কালো মোরগ

কালো মোরগ

লজিকের প্রফেসর গোকুলবাবুর শিকারের নেশা ছিল। শীতকালে কলেজের ছুটিছাটা পাইলেই তিনি বন্দুক লইয়া বাহির হইয়া পড়িতেন। বাঘ ভালুক শিকারের দুরাকাঙ্ক্ষা তাঁহার ছিল না; ঘুঘু, বন-পায়রা, হরিয়াল, বড় জোর খরগোশ হত্যা করিয়া তাঁহার রক্তপিপাসা চরিতার্থ হইত।

ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপক গোকুলবাবুর মনটি ছিল অতিশয় যুক্তিপরায়ণ। অমোঘ যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়া তিনি বিবাহ করেন নাই; একটি স্ত্রীলোককে কেন তিনি সারা জীবন ধরিয়া ভরণপোষণ করিবেন ইহার কোনও যুক্তিসম্মত কারণই তিনি খুঁজিয়া পান নাই। অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবও কেহ ছিল না। তাঁহার কাছে এই সকল সম্পর্কের কোনও মানে হয় না। বস্তুত এই ‘মানে হয় না’ কথাটা তাঁহার মনের এবং কথার মাত্রা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ভূত ভগবান প্রেম আত্ম-বিসর্জন প্রভৃতি কথা শুনিলে তিনি একটু মুখ বাঁকাইয়া বলিতেন—‘মানে হয় না।’ নিজের শিকার-প্রীতিরও তিনি একটি মানে আবিষ্কার করিয়াছিলেন। জীবমাত্রেই হিংসাপরায়ণ, হিংসাবৃত্তি মানুষের স্বধর্ম; মাঝে মাঝে রক্তপাত না করিলে মনের স্বাস্থ্য খারাপ হইয়া যায়। তাই শিকার করা আবশ্যক।

তিনি একাকী শিকারে যাইতেন। তাঁহার পরিচিতদের মধ্যে কাহারও শিকারের নেশা ছিল না, তাছাড়া গোকুলবাবুর মতে দল বাঁধিয়া শিকার করিতে যাওয়ার মানে হয় না। তাঁহার একটি সাইকেল ছিল; একনলা বন্দুকটি সাইকেলের রডে বাঁধিয়া তিনি বাহির হইতেন। শহরের আট-দশ মাইল বাহিরে লোকাল বোর্ডের রাস্তার ধারে একটি মাঝারি গোছের জঙ্গল আছে; শীতকালে যখন বট ও অশ্বত্থের ফল পাকিতে আরম্ভ করে, তখন পারাবত জাতীয় পাখিরা সেখানে ভিড় করে। গোকুলবাবু প্রতি বৎসর সেই জঙ্গলে শিকার সন্ধানে যান।

পৌষ মাসের মাঝামাঝি এক মধ্যাহ্নে গোকুলবাবু সাইকেল চড়িয়া যাত্রা করিলেন। মন্দমন্থর চরণে সাইকেল চালাইয়া বনের কিনারায় উপস্থিত হইলেন। বনের কিনারায় একটি গ্রাম; গ্রামে এক মুদির দোকানে সাইকেল রাখিয়া বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

বনটি আকারে প্রায় গোলাকৃতি, ব্যাস অনুমান তিন মাইল; ইহার নেমিবৃত্ত ঘিরিয়া কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম; কোনও গ্রাম হিন্দুপ্রধান, কোনও গ্রাম মুসলমানপ্রধান। গ্রামীণেরা সকলেই চাষী। জঙ্গলের চারিপাশে গ্রামগুলির অবিস্থিতি দেখিয়া মনে হয় যেন জঙ্গলকে পাহারা দিবার জন্য থানা বসিয়াছে। বনটি খাসমহলের সম্পত্তি হইলেও গ্রামবাসীরা এখানে গরু মোষ চরায়।

