1 of 2

কার হাত? – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

কার হাত? – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়। কাগজের অফিসে, কাজের চাপ থাকলে যা হয়। কোনো খবর বাদ না যায়, আবার গুরুত্ব পাবে কোন খবর, কী মেইন হবে, সেকেন্ড মেইন কিংবা আরও সব দেখে শুনে মোটামুটি কাগজের প্রথম পাতার লে—আউট দেখে ফিরতে হয়। অফিস থেকে গাড়িতে ঘণ্টা খানেকের পথ। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা কখনো বারোটা হয়। একমাত্র স্ত্রী এবং রান্নার লোকটা বাদে অত রাত পর্যন্ত কেউ জেগে থাকে না। কোনোদিন মেজো ছেলে পড়াশোনার চাপ থাকলে জেগে থাকে। কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরে দেখছি সবাই জেগে। রাত নেহাত কম হয়নি। দু—পাশের বাড়ি ঘরের আলো নেভানো। শুধু রাস্তার আলো জ্বলছে। আর মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুরগুলি এলোপাথাড়ি দৌড়চ্ছে। কখনো ঘেউ ঘেউ করছে। গেট খুলে দেয় রান্নার লোকটা। দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখি ছোটো মেয়ে দৌড়ে আসছে। কাছে এসেই বলল, জানো মেজদা না সেই কঙ্কালটা নিয়ে এসেছে!

আমি জানি এটা আনার কথা। বিস্ময়ের কিছু নেই। ডাক্তারি পড়তে গেলে ও—সব লাগে। তবে বিস্ময় না থাকলেও মনের মধ্যে কেমন একটা খিঁচ ধরে গেল। শত হলেও নিজের বাড়ি বলে কথা। তাছাড়া সংস্কার যাবে কোথায়। বললাম, কোথায় রেখেছে ওটা?

দাদার খাটের নীচে।

খাটের নীচে রাখতে গেল কেন? সিঁড়ির চাতালে রেখে দিলেই পারত! সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, এসব বলা বোধহয় ঠিক হল না। কঙ্কালটা সম্পর্কে আমারও ভীতি আছে—এই কঙ্কাল নিয়ে আসার ব্যাপারে বাড়িতে কিছুটা ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি গিন্নি এবং ছোটোমেয়ে সোনালির! একদিন খেতে বসে সমীর কঙ্কালের কথা তুলতেই, খাওয়া পাত থেকে সোনালি উঠে পড়েছিল—আর সময় পেলি না মেজদা।

সমীর অবাক। সে বলেছিল, তোদের বাড়াবাড়ি!

খেতে বসে সমীরের সাহস দেখে আমার বেশ গর্বই হয়েছিল। এইতো তার আঠারো পার হয়েছে। কঙ্কাল সম্পর্কে ওর কোনো খিঁচ নেই। ডাক্তারি পড়তে গেলে ও—সব থাকলে হয়ও না। কিন্তু তাই বলে খাটের তলায় রেখে ওপরে সে ঘুমোবে ভাবতেও আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল।

যেন কিছুই না ব্যাপারটা, আমি জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে ঢুকতে গেলে সোনালি ফের বলল, বাবা তুমি কঙ্কালটা দেখবে না?

ওটা আবার দেখার কী আছে!

স্ত্রী বলল, সমীরের ঘরে তুমি বরং আজ শোও। ও একা থাকবে!

সমীর বোধ হয় দোতলার ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলল, তোমাদের কী হচ্ছে।

আমিও বললাম, ওটাতে তো আর কিছু নেই! ভয়ের কি?

