা খুলতেই জ্বলে উঠল ভেতরের বাতি। সেই আলোয় দেখলাম পেছন-সিটে অনেক বুড়ো এক লোক। হাতে ওয়াকিং স্টিক। ওটার হ্যাণ্ডেল দ্বীপের মূর্তির মাথার মত। …কী যেন বললেন অপদেবতার নাম?’
‘থঅথ।’
‘গাড়ির ভেতরে ছিল আরেকজন। বয়স ষাটমত।’ তিক্ত স্বরে বলল ফক্স, ‘তাকে আমি আগেও দেখেছি।’
‘চেনো ওদেরকে?’ জানতে চাইল রানা।
‘আগে তারা ছিল আমার বস্। বুড়োর নাম জানি না। আগে একবার দেখেছি এজেন্সির মিটিঙে। কারও সঙ্গে কথা বলেনি। তবে বুঝেছি, আসলে এজেন্সির প্রধান হচ্ছে সে।’
ফক্স জানাল, ডাক না এলে এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগের অনুমতি ছিল না। কয়েকবার ওকে ডেকে খুনের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে প্রৌঢ়। এজেন্সির মালিকপক্ষের কারও নাম ওর জানা নেই। কয়েকটা ডিপার্টমেন্টে বিভক্ত সেই এজেন্সি। দরকার ছাড়া একাধিক খুনিকে একই কাজে পাঠাত না। ওর ওপরে চোখ রাখত আরেক খুনি। ফক্স কাউকে খুন করার সঙ্গে সঙ্গে বস্ জেনে যেত, শেষ করা হয়েছে কাজ। দূরের কোন লকারে থাকত প্রাপ্য টাকা। অথবা, টাকা দিয়ে যেত অচেনা কেউ। খুনির ছোট এক চক্রের একজন ছিল ফক্স- বিশ্বস্ত, অনুগত ও দক্ষ।
‘গত একবছরে আমার সঙ্গে পাঁচবার দেখা করেছে সে,’ বলল ফক্স। ‘বিপজ্জনক ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুনের জন্যে ব্রিফও করেছে। সবই ছিল রাজনৈতিক হত্যা।’
‘কারও নাম জানতে চাইছি না।’
‘সে-ই ভাল। আমি নিজেও কিছু বলব না।’
‘ওই ষাটোর্ধ্ব লোকটার নাম কী?’ জানতে চাইল রানা।
‘নাম অ্যালান শ’। যদিও বুঝতাম ওটা তার আসল নাম নয়। নিজের ব্যাপারে খুব গোপনীয়তা বজায় রাখত।’
‘বয়স তার ষাটের মত, তাই না?’ বলল রানা।
‘আমার তা-ই ধারণা।’
‘তার চেহারার বর্ণনা দাও।’
মনে মনে কথা গুছিয়ে নিল ফক্স। ‘বলার মত কিছুই ছিল না তার। লম্বা নয়। বেঁটে নয়। মোটা নয়। চিকনও নয়। পড়ে যাচ্ছিল মাথার চুল। অবশিষ্ট কোঁকড়ানো চুল ঝোপের মত ঘন। চোখে কালো ফ্রেমের ভারী চশমা। পুরু কাঁচের জন্যে চোখদুটো দেখাত অনেক বড়। দু’কানের ডগা শয়তান- মূর্তির কানের মত খাড়া। শিরা-ওঠা নাক অস্বাভাবিক বড়। আমার ধারণা অতিরিক্ত মদ্যপান করে। নাকের পাশে জঙুলটা দেখলে কেমন যেন গা ঘিনঘিন করত।
আগেও সবকিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করত ফক্স। আর্মি থেকে বেরিয়ে গেলেও সেই গুণ হারিয়ে বসেনি।
‘তা হলে ওই লোকই অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল,’ বলল রানা।