গোকুলবাবু বন্দুক কাঁধে লইয়া বনের কেন্দ্রস্থল লক্ষ্য করিয়া চলিলেন। বেলা তৃতীয় প্রহর, সূর্য একটু পশ্চিমে ঢলিয়াছে; শষ্পাকীর্ণ ভূমির এখানে ওখানে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছগুলা একক দাঁড়াইয়া আছে। কোথাও বা কয়েকটা গাছ একত্র হইয়া ঘোঁট পাকাইতেছে। বটগাছগুলা ফলে ফলে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু আশ্চর্য! কোথাও একটি পাখি নাই। এই সময় গাছে গাছে ফলাশী পাখির ভিড় লাগিয়া থাকে, আজ পাখিগুলা গেল কোথায়? গোকুলবাবু একস্থানে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কান পাতিয়া শুনিলেন। ঘুঘুর উদাস বিলাপ, বন-কপোতের ফট্‌ ফট্‌ পাখার আওয়াজ কিছুই শোনা যায় না। তিনি চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন; কই, গরু ভেড়াও তো চরিতেছে না। বনের সকল পশুপক্ষী সলা-পরামর্শ করিয়া একসঙ্গে অদৃশ্য হইয়াছে নাকি? বিরক্ত হইয়া তিনি মনে মনে মন্তব্য করিলেন—মানে হয় না।

তবু তিনি অগ্রসর হইলেন। কাল হয়তো একদল শিকারী আসিয়াছিল; দমাদ্দম বন্দুক ছুঁড়িয়া পাখিগুলাকে বনছাড়া করিয়াছে। কিংবা হয়তো বনের অন্য প্রান্তে তাহার জড়ো হইয়াছে।

গোকুলবাবু বড় বড় গাছগুলার তলা দিয়া চলিতে চলিতে ঊর্ধ্বে গাছের ঘন ডালপালার মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। হরিয়াল পাখিগুলা বর্ণচোরা, তাহারা যখন আকাশে ওড়ে, তাহাদের সবুজ রঙ সহজেই চোখে পড়ে, কিন্তু একবার গাছে বসিলে নিমেষে অদৃশ্য হইয়া যায়; গাছের পাতার সঙ্গে তাহাদের গায়ের রঙ এমন বেমালুম মিশিয়া যায় যে, তাহাদের আর দেখা যায় না। গাছের তলা হইতে শিকারীর অভিজ্ঞ চক্ষু তাহাদের সিলয়েট দেখিয়া চিনিতে পারে। গোকুলবাবু দেখিতে দেখিতে চলিলেন, কিন্তু একটিও হরিয়াল দেখিতে পাইলেন না।

বনের কেন্দ্রস্থলে আট-দশটা বড় বড় গাছ একত্র হইয়া নিম্নে ঘন ছায়া রচনা করিয়াছিল। গোকুলবাবু কাঁধ হইতে বন্দুক নামাইয়া একটি গাছের গুঁড়িতে হেলাইয়া দিলেন, একটু নিরাশভাবে গাছতলায় বসিলেন। যে-পুকুরে মাছ নাই সে-পুকুরে মাছ ধরা এবং যে-বনে পাখি নাই সে-বনে পাখি মারিতে আসা একই কথা, মানে হয় না। তিনি পকেট হইতে কুচা সুপারি লইয়া কিছুক্ষণ চিবাইলেন। তারপর মন একটু চাঙ্গা হইলে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

উঠিয়া দাঁড়াতেই কে যেন তাঁহার পিছন হইতে গরম পাঞ্জাবির ছুট ধরিয়া টান দিল। গোকুলবাবু চমকিয়া ফিরিয়া চাহিলেন। তাঁহার বুক ধড়াস করিয়া উঠিল।

ভয়ের কিছু নয়, গাছের গোড়ায় একটা কাঁটালতা ছিল, তাহারই কাঁটায় পাঞ্জাবির প্রান্ত আটকাইয়া গিয়াছিল। গোকুলবাবু ধাতস্থ হইলেন। কিন্তু গত বৎসরের একটি ঘটনা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। তিনি গাছটিকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলেন। হ্যাঁ, এই গাছটাই বটে। গত বৎসর এই সময় এই গাছতলায় একটি ব্যাপার ঘটিয়াছিল।

গত বৎসর এমনি একটি দ্বিপ্রহরে গোকুলবাবু এই বনে পাখি মারিতে আসিয়াছিলেন। আসিয়া দেখিলেন, পুলিস বন ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। একজন ডি এস পি, দু’জন দারোগা পাঁচ-ছয় জন ছোট দারোগা এবং অসংখ্য কনস্টেবল। সকলেই সশস্ত্র। কী ব্যাপার? একজন ছোট দারোগার সঙ্গে গোকুলবাবুর সামান্য আলাপ ছিল, তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হয়েছে? আপনারাও পাখি শিকার করবেন নাকি?’

