1 of 2

কালী কলকাত্তেওয়ালী

কালী কলকাত্তেওয়ালী 

‘কালী কলকাত্তেওয়ালী’। উত্তর ভারতের লোকদের কাছে কালীঘাটের কালীর এটাই হচ্ছে অভীধা। এই অভীধা থেকেই কালীঘাটের কালীর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। কালীঘাটের কালীই হচ্ছে কলকাতার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। মন্দিরটির এখন যেখানে অবস্থান, জনশ্রুতি অনুযায়ী মন্দিরটি আগে ওখানে ছিল না। এখন মন্দিরটি আদিগঙ্গার তীরে অবস্থিত। ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে মন্দিরটি নাকি ভবানীপুরে ছিল। তবে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল রচনার সময় মন্দিরটি যে আদিগঙ্গার তীরেই অবস্থিত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

কালীঘাটকে একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ বলে ধরা হয়। কিন্তু আমার ‘কলকাতা বইয়ে (পৃষ্ঠা ৩৬) দেখিয়েছি যে পীঠস্থান হিসাবে কালীঘাটের স্বীকৃতি খুব আধুনিক কালের। সকলেরই জানা আছে যে পীঠস্থানসমূহের উদ্ভবের সঙ্গে বিষ্ণু কর্তৃক শিবের স্কন্ধস্থিত সতীর শবদেহ বহুখণ্ডিত হবার কাহিনী জড়িত। কিন্তু সতীর দেহখণ্ড যেখানে যেখানে পড়েছিল, সেই সব স্থান এক একটা পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল, এ কাহিনী আমরা সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত ‘কালিকাপুরাণ’-এ প্রথম পাই। আগেকার পুরাণসমূহে আমরা দক্ষযজ্ঞের যে কাহিনী পাই, তাতে এটা নেই। কালিকাপুরাণেই এ কাহিনী প্রথম স্থান পায়। তবে ‘কালিকাপুরাণ’-এ মাত্র সাতটি পীঠস্থানের নাম আছে। এ সাতটি পীঠস্থান হচ্ছে দেবীকূট, উড্ডিয়ান, কামরূপ, জলন্ধর, পূর্ণগিরি ইত্যাদি। তারপরে রচিত ‘রুদ্রযামল’ তন্ত্রে ১৮টি, কুব্জিকাতন্ত্রে ৪২টি ৬ জ্ঞানানবতন্ত্রে ৫০টি পীঠের নাম পাই। ৫১ টি পীঠের উল্লেখ আমরা তন্ত্রসার, পীঠমালা ও অন্যান্য অর্বাচীন গ্ৰন্থসমূহে পাই। এগুলো সবই সপ্তদশ শতাব্দী বা তার পরে রচিত। পীঠমালা অনুযায়ী কালীঘাটে দেবীর দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পড়েছিল। 

মনে হয় কালীঘাটের কালীমাতা প্রথমে এক চালা ঘরের মধ্যে অধিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বেহালার সাবর্ণ চৌধুরীদের সন্তোষ রায় বর্তমান মন্দির তৈরী করে দেন। বর্তমান মন্দিরটি ৭৫ ফুট চতুষ্কোণ আয়তন বিশিষ্ট এক পাদপীঠের ওপর দণ্ডায়মান এবং উচ্চতায় ৯০ ফুট। দক্ষিণ দিকে একটি প্রশস্ত নাটমন্দির আছে ও মন্দিরের মধ্যে আরও অনেকগুলি ছোট ছোট মন্দির আছে, যাদের মধ্যে শ্যামরায়ের মন্দির প্রসিদ্ধ। মোট আয়তন এক বিঘা এগার কাঠা তিন ছটাক। 

যেখানে কালী, সেখানেই শিব। সেজন্য প্রতি পীঠস্থানেই শক্তি মন্দিরের কাছে, একটি করে শিব বা ভৈরবের মন্দির থাকে। কালীঘাটের ভৈরব নকুলেশ্বর। নকুলেশ্বরের মন্দির কালীমন্দিরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। নবনির্মিত বড় রাস্তা এটাকে কালীমন্দির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। নকুলেশ্বরের বর্তমান মন্দির ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে তারাসিং নামে এক পাঞ্জাবী বণিক তৈরী করে দিয়েছিল। শিবরাত্রির ও নীলষষ্ঠীর দিন এখানে পূজা দেবার জন্য বহু নরনারীর সমাগম হয়। আগে মহাসমারোহে এখানে গাজন উৎসব হত। ফ্যানী পার্কস্ বলে গেছেন যে শহরের বারবনিতারাও কেরাঞ্চী গাড়ী করে এই উৎসবে যোগদান করতে যেত। 

কালীঘাট ছাড়া কলকাতার আর এক পুরানো কালীমন্দিরের কথা আমরা ইতিহাসে পড়ি। এটা হচ্ছে কলকাতার কালেকটর সাহেবের সহকারী গোবিন্দরাম মিত্র কর্তৃক নির্মিত মন্দির। বৈধ ও অবৈধ উপায়ে গোবিন্দরাম প্রভূত অর্থ উপার্জন করে কলকাতার সমাজে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়েছিলেন। ১৭২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গঙ্গার ধারে কুমারটুলিতে বসতবাড়ী ও নয়চূড়াবিশিষ্ট এক সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির স্থাপন করেছিলেন। উচ্চতায় এই মন্দির (১৬৫ ফুট) পরবর্তীকালীন শহীদ মিনারের (উচ্চতা ১৫২ থেকে ১৫৮ ফুট) চেয়েও বড় ছিল। এই মন্দিরটাই কলকাতার এক দিকচিহ্ণ ছিল, এবং জাহাজের নাবিকরা এটাকে ‘দি প্যাগোডা’ বলে অভিহিত করত। ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের ঝড়ে, এর শিখরের খানিকটা পড়ে যায়। সেটা মেরামত করে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দের ঝড়ে মন্দিরটা ধ্বসে পড়ে। তারপর এর আর বিশেষ সংস্কারের চেষ্টা হয় নি। এখানে উল্লেখনীয় যে গোবিন্দরামের মন্দির সম্বন্ধে এক বিতর্ক আছে। অনেকে বলেন যে গোবিন্দরামের মন্দিরটা ছিল শিব মন্দির, আর বনমালী সরকার তৈরী করেছিলেন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। কোনটা কি, তা এখন বলা খুবই মুস্কিল। কেননা, আমরা জানি যে কাছাকাছি স্থানে, বাগবাজারে বর্তমান সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকে চিৎপুর রোডের ওপর একটা জোড়-বাংলা মন্দির ছিল, যেটাকে লোকে ‘ডাকাতে কালী’র মন্দির বলত। ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ঝড়ে এই মন্দিরটা ভূমিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। 

তবে পুরানো কলকাতার অনেক কালীমন্দির এখনও বিদ্যমান আছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিমতলার আনন্দময়ীর মন্দির, বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীর মন্দির, ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বৌবাজারের ফিরিঙ্গি কালী প্রভৃতি। যদিও খাস কলকাতার মধ্যে অবস্থিত নয়, তা হলেও চিত্তেশ্বরী কালীর উল্লেখও এখানে প্রয়োজন। 

বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে। পুরানো মূর্তিটি পাথরের তৈরী ছিল। সেটা এখনও মন্দিরের মধ্যে রক্ষিত। কিন্তু বর্তমান মূর্তি মাটির তৈরী ও উচ্চতায় ৭ ফুট। পুরানো মন্দিরটা নাকি গঙ্গার ধারে ছিল। তার আকার আমাদের জানা নেই। বর্তমান মন্দিরটি দালান রীতিতে গঠিত ও অনেক পরে নির্মিত হয়েছিল। কালীর দুপাশে দুটি শিবলিঙ্গ আছে। 

নিমতলার আনন্দময়ীকে শ্মশান কালী বলা হয়, কেননা এক সময় এটা শ্মশানের মধ্যেই অবস্থিত ছিল। কথিত আছে যে এক মোহন্ত এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ওই মোহন্তর জগন্নাথ নামে এক শিষ্য ছিল। তার খড়ের ব্যবসা ছিল। মোহন্ত তাঁর মৃত্যুর সময় দেবীকে জগন্নাথের হাতে সমর্পণ করে যান। কিছুদিন পরে অর্থসঙ্কটের সম্মুখীন হলে জগন্নাথ, নারায়ণ মিশ্র নামে এক ভক্তকে সংলগ্ন জমিসমেত মূর্তিটি বেচে দেন। নারায়ণ মিশ্রের মৃত্যুর পর তার ছেলে হরদেব মিশ্র মন্দিরের অধিকারী হয়। হরদেবের মৃত্যুর পর মন্দিরটি তার ভাগিনেয় ও নিমতলা স্ট্রীটের জমিদার মাধবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে আসে। মাধবচন্দ্রের মৃত্যুর পর তস্য পুত্র শিবকৃষ্ণ ও তারপর তার পুত্র ননীলাল ও তারপর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অন্যান্যরা মন্দিরের স্বত্বাধিকারী হন। মা আনন্দময়ীর মূর্তি শবের ওপর আরূঢ় ও কালো পাথরের তৈরী। উচ্চতায় দু ফুট। রাস্তা উঁচু হওয়ায় মূর্তিটি এখন অনেক নীচে নেমে গেছে। বহু চেষ্টা করেও মূর্তিটিকে ওপরে তোলা সম্ভবপর হয় নি। 

যে শ্মশানের মধ্যে মা আনন্দময়ীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আগে ওটা গঙ্গার ধারেই ছিল। তারপর গঙ্গায় চড়া পড়বার পর যখন ষ্ট্রাণ্ড রোড তৈরি হল, তখন মন্দির শ্মশান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। 

নিমতলার প্রাচীন শ্মশানটি জলমগ্ন হওয়ায় শহরবাসী হিন্দুদের শবদাহ সম্বন্ধে ক্লেশের পরিসীমা ছিল না। এ সম্বন্ধে ১ জুলাই ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দের ‘সংবাদচন্দ্রিকা’য় লেখা হয়— ‘এ শহরে হিন্দু লোক দুই লক্ষ হইতে পারে। প্রতিমাসে আন্দাজ তিন শত লোক মরিয়া থাকে। কাশি মিত্রের ঘাটে গড়ে দশ জনের দাহ হয়। কোন কোন সময়ে প্রতিদিন ২০ কুড়ি ২৫ পঁচিশ জন মরে। আর ওলাউঠা হইলে ইহার দ্বিগুণ ত্রিগুণ চতুর্গুণ মরিয়া থাকে।….যত লোক মরে বা যত শব কলিকাতার ঘাটে জ্বালায় তাদের উপর নিশ্চিত কর স্থাপন করিয়া তদুৎপন্ন অর্থ সংগ্রহ করিয়া গঙ্গাতীরে রাস্তার ধারে জলের ভিতর ভিত্তি উঠাইয়া তিন দিকে দেওয়াল দেওয়াইয়া দুইটি চত্বর নির্মিত করা যায় তাহাতে পশ্চিম দিক খোলা থাকে পোতা মৃত্তিকাতে ভরাট হয় তাহাতে ঐ শবদাহ কার্য হয়।” তারপর ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে ‘নিমতলা হইতে বাগবাজার পর্যন্ত তিনটা শবদাহের নিমিত্ত স্থান হইবেক ও তাহা সম্পূর্ণার্থে এই শহরের ভাগ্যবান লোকদিগের মধ্যে একটা চাঁদা হইয়াছে।’ ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দের ২২ মার্চ তারিখের শেষ সংবাদে প্রকাশ—‘অবগত হওয়া গেল যে মোং নিমতলার ঘাটে যে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার স্থান নির্মিত হইতেছিল, তাহা এক্ষণে প্রস্তুত হইয়াছে বিশেষতঃ গত সোমবার অবধি ঐ স্থানে শবের সৎকার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহাতে অনেকের পরিশ্রম দূর হইয়াছে।’ এই সংবাদ হতে বুঝতে পারা যায় যে বর্তমান নিমতলা ঘাটে ইংরেজি ১৭ মার্চ ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ বা ৬ চৈত্র ১২৩৪ সন হতে শবদাহ শুরু হয়েছে। পরবর্তীকালে বহু অর্থব্যয়ে পোর্ট কমিশনাররা নিমতলা ঘাটের ইমারত তৈরী করে দেয়। রানী রাসমণির স্বামী রাজচন্দ্র ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এখানে গঙ্গাযাত্রীদের জন্য একটা ঘর তৈরী করে দেন। ১৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দের ‘ঐতিহাসিক’ পত্রিকায় (পৃষ্ঠা ৭ ) শ্রীরাধারমণ মিত্র মশায় লিখেছিলেন যে কাশী মিত্রের ঘাটে বিভিন্ন হাসপাতালের কাটাছেঁড়া মড়া পোড়ানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এরূপ মড়া পোড়ানো হয় নিমতলা ঘাটে। আমি রাধারমণ বাবুর ঐ ভুল সংশোধন করে দিই। (‘গঙ্গার ঘাট’ পৃষ্ঠা ৬৯ দ্রষ্টব্য) 

১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে চিত্তেশ্বরী মন্দির নির্মিত হয় বলে মন্দিরের মাথায় লেখা আছে। মন্দিরটা গান ফাউণ্ডারী রোডে অবস্থিত। পূর্বে ডাকাতরা চিত্তেশ্বরী আরাধনা করে তবে ডাকাতি করতে বেরুত। ডাকাতদেরই এক সরদারের নাম ছিল চিতে। জনশ্রুতি তার নাম থেকেই চিত্তেশ্বরী নামের উদ্ভব। কিন্তু কিংবদন্তী অনুযায়ী মনোহর ঘোষ ওরফে মহাদেব ঘোষ চিত্তেশ্বরী দেবী প্রতিষ্ঠা করেন। মনোহর ঘোষের মৃত্যু হয় ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। এই চিত্তেশ্বরীর নাম থেকেই চিৎপুর নামের উৎপত্তি। কলিকাতা কালেকটরের ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দের এক পাটা অনুযায়ী চিৎপুর ছিল আমিরাবাদ পরগণার অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি বীরেন রায় মশায় তাঁর ‘ক্যালকাটা’ বইয়ে ১৬১৬ খ্রীষ্টাব্দের চিত্তেশ্বরী মন্দিরের একটা ছবি দিয়েছেন। ১৬১৬-তে ইংরেজরা বাঙলা দেশে আসে নি। সুতরাং ওটা কোন ইংরেজ শিল্পীর আঁকা ছবি নয়। ছবিটা কোন্ দেশীয় শিল্পীর আঁকা এবং তাঁর নাম কি এটা না জানা পর্যন্ত ওই ছবিটার প্রামাণিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ করবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। 

ঠনঠনিয়ায় অবস্থিত সিদ্ধেশ্বরী কালী উদয়নারায়ণ নামে এক ব্রহ্মচারী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনিই দেবীর পুরোহিত ছিলেন। বর্তমান মন্দিরের গায়ে ১১১০ সাল লেখা আছে। ইংরেজি হিসাব অনুযায়ী এ তারিখ দাঁড়ায় ১৭০৯ খ্রীষ্টাব্দ। অনেকে এটাকেই মন্দির নির্মাণের তারিখ ধরে নিয়েছেন। তা যদি হয় তা হলে বলতে হবে যে গোবিন্দরাম মিত্রের কুমারটুলির নয় চূড়া বিশিষ্ট সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের (আগে দেখুন) চেয়েও এটা পুরানো। কিন্তু আমার মনে হয় তারিখটা সন্দেহজনক। বোধ হয় এটা কোন রকমে গুলিয়ে গেছে, শঙ্কর ঘোষ যখন বর্তমান মন্দির তৈরী করে দেন তার সঙ্গে। কেননা, বাংলা সন ১২১০ সালে ঠনঠনিয়ার শঙ্করচন্দ্র ঘোষ (যার নাম থেকে শঙ্কর ঘোষ লেনের নাম হয়েছে) দেবীর বর্তমান মন্দির তৈরী করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দ-মুসলমান দাঙ্গার সময় মন্দিরটাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে। ঠনঠনিয়ার দেবীমূর্তি মাটির তৈরী। এর গায়েই এক শিব মন্দির আছে। 

২৪৪ নং বৌবাজার ষ্ট্রীটে (এখন বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট) ‘ফিরিঙ্গি কালীর মন্দির অবস্থিত। এখানেও কালী মন্দিরের গায়ে একটা শিবমন্দির আছে। এই কালীর প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে নানারূপ জনশ্রুতি আছে। এক জনশ্রুতি অনুযায়ী শ্রীমন্ত নামে এক ডোম এই কালী প্রতিষ্ঠা করে, এবং নিজেই এর পূজারী ছিল। এই ডোম বসন্তের চিকিৎসা করত, এবং সেজন্য মন্দিরের মধ্যে একটি শীতলা মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেছিল। বসন্ত রোগাক্রান্ত স্থানীয় ফিরিঙ্গি বাসিন্দারা শ্রীমন্তের শরণাপন্ন হত, এবং নিরাময় হলে দেবীর পূজা দিত। সেজন্যই এর নাম ফিরিঙ্গি কালী। অপর জনশ্রুতি অনুযায়ী কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই কালী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং সেজন্যই এর নাম ফিরিঙ্গি কালী। বর্তমান সেবাইতরা ব্রাহ্মণ। 

উত্তর কলকাতায় আরও অনেক কালীমন্দির আছে। যথা, 

১। বরানগরে জয় মিত্রের কালীমন্দির, 

২। বাগবাজারে চিৎপুর খালের পুলের নিকট ব্যোমকালী মন্দির, ৩। বাগবাজার ষ্ট্রীটের শেষে বাগবাজারের কালী, 

৪। শ্যামবাজার বাজারের গায়ে জয়কালীর মন্দির, 

৫। শ্যামপুকুর থানার পশ্চিমে কম্বুলিয়াটোলার কালী, 

৬। চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যু ও রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রীটের সংযোগস্থলে লাল মন্দিরের কালী ইত্যাদি। 

উপকণ্ঠে অবস্থিত দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালী ইদানীংকালে এত জনপ্ৰিয়তা লাভ করেছে যে, ওর সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ১২৬২ বঙ্গাব্দের ১২ জ্যৈষ্ঠ স্নানযাত্রার দিন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন জানবাজারের রাজচন্দ্র মাড়ের বিধবা রানী রাসমণি। এর প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটা খুব চমকপ্রদ। রানী যাচ্ছেন কাশী, দর্শন করতে অন্নপূর্ণাকে ও মহাভিক্ষুক বিশ্বনাথকে। যাচ্ছেন রাজরানীর মত। সঙ্গে একশখানা নৌকা, নানা সামগ্রীতে ভরা। রানী দুহাতে সে সব বিলোবেন। সঙ্গে আরও যাচ্ছে শত শত দাসদাসী ও আত্মীয় পরিজন। উত্তরে দক্ষিণেশ্বর গ্রাম পর্যন্ত এসেছেন,—স্বপ্ন দেখলেন রানী রাসমণি। দেখলেন দেবী ভবতারিণী নিজে এসে দাঁড়িয়েছেন। বলছেন, ‘কাশী যাবার দরকার নেই। এই ভাগীরথীর পারেই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। আমাকে অন্নভোগ দে।’ রানীর আর কাশী যাওয়া হল না। এক লপ্তে কিনলেন ষাট বিঘে জমি। জমিটা ছিল হেষ্টি নামে এক সাহেবের, আর বাকীটায় ছিল মুসলমানদের এক কবরখানা ও গাজী পীরের থান। জমির গড়নটা ছিল কচ্ছপের পিঠের মত। তন্ত্র মতে নাকি ওরকম জমিই শক্তি সাধনার অনুকূল। এরকম জমি পাওয়াতে, রানী নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন বটে, কিন্তু এক সঙ্কট দেখা দিল। কলকাতার পণ্ডিতসমাজ পাতি দিল শূদ্রাণীর অধিকার নেই দেবতাকে ভোগ দেবার। সে সঙ্কট থেকে, রানীকে বাঁচান ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠীর রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিধান দিলেন প্রতিষ্ঠার আগে রানী যদি দক্ষিণেশ্বরের যাবতীয় সম্পত্তি কোন ব্রাহ্মণকে দান করেন, তবে অন্নভোগ চলতে পারে। এই পাতি পাবার পর রানী ঠিক করলেন তাঁর গুরুর নামে মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু পূজক হবে কে? তাঁর গুরু বংশের কেউ পূজা অর্চনা করে, এটা রানীর অভিপ্রায় ছিল না। কেননা, তাঁরা সবাই অশাস্ত্রজ্ঞ, আচার সর্বস্ব। কিন্তু কোন ব্রাহ্মণই পূজা করতে রাজী হল না। সে বিপদেও উদ্ধার করলেন রামকুমার। তিনি বললেন, পূজকের অভাবে মন্দির যখন প্রতিষ্ঠা হয় না, তখন বেশ আমিই পূজক হব। রামকুমারই পূজক হলেন ও তারপর তাঁর ভাই গদাধর—রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। এখানে বলা দরকার যে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী পাষাণময়ী। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *