৪
উপবাসক্লিষ্টা কন্যাটির মুখের দিকে সমস্ত দিন চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। এ কী হয়ে গেল! এমন আকাশভাঙা বিপর্যয়ের সম্মুখী হতে হবে এ যে তাঁর দুঃস্বপ্নের অগোচর! পুরন্দর ক্ষেত্রী দুঃশাসক নানাবিধ অত্যাচার সে চালিয়ে যাচ্ছে এ দুঃসংবাদ যে না পান তা নয়। তার অত্যাচারে রাজপুরোহিত অবসর নিয়েছেন, মন্ত্রী অপসারিত। সেনাপতি বজ্ৰধর দেশত্যাগী—সে নাকি বর্তমানে শাহাবাদভুক্তির রোহিতাশ্ব দুর্গের দুর্গাধিপ। প্রাক্তন কাশী নরেশের একান্ত বিশ্বস্ত দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল ঈশান কৈবর্তের শাস্তির কথা কে না জানে? তার কুটিরে নাকি রাজাসাহেবের নির্দেশে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়—নিদ্রাগত ঈশানকে সপরিবারে হত্যা করতে। পুরন্দর লোকটা কামুক। তার অসিঘাটের বাগানবাড়িতে দেখা যায় নিত্য নূতন হুরী। শোনা যায়, তার ভিতর কিছু যবনীও আসে নাকি! এবং ভদ্রঘরের কুলনারীরাও! বলপ্রয়োগে! এদিকে অতিশয় ধূর্ত। প্রতিটি ঘাঁটিতে বসিয়েছে নিজের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। গুপ্তচরেরা রাজ্যের সর্বত্র সন্ধান করে বেড়ায়—প্রজাবিদ্রোহ সে কিছুতেই হতে দেবে না। শাসনের নামে কাশীরাজ্যকে শোষণ করার সুপরিকল্পিত বন্দোবস্ত। এসব তথ্য মোটামুটি জানাই ছিল। যেহেতু তিনি নিজে ভিন্ন পথের পথিক, তাই দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণব এইসব রাজনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়ে কোনদিন মাথা ঘামাননি।
আজ ঘামাতে হচ্ছে—যেহেতু শেলটা আজ এসে বিঁধেছে তাঁরই পাজর-সর্বস্ব বুকে!
লোকটা আজ বেপরোয়া। কারণ আছে। ঘটনাচক্রে আজ কাশীর বৃহত্তর জনসমাজ বিদ্যার্ণব আর তাঁর কন্যাটির বিপক্ষে। নারীর মুক্তি, নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা—সেইসব কথা এই কূপমণ্ডূকেরা চিন্তাই করতে পারে না। কন্যার পরামর্শে তিনি চতুষ্পাঠী উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন ছাত্রীদের জন্যও। ‘ব্রহ্মবাদিনী’ ছাত্রী নয় ‘সদ্যোদ্বাহা’। অর্থাৎ যারা প্রাকবিবাহ-কালে বিদ্যাশিক্ষা করবে। সংস্কৃত কাব্য পড়তে শিখবে, সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারিত হলে তার অর্থ বুঝবে। এ ছাড়া সংসারী হবার পর পূজা অর্চনার জন্য পরমুখাপেক্ষী হতে হবে না। মদালসার মতো পুত্রকে ব্রহ্মবিদ্যা দান করতে না পারুক, অন্তত তার অক্ষর পরিচয়ের সহায়ক হবে। কিন্তু পিতাপুত্রীর যৌথপ্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কাশীবাসী কোন গৃহস্থ তাঁর কন্যাকে চতুষ্পাঠীতে প্রেরণ করেননি। এই কূপমণ্ডূক সমাজ কন্যাদের শিক্ষিত করতে ভয় পায়। বৈধব্যের ভীতি!