‘পাখি নয়, আরও বড় শিকার।’ ছোট দারোগা বলিল, আবদুল্লা নামে একটা দুর্দান্ত খুনী আসামী এই বনে লুকাইয়া আছে। আবদুল্লা একজন বড় গুণ্ডা, বিপক্ষ দলের একটা গুণ্ডাকে খুন করিয়া সে ধরা পড়িয়া যায়। বিচারে তাহার ফাঁসির আজ্ঞা হয়। বিচারের পর আদালত হইতে জেলখানায় যাইবার সময় সে দুইজন রক্ষীকে গুরুতর আহত করিয়া দড়িদড়া ছিঁড়িয়া পলাইয়াছিল। এই বনের কিনারায় একটি গ্রামে আবদুল্লার আত্মীয়স্বজন বাস করে; পুলিস সন্ধান লইয়া জানিতে পারিয়াছে সে এই বনে লুকাইয়া আছে, আত্মীয়স্বজনেরা তাহার খাদ্য সরবরাহ করে। তাই পুলিস আজ এই বনে হানা দিয়াছে, আবদুল্লাকে ধরিবে।

শুনিয়া গোকুলবাবু বলিলেন, ‘তাহলে আমি ফিরে যাই, আজ আর শিকার হল না। আমি বৃথাই এতদূর এলাম। মানে হয় না।’

ছোট দারোগা বলিল, ‘আপনি তো প্রায়ই এ জঙ্গলে শিকার করতে আসেন। জঙ্গলের ঘাৎঘোঁৎ সব জানা আছে!’

‘তা আছে!’

‘আসুন আমার সঙ্গে—’

ছোট দারোগা গোকুলবাবুকে ডি এস পি-র কাছে লাইয়া গেল। ডি এস পি গোকুলবাবুর পরিচয় শুনিয়া এবং জঙ্গলের সহিত ঘনিষ্ঠতার কথা জানিতে পারিয়া বলিলেন, ‘বেশ তো। আপনিও খুঁজুন না। আপনার সঙ্গে বন্দুক আছে, ভয়ের কিছু নেই। যদি ধরতে পারেন, নামও হবে।’

গোকুলবাবু বনে প্রবেশ করিলেন। ভাবিলেন, পাখির বদলে মানুষ মৃগয়া মন্দ কি! একটা নূতন অভিজ্ঞতা। বনের মধ্যে আরও অনেক পুলিসের লোক খোঁজাখুঁজি করিতেছে, ঝোপঝাড় ঠেঙাইয়া বিবিধভাবে বনের কিনারা হইতে কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হইতেছে। গোকুলবাবু তাহাদের অতিক্রম করিয়া অভ্যন্তর দিকে চলিলেন।

তাঁহার দৃষ্টি গাছের মাথার দিকে। পুলিস ঝোপঝাড় ঠেঙাইতেছে, ঠেঙাক, গোকুলবার যুক্তি-নিয়ন্ত্রিত বুদ্ধি বলিতেছে আসামী যদি বুদ্ধিমান হয় সে গাছের নীচে থাকিবে না, উপরে থাকিবে।

ঘণ্টা দুই এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে গোকুলবাবু একাকী এই গাছটির তলায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রকাণ্ড গাছ, একেবারে মহীরুহ; গুঁড়িটা তিনজন মানুষ জড়াইয়া ধরিতে পারে না, ডালগুলা অতিকায় হাতির গুঁড়ের মতো জড়াজড়ি করিয়া বহু শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিয়া বহু ঊর্ধ্বে চলিয়া গিয়াছে; ঘন পাতার আবরণের মধ্যে গোধূলির অন্ধকার।

গোকুলবাবু গাছের নীচে ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিতে লাগিলেন।

ঊর্ধ্ব মুখে দেখিতে দেখিতে তাঁহার চোখ পড়িল, মাটি হইতে আন্দাজ বিশ হাত উচ্চ একটা মোটা ডালকে গিরগিটির মতো জড়াইয়া আছে একটা মনুষ্যদেহ। অভিজ্ঞ চক্ষু নহিলে মনুষ্যদেহ ঠাহর করা যায় না, মনে হয় গাছেরই একটা শাখা।

গোকুলবাবুর বন্দুকে টোটা ভরাই ছিল, তিনি ডাকিলেন, ‘এই, নেমে আয়!’

উপর হইতে সাড়াশব্দ আসিল না, গিরগিটির মতো আকৃতিটা নিশ্চল রইল। তিনি তখন বলিলেন, “আমি তোকে দেখতে পেয়েছি। ভাল চাস তো নেমে আয়, নইলে গুলি করবো।’

এবারও আকৃতিটা নিশ্চল। গোকুলবাবুর ইচ্ছা ছিল আসামীকে নিজেই ধরিবেন এবং বন্দুকের আগায় লইয়া গিয়া ডি এস পি-র হাতে সমর্পণ করিয়া দিবেন। কিন্তু তাহা হইল না দেখিয়া তিনি গলা চড়াইয়া হাঁক দিলেন, ‘আসামীকে দেখেছি। শিগ্‌গির এস—জলদি—!

মুহূর্তের মধ্যে পঞ্চাশজন লোক আসিয়া গাছ ঘিরিয়া ফেলিল।

আসামী তবু গাছ হইতে নামিতে চায় না। ডি এস পি তখন কয়েকবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করিয়া বলিলেন, ‘আবদুল্লা, যদি স্বেচ্ছায় নেমে না আসো, তোমাকে গাছের ওপরেই গুলি করে মারব।’

অবশেষে আবদুল্লা নামিয়া আসিল। কয়লার মতো কালো লিকলিকে একটা লোক, পরনে শুধু একটা নীল রঙের লুঙ্গি। পুলিস তাহার হাতে হাতকড়া পরাইল, সে বাধা দিল না। কেবল তাহার বিষাক্ত হিংস্র দৃষ্টি গোকুলবাবুর উপর স্থির হইয়া রহিল।

পুলিস আবদুল্লাকে টানিয়া লইয়া চলিয়া গেল। কিছুদিন পরে গোকুলবাবু খবর পাইলেন আবদুল্লার ফাঁসি হইয়া গিয়াছে।

ইহা এক বছর আগের ঘটনা।

বন্দুক কাঁধে তুলিয়া গোকুলবাবু আর একবার গাছটিকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিলেন। হ্যাঁ, এই গাছ হইতেই তিনি আবদুল্লাকে ধরিয়াছিলেন; ওই যে ডালটা, যাহার গায়ে তাহার কালো দেহটা গিরগিরিটর মতো জড়াইয়া ছিল। কিন্তু আজ পিছনে অতর্কিতে টান পড়ায় তাঁহার বুক ধড়াস করিয়া উঠিল কেন? তাঁহার মনে কুসংস্কার নাই, লজিকের ফাঁদে যাহা ধরা যায় না তাহা তিনি বিশ্বাস করেন না। তবে? নিশ্চয় গত বৎসরের ঘটনাটা তাঁহার অবচেতন মনে সঞ্চিত হইয়াছিল। মনের অনাবশ্যক জঞ্জাল। মানে হয় না।

তিনি আবার চলিলেন। শীতের সূর্য আর একটু পশ্চিমে ঢলিয়াছে, রৌদ্রের রঙ পীতাভ হইয়াছে। গোকুলবাবু দ্রুত পা চালাইলেন; বনের ওদিকটা দেখিয়া তাড়াতাড়ি ফিরিতে হইবে। বনের মধ্যে রাত্রি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

আরও মাইলখানেক গিয়া গোকুলবাবু দাঁড়াইলেন। দুত্তোর! আর টো টো করিয়া কি হইবে? সব পাখি পালাইয়াছে। এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়া গেলেই ভাল। গোকুলবাবু অসংখ্যবার শিকারে আসিয়াছেন, কিন্তু নিষ্ফল যাত্রা কখনও হয় নাই।

তিনি ফিরিবার জন্য পা বাড়াইয়াছেন, এমন সময়—

কোঁকর কোঁ!

গোকুলবাবু বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় পাশের দিকে ফিরিলেন।

পাশের দিকে লম্বা খানিকটা খোলা জমি, গাছপালা নাই। তাহার অপর প্রান্তে প্রায় দুই শত গজ দূরে একটা শুষ্ক মৃত শেওড়া গাছ নিষ্পত্র ডালপালা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। এত দূর হইতে স্পষ্ট দেখা না গেলেও শেওড়া গাছের মাথায় হাঁড়ির মতো কি একটা রহিয়াছে। গোকুলবাবু চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া দেখিতে লাগিলেন। মোরগই মনে হইতেছে। বন-মোরগ! শিকারীর কাছে বন-মোরগের মতো লোভনীয় পাখি আর নাই। গোকুলবাবু জানিতেন এ বনে মোরগ আছে, কিন্তু কোনও দিন মারিতে পারেন নাই।

এই সময় গাছের চুড়ায় হাঁড়িটা গলা উঁচু করিয়া আবার ডাকিয়া উঠিল—কোঁকর কোঁ।

আর সন্দেহ রহিল না। একটা চাপা উত্তেজনা গোকুলবাবুর স্নায়ুমণ্ডলকে ধনুর্গুণের মতো টান করিয়া দিল। তিনি দূরে বৃক্ষশীর্ষে দৃষ্টি রাখিয়া কাঁধ হইতে বন্দুক নামাইলেন, পকেট হইতে চার নম্বরের একটি টোটা লইয়া বন্দুকে ভরিলেন; তারপর বন্দুক হস্তে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে অগ্রসর হইলেন।

একশো গজের মধ্যে পৌঁছিয়া তিনি মোরগটাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন। প্রকাণ্ড মোরগ, যেন একটা ময়ূর। কুচকুচে কালো গায়ের পালক, তাহার উপর রৌদ্র পড়িয়া ঝক্‌মক্‌ করিতেছে, পুচ্ছের ময়ূরকণ্ঠী পালকগুলি বক্রভাবে উদ্যত হইয়া আছে। মোরগ সগর্বে গলা উঁচু করিয়া এদিক ওদিক চাহিতেছে। গোকুলবাবুর শরীরের ভিতর উত্তেজনার একটা শিহরণ খেলিয়া গেল।

তাঁহার বন্দুকের পাল্লা একশো গজ, মোরগটা পাল্লার মধ্যে আসিয়াছে। কিন্তু গোকুলবাবু সাবধানী লোক, একশো গজ দূর হইতে ছর্‌রা এদিক ওদিক নিক্ষিপ্ত হয়, লক্ষ্যে না লাগিতে পারে। তিনি অতি সন্তর্পণে এক পা এক পা করিয়া অগ্রসর হইলেন। কাছে-পিঠে গাছ থাকিলে ভাবনা ছিল না, কিন্তু গাছ নাই; তাঁহাকে খোলা মাঠ দিয়া অগ্রসর হইতে হইল।

আরও পঁচিশ গজ গিয়া তিনি থামিলেন। এইবার বেশ পাল্লার মধ্যে আসিয়াছে, আর লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবার ভয় নাই। তিনি ধীরে ধীরে বন্দুক তুলিলেন।

কিন্তু টিপ করিয়া ঘোড়া টিপিবার আগেই মোরগটা ফর্‌ফর্‌ শব্দ করিয়া উড়িয়া গেল।

মোরগ জাতীয় পাখি ভাল উড়িতে পারে না, তাহাদের ওজনের তুলনায় পাখনা ছোট। কিন্তু উঁচু হইতে লাফাইয়া পাখনার সাহায্যে অক্ষত দেহে মাটিতে নামিতে পারে। মোরগটা পাখনা নাড়িতে নাড়িতে মাটিতে নামিয়া কোঁক কোঁক শব্দ করিতে করিতে একদিকে ছুটিল। গোকুলবাবু দেখিলেন, প্রায় একশো গজ গিয়া মোরগটা একটা গাছের তলায় দাঁড়াইল, তারপর যেন কিছুই হয় নাই এমনিভাবে গাছের নিচু ডালে উঠিয়া ডাকিল—কোঁকর কোঁ।

গাছের তলায় ছায়া-ছায়া, তবু মোরগটাকে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। গোকুলবাবু বিড়াল পদক্ষেপে অগ্রসর হইলেন। তাঁহার বাহ্যজ্ঞান নাই, সমস্ত ইন্দ্রিয় ওই পাখিটির উপর কেন্দ্রীভূত হইয়াছে। তিনি আবার তাহার পাল্লার মধ্যে উপস্থিত হইলেন।

কিন্তু এবারও বন্দুক তোলার সঙ্গে সঙ্গে মোরগ উড়িয়া গেল। বেশীদূর গেল না, ঠিক পাল্লার বাহিরে গিয়া একটা ঝোপের পাশে দাঁড়াইল। গলা উঁচু করিয়া ব্যঙ্গভরে ডাকিল, কোঁকর কোঁ।

গোকুলবাবু আবার চলিলেন, নিয়তির চুম্বক তাঁহাকে টানিয়া লইয়া চলিল।

ক্রমে সূর্য বনের আড়ালে ঢাকা পড়িল, চারিদিক ছায়াচ্ছন্ন হইয়া আসিল। গোকুলবাবুর সেদিকে লক্ষ্য নাই, তিনি মোহগ্রস্তের মতো মোরগের পিছনে চলিয়াছেন।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও তিনি মোরগটাকে মারিতে পারিলেন না। যতবার পাল্লার মধ্যে আসেন ততবার বন্দুক তোলার সঙ্গে সঙ্গে মোরগ পলাইয়া যায়। তাহার অনুসরণ করিয়া তিনি কোন দিকে চলিয়াছেন তাহাও তাঁহার লক্ষ্য নাই। কেবল একাগ্র ব্যগ্রতায় পাখির পিছনে চলিয়াছেন।

একবার তাঁহার মনে হইল গাছপালার ওপারে ধোঁয়া উঠিতেছে, তাহার মনের উপর অস্পষ্ট ছায়া পড়িল, বনের কিনারে কোনও গ্রামের কাছে আসিয়া পড়িয়াছেন। দিনের আলো দ্রুত নিভিয়া আসিতেছে, চারিদিকের গাছপালা আবছায়া হইয়া গিয়াছে। তবু কালো মোরগটাকে পরিষ্কার দেখা যায়—

হঠাৎ মোরগটা থামের মতো একটা উঁচু জায়গায় উঠিয়া তীব্রকণ্ঠে ডাক দিল। গোকুলবাবু দেখিলেন, একটা গোরস্থান। গ্রাম্য গোরস্থান, অধিকাংশ কবরই মাটির, ইটের কবর যে দুই-চারিটা আছে তাহাও চুন-সুরকি খসিয়া জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। কেবল একটা গোর নূতন, তাহার গায়ের চুনকাম সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। সেই গোরের শিরঃস্তম্ভের উপর মোরগটা গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে।

গোকুলবাবু শীর্ণ একটা নিশ্বাস টানিলেন। অন্ধকারে পাল্লা বোঝা যায় না, তবু ষাট সত্তর গজের বেশী নয়। গোকুলবাবুর বুক উত্তেজনায় দুরুদুরু করিয়া উঠিল। এবার ফস্‌কাইলে আর মোরগ মারা যাইবে না।

সামনে বাঁ পাশে একটা বড় ফণী-মনসার ঝোপ। সেটার আড়ালে গিয়া দাঁড়াইতে পারিলে—

গোকুলবাবু কোণাচে ভাবে ফণী-মনসার ঝোপের দিকে চলিলেন, দৃষ্টি মোরগের দিকে। তারপর হঠাৎ ঝোপের দিক হইতে একটা সর্‌সর্‌ শব্দ শুনিয়া মোরগের উপর হইতে তাঁহার দৃষ্টি, সরিয়া গিয়া ঝোপের উপর পড়িল।

ঝোপের ভিতর হইতে একটা কালো মানুষের মুখ বাহির হইয়া আসিতেছে। নিষ্ক্রান্ত দন্ত, চক্ষু দুটা অপার্থিব হিংসায় জ্বলিতেছে। দুই হাতে ফণী-মনসার কাঁটা সরাইয়া মূর্তি বাহির হইয়া আসিল। কয়লার মতো কালো গায়ের রঙ, পরনে নীল রঙের লুঙ্গি।

নরঘাতক আবদুল্লা! তাহার অভিপ্রায় সম্বন্ধেও সংশয়ের অবকাশ নাই। গোকুলবাবু দ্বিধা করিলেন না, বন্দুক তুলিয়া ফায়ার করিলেন আবদুল্লার মুখে।

কিন্তু কিছুই হইল না। আবদুল্লা অগ্রসর হইয়া আসিতে লাগিল। গোকুলবাবু ক্ষণেক হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। তারপর যে কথাটা সঙ্কটকালে তিনি ভুলিয়া গিয়াছিলেন তাহা মনে পড়িয়া গেল। আবদুল্লার ফাঁসি হইয়া গিয়াছে, সে বাঁচিয়া নাই!

গোকুলবাবুর হৃৎপিণ্ডটা একবার উন্মত্তভাবে লাফাইয়া উঠিল। তাঁহার যুক্তিনিষ্ঠ মস্তিষ্কে শেষবারের জন্য চিন্তার ছাপ পড়িল—মানে হয় না।

২৬ ভাদ্র ১৩৬৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *