১.
বাংলাদেশের একজন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা সন্ত্রাস করে, খুন করে, জঙ্গিবাদ করে, দুর্নীতি করে, চাঁদাবাজি করে তারা প্রতিবন্ধী। ’
সাধারণত ভ্রূণের বেড়ে ওঠায় কোনও ব্যাঘাত ঘটলে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। শারীরিক প্রতিবন্ধীরা অনেক ক্ষেত্রেই অসহায়। মানসিক প্রতিবন্ধীদের বুদ্ধিশুদ্ধি সাধারণ মানুষের চেয়ে কম। প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধী হওয়ার পেছনে নিজেদের কোনও হাত নেই। এ তাদের দোষ নয় যে তারা প্রতিবন্ধী। নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী নয় ওরা। আমরা প্রতিবন্ধীদের করুণা করি, দয়ামায়া করি, দেখভাল করি। ওরা নিরীহ। মানুষের জটিলতা, ঘৃণা, ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন খারাবি শিখতে মানসিক প্রতিবন্ধীরা অপারগ। সন্ত্রাসী, খুনি, জঙ্গিদের প্রতিবন্ধী আখ্যা দেওয়া মানে প্রতিবন্ধীদের অপমান করা। প্রতিবন্ধীরা সন্ত্রাস করে না, খুন করে না, দুর্নীতি করে না, চাঁদাবাজি করে না। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসী; প্রতিবন্ধী নয়। তারা সন্ত্রাসী হয়েছে প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে নয়। তারা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী হলে তাদের সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে রাজনীতি একটা কারণ। সন্ত্রাসীরা জেনে বুঝেই সন্ত্রাসী হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা দোষী। সন্ত্রাসীদের মানসিক প্রতিবন্ধী বলার মানে তাদের নির্দোষ বলা।
প্রতিমন্ত্রী, শুনছেন?
২.
বাংলাদেশের কাণ্ডকারখানা দেখে বড় দুঃখ হয়, বড় রাগ হয়। সেদিন নারায়ণগঞ্জের এক ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে যখন একপাল লোক অসৎ উদ্দেশে হেনস্থা করছিল, সরকারি এক প্রতিনিধি এসে ওই লোকগুলোকে শাস্তি না দিয়ে শাস্তি দিলেন শিক্ষককে। শিক্ষককে তাঁর ছাত্র এবং গ্রামবাসীর সামনে কান ধরে ওঠবস করতে হলো। শিক্ষকের এই অপমান, এই লাঞ্ছনা কোনও সুস্থ সচেতন মানুষের ভালো লাগার কথা নয়। অনেকেই কান ধরে শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করেছে কিছু শিক্ষার্থী। শিক্ষক শ্যামল কান্তির কাছে জাতির পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়েছে তারা। নিরীহ নির্দোষ নিরপরাধ মানুষের ওপর লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অন্যায়, অত্যাচার— আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। কিন্তু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ খুব একটা চোখে পড়ে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রী, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, একটুও নড়ছে না। মন ভরে গেল দৃশ্যটি দেখে। সত্যি বলছি, প্রতিবাদের দৃশ্যের মতো সুন্দর দৃশ্য আর নেই।
৩.
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই মিথ্যে অভিযোগে এক ইস্কুলের শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে, তাঁকে লাঞ্ছনা করা হয়েছে বলে, বাংলাদেশের অনেকে আজ প্রতিবাদে মুখর। ব্যাপারটি চমৎকার। কিন্তু চমৎকার এই ব্যাপারটি এটি প্রমাণ করে না যে বাংলাদেশের সকলে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারকে সম্মান করে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে এই সত্য অভিযোগে যখন কাউকে হত্যা করা হয়, যখন কাউকে লাঞ্ছনা করা হয়, তখন যদি দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ করে, অপরাধীদের বিচার হয়, বুঝবো দেশ নিয়ে আশা করার কিছু আছে। বুঝবো দেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারকে মানুষ সম্মান করে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার পরও যদি কেউ হুমকি না পায়, শাস্তি না পায়, কোপ না খায়, গুলি না খায়, তখন বুঝবো দেশে গণতন্ত্র আছে, বাকস্বাধীনতা আছে, মত প্রকাশের অধিকার আছে। সেই দিনটির অপেক্ষায় আছি আমি।
৪.
এদিকে একই সময়ে আরও একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। মেহেরপুরের এক ইস্কুলের সহকারী শিক্ষিকা সেই ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন। মেহেরপুর থেকে নিবন্ধন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন শিক্ষিকা, সঙ্গে এসেছিলেন প্রধান শিক্ষক। কুষ্টিয়া শহরের আল আমিন হোটেলে পাশাপাশি দুটো রুমে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন। পরদিন ভোরবেলায় প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন দেওয়ার নাম করে দরজা খুলতে বললে শিক্ষিকা দরজা খোলেন। প্রধান শিক্ষক তাঁকে বলা নেই কওয়া নেই ধর্ষণ করেন। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললে শিক্ষিকাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে পালিয়ে যান প্রধান শিক্ষক।
নারায়ণগঞ্জের প্রধান শিক্ষকের পক্ষে আজ সারা দেশ দাঁড়িয়েছে। কুষ্টিয়ার প্রধান শিক্ষকের বিপক্ষেও তো সারা দেশের দাঁড়ানো উচিত। কানে ধরে ওঠবস করলেই অসম্মানিত বা অপমানিত বোধ করে মানুষ? ধর্ষণ কি অসম্মান বা অপমান বোধ জাগায় না? নাকি পুরুষের অপমান নারীর অপমানের চেয়ে বড় হয়ে বাজে।
৫.
শুনেছি স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আন্দোলন চলছে। পাঠ্যবইয়ে ইসলাম বিদ্বেষী কবিতা, গল্প ও রচনাবলি রয়েছে এমন অভিযোগ তুলে সংশোধনের দাবিতে সংগঠিত হচ্ছে কওমিপন্থি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো। এমনকি ‘শিক্ষানীতি ২০১০’ এবং প্রস্তাবিত ‘শিক্ষা আইন ২০১৬’ বাতিলের দাবি তুলে আন্দোলন করছে এসব সংগঠন। ইতিমধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। পাঠ্যবই সংশোধন না হলে আরও তীব্র আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যদিও এনসিটিবি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘কোনও ধর্মকে বিন্দুমাত্র হেয় করা হয়েছে, এমন একটি শব্দও পাওয়া যাবে না পাঠ্যবইয়ে। এমন কিছু যদি কেউ দেখাতে পারেন আমরা সংশোধন করবো। ’
ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এসব পাঠ্যবইয়ে যোগ করা হয়েছে ধর্মহীন নাস্তিক ও হিন্দুত্ববাদের দীক্ষা। আশা করি দেশে এখনও ভালো মানুষ আছেন, যাঁরা দেশটাকে বাঁচাবেন, দেশটাকে নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাবেন।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৯ মে, ২০১৬