বিদ্যার্ণব এবং তাঁর পালিতা কন্যা যে সমাজে নারী-শিক্ষার দীপশিখাটি প্রজ্বলিত করতে চেয়েছিলেন সেই সমাজ সম্বন্ধে আমাদের কোন ধারণা নেই। থাকবে কোথা থেকে? তখন না ছিল কোন সংবাদপত্র না মাসিক পত্রপত্রিকা। বাঙলাভাষার তখন চর্চা হত সামান্য। দলিল- দস্তাবেজ সব ফার্সিতে। ভুললে চলবে না, আমাদের আখ্যায়িকার কালে রাজা রামমোহনের বয়স দুই বৎসর! উইলিয়াম কেরী—যাঁর উদ্যোগে পঞ্চানন কর্মকার শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে ম্যাথু-লিখিত সুসমাচারের প্রথম পৃষ্ঠাটি বাঙলাভাষায় মুদ্রিত করেন—সেই কেরী সাহেব তখনো ভারতবর্ষে আসেননি। তাই আমাদের আখ্যায়িকার ঘটনাকালের প্রায় সত্তর বছর পরের তিনটি উদ্ধৃতি পাঠকের দরবারে পেশ করি—তাহলে আন্দাজ পাবেন, আমাদের কাহিনীর কালে সমাজের কী অবস্থা ছিল—
১। “বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংঘটনের আশঙ্কা আছে।” (সংবাদ প্রভাকর, 12.5.1849 )
২। “স্ত্রীজাতি বিদ্যাবতী হইলে পতির প্রতি অশ্রদ্ধা করিবেন” (সংবাদ-প্রভাকর, 31.5.1849)
৩। “স্ত্রীলোকেরা বিদ্যারসিকা হইলে ব্যাপিকা হইবেন। ব্যভিচার করিবেন, রন্ধনাদি গৃহকর্ম করিতে চাহিবেন না, পতিসেবা এবং পুত্রকন্যাদির মলমূত্রাদি ধৌত করিবেন না, গরুকে যাব দিবেন না, পাকশালায় গোবর লেপন করিবেন না, বাসন মাজিবেন না, পতির উচ্ছিষ্ট খাইবেন না, শয্যা পাড়িবেন না, পান সাজিবেন না, স্বামীর পদতলে তৈল দিবেন না, পতির পাদোদক গ্রহণ করিবেন না।” (সংবাদ প্রভাকর, 19.6.1849 )
তবু সেই অশীতিপর বৃদ্ধ বৈদান্তিক আর তাঁর পালিতা কন্যা দুর্গাবাড়ি অঞ্চলের গৃহস্থদের দ্বারে দ্বারে ফিরেছেন—কেউ স্বীকার করেননি। ‘অষ্টমবর্ষে তু ভবেৎ গৌরী’ নিয়ম তখনো চালু আছে; কিন্তু কৌলিন্য প্রথার প্রাদুর্ভাবে অনেক হতভাগিনীকে হয়তো আজন্ম কুমারীই থাকতে হত—পাত্রের অভাবে। কুলীনপাত্র কিছু মূল্য ধরে দিলে পিসী-ভাইঝিকে হয়তো একই লগ্নে উদ্ধার করে দিয়ে যায়—কিন্তু ত্রিরাত্রির বেশি শ্বশুরালয়ে থাকতে স্বীকৃত হয় না। বছরে যে মাত্র তিনশ পঁয়ষট্টির অধিক রাত্রি নাই! সেইসব স্বামীসুখবঞ্চিতাদের অভাব ছিল না—বালবিধবাদের দল তো ছিলই। তবু দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের চতুষ্পাঠীতে একটিও ছাত্রীর শুভাগমন ঘটেনি।
তবু চলছিল। কিন্তু এ কী বিপর্যয়!
কী যেন বলে গেল পুরন্দর?
“কুলীন ব্রাহ্মণের বিধবা সহমরণে যেতে ভীতা হলে তার কী অন্তিম পরিণাম হয়!”
হ্যাঁ। সেটাই সমাজের বিধান!
স্বামীর মৃত্যুতে মরতে তোমাকে হবেই! এটা স্ত্রীজন্মের অনিবার্য নিয়তি। তবে কীভাবে মরতে চাও সেটা বেছে নেবার অধিকার সমাজ তোমাকে দিয়েছে। ইচ্ছা করলে স্বামীর দেহান্তে তার সঙ্গে চিতায় উঠে বসতে পার। তখন তোমার কী সম্মান! তোমার পায়ে ওরা আলতা পরিয়ে দেবে, সিঁদূরে সিঁদূরে ব্রহ্মতালুটা আগুনবরণ করে দেবে! অলক্তকরাগে রঞ্জিত করে তোমার রাতুল চরণদ্বয়ের ছাপ তুলে নিয়ে যাবে। তুমি যে মহাসতী! অবশ্য তোমার গায়ের গহনাগুলো সব খুলে নেবে। ওগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলার তো কোন অর্থ হয় না। পরের মেয়েটিকে তো পার করতে হবে! একবস্ত্রা হয়ে তুমি স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় পতিসহ পুষ্পক রথে ড্যাংডেঙিয়ে স্বর্গপানে রওনা হতে পার
তা যদি না চাও, তাহলেও আগুনে তোমাকে পুড়তে হবে। অন্য জাতের আগুন! সমাজ এ বিষয়ে উদার—কোন জাতের আগুনে পুড়বে তা তোমার ইচ্ছানুসারে। একেবারে প্রথম পর্যায়েই যদি আগুনে পুড়তে ভয় পাও তাহলে আমৃত্যু—অন্তত আযৌবন, দগ্ধে দগ্ধে মরতে পার। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সেবা করে। তাদের কাম চরিতার্থ করে। যা তোমার অভিরুচি। তোমার অন্তিমগতি বড় বড় শহরের লালবাতি-জ্বলা কোন এক স্বর্গে!
আগুন এবং স্বর্গ দুটোই পাবে। যে পথেই যাও!
কিন্তু ভদ্রভাবে কোন বিগতভর্তার প্রাণধারণের প্রচেষ্টা? সেটা আকাশকুসুম! মনু তেমন বিধান দিয়ে যাননি—অন্তত এটাই ওদের মনুসংহিতার ভাষ্য!
তা না হয় হল। কিন্তু এখন কী করবেন বিদ্যার্ণব? কীভাবে ধর্মরক্ষা হবে তাঁর আদরের পালিতা কন্যার? রাজমাতার দরবারে আর্জি পেশ করার প্রচেষ্টা বৃথা। সেই অন্তঃপুরে তিনি প্রবেশ করতেই পারবেন না। কন্যাটিকে সেখানে পাঠাতে পারেন—কিন্তু তাতেও ফল হবে না কিছু। রাজমাতা নিঃসহায়া। বস্তুত রাজাবরোধের ভিতর তিনি বন্দিনীমাত্র!
দ্বারকেশ্বর অকৃতদার। জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নিতান্ত দৈবক্রমে তাঁর সংসারে এসেছে এই মা-জননী। তার ফেলে আসা বর্ধমানের জীবনের কথা প্রায় কিছুই জানেন না। বৃদ্ধ কোন কৌতূহল কখনো দেখাননি, মেয়েটিও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তা জানায়নি।
শুধু জানেন—সে এক পণ্ডিত পিতার আদরের দুলালী : রূপমঞ্জরী। গৌরীদান করেছিলেন পিতা কন্যার নবম বর্ষে। ত্রয়োদশে বিধবা। আর জানতেন—অসাধারণ মেধা ঐ বাল-বিধবার, অনন্যসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তা।
প্রায় পাঁচ বছর আগেকার কথা। এক নিদাঘ প্রত্যুষে তার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন দশাশ্বমেধ ঘাটের একান্তে। তখনো পুব আকাশটা ফর্সা হতে শুরু করেনি। পথঘাট নির্জন। এই ব্রাহ্ম-মুহূর্তেই বিদ্যার্ণব গঙ্গাস্নান সেরে আসেন—কী শীত, কী বর্ষা। হঠাৎ নজরে পড়ে পথের ধারে বসে আছে একটি যুবতী মেয়ে। দু হাঁটুর মধ্যে মুখটা গুঁজে। ওর পিঠটা মাঝে মাঝে ফুলে-ফুলে উঠছে। মেয়েটি যে কাঁদছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু বৈয়াকরণিক পণ্ডিতের মনে পড়ে গেল হেত্বর্থে পঞ্চমী-বিভক্তির সূত্রটা। অগ্নিকে চোখে না দেখেও শুধু ধূম দর্শনে যদি প্রমাণিত হয় ‘পর্বতো বহ্নিমান’; তাহলে ওর পৃষ্ঠ-আন্দোলনাৎ’ সিদ্ধান্তে আসা যায়—অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে মেয়েটি কাঁদছে। ওঁর মনে হল—মেয়েটি পথ হারিয়েছে। ধীরপদে এগিয়ে এসে ওর পিঠে একটা হাত রাখলেন।
চমকে অশ্রুআর্দ্র মুখখানা মেলে ধরতেই বৃদ্ধ বললেন, কী হয়েছে মা? কাঁদছিস্ কেন? বাড়ির পথ খুঁজে পাচ্ছিস না?
মেয়েটি বললে, না বাবা, বাড়িই নেই, তার পথ হারাবো কী করে?
অনেক পীড়াপীড়ির পর শুনলেন, মেয়েটি গত রাত্রের মধ্যযামে এসে পৌঁচেছে এই ঘাটে। নৌকাযোগে। কে যে ওকে এভাবে মধ্যরাত্রে দশাশ্বমেধ ঘাটে নামিয়ে দিয়ে গেল তার নামটা কিছুতেই স্বীকার করল না। তবে এটুকু জানাল যে, সে নিজে কুলীন ব্রাহ্মণ বংশের বালবিধবা। তিনকুলে তার কেউ নেই। অগতির গতি ঁবিশ্বনাথের চরণে আশ্রয় নিতে আসছিল। পথে বিপর্যয়। কী জাতের বিপর্যয় তাও স্বীকার করল না। ওর আদি নিবাস বঙ্গভূমে। বর্ধমান জিলার সোঞাই গ্রামে।
ইতিমধ্যে আলো ফুটেছে। স্নানার্থীদের ভিড় বাড়ছে। একটি পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া রোরুদ্যমান’ অনিন্দ্যকান্তি বিধবার সঙ্গে আলাপনরত বৃদ্ধকে দেখে অনেকে কৌতূহলী হয়ে ঘনিয়ে এল : কী হয়েছে পণ্ডিতমশাই?
বিদ্যার্ণব স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মেয়েটির উপস্থিতবুদ্ধি দেখে। তার চেয়েও বেশি, ওর মুখে নির্ভুল দেবভাষা শুনে। মেয়েটি তার বক্তব্যের শেষাংশ পেশ করল সংস্কৃত ভাষায়! কৌতূহলী মানুষজন ও দুর্বোধ্য ভাষার নাগাল গেল না—যে যার পথ দেখল। বৃদ্ধ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, সংস্কৃতেই—এ দেবভাষা কার কাছে শিখেছিস?
—আমার পিতৃদেবের কাছে। তাঁরও ছিল চতুষ্পাঠী। তদুপরি তিনি ছিলেন প্রখ্যাত কবিরাজ। তিনিই আমাকে সহমরণে যেতে দেননি, তাই গ্রামে জাতিচ্যুত হয়ে বাস করতেন। তাঁর বৈকুণ্ঠলাভের পরে বাধ্য হয়ে আমি কাশীযাত্রা করেছিলাম—
বিদ্যার্ণব দৃঢ়মুষ্টিতে রূপমঞ্জরীর হাতটি ধরে বলেছিলেন, আয়।
—কোথায় বাবা?
—’বাবা’ বলে ডেকেছিস, আবার বোকার মতো জানতে চাইছিস, ‘কোথায়’? চল, আগে দুজনে গঙ্গাস্নানটা সেরে নিই—
—এগুলো?
এতক্ষণে বিদ্যার্ণবের নজর হল, মেয়েটির হাতে একটি পুঁটুলি। বললেন, ঘাটেই কারও কাছে জমা রেখে বাপবেটিতে স্নান সেরে নেব, আয়।
রূপমঞ্জরী স্বীকৃতা হল না। পুঁটুলি খুলে দেখাল তার সম্পদ। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দুটি দ্রব্য : একটি জীবন্ত কবুতর আর একটি দুর্লভ বামাবর্ত শঙ্খ।
গঙ্গাস্নান মাথায় উঠল। মেয়ের হাত ধরে ফিরে এলেন চতুষ্পাঠীতে। এগুলি ওঁর মা-জননী কোথায়, কেমন করে পেয়েছে তা আর জানতে চাননি।
জীবনযাত্রার ছকটাই গেল পালটে। চিরদিন একলাটি থেকেছেন। একবেলা স্বপাক আহার। এখন সংসারের সব দায়-ঝক্কি মা-জননীর। এত দীর্ঘদিনের অভ্যাসটা ছাড়তে প্রথমটা রাজি হননি ঐ স্বপাক আহার। কিন্তু যখন বুঝলেন, সে অভ্যাসটা ত্যাগ করতে না পারলে কন্যাটিকেই ত্যাগ করতে হবে, তখন বাধ্য হয়ে মেনে নিলেন। তারপর পাঁচ-পাঁচটি বছর কেটে গেছে।
পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া রূপমঞ্জরী আজ ত্রিশের কোঠায়। ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি, ন্যায়, নব্যন্যায়, সমাপ্ত করে আজ মা-জননী কাশীর পণ্ডিত সমাজে বিদ্যালঙ্কার।
বাকি আছে শেষ জ্ঞান: ব্রহ্মবিদ্যা। সেটা উনি দেবেন না। না, মন্ত্রদীক্ষা দিতে স্বীকৃত হননি। বিদ্যার্ণব নিজে দীক্ষিত সন্ন্যাসী নন। তাই মা-জননীকে বলে রেখেছেন উপযুক্ত গুরুর ব্যবস্থা — তিনি করে দেবেন। সম্ভাব্য গুরু যে কে, তা জানাননি তাঁর কন্যাটিকে। কিন্তু নিজে মনে মনে তাকে নির্বাচন করে রেখেছেন। সেই মহাযোগীর বর্তমান অধিষ্ঠান এই কাশীধামেই—যাবৎ চন্দ্রার্কমেদিনী না হলেও অন্তত পূর্ববর্তী সপ্তদশ শতাব্দী থেকে! উনি অবশ্য কাউকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে চান না—তবে একথাও ঠিক যে, তিনি নিতান্ত খেয়ালী। শিশুর মতো সরল। হঠাৎ রাজি হলেও হয়ে যেতে পারেন।
সবই পরিকল্পনা করা ছিল—ইতিমধ্যে এই বিনামেঘে বজ্ৰপাত!
নাঃ। পুরন্দরের ওটা ফাঁকা আওয়াজ নয়!
আশ্রমে নেমে এসেছে একটা মৃত্যুশীতল কুাটিকা। পুরন্দরের কুৎসিত শাস্তিদানের প্রস্তাবটা ছিল যথেষ্ট সোচ্চার। আশ্রমিক ছাত্রদলের মধ্যে যারা কিশোর বা তরুণ তারা না-বুঝল তা নয়! তরুণ আশ্রমিক ব্রাহ্মণ বিদ্যার্থীরা ক্ষাত্রধর্মের অভাবটা অনুভব করল যেন
পরদিন রমারঞ্জন বললে, আপনাকে কখনো বলা হয়নি দিদি, আমার এক বড় ভগ্নী ছিলেন। আপনার চেয়ে কিছু বড়ই হবেন—এবং তিনি ছিলেন শ্যামবর্ণা। আমার কৈশোরে তাঁকে মণিকর্ণিকায় দাহ করে এসেছি। আপনাকে দেখলে আমার নিরন্তর তাঁর কথা মনে পড়ে যায়।
রূপমঞ্জরী বুদ্ধিমতী। সহজেই বুঝতে পারে রমা আজ অন্তরঙ্গ হতে চাইছে—ছোটভাইয়ের আসনটা দৃঢ়তর করতে চাইছে। সেই অশ্লীল বিপদটার কথা আলোচনা করার পূর্বপ্রস্তুতি। সে কথা সহাধ্যায়ীর সঙ্গে আলোচনা করতে সঙ্কোচ হয়, দিদির সঙ্গে নয়।
রমারঞ্জন প্রশ্ন করে, আপনার এমন নাম হল কেন? হটী?
—তোমার নাম রমারঞ্জন হল কেন?
—বাঃ। তার একটা অর্থ আছে। ‘হটী’র মানে কী?
রূপমঞ্জরী বলেন, ওটা আমার নাম নয়, পিতৃদত্ত উপাধি। ‘হট’ শব্দের অর্থ সংস্কৃতে নানান প্রকার। যেমন : ‘বিদ্রোহ-বুদ্ধি’, উদাহরণ : “মনসার হটে সাধু ভিক্ষা মাগি খায়”—এটা মনসার ভাসান থেকে। আবার ‘হট’ মানে ‘ক্রোধ’; যেমন ঘনরামের শ্রীধর্মমঙ্গলে আছে, “হটে হৈমবতী ঘরে হানিল তার শির”। অথবা ‘জোর-জবরদস্তী’, যেমন দুর্গাপঞ্চরাত্রিতে ‘হট’ শব্দের ব্যবহার—”আজি হবে এ সঙ্কট, তেঁই হর কৈলা হট।” ‘হটী’ নিঃসন্দেহে ‘স্ত্রী-আম ঈপ’। আমি অবশ্য জানি না, পিতৃদেব আমার কোন গুণে মুগ্ধ হয়ে ঐ ডাকনামের উপাধি দিয়েছিলেন—বিদ্রোহবুদ্ধি, ক্রোধ অথবা জবরদস্তী।
—তাহলে আপনার নামটা কী দিদি?
—সেটা শুনলে তুমি হাসবে ভাই: রূপমঞ্জরী।
—কেন? হাসব কেন?
—আমার এই নেড়ামুণ্ডি
কথাটা শেষ করতে পারেন না। রমারঞ্জনও অধোবদন হয়। দুজনেরই মনে পড়ে যায় পুরন্দরের সেই অশ্লীল কদর্য ইঙ্গিত : ন্যাড়ামুণ্ডির সঙ্গে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধটা জমবে না।
রমারঞ্জন আর দ্বিধা করে না। সরাসরি নেমে পড়ে কাজের কথায়, নিশ্চয় বুঝতে পারছেন দিদি, আজ আপনার সঙ্গে খোশগল্প করতে আসিনি আমি। গুরুদেব তো বজ্রাহত তালগাছের মতো নিথর হয়ে আছেন। লক্ষ্য করেছিলেন কিনা জানি না, আজ তিনি গঙ্গাস্নানে যাননি—বোধকরি বিগত পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম! এমন উদাসীনভাবে বসে থাকাটা তো কোন কাজের কথা নয়।
বিদ্যালঙ্কার ম্লান হাসলেন। বললেন, আমি তো উদাসীনের মতো বসে নেই রমা। সংসারের কাজ তো করে যাচ্ছি একই ভাবে-
—কিন্তু কী করে করছেন?
—সহজেই। যে হেতু আমি সমাধানে পৌঁছে গেছি। উদ্ধার পাবার পথ আমার ‘হস্তামলকবৎ’!
উৎসাহে সোজা হয়ে বসে রমারঞ্জন, কী তা?
—তুমি রূপমতীর নাম শুনেছ রমারঞ্জন? মালোয়া রাজ্যের জনপদকল্যাণী ‘রূপমতী’?
—না। আপনি তাঁর কথা কোথায় শুনলেন?
—আমার বাবামশায়ের কাছে। তিনি আরবী-ফার্সি দুটো ভাষাই জানতেন। রূপমতীর উপাখ্যান আছে আবুল ফজলের আকবরনামায়। শোন, তোমাকে গল্পটা বলি আগে। নামসাযুজ্যে রূপমতীর কথাই আজ মনে পড়ে গেল আমার। শোন গল্পটা—
আকবর বাদশার ফৌজ নিয়ে বীরদর্পে সেনাপতি আধম খাঁ প্রবেশ করল পরাজিত মালোয়ার রাজধানীতে। আধম হুকুম জারি করে রেখেছিলে—মুগল সৈন্য মালোয়ার যৌবনবতীদের ইচ্ছামতো দখল করতে পারে। শুধুমাত্র যদি মালোয়ারাজ্যের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রূপমতীকে ধরতে পারা যায় তাহলে কেউ তার গাত্র স্পর্শ করবে না। তাকে পৌঁছে দিতে হবে স্বয়ং সিপাহসালারের শিবিরে।
হত্যা-উৎসব শেষ হল রাত্রির তৃতীয় যামে। ক্লান্ত অবসন্ন রক্তমাখা আধম শয্যাগ্রহণের উপক্রম করছে। ঠিক তখনি এল জবর খবর : রূপমতীকে জিন্দা পাওয়া গেছে!
উৎসাহে চারপাইয়ের উপর উঠে বসল আধম : তব লাও বহ্ ছুকরিকো!
দুই মুগল সৈন্য দুই বাহুমূল ধরে নিয়ে এল বন্দিনীকে। রূপমতীর ঘাঘরা ছিন্নভিন্ন, ওড়না খসে গেছে, কঞ্চলিকা স্থানচ্যুত। তার কপালে রক্তের ধারা। আধম অবাক বিস্ময়ে দেখছিল।
শিবির নির্জন হলে, প্রহরীরা নিষ্ক্রান্ত হলে, গোঁফে চাড়া দিয়ে আধম বললে, শোন বাঈজী! বেয়াদবী আমার বিলকুল লা পসন্দ। রাত্রে যাকে আমার বিছানায় উঠে বসার অধিকার দিই তার সতীপনা আমার বরদাস্ত হয় না। বেচাল দেখলে তোমার ঐ কাঁচুলী-খসা বুকের উপত্যকায় এই ছোরাখানা আমূল বিদ্ধ করে দিতে আমার হাত কাঁপবে না! কিছু বুঝলে?
চৌষট্টিকলায় পারঙ্গমা রূপমতী একটি কুর্নিশ করে বললে,
‘বক্ৎল-এ চুন মনীপর খাতিরৎ
খুশ্নূদ সী গরদদ্।
বজায় মিন্নৎ ওয়ালি টেঘ-ই-তুদন্
আলুদ মী গরখুদ।।
কিছু বুঝলেন?
আধমের শিরস্ত্রাণ ভেদ করে কাব্যমাধুর্য আদৌ প্রবেশ করল না। বললে, সোজা ভাষায় কথা বল?
—সোজা ভাষায় তার অর্থ:
খুন- খারাবির রঙ-তামাশায় খেলতে হোলী চাও?
খুশ্ হবে কি গুপ্তিখানা বিধলে বুকে? দাও!
তোমার খুশেই হই খুশিয়াল, ভয় শুধু মোর দিলে
খুন কলঙ্কে লিপ্ত হবে তোমার ছোরাটাও।।
আরও সহজ ভাষায়—আমি বাঈজী, সুরৎ আর জওয়ানি নিয়েই আমার মহব্বতের বেসাতি। তাই জানতে চাইছি, মুগল সেনাপতির রুচিটা কী জাতের? আমার মঞ্জিলে আতিথ্য গ্রহণ করে আমাকে স্বমহিমায় দেখতে চান? না কি রক্তমাখা বিবস্ত্রা একটা নারীদেহ ধর্ষণ করেই আপনি তৃপ্ত?
আধম স্তম্ভিত হয়ে গেল। গ্রহণ করল বাঈজীর আমন্ত্রণ। পরদিন সন্ধ্যায় সেজে-গুজে আতর মেখে সে উপস্থিত হল রক্তস্নাত জনপদের শেষ প্রান্তে—বাঈজীর মঞ্জিলে। সেখানে শুয়ে আছে রূপমতী—অতিথির জন্য সাজানো আছে নানান উপকরণ : সিরাজি, চষক, ভৃঙ্গার, নানান বাদ্যযন্ত্র, তবক্-দেওয়া সুগন্ধী পান, রূপার রেকাবিতে গোড়ে মালা। আর তার মাঝখানে রেশমী চীনাংশুকে আবৃত রূপমতীর মৃতদেহ!
রমারঞ্জন আত্মবিস্মৃত হল। হঠাৎ দুই হাত চেপে ধরল রূপমঞ্জরীর। আর্তকণ্ঠে শুধু বললে, ন্—না!
পরক্ষণেই সে সম্বিত ফিরে পায়। সলজ্জে হাত ছেড়ে দেয়। এবার রূপমঞ্জরীই সেই হাত দুটি চেপে ধরে বলে, দিদির একটা মিনতি, রমা! আমার তো তিনকুলে কেউ নেই। মণিকর্ণিকাঘাটে এ দিদির মুখাগ্নিটাও তুই করিস!
রমারঞ্জন দিদির হাত ছাড়িয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।
.
পরদিন সে আবার এল। বললে, প্রণাম করতে এলাম দিদি। কাশীধামের বাইরে যাচ্ছি! কাল ফিরে আসব।
—কোথায় যাচ্ছ ভাই?
—সাসারামের পথে রোহিতাশ্ব দুর্গে। গুরুদেব একটি পত্র দিয়েছেন বজ্রধর মিশ্রকে। জবাব নিয়ে আসতে হবে।
বিদ্যালঙ্কারের মনে পড়ল না তিনি কে। রমারঞ্জন বুঝিয়ে দিল বজ্রধর মিশ্র হচ্ছেন প্রাক্তন কাশীরাজের প্রধান সেনাপতি। কাশীনরেশের মৃত্যুর পরে তাঁকে পদচ্যুত করেছে রাজাসাহেব। বর্তমানে তিনি শাহাবাদভুক্তির রোহিতাশ্ব কিল্লার দুর্গাধিপ। মহামহোপাধ্যায় দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছেন গুরুদেব
এবার বিদ্যালঙ্কার নিজেই আপত্তি তোলেন—এ হতে পারে না! একটি মেয়ের জন্য হয়তো অসংখ্য সৈনিকের মৃত্যু হবে! তা আমি হতে দেব না, দিতে পারি না।
রমারঞ্জন দৃঢ় প্রতিবাদ জানায়, এবার আপনিই ভুল বলছেন দিদি। একটি নারীর জন্য নয়, একটি আদর্শের জন্য।
কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ব্যর্থ হল রমারঞ্জনের পরিশ্রম। দুর্গাধিপ বজ্রধর মিশ্র রোহিতাশ্ব দুর্গে অনুপস্থিত। সৈন্যসংগ্রহ মানসে তিনি কোথায় কোথায় ঘুরছেন। পাটনা-শাহাবাদ অঞ্চলে যেসব দস্যুর দল বিচ্ছিন্নভাবে ডাকাতি করে সেইসব দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ারদের নিজ সৈন্যদলে বেতনভুক সিপাহীতে রূপান্তরিত করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা তাঁর। দুর্গরক্ষার জন্য যেসব অধীনস্থ সেনানায়কদের রেখে গেছিলেন তারা এতবড় দায়িত্ব নিতে স্বীকৃত হল না। কাশীশ্বরের সৈন্য-বাহিনী সংখ্যায় বৃহত্তর। তদুপরি—জনশ্রুতি, কোম্পানির ফৌজ পুরন্দরের সহায়। লক্ষ্ণৌ-প্রয়াগ ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে রাজা-সাহেবের আঁতাত আছে!
রমারঞ্জন দ্বিতীয় একটা বিকল্প সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিল—গোপনে দিদিকে নিয়ে সে কাশীরাজ্য ত্যাগ করে যাবে। রূপমঞ্জরী স্বীকৃতা হতে পারেনি। প্রথমত সে-ক্ষেত্রে অকথ্য অত্যাচার হবে রমারঞ্জনের পরিবারবর্গের উপর। সে কাশীরই বাসিন্দা। তার বাবা, মা এবং ভগ্নীরা কাশীর প্রজা। দ্বিতীয়ত সমাজ তো ওদের ভাইবোনো সম্পর্কটা বুঝবে না—এই গৃহত্যাগের একটা কদর্য ইঙ্গিত করবে; সমাজে পতিত হবেন রমারঞ্জনের পিতৃদেব; মাথা হেঁট হয়ে যাবে দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের।
বিদ্যালঙ্কার কিন্তু বিচলিতা নন—সমাধান তো তাঁর মুঠায়—’হস্তামলকবৎ’!
রূপমঞ্জরীর আদর্শ—রূপমতী!