বাড়িটায় লোকের চেয়ে ঘরের সংখ্যা বেশি এক এক ঘর এক এক জনের। কেবল, নীচের ডাইনিং স্পেসে রান্নার লোকটা শোয়। সোনালি নিজের ঘরে শুতে যায়নি। সে তার মা—র সঙ্গে শোবে বলে বায়না ধরে বসে আছে। একা কোনো ঘরে ঢুকছে না।

আমি জানি এসব কুসংস্কার থাকা ভালো না। আসলে কঙ্কালটা আসায় বাড়িতে বেশ একটা ভূতুড়ে পরিবেশ যেন সৃষ্টি হয়ে গেছে। এসব ভালো লক্ষণ না। সুস্থতার লক্ষণ না। বললাম চল কঙ্কালটা দেখি।

আমি যাব না বাবা! তুমি যাও।

সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতেই দেখি সমীর উবু হয়ে বেতের ঝুড়ি থেকে একটা হাড় টেনে বের করছে। বোধ হয় সে মিলিয়ে দেখছে, সবগুলি হাড় ঠিক ঠিক সে পেয়েছে কি না। আমাকে দেখেই হাড়টা তুলে বলল, বল তো এটা কোথাকার হাড়।

আমি কী করে জানব?

হাতের। হাড়টার নাম হিউমারাস।

হিউমারাস বলার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলের দিকে চোখ গেল। একটা পুরো আর্টিকুলেটেড হাতের কঙ্কাল টেবিলে। আঙুলগুলো ছড়ানো। সত্যজিৎবাবুর মণিহার ছবিতে এমন একটা হাতের কঙ্কাল ঝপাৎ করে পড়তে দেখেছিলাম। ঠিক সেইভাবে হাতের কঙ্কাল তার আঙুলগুলো ছড়িয়ে রেখেছে। ভেতরে কেমন যেন কেঁপে উঠলাম। কঙ্কালটা আলগা থাকলে এতটা বীভৎস লাগত না।

বললাম, সবই আলগা এনেছিস? এ—হাতটা কেন আবার জোড়া লাগানো!

সমীর বলল, যা পাব তাইতো আনব!

সোনালি নীচ থেকে বলছে, দেখলে বাবা?

দেখলাম তো! তুই আয় না। ভয়ের কি আছে?

ওরে বাববা। সে ছুটে পালিয়ে তার মায়ের কাছে বোধ হয় চলে গেল। সমীর হঠাৎ বলল, সোনা বড়ো জ্বালাতন করছে। মা—ও কেমন আমার ঘরে পা দিচ্ছে না বিকেল থেকে।

বিষয়টাকে হালকা করে দেবার জন্য বললাম, মানুষের সংস্কার যাবে কোথায়! কোথাকার কোন অপমৃত্যুর ফলে এটা হয়েছে কে জানে! গেরস্ত ঘরে এটা প্রথম প্রথম হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে জ্যান্ত আস্ত কঙ্কাল তো—আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, ভূতটুতের আশঙ্কায় তোমার মা কেমন ত্রস্ত। থাকতে থাকতে দেখবে, সব সয়ে গেছে। এটা যেই না ভাবা, অবাক, দেখি টেবিলের সেই কঙ্কালটা কেমন চকিতে কোনো নারীর সুন্দর সুগোল হাত হয়ে গেল এবং হাতে শাঁখা। আমি খুবই ঘাবড়ে গেছি। বদ হজম হবেটবে। চোখ ঝাপসা হতে পারে। ভালো করে দেখতেই বুঝলাম, ওটা কঙ্কালই! কঙ্কালের একটা হাত। তবু এটা কেন দেখলাম! মনের গোলমাল হতে পারে। বের হয়ে আসার মুখে বললাম, কঙ্কালটা কি মেয়েমানুষের?

সমীর বলল, হ্যাঁ। কেন বল তো?

সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, শীতের রাতেও আমি ঘামছি। তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলাম। বেশি কৌতূহলও প্রকাশ করতে পারছি না। আমি তো বাড়ির অবিভাবক, আমিই যদি ঘাবড়ে যাই তবে আর সব যাবে কোথায়। দীর্ঘকালের সংস্কার থেকে এ—সব হচ্ছে। ঝেড়ে ফেলা দরকার। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি।

বাথরুমে ঢুকে হাতে মুখে ভালো করে জল দিলাম। নীলাভ আলোটা জ্বলছে বাথরুমের। কেন যে এমন দেখলাম। স্পষ্ট চোখের উপর কোনো বিবাহিত নারীর হাত ভেসে উঠল কেন! বাথরুম থেকে বের হয়ে নীচে খেতে গেলাম। খাবার টেবিলে স্ত্রী পাশের চেয়ারে বসে এটা ওটা এগিয়ে দেয়। কী জানি কেন, ওর হাতের দিকে আমার চোখ গেল। চোখ সরাতে পারছি না। আমি যে খাচ্ছি না, স্ত্রী লক্ষ করে বলল, কী ব্যাপার আমার হাতে কী দেখছ!

কেমন বোকার মতো বললাম, না কিছু না।

কিন্তু ভেতরের খিঁচটা গেল না। রাতে কেন আমি ভালো ঘুমও হল না। পাশের ঘরে সমীর তার খাটের নীচে একটা কঙ্কাল। কেমন একটা অলুক্ষণে ব্যাপার ঘটে গেল চোখের ওপর—তা ছাড়া যদি সমীর ভয় টয় পায়—এসব দুশ্চিন্তায় প্রায় সারাটা রাতই এ—পাশ ও—পাশ করলাম। সাহসেও কুলাচ্ছে না যে যাব তার ঘরে। ঘর থেকে কঙ্কালের ঝুড়িটা চাতালে তুলে রাখব। যেন ও—ঘরে গেলেই হা হা করে তেড়ে আসবে হাতটা। হাওয়ায় কিংবা বাতাসে একটা কাটা হাত ভেসে বেড়াতে দেখলে, কিংবা টেবিলের ওপর পড়ে থাকলে কার না ভয় লাগে!

কাচের জানলায় দেখলাম, কখন পুব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। দিনের আলো ফুটতেই কেমন সব অস্বস্তি কেটে গেল। সমীর ঠিকঠাক আছে তো! ভিতরে ভয় ধরে যেতেই ওর ঘরের দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকে দেখি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছে সমীর। ওর মাথার কাছে সেই—হাতের কঙ্কালটা। ওটা তো টেবিলে ছিল, রাতে ওর মাথার কাছে এনে কে ওটা রাখল!

সমীরকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করতে পারি, হাতের কঙ্কালটা এখানে কে রাখল! কিন্তু সাত সকালে, সকালই বা বলি কি করে, এখনও অন্ধকার ভাবটা ভালো করে কাটেনি, আর এত সকালে তো আমি উঠি না—এসব মনে হতেই খুব সন্তর্পণে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম চোরের মতো। যদি জেগে গিয়ে দেখি আমি তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ—ঘাবড়ে যেতে পারে।

সকালে চা খাবার দিলে দেখলাম, সমীর স্নানে যাচ্ছে। আটটার মধ্যে কলেজে তাকে বের হতে হয়। ডাকলাম, শোন। কাছে এলে বললাম, হাড়—টাড় নিয়ে শুতে তোর ঘেন্না হয় না! ভয় কথাটা ইচ্ছা করেই বললাম না।—ওটা তো টেবিলে ছিল। ওখানে গেল কী করে? তুই রেখেছিস?

কী জানি, মনে করতে পারছি না।

এতে ধন্দ আরও বেড়ে যায়। —মনে করতে পারছিস না মানে।

আমার কথায় সমীর কেমন অবাক হয়ে গেল। আমার মুখে কি সে কোনো ত্রাস দেখতে পেয়েছে! সে বলল, আমার অত খেয়াল নেই।

বিষয়টা আর ঘাঁটালাম না। সে নীচে নেমে গেল। মনের মধ্যে ধন্দটা ঘুচছে না। অশরীরী আত্মা—টাত্মা নিয়েও তেমন আমার একটা বিশ্বাস নেই। কিন্তু নিজের চোখকে অবিশ্বাস করি কি করে। কেমন একটা বিপদের আশঙ্কা ভেতরে অনুভব করলাম। সমীরকে কলেজে যাবার সময় বললাম, আইডেনটিটি কার্ড নিয়েছিল তো! সাবধানে যাস। এসব আমি কোনোদিন দেখি না, কিংবা বলি না কিন্তু আজ কেন যে বলতে গেলাম।

আমাকে চারটায় বের হতে হয়। সকাল দশটায় সোনা বের হয়ে গেল। ওর মা বের হয়ে গেল সাড়ে দশটায়। এখন বাড়িতে আমি আর কাজের লোকটা। খুবই উচাটনে আছি। স্নান খাওয়া করতে হয় করা। সবাই ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে হয়। ওপরের ঘরে আর গেলামই না। গেলেই হাত দেখব না কঙ্কাল দেখব, এই আশঙ্কায় বেশ মিইয়ে গেছি। বাবা বেঁচে নেই। অশুভ আত্মা সম্পর্কে তাঁর একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বাড়ি করার পর, বাবা রক্ষাকালীর পূজা করে গেছেন। মাস তিনেক ছিলেন, রোজই সকালে চণ্ডীপাঠ করতেন। এসবে নাকি বাড়ি থেকে অশুভ প্রভাব দূর হয়। তখন আমার ছেলেমেয়েরা ছোটো ছিল, অত ওরা বুঝত না। কষ্ট না পান ভেবে আমরাও বাবার রক্ষাকালীর পূজা এবং চণ্ডীপাঠ নিয়ে কোনো অবিশ্বাসের কথা বলিনি। এখন কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা বেঁচে থাকলে এ—নিয়ে পরামর্শ করা যেত।

আশ্চর্য, সোনা দেখছি লাফিয়ে বাড়ি ঢুকছে। খুব খুশি। ওর আজ বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হবার কথা। আমার কিছুই মনে ছিল না। ও এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, বাবা আমি ফার্স্ট হয়েছি। খুবই সুখবর। তিন বছর ধরে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রথম হবার। কিন্তু হতে পারছিল না। ওর কী আনন্দ। আমরা কী মনে হল কে জানে, অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, আজ যাচ্ছি না।

এমন সুখবরেও কিন্তু মনের খিঁচটা আমার দূর হল না। সমীর ফিরে না আসা পর্যন্ত—যা সব দুর্ঘটনা ঘটে, তার উপর একটা হাতের কঙ্কাল এভাবে ভয় দেখালে কোনো অশুভ ইঙ্গিত থাকতে পারে এমন মনেই হতে পারে। এবং বার বার জানলায় গিয়ে দাঁড়াই। ঘরে বসে থাকলেও উৎকর্ণ হয়ে থাকি, গেট খোলার শব্দ হয় কি না। একবার হতে নীচে নেমে গেলাম— দেখি ডাক পিয়ন, চিঠি রমার। বড়োমেয়ে রমার চিঠি অনেক দিন পাচ্ছিলাম না। চিন্তায় ছিলাম। চিঠিটি খুলে পড়তে আরও অবাক, ওর বর দিল্লিতে বদলি হয়েছে। আসামে ছিল, সেখানে বিদেশি প্রশ্নে গন্ডগোল, হানাহানি, অরাজকতা, কত কিছু চলছে বছরের পর বছর। বাড়িতে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। কি যে হালকা লাগছে! এই করে এক সময় সমীর এবং তার মা—ও ফিরে এল। এবং মনের মধ্যে যে খিঁচ ছিল সেটা একেবারেই উবে গেল। অশরীরী আত্মার প্রভাব তবে এই বাড়িটাতে কোনো অমঙ্গল ডেকে আনেনি।

এরপর বেশ ক—দিন কেটে গেছে। কঙ্কালটা নিয়ে আমাদের মধ্যে যে ত্রাসের ভাব ছিল, সেটা কেটে গেছে। অনেক দিন বিছানা তুলতে গিয়ে দেখা গেছে, ছোটোখাটো দুটো একটা হাড় পড়ে আছে সমীরের বিছানায়। আসলে সে বিছানায় শুয়ে পড়তে ভালোবাসে। প্রথম বছরটা ডিসেকসান আর হাড়ের নাম মুখস্থ করতে করতেই বুঝি কেটে যায়। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়ে সে নিজেই টের পায় না।

হাড়গোড় বিছানায় পড়ে থাকলেও এ—নিয়ে কেউ আর কোনো সোরগোল তোলে না। তবে ওর মা চানটান করে পারতপক্ষে এখনও সমীরের ঘরে ঢুকতে যায় না। আমি আবার স্বাভাবিক— ওটা মনেরই ভুল ভেবে বিষয়টাকে হালকা করতে চেয়েছি। বাড়ির কুকুরটা আগে আমার ঘরে শুত। এখন সমীরের ঘরে শোয়। একদিন কুকরটা সমীরের ঘরে শুয়েছে কিনা উঁকি দিতেই অবাক, যেখানে কুকুরটা শুয়ে থাকে তার পাশেই সেই হাত। কিন্তু এবারে একেবারে ন্যাড়া। হাতে শাঁখা নেই। সমীর ঘুমিয়ে আছে। ঝুড়িতে কঙ্কালের দাঁতগুলি যেন আমাকে ভেংচি কাটল। গাটা সঙ্গে সঙ্গে ফুলে উঠল। কী করব বুঝতে পারছি না। কুকুরটা আমার পায়ের শব্দে জেগে যেতেই দেখলাম, হাতটা আবার কঙ্কাল হয়ে গেছে! আমি দাঁড়াতে পারছিলাম না। আমি ঠিক আছি কি না ভেবে নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। না এটা আমি নিজে, নিজের চোখে দৃশ্যটা দেখেছি। এবং পরদিন একটা দুঃসংবাদ পেলাম। আমার এক খুড়তুতো বোন আত্মহত্যা করেছে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা।

হাত ন্যাড়া—ঠিক বিধবার হাতের মতো সাদা ফ্যাকাসে—আগে যেটা দেখেছিলাম, একজন যুবতীর হাত, এবারে দেখলাম খুব শীর্ণকায়। তবে এই অশরীরী কি আমায় শুভাশুভ আগে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছে।

একদিন রাতে বাথরুমে যাচ্ছি, দেখলাম সেই বিধবা হাত আবার মেঝেতে পড়ে আছে। সারারাত আমার ঘুম হল না। খেতে বসে খেতে পারলাম না। স্ত্রী ঠিক টের পেয়ে বলল, তোমার কী হয়েছে। মাঝে মাঝে তুমি কেমন হয়ে যাও। আমি তো বলতে পারি না, বাড়িতে কঙ্কালটা যেমন এসেছে, তার সঙ্গে সেই অশরীরী আত্মাও হাজির। পর পর তিনদিন দেখার পর, নিজের ভ্রম বলে স্বীকার করি কি করে।

সকালে বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। একবার ইচ্ছে হল বলি, সমীর তুই এটা ফেরত দিয়ে আয়। কিন্তু বলি কী করে! আমি প্রবীণ মানুষ, আমার মধ্যে যদি বিভীষিকা দেখা দেয় একটা কঙ্কালের কাণ্ডকারখানায়, তাও আস্ত কঙ্কাল নয়, শুধু একটা হাতের কঙ্কাল, তবে সমীরের মতো ছেলেমানুষের পক্ষে মাথা ঠিক রাখাই দায় হবে। কাউকে তো বলাও যায় না। আমার বাড়িটা কঙ্কালটা আসায় ভূতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে ভাবতেও কেমন খারাপ লাগছিল। অমঙ্গলের আশঙ্কায় খুবই ঘাবড়ে গেছি। বড়ো ছেলে বাইরে থাকে যদি কিছু হয়। সকালেই ট্রাংকল করলাম, পেয়েও গেলাম, না পরমেশ ভালোই আছে। আর কী হতে পারে? এই সব সাত পাঁচ ভেবে যখন কূল—কিনারা পাচ্ছিলাম না, কারণ যেকোনো মুহূর্তে যা কিছু অঘটন আছে সব ঘটতে পারে। কাজেই ভিতরে স্বস্তি পাচ্ছি না। ছেলে কলেজে গেল, স্ত্রী স্কুলে চলে গেল, সোনা স্কুলে—এখন বাড়িতে বসে থাকা শুধু অপেক্ষায়। অনেকগুলো খবরের কাগজ আসে। সব দেখা দরকার। আমরা কোন খবর মিস করলাম, কিংবা কোন কাগজ কী খবর মিস করল, আমাদের হেডিং স্টান্ট কতটা—এসব দেখার একটা আকুলতা থাকে। কিন্তু কিছুতেই খবরের কাগজগুলিতে মনসংযোগ করতে পারছিলাম না—এই বুঝি কলিংবেল টিপে কেউ কোনো দুঃসংবাদের খবর দিতে এল। ভিতরে গুটিয়ে আছি কেমন।

না দিনটা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। রাতে ফিরে এসেও দেখলাম সব ঠিকঠাক আছে। কেবল একটি সংশয় মনের মধ্যে কঙ্কালটা সত্যি কোনো নারীর কি না। সমীর এমনিতেই বলতে পারে। কিংবা একটা মানুষের সব কটা হাড় না আর কারও হাড় মিশে গেছে। কিন্তু এসব কথা তো গুরুত্ব সহকারে বলা যায় না। যেভাবে আমি বার বার কঙ্কালটা নিয়ে প্রশ্ন করছি তাতে ভাবতেই পারে সমীর আমি ভালো নেই। সুতরাং ওই ডিসেকসান—রুমের কথা দিয়ে আলোচনাটা শুরু করলাম। সমীর বলল, এবারের বডিটা ভালো পেয়েছি।

তারপর আরও দুটো একটা কথার পর বললাম, এটা মেয়েছেলের কঙ্কাল কী করে বুঝলি। ডোম কি বলে দিয়েছে!

বলে দেবে কেন। মেয়েদের ছেলেদের স্যাকরাম আলাদা রকমের। পিউবিসের গঠনও আলাদা।

সুতরাং এরপর আর কি বলি! তবে ওটা যা দেখি বিধবারই হাত। ন্যাড়া এবং ভয়াবহ রকমের কুৎসিত। রাতের বেলায় হঠাৎ সমীর সেদিন চিৎকার করে উঠল, বাবা কুকুরটা দেখ এসে কী করছে।

একটা দাপাদাপির শব্দ পাচ্ছিলাম। ছুটে ভিতরে যেতেই শরীর হিম হয়ে গেল। কুকুরটা মুখ ঘষছে মেঝেতে, মুখ ঝাড়ছে আর পাগলের মতো মুখ থেকে কী ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। ভয়ে সমীর খাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সোনা কান্না জুড়ে দিয়েছে। কুকুরটা কোনো শব্দ করতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে দাপাতে দাপাতে মরে গেল। আমার মুখ থেকে শুধু একটাই অস্ফুট শব্দ, আমি তবে ঠিকই দেখেছি।

সমীর একদিন বলল, মনে হয় ওটার কৃমিটিমি হয়েছিল বাবা।

আমি কিছু বললাম না। কারণ হাতটা যদি আবার দেখি তবে আর একটা বিপদ সামনে বুঝতে পারি।

আমার স্ত্রী একদিন বলল, তোমার শরীর এত ভেঙে পড়ছে কেন! কী চেহারা হয়েছে তোমার!

বললাম, বা বয়েস হয়েছে না। এ—বয়সে আর চেহারাতে চিকনাই আসবে কী করে।

সেদিনই রাতে বাথরুমে যাব বলে বের হয়েছি। জিরো পাওয়ারের এখন আলো জ্বালা থাকে ঘরে। রাস্তার আলোগুলো দেখা যায়—বাড়িটার বড়ো বড়ো জানলা সব কাচের, বাইরের সবই দেখতে পাই, মনে হল গভীর রাতে কোনো যুবতী হাতে টিনের সুটকেস নিয়ে একটা প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বড়ো চেনা। ঠিক সুষমার মতো। ধীরে ধীরে আমার বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে। এত রাতে! গাড়ি লেট থাকলেই হতে পারে। কিন্তু একা! সুষমা কবেকার সেই মেয়ে। আমি দরজা খুলে দিতে নীচে নেমে গেলাম। দরজা খুলে দেখলাম কেউ নেই। গেট খুলে বাইরে বের হয়ে দেখলাম সব ফাঁকা। গেট খোলার আওয়াজে সোনা সমীর ওর মা এবং কাজের লোকটাও জেগে গেছে।—কে গেট খুলল।

কে! কে!

নীচ থেকে বললাম আমি!

এত রাতে কোথায় যাচ্ছ? বলে সবাই ছুটে নেমে এল। সবার চোখে মুখে ভারি উদ্বেগ।

তাইতো! প্ল্যাটফরম আসবে কোত্থেকে। এত রাতে কেউ বাড়ি আসে! আর সুষমা যুবতী থাকবে কেন। সেও তো প্রৌঢ় হয়ে গেছে। ইস কি যে ভুল দেখলাম! মাথা—ফাতা খারাপ হয়ে যায়নি তো! তবে কঙ্কালটা কি সুষমার! সেই কি এ—বাড়িতে হাজির। ধুস কি যে ভাবছি। এমনিতেই ঘুম পাতলা, মাঝে মাঝে ঘুম হয় না। আজ দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়তে যাব এমন সময় সমীর সোনা এবং তাদের মা পাশে দাঁড়িয়ে। কৈফিয়ত চাইছে, দরজা খুলে কোথায় যাচ্ছিলে? কুকুরটার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর সমীর, কেমন কিছুটা সংশয়ে ভুগছে।

বললাম, মনে হল কেউ হাঁটছে। চোরের যা উৎপাত! কুকুরটা নেই। চোর ঠিক বুঝতে পেরেছে। প্ল্যাটফরম অথবা সুষমার কথা এড়িয়ে গেলাম। আর সুষমা তো আমাদের দেশের বাড়িতে বছরখানেকের জন্য ছিল। তখন আমি কলেজে পড়ি। সুষমা আর ওর দাদা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। দেশ ভাগ হবার পর ওরা আমাদের বাড়িতে এসে বছরখানেক ছিল। বাঁশবেড়ের দিকে ওর দাদার চটকলে চাকরি হয়ে গেলে সুষমা চলে যায়। তবে সুষমা এই বছরখানেক আমার ঘরের সব কিছু এত সুন্দর করে সাজিয়ে রাখত; বই, জামা, প্যান্ট সব কিছু। সে ভারি যত্নে গোছগাছ করে রাখত। ও আমার চেয়ে বছর দুই—তিনের ছোটোই হবে। ফ্রক পরার বয়স যায়নি তখন, কিন্তু আমাদের সময়টাতে বারো—চোদ্দো বয়স হলেই মেয়েদের শাড়ি পরার নিয়ম ছিল। যাবার দিন আমি সুষমাকে ট্রেনে তুলে দিতে গেছিলাম। টিনের সুটকেসটা নিয়ে যে যখন ট্রেনে উঠে গেছিল তখন আমার বুকটা কেমন ভারি খালি হয়ে গেছিল। সুষমা জানলায় মুখ রেখে শুধু আমাকে দেখেছে। চোখে জল চিকচিক করছিল।

শুয়ে শুয়ে পুরোনো স্মৃতি হাঁটকাচ্ছিলাম। সমীরের ঘরের কঙ্কালটা সুষমার হতে যাবে কেন। যদিও এর পর জানি না সুষমা কোথায় আছে। সে গিয়ে আমাকে চিঠিও দেয়নি। ওর দাদা বাবাকে চিঠি দিত। তাতে অবশ্য সুষমার কথা বিশেষ থাকত না। চিঠিও একদিন বন্ধ হয়ে গেল। আমার মেজোমাসি কেবল একবার বাড়ি গেলে বলেছিলেন, সুষমার বিয়ে হয়ে গেছে। মেজোমাসির ননদের মেয়ে সুষমা।

এসব ভাবলে ঘুম আসবে না। দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছি। চোখ বুজে আসছে এবং একসময় আবার খুট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতে পারছি না। তবু খোলার চেষ্টা করছি। একটা কাচের গ্লাস পড়ে ভেঙে গেলে যেমন ঝন ঝন শব্দ হয়, তেমনি শব্দ কোথাও। মাথাটায় ঝিম ঝিম করছে। চোখ খুলতে পারছি না। তবু তাকালাম। দেখলাম, সত্যি সুষমার মতো কেউ দাঁড়িয়ে শিয়রে। হাতটা আমার চোখের ওপর বাড়িয়ে রেখেছে। হাতে শাঁখা। যেন হাত ঘুরিয়ে সে তার শাঁখার সৌন্দর্য দেখাচ্ছে। এবারে আর পারলাম না। উঠে বসলাম। তারপরই সব ফাঁকা। বুঝতে পারছি আমি প্রচণ্ড ঘামছি। জল তেষ্টা পেয়েছে। নেমে জল খেলাম। আর ঘুম হল না। অবসাদ শরীরে। ভোরের দিকে ঘুমটা এল এবং বেশ বেলায় ঘুম ভাঙল। এত বেলা করে আমি কখনো উঠি না।

ঘুম থেকে উঠে দেখছি স্ত্রী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। কপালে সুন্দর করে টিপ পরছে সিঁদুরের। ওর টিপ পরা দেখে বললাম, জানো দু—একদিনের মধ্যে কোনো সুখবর পাব। এবং পেলামও। বড়ো ছেলে পরমেশ চিঠিতে জানিয়েছে—সে হ্যালে যোগ দিচ্ছে। বড়ো ছেলের অনেক দিনের স্বপ্ন তাহলে এতদিনে সফল হল। আসলে খুলে বললাম না, হাতে তার শাঁখা পরা দেখেছি। শাঁখা থাকলে কোনো—না—কোনো শুভ খবর পাই। না থাকলে অশুভ খবর। কেউ আমাকে আগেই সতর্ক করে দিয়ে যায়। হাতটা যে কার?

এরপর আর অনেক দিন কিছু দেখি না। সুষমার কথাও ভুলে গেছি। মেয়ে জামাই বাড়িতে। বেশ উৎসবের মতো কটা দিন কেটে গেল। নাতি—নাতনিকে নিয়ে চিড়িয়াখানা, বিধান শিশু উদ্যানে ঘুরে বেড়ালাম। একদিন গুপি গায়েন বাঘা বায়েন দেখলাম। এই করতে করতে ওদের যাবার দিন এসে গেল। রিজার্ভেশন ঠিক। ওরা এলাহাবাদে দু—দিন কাটিয়ে দিল্লি যাবে। মাঝে একবার মোগলসরাইতেও নামার কথা। সেখানে মেয়ের ননদ থাকে। যাবার সময় আত্মীয়স্বজন সবাইকে দেখে যাবার ইচ্ছা তাদের। দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল। এবং সেদিন রাতে খেতে বসে আবার সেই কঙ্কালের ন্যাড়া হাত বারান্দায় পড়ে আছে দেখতে পেলাম। আবার চমকে গেলাম। এটা দেখলেই টের পাই কোনো অশুভ ইঙ্গিত আছে এর মধ্যে। খাবার টেবিলেই অরূপকে বললাম, কাল তোমাদের যাওয়া হবে না। টিকিট ক্যানসেল কর।

ওরা তো অবাক!

অরূপ বলল, কেন কাল গেলে কী হবে?

আমার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না।

স্ত্রী ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, তুমি যে কি না! এই হয়েছে—মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বাবা যেন আজকাল কেমন হয়ে গেছে।

আমি শুধু বললাম, যাওয়া হবে না। বলে টেবিল থেকে উঠে গেলাম। রাতে আমার ঘরে অরূপ এল। বলল, আবার রিজার্ভেশন কবে পাওয়া যাবে?

বললাম, সে আমি ঠিক করে দেব। তোমাদের ভাবতে হবে না।

দু—দিন বাদে খবরের অফিসে টেলিপ্রিন্টারে ভেসে উঠল খবরটা। এলাহাবাদের কাছে ভয়ংকর ট্রেন দুর্ঘটনা। বিরাশি জন দুর্ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। দুটো বগি চুরমার। এবং বগির নম্বর ট্রেন মিলিয়ে বুঝতে পারলাম—এই কামরাতেই ওদের থাকার কথা ছিল।

অবশ্য এসব খুবই রহস্যজনক ঘটনা। কাউকে খুলে বলাও যায় না। স্ত্রী বলল, তুমি কি সব আগাম দেখতে পাও?

আমি শুধু বললাম, জানি না।

পরে খবর নিয়ে জেনেছি, সুষমা স্বামীর ঘর থেকে পাঁচ—সাত বছর আগে কোথায় চলে গেছে। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *