কান্না
নবেন্দু ঘোষ
ঢং ঢং করে দুটোর ঘণ্টা বাজল।
কান পেতে শুনল বিপিন রাত দুটোর ঘণ্টা বাজল।
করিডোরে সান্ত্রীর পদচারণা চলছে। নাল বাঁধানো বুটের কঠিন শব্দ উঠছে— খট খট খট খটা একটানা শব্দ।
শেষ রাতের স্তব্ধতা। সারা শহর ঘুমুচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে। এই জেলখানার ভেতরেও সেই ঘুমের ঢেউ এসেছে, স্বপ্নের জোয়ার এখানকার উঁচু দেওয়ালকেও অতিক্রম করেছে। শুধু ঘুমোয়নি বিপিন, ঘুমোয়নি ঐ সান্ত্রী এবং আরো দু’তিনজন।
সান্ত্রীর বুটের শব্দটা কাছে এল। করিডোরের দেওয়ালে একটা বাতি জ্বলছিল, তার আলোর একটা ধারা এসে পড়েছিল বিপিনের কামরার সামনে, কিন্তু তাতে ভেতরটা সম্পূর্ণ আলোকিত হয়নি, আবছা অন্ধকার ঘুপটি মেরে ছিল কোণের দিকটায়—যেখানে একটা কম্বলের ওপর চুপচাপ বসে ছিল বিপিন। নিঃসাড় হয়ে বসে ছিল আর প্রহর গুনছিল।
‘ক-টা বাজল চৌবেজী? ক-টা?’ মৃদুকণ্ঠে হঠাৎ সে প্রশ্ন করল।
চৌবেজী তাকাল ভেতরের দিকটাতে, বিপিনের মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সে বেশ অনুভব করল যে তার গলাটা ধরা-ধরা। বেচারা—
‘কটা আবার দুটো বাজল ভাই’—
চৌবেজীর বুট জুতো আবার শব্দ তুলতে লাগল।
দুটো! তাহলে আরো তিন ঘণ্টা সময় আছে। আরো তিন ঘণ্টা আছে তার জীবনের মেয়াদ! বিপিন হাসল, একটু নড়ে বসল সে, জোরে জোরে বারকয়েক নিঃশ্বাস টানল। আঃ! আরো তিন ঘণ্টা। কতক্ষণ আর? কালসমুদ্রে কত যুগযুগান্ত ভেসে গেছে—খড়কুটোর মত এই তিন ঘণ্টাও তার দুরন্ত স্রোতেবেগে ভেসে যাবে—তারপর যখন পাঁচটা বাজবে তখন ঐ লোহার দরজাটা খুলে যাবে, ফাঁসির দড়ির ডাক শোনা যাবে হ্যাঁ, আজই শেষরাতে তার ফাঁসি হবে।
শেষরাতের ভৌতিক মুহূর্তগুলো। পাথর আর কংক্রীটের তৈরী এই কামরার বাইরে, জেলখানারও বাইরে, নিস্তরঙ্গ মহাসমুদ্রের মত পৃথিবীটা এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন ও শান্ত হয়ে আছে। সেখানে গিয়ে একবার দাঁড়াতে ইচ্ছে হয় বিপিনের হাসি কান্না, সুখ দুঃখ, আলো আঁধারের দ্বন্দ্বে। ভরা পৃথিবীকে শেষবারের মত আর একবার দেখতে ইচ্ছে করে। অথচ উপায় কোথায়? রাত্রিশেষে তার ফাঁসি হবে খুনী আসামী সে, কলঙ্কযুক্ত অপরাধীর বহমূল্য জীবন তার, পাথর আর কংক্রীটের গাঁথা কামরায় তাকে রাখা হয়েছে, সদাসতর্ক সান্ত্রীর বুটে আজ পৃথিবীর অস্বীকৃতি ঘোষিত হচ্ছে। সে আর এখন পৃথিবীর জীব নয়—এই সেলের অন্ধকারে, নিঃশব্দে বসে বসে, আসন্ন মৃত্যুরাজ্যের ছাড়পত্রের জন্যই তাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। উপায় নেই।
খুনী আসামী বিপিন। বহাল তবিয়তে সে তার স্ত্রী মালাকে গলা টিপে মেরেছে। প্রমাণ অজস্র, সাক্ষী অসংখ্যা বস্তির নরনারীরা এসে যখন তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে একপাশে নিয়ে এল তখন দেখা গেল যে মালার জিভ বেরিয়ে এসেছে, নাক দিয়ে, দু-কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। আতঙ্ক বিস্ফারিত দুটো চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে সে মারা গেছে। বিচার বেশীদিন চলেনি। প্রমাণ সুস্পষ্ট। দায়রা জজ রায় দিলেন যে একেবারে না মরা পর্যন্ত আসামী বিপিনকে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে। আজ, ৩রা মার্চ, সোমবার, শেষরাতে দায়রা জজের সেই মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রতিপালিত হবে। বিপিন তা গতকাল জানতে পেরেছে।
সত্যিই সে খুন করেছিল। প্রমাণ এবং সাক্ষীর দরকার ছিল না—সে নিজেই তার অপরাধ স্বীকার করেছিল শুধু স্বীকার করেনি যে, কেন সে খুন করেছিল। আসামী পক্ষের উকিল প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে বিপিন উন্মাদ প্রমাণ টেকেনি, ডাক্তারের রিপোর্টে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হল। সাক্ষীরা প্রমাণিত করল যে আসামী নিজে দুশ্চরিত্র ছিল এবং এই নিয়ে তার স্ত্রী তাকে গঞ্জনা দিত বলেই সে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মালাকে খুন করেছে। বিপিন কোন প্রতিবাদ করল না। আসামী পক্ষের উকিল ক্ষীণকণ্ঠে একটু প্রতিবাদ করল। বিচারক সাক্ষীদের কথাই বিশ্বাস করলেন। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা সহজেই ঘোষিত হয়ে গেল।
বিপিন প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করলে খুন করার কারণ সম্পর্কে যদি সে সত্যি কথা বলত তাকে কি কেউ বিশ্বাস করত? বিপিন হাসল। আর মাত্র তিন ঘণ্টা আর একবার আগাগোড়া এই জীবনটার কথা ভাবা যাক না। আজ, এই মুহূর্তে, নিজের জীবনের অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি ব্যতীত আর কী-ই বা অবশিষ্ট আছে?
বিপিনের জীবন! জন্ম আর আসন্ন মৃত্যুর মধ্যবর্তী একটা অবিচ্ছিন্ন দুঃখের জীবন। সে জীবনে। ঘটনা-বৈচিত্র্য নেই, চাকচিক্য নেই, মহাকাব্য কিংবা নাটক তৈরীর উপাদান নেই তাতো দূর বরিশালের কোন গ্রামে সে জন্মেছিল, কেমন করে অশিক্ষায়, অভাবে বড় হয়ে সে একদিন আয়রন ফ্যাক্টরীতে ষোল বছর বয়সে ঢুকেছিল—সে কথা আর ভেবে লাভ কি তার চেয়ে আজ ঠিক সেইখান থেকেই ভাবা যাক— যেখান থেকে ফাঁসির দড়িটা বিপিনকে অদৃশ্যভাবে আকর্ষণ করতে লেগেছিল।
জেলখানার ভেতরেও এখন স্তব্ধতা। শুধু সান্ত্রীর বুট শব্দ তুলছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত—আকাশে হয়ত অসংখ্য তারা ছড়ানো রয়েছে। কিন্তু বিপিন তা দেখতে পাচ্ছে না। চোখ বুজে সে ভাবছে। হঠাৎ সে উঠল, চোখ মেললা কে যেন কাঁদছে! বিনিয়ে বিনিয়ে কে যেন কাঁদছে! দূরে, অতি— দূরে বহুদূরে—! ঐ কান্নাই তো রাত্রিশেষে আসন্ন ফাঁসির দড়ির পেছনে। কে কাঁদে!
‘চৌবেজী, কে যেন কাঁদছে’—
চৌবেজী থমকে কান পাতল, মাথা নেড়ে বলল ‘দূর’—
বিপিন চুপ করল। সে ছাড়া কেউ শুনতে পাবে না এ কান্না। এ কান্নার সঙ্গে পরিচিত হতে হলে তার বস্তির ঘরে ফিরে যেতে হবে কাঠ মাটি আর টিনের একখানা ঘর, পেছনে ছোট একটা উঠোন পেরিয়ে খড়ের ছাউনি-দেওয়া রান্নাঘর। তাতেই থাকত সে, মালা, পাঁচ বছরের ছেলেটা আর জরাজীর্ণ শাশুড়ীকে নিয়ে।
লোহালক্কড় পিটিয়ে সে মাইনে পেত মোট আটত্রিশটি টাকা। লম্বা চওড়া জোয়ান মানুষ সে, লোহার মত শক্ত তার পেশী, স্বাস্থ্যবতী স্ত্রী মালা, বাচ্চাটাও জীর্ণ-শীর্ণ নয় আর শাশুড়ী বুড়ী হলেও কম খেত না। আটত্রিশ টাকায় কুলোবে কেন, তাই ভাতেও কুলোত না। অথচ বয়লারের আগুন, গলানো লোহার উত্তাপ আর ভারী হাতুড়ী মানুষকে রাক্ষসের মত ক্ষুধার্ত করে তোলে। প্রতিদিন বাড়ী ফিরত বিপিন আর খাবার সময় হাড়ির ভেতরটা দেখে হাত গুটিয়ে নিত। আক্রোশে জ্বলতে জ্বলতে শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে সে হিংস্র হয়ে উঠত। কোত্থেকে যে এই আপদটা এসে জুটল— উঃ—
বুড়ীর দোষ নেই। জামাই ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই, সে যাবে কোথায়? সে জানে যে তার পরমায়ু ফুরিয়ে এসেছে, তাই পরিপূর্ণ ভাবে জীবনের স্বাদটা পেতে চায় বুড়ী লোভীর মত। খেতে বসে জেঁকে বসত, ভাত দেখে গভীর তৃপ্তির আবেশে তার চোখ দুটো বুজে আসতা মুখে চার-পাঁচটা মাত্র নড়বড়ে দাঁত আছে, তাই দিয়ে ধীরে ধীরে, রসিয়ে রসিয়ে ভাত চিবোত সে, আর অনেকক্ষণ ধরে খেতা
বিপিনের খাওয়া হয়ে যেত, বাচ্চাটারও শেষ হত, বুড়ী তবু বসে থাকত বসে বসে ভাত কটা শেষ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলত, ‘তোর ডাঁটাচচ্চড়িটা বড় ভাল হয়েছে মালা দে তো আর চাট্টি ভাত মা—’
মালা মৃদু হেসে হাঁড়ি থেকে ভাত দিত আর প্রায় শূন্য হাঁড়ির চেহারাটা দেখে বিপিন বারুদের মত জ্বলতা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে ক্রোধের উচ্ছ্বাসটাকে দমন করতে গিয়ে সে বিড় বিড় করে বলত, ‘হারামজাদি রাক্ষুসী—মরেও না, বজ্জাত মাগী কোথাকার—
মালা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করত, ‘কি হল! তুমি কিছু বলছ নাকি?’
বাচ্চা ছেলেটা ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ আবদার করে উঠত, ‘আমুও খাব দিদিমা—হ্যাঁ—’
ছেলেটার পিঠে লোহার বলের মত শক্ত মুষ্টির এক ঘা বসিয়ে বিপিন সজোরে বলত, ‘কিচ্ছু বলছি না—তুমি খাও—’
ছেলেটা আচমকা কিল খেয়ে কান্নায় ফেটে পড়ত, সে শব্দে সমস্ত ঘরটা ভেঙে পড়তে চাইত আর বিপিনের হিংস্রতা বেড়ে উঠত ক্রমশা ছেলেটার দিকে তর্জনী নাচিয়ে সে আদেশ করত, ‘চোপ—চোপ বলছি।’
ছেলেটা থামত না। কেঁদেই চলত।
মালা তখন চেঁচিয়ে উঠত, ‘কথা নেই বাত্তা নেই, ওকে মারলে যে! তার চেয়ে একেবারে মেরেই ফেল না ওকে—‘
‘চোপ—‘
‘কেন, চুপ করব কেন, কি দোষ করলাম?’ মালা কেঁদে উঠত।
ধাঁ করে মালাকে একটা লাথি মেরে বিপিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত। বাইরে দাঁড়িয়ে ছেলে আর বৌয়ের কান্নার বিশ্রী শব্দটা দু-চার সেকেন্ড চুপ করে শুনে বিপিন ভাটিখানার দিকে পা চালিয়ে দিত। সে কান্না সইতে পারে না। চলতে চলতে আফসোস হত তারা কাকে মারতে কাকে মারলাম বাবা, ওদের না মেরে বুড়ীকে এক ঘা মারলেই তো হতা।
এমনিভাবে দিন কাটছিল। ছেলে বউয়ের কান্না শুনে আর পেট ভরে খেতে না পাওয়ায় শুধু বিপিনের মনের মধ্যেই যে হিংস্রতার ঝড় উঠেছিল তা নয়, বিপিনের সহকর্মীদের মনেও তেমনি ঝড় উঠেছিল। ধীরে ধীরে দলবদ্ধ হচ্ছিল তারা, সংগঠিত হচ্ছিল। ফাঁকা বুলির দমকে তারা এক হচ্ছিল না, পেটের দায় তাদের পাশাপাশি দাঁড়াতে শেখাচ্ছিল যুদ্ধের বাজারে কোটি টাকা আয় হয়েছে ফ্যাক্টরীর কিন্তু তাদের আয়ের অঙ্ক বদলায়নি। যুদ্ধের দেবতারা বাজারে আগুন ছড়িয়েছে, চাল ডাল আর নুন তেল হয়েছে দুষ্প্রাপ্য, দুমূর্ল—অথচ তাদের শ্রমের দাম বাড়েনি। হাড়ভাঙা খাটুনির পর পেটে যে রাক্ষসের ক্ষুধা জন্মায় তার সামনে অল্প আহার্য দেওয়ায় এবার বিপর্যয় ঘটল ফ্যাক্টরীর শ্রমিকেরা বিদ্রোহের পতাকা তুলে হাওয়ায় ধরল। বেতনবৃদ্ধির দাবী নিয়ে তারা কর্তৃপক্ষের সামনে দাঁড়াল, দাবীর খসড়াটা সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিয়ে রক্তচক্ষু করল মালিকেরা। শ্রমিকেরা পালটা ঘা মারল স্ট্রাইক। বিপিনও সোৎসাহে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এক দিন—দু দিন—দশ দিন— তবু মীমাংসা হল না। এ লড়াইয়ের নিয়মই যে এমনি। মালিকেরা ভাবে যে ক্ষুধার তাড়নায় হয়ত ধর্মঘট ভেঙে যাবে। যাই ভাবুক—এখানে তা হল না। ধর্মঘট চলল।
ওদিকে শ্রমিকের কোষাগার শূন্য হয়ে গেল। মাসের মাঝামাঝি তারা বিদ্রোহ করেছে, ভেবেছিল কয়েক দিনেই তা শেষ হবে। অথচ তা হল না, অবস্থা খারাপ হয়ে উঠল।
বিপিন চিন্তায় পড়ল। চারটে পেটের জোগান, এখন সে দেবে কোত্থেকে? কি করে চালাবে সে? চালালে চলবেই বা কি করে? বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে পারে না, চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে আসে সব কিছু। অথচ হার মনলেও চলবে না। কি করা যায় তবে? ধার? কার কাছে, কোন মুখে সে তা চাইবে?
এমনি অভাবের সময় বুড়ি শাশুড়ী যেন আরও ক্ষেপিয়ে তুলল বিপিনকো পকেটে পয়সা নেই, শিগগীর টাকা পাবার কোন আশাই নেই, অতি কষ্টে নুন ভাত জুটছে এক মুঠো করে—তবু বুড়ীর নির্লজ্জ ক্ষুধা এত তিলও কমেনি। সন্ধ্যার পর সেদিন বিপিন চুপ করে বসে ছিলা ক্ষুধার জ্বালায় ঝিমোতে ঝিমোতে সে ফ্যাক্টরীর কর্তৃপক্ষের অনমনীয় দৃঢ় মনোভাবের কথা ভাবছিল। আর কতদিন, আর কতদিন চলবে এমনি ধারা?
মালা এসে ডাকল, ‘ভাত খেতে এস—’
ভাত! লাফিয়ে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে বসল বিপিন। গিয়ে দেখল যে ছেলেটা আর বুড়ী আগেভাগেই বসে আছে সেখানে ভাত খেতে আরম্ভ করল সবাই। শুধু ভাত আর আলুসেদ্ধ, আর কিছু নয়। খাওয়া শেষ করেও বিপিন উঠল না, বসে বসে বুড়ীর খাওয়া দেখতে লাগল। কেমন যেন নীচ হয়ে গেছে সে, কিন্তু টের পেয়েও নিজেকে সংশোধন করতে পারে না বিপিন।
বুড়ী পাতের ভাত শেষ করে মেয়ের দিকে তাকাল—’মালা, অ-মা!’
‘কি?’
‘আর চারডি ভাত দে তো মা—এই এত কটি দে—’
মালা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শীর্ণ হাসি হাসল, তারপর এক হাতা ভাত দিল তার পাতে।
বুড়ী খুশী হয়ে বলল, ‘থাক থাক, ওতেই হবে মা, ওতেই হবে—’
দিদিমাকে ভাত খেতে দেখে ছেলেটাও হঠাৎ দাবি জানাল, ‘আমাকেও ভাত দে—এই মা—’
মালা ধমক দিল, ‘আগে ঐ কটি খা দেখি রাক্কস—তারপরে চাস–’
ছেলেটা অসহিষ্ণু হয়ে মাথা নাড়ল, ‘না, আমায় আরো ভাত দে, দে বলছি।’
‘না।’
ফস করে প্রশ্ন করল বিপিন, ‘কেন, দেবে না কেন?’
‘বা রে, আমি খাব না?’
বিপিনের মুখ কুৎসিত হয়ে উঠল, ‘মা চাইলে দিতে পার আর ছেলে চাইলে দিতে পার না কেন?’
‘কি বললে!’ মালা চেঁচিয়ে উঠল।
‘মা—অ-মা—আরো ভাত দে না’—
দুম করে ছেলের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল মালা। তারস্বরে কেঁদে উঠল ছেলেটা। বুড়ী খাওয়া বন্ধ করে মাথা নীচু করে স্তব্ধ হয়ে রইল।
বিপিন একবার নড়ে উঠলা। ক্রন্দনরত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল, সারা শরীর গরম হয়ে উঠল। কি বিশ্রী দেখাচ্ছে ছেলেটাকে! আর কী বিশ্রী এই বলে, কি বিশ্রী! অসহ্য মনে হল তার।
কর্কশ কণ্ঠে সে মালাকে প্রশ্ন করে, ‘ওকে মারলে যে?’
‘বেশ করেছি’—উদ্ধত ভঙ্গিতে জবাব দিল মালা।
লোহা পিটানো হাতের মধ্যে এঁটো ভাত শুকিয়ে খড়খড় করছিল, সেই হাত দিয়েই বিপিন মালার গালে একটা চড় কষিয়ে দিল। ঠাস করে একটা শব্দ হল।
মালা কাঁদল না। কিন্তু আরো জোরে কেঁদে উঠল ছেলেটা আর কেঁদে উঠল বুড়ী হাউমাউ করে।
বিপিন উঠে দাঁড়াল আর টেকা যাচ্ছে না কুৎসিত কান্নায় রান্নাঘরটা ভরে উঠেছে। কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় ভরাট ঘরে যেমন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তেমনি কষ্ট হচ্ছে তারা বুড়ী কাঁদছে। বলি-রেখাঙ্কিত মুখের চামড়ায় তার কান্নার প্রাবল্যে আরও ভাঁজ পড়েছে। গুমরে গুমরে কাঁদছে বুড়ী।
বিপিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে বেড়াতে লাগল সে, ভাঁটিখানায় যাবার মত রসদ তো আর নেই।
ভোরবেলায় পরদিন উঠে দেখা গেল বুড়ী ঘরে নেই। মালা ছটফট করতে লাগল, বিপিন গিয়ে বস্তির এদিক-ওদিক খোঁজ নিল, কোত্থাও পাওয়া গেল না বুড়ীকে। বেলা বাড়তে লাগল, দিন কাটল, বুড়ী আর ফিরল না। মালা অনবরত চোখের জল মুছতে লাগল কিন্তু বিপিন একটুও বিচলিত হল না। ভালই হয়েছে। আপদটা বিদেয় হয়েছে, এখন থেকে তবু দু-মুঠো বেশী খাওয়া যাবে।
তিন-চারদিন কেটে গেল আরো ধর্মঘটের অবস্থা ওদিকে একই রকম। কর্তৃপক্ষেরা মাঝে দালাল দিয়ে বিভেদ-সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, ফল হয়নি—শ্রমিকদের দৃঢ়তা তাতে আরো বেড়ে গেল।
কিন্তু আর যে চলে না।
মালা বলল, ‘কোনমতে আরো দু-দিন চলবে, বুঝলে? আমার মা হতভাগী তো নিষ্কৃতি দিয়ে গেছে, তাই কোনমতে আরো দু-দিন তোমার পেট ভরাতে পারব—’
বিপিন ক্ষেপে গেল, ‘শুধু আমার পেট ভরাবে? আর তোমরা?’
মালা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমাদের কথা ভেবে তোমার দরকার কি গো—আমরা হাওয়া খেয়ে থাকবে।’
মালার চুলের গোছা টেনে, খারাপ একটা গাল দিয়ে বিপিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোর বড় বাড় বেড়েছে মালা, সাবধান—’
বিপিনের চোখমুখের চেহারা দেখে কেমন যেন ভয় পেল মালা। সে চুপ করল কিন্তু তার অন্তরের জ্বালা জল হয়ে বেরোল চোখ দিয়ে, আর তাই দেখে তাকে ছেড়ে দিয়ে পালাল বিপিন। কান্না—এই কান্না সে সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু কান্নার হাত এড়াবে কি করে বিপিন? বাচ্চা ছেলেটা সকালে বিকেলে খেতে চায়, অনবরত কাঁদে।
‘ভাত খাব মা-–ভাত—’
‘মাগো, খেতে দে মা—’
তীক্ষ্ণ, একটানা সুরে কাঁদে ছেলেটা। একটা আহত জন্তুর মত। সে কান্না শুনে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে বিপিনের।
ছেলের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলায় সে, ‘কাঁদছিস কেন বাবা, অ্যাঁ? কাঁদিস না, থাম থাম—’
কিন্তু ছেলেটা বোঝে না, শোনে না, অন্ধ আবেগে, শূন্য-জঠরের নিষ্ঠুর তাড়নায় সে সমানে কেঁদে চলে আর বলে, ‘ভাত খাবো মা—মাগো—মা—’
বুঝিয়েও কান্না থামাতে না পেরে ক্ষেপে ওঠে বিপিন, হঠাৎ ছেলেটার কান ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘চুপ কর শুয়ারকা বাচ্চা–
চুপ’ ছেলেটার কান্না তাতে আরো সশব্দ হয়ে ওঠে, বিকট হয়ে ওঠো বিপিন তখন পাগলের মত ঘর থেকে ছুটে বেরোয়।
মালার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে পেছন পেছন, ‘ছেড়ে দিয়ো না গো, মেরে ফেল, তুমি ওর জন্ম দিয়েছ, তুমিই ওকে শেষ করো, বুঝলে?’
বস্তির আঁকাবাঁকা, নোগ্রা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় বিপিন। সামনে যা পড়ে তাতেই পরম আক্রোশে লাথি মারে সো হাঁস মুরগী কুকুর—কেউই রেহাই পায় না। কান্না সইতে পারে না সে। কেন কাঁদে বাচ্চাটা, কেন কাঁদে মালা আর কেনই বা কাঁদত সেই বুড়ীটা? বস্তির ঘরে ঘরে আরো কত লোক যে এমনি কাঁদে, কত অসংখ্য লোক কাঁদে সারা পৃথিবীতে!
ধর্মঘটের ইতিহাস ওদিকে বদলায় না। মুখোমুখি দু’দল দাঁড়িয়ে আছে। দু’দলই সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু কেউই হার মানছে না একদল শুকিয়ে মেরে জিততে চায়—আর একদল শুকিয়ে মরেও জিততে চায়।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বিপিন বাড়ী ফিরে দেখল যে ছেলেটার প্রবল জ্বর এসেছে। চোখ বুজে জ্বরের ধমকে নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা, আর শিয়রের কাছে প্রস্তরমূর্তির মত বসে আছে। মালা।
ছেলেকে দেখে বিপিনের মুখ দিয়ে কথা সরল না। হাতে পয়সা নেই, ওষুধ পথ্য কি করে আসবে ছেলের? এমন অসময়ে হঠাৎ ছেলেটার অসুখ হল কেন?
কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ জ্বলে উঠল বিপিন, বলল, ‘বুড়ী—ঐ বুড়ীর শাপেই চ্যাংড়ার জ্বর এসেছে–’
মালা জবাব দিল না, শুধু তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসতে লাগল।
‘কাঁদছ! দূর ছাই’—
আবার সেই কান্না! বিপিন ছিটকে বাইরে চলে গেল।
পরদিন সকালে একটা কাণ্ড ঘটল।
ছেলেটার জ্বর সকালের দিকে কম দেখা দিল। সেই সুযোগে মালা গেল বড় রাস্তার ওদিককার একটা বাড়ীতে সেখানে নাকি ঝি রাখা হবে বিপিন বাড়ীতে রইলা ছেলের কাছে বসে চুপচাপ সে ভাবছিল আর কতদিন ধর্মঘট চলবে, আর কতদিন?
ঠিক এমনি সময়ে ক্ষীণকণ্ঠে কে যেন বাইরে থেকে ডাকল, ‘মালা—অ-মা’—ডাকতে ডাকতে কে যেন একেবারে ঘরের ভেতর এসে পড়ল। বিপিন তাকাল। তার বুড়ী শাশুড়ী।
‘তুমি!’ বিপিন উচ্চারণ করল।
বুড়ীর মুখটা কালো হয়ে গেল ভয়ে, অপ্রত্যাশিত বিভীষিকার মত জামাইকে দেখো বুড়ীর ছেড়া শাড়ীটা আরো ছিঁড়ে গেছে, ময়লা হয়ে গেছে। তার চোখে মুখে আরো বলিরেখা স্পষ্ট ও ঘন হয়ে হয়ে উঠেছে, পিঠটা যেন আরো ভেঙে গেছে।
অর্থহীন হাসি হেসে, শুষ্ক ও অস্পষ্ট ভাবে সে বলল, ‘মালা নেই, না?–’
‘না’—বিপিন মাথা নাড়ল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বলল, ‘কিন্তু তুমি ফিরে এলে যে!’
বুড়ী ফোগলা দাঁত মেলে আবার হাসল, ‘এলাম কোথায় আর যাব বাবা’ বলেই হঠাৎ কেঁদে ফেলল বুড়ী, ‘সাতদিন কিছু খাইনি—’।
বুড়ীর কান্না দেখে হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল বিপিন। কান্না! এরা শুধু কাঁদে খায় আর কাঁদে। কিন্তু খাবার নেই, খাবার অত সস্তা নয়।
কঠিন কণ্ঠে সে বলল, ‘তুমি বেরোও এখান থেকে—‘
‘কোথায় যাব বাবা?’
‘যেখানে খুশি কাজ করে খাওগে যাও—‘
বুড়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, ‘সাতদিন ধরে কিছু খাইনি সোনা—ও আমার বিপিন—ও মানিক—’
হঠাৎ এগিয়ে এল বিপিন, দুলে উঠে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলল, ‘ভাল ভাবে যদি না বেরোস বুড়ী, আমি গলা টিপে তোকে মেরে ফেলব—‘
সভয়ে, সত্রাসে বুড়ী কান্না বন্ধ করল, মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা আর আমি আসব না গোপাল–তোমরা সুখে থাকো’–যাওয়ার সময় বুড়ীর পিঠটা যেন আরো ভেঙে গেল। কাঠের পায়ের মত পা দুটোকে টেনে টেনে সে ধীরে ধীরে চলে গেল সেখান থেকে।
বিপিন হাঁফ ছাড়ল। বাঁচা গেল বাবা, নীচতা, নিষ্ঠুরতা যাই বলুক লোকেরা, সে ভালভাবে বাঁচতে চায়।
পরদিন।
ছেলেটার অসুখ আরো বাড়ল। অতিকষ্টে এক জায়গা থেকে চার টাকা ধার করল বিপিন, দু টাকা ভিজিট দিয়ে ডাক্তার ডেকে দেখাল।
অনেকক্ষণ ধরে দেখল ডাক্তার, দেখে বলল, ‘জ্বরটা ভাল নয় হে, ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দাও—’
‘আজ্ঞে আচ্ছা—’
কিন্তু হাসপাতালে বেড নেই। সব হাসপাতালেই অতিরিক্ত ভীড়। তবু একটা প্রেসক্রিপসন নিয়ে ওষুধ পাবার সুযোগ করে দিল তারা।
ইতিমধ্যে ধর্মঘটের অবস্থা জটিল হল। ভেতরে ভেতরে ফ্যাক্টরীর মালিকেরা বিভেদ-সৃষ্টির কাজে খানিকটা সফল হল। পেটের দায়ে দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেল শ্রমিকেরা। দালালেরা এবং ক্ষুকাতর শ্রমিকেরা একদিকে, অন্যদিকে সেই সব শ্রমিকেরা যারা ক্ষুধার জ্বালাকেও অস্বীকার করে নিজেদের অবস্থা ভাল করতে চাইছিল। একদল চাইল মিটমাট করে কাজে যোগ দিতে, অন্যদল চাইল ধর্মঘট চালিয়ে যেতে একদল স্থির করল যে পরদিনই তারা যোগ দেবে, অন্যদল স্থির করল যে সহকর্মীদের তারা বাধা দেবো।
তাই হল। পরদিন দুদলই গিয়ে ফ্যাক্টরীর দরজার সামনে ঠেলাঠেলি আরম্ভ করল। চীঙ্কার, কোলাহল, মারামারি। ফলে পুলিস এল, গুলি চলল, কিছু লোক গ্রেপ্তার হল। যারা বাধা দিচ্ছিল, তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, অন্যদল কাজে যোগ দিল দিনের শেষে আরো অনেকেই গিয়ে যোগ দিল। ধর্মঘট ভেস্তে গেল। নামেই যারা চালু রাখল তা, বিপিন তাদের অন্যতম।
অথচ বাড়ীতে আর একদানাও চাল নাই, ছেলেটাও অসুস্থ। আহত অবস্থায় এই সব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ী ফিরল বিপিন।
সব শুনে মালা গুম হয়ে রইল, পরে বলল, ‘তুমিও গেলে না কেন কাজ করতে, অ্যাঁ?’
‘আমি! আমি যাব কেন, আমি কি কুত্তার বাচ্চা?’
মালা ঝংকার দিয়ে উঠল, ‘হয়েছে হয়েছে, ওসব বড় বড় কথা থামাও—মুরোদ নেই তার। আবার—‘
রক্তটা তখনও টগবগ করে ফুটছিল বিপিন কাছে এগিয়ে এল, বলল, ‘কি বললি?’
‘যা বললাম তা শোননি, কানে কি নোম ঢেলেছ নাকি?’ ক্ষুধার জ্বালায় মালাও আজ হিংস্র হয়ে উঠেছে।
একটা কিছু করে বসত বিপিন, নিশ্চয়ই করে বসত। এমনি সময়ে ছেলেটা কেঁদে উঠল, ক্ষীণকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ‘ভাত খাব—অমা—মা—‘
কুঁকড়ে গেল বিপিন, অবসন্নের মত একপাশে বসে পড়ল সে, বসে বসে ছেলের কান্না শুনতে লাগল। কি বিশ্রী এই কান্না! শুনতে শুনতে কেমন যেন অসহায় বোধ করে সে, দুর্নিবার একটা আক্রোশে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে, কাউকে দায়ী করতে ইচ্ছে হয় এই কান্নার জন্য।
বিড়বিড় করে সে মাঝে মাঝে বলতে লাগল, ‘কাঁদিস না, ওরে–কাঁদিস না বাবা—’
দু পয়সার বার্লি দু-দিন ধরে চলছে। শুধু জলই বলা যায়। তাই খেয়ে ছেলেটা একসময় চুপ করল, আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল। জ্বর বাড়ছে তার।
‘বিপিন—ওহে বিপিন—‘
‘কে?’
দরজার গোড়ায় বন্ধু সাধুচরণ এসে দাঁড়াল, ‘আমি। একবার বাইরে এস তো। বাজারের বুড়ো বটগাছটার নীচে তোমাদের বুড়ী বোধহয় মরে পড়ে আছে—‘
‘কি বললে?’
বিপিন উঠে দাঁড়াল, যেন বিদ্যুতের চাবুক এসে পড়ল তার গায়ে।
‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। খুব রোগা, চিনতে কষ্ট হয়—তবু ভুল করিনি আমরা—’
বিপিন ঘর থেকে বেরোল তাড়াতাড়ি। বাইরে এসে সে শুনতে পেল যে ঘরের মধ্যে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ে মালা কাঁদছে আর মায়ের কান্না শুনে ছেলেটাও ভয় পেয়ে কাঁদছে। বিপিনের শরীর শিউরে উঠল। কি বিশ্রী এই কান্না! শুধু মৃত্যুশোকের কান্না তো এত কুৎসিত নয়। বার্ধক্যে, অনাহারে, পথের ওপর মা মারা গেছে বলেই বোধ হয় মালার কান্না এত ভয়াবহ।
সেইদিন থেকে যে তার কি আরম্ভ হল তা বিপিন বোঝাতে পারে না। যখন তখন ইনিয়ে। বিনিয়ে কাঁদে মালা, নিঃশব্দে কাঁদে আর কাঁদে ছেলেটা জ্বর যখন কম থাকে তখনও ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে চারদিকে তাকায় আর নাকী সুরে কাঁদতে থাকে জানাতে থাকে তার অসংখ্য চাহিদাকে। ভাত খাবে, মাছ খাবে, এটা খাবে, ওটা খাবে সো। রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা, চোখ বসে গেছে, গাল ভেঙে গেছে, জিরজির করছে হাড়গুলো দেখে চোখে জল আসে আর কী বিশ্রী তার কান্না! সে কান্না শুনে বিপিনের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে ওঠে, সেখানকার যন্ত্রপাতি যেন উলটে পালটে ভেঙে চুরে যাবার উপক্রম করে। গগনভেদী মনে হয় ছেলেটার কান্না। ছেলেটা যেন একা কাঁদছে না, তার সঙ্গে যেন আরো অসংখ্য ছেলেরা কাঁদছে। সেই সব ছেলেরা—যাদের বাপেরা মাটি কাটে, ফসল কাটে, যন্ত্র-দানবকে পরিচালিত করে, লোহা পিটোয় আর পাথর ভাঙো অসহ্য মনে হয় তা দুকানে আঙুল পুরে তার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায় বিপিন।
ধর্মঘটকারী যে ক-জন তখনও লড়াইটা জিইয়ে রেখেছিল তারা হঠাৎ দু-দিন বাদে আবিষ্কার করল যে ফ্যাক্টরী তাদের বাদ দিয়েই চলতে আরম্ভ করেছে—তাদের কথা যেন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য শ্রমিকেরা ভুলেই গেছে। বস্তিতে অবসর সময়ে তারা সহকর্মীদের বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হল। সবাই কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাই আরো দু-দিন অপেক্ষা করে তারা শেষে এক পা এক পা করে ফ্যাক্টরীর গেটের সামনে হাজির হল। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হল না সবাইকে। কয়েকজনকে মাত্র ডেকে নেওয়া হল। আধ ঘণ্টা বাদে বুড়ো দারোয়ান এসে একটা বড় কাগজ টাঙিয়ে দিয়ে গেল ফটকের সামনে সবাই গিয়ে ভিড় করল সেখানে কি ব্যাপার, কি লিখে জানাল মালিকেরা? দুরু দুরু বুকে পড়তে আরম্ভ করল সবাই, পড়ে তাদের হৃদস্পন্দন যেন থেমে যাবার উপক্রম হল, দু-চোখের তারায় ঝিকমিক করে আগুন জ্বলে উঠল। তিন-চারজন ছাড়া বাকী বাইশজন লোক ফ্যাক্টরী থেকে বরখাস্ত হয়ে গেছে, তারা যেন পাঁচদিন বাদে তাদের প্রাপ্য টাকাকড়ি নিয়ে যায়।
বিপিনও খড়গের ঘা থেকে রেহাই পেল না। ক্লান্তপদে যখন সে বাড়ী ফিরল তখন তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, চোখের সামনে ঝিলমিল করে দুলছে সব কিছু, চিন্তাশক্তি মাঝে মাঝে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। টাকা নেই, পয়সা নেই, আগুনের মত বাজার—চাকরিটা গেল! ছেলেটার অসুখ, মরে বাঁচে ঠিক নেই, ওষুধ পথ্য কেনার সঙ্গতি নেই। তবু চাকরিটা গেল! সুবিচার চেয়েছিল যারা, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, চুরি করতে চায়নি, খুন করতে যায়নি—তবু বরখাস্ত হল সে! তাহলে? সব মিথ্যা নীতি, ন্যায়, ধর্ম—সব বাজে কথা! মানুষের জীবনটা তাহলে অদৃশ্য এক অন্ধ নিয়তির ইঙ্গিতে চলে! তাই বিপদগ্রস্ত আরো বিপদাপন্ন হয়, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়ে, অসংখ্যের রক্তমাংস দিয়ে মুষ্টিমেয়র প্রাসাদ রচিত হয়। বিপিনের মাথা যেন ফেটে পড়বার উপক্রম হল।
কিন্তু বাড়ী ফিরেই আর একটা বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়াল সে আগ্নেয়গিরির এক মুখ থেকে আর একটা মুখে গিয়ে পড়ল সো ছেলেটা জ্বরের ঘোরে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। মালা কাঁদছে।
হাত পেতে, ভিক্ষুকের মত কথা বলে অনেক সময় ধার পাওয়া যায় তা দিয়ে ডাক্তার ডাকাও হল কিন্তু ডাক্তার মাথা নাড়ল। দেরী হয়ে গেছে, টাইফয়েডের জটিলতম রূপ।
মালা বিনিয়ে বিনিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বসে বসে বিপিন তাই দেখো আর জ্বলে ওঠে তার সারা দেহ। তার ছেলেটা মারা যাচ্ছে। ব্যাধি কিন্তু তার মূলে কি? কাকে বলবে একথা বিপিন? এসব নিরর্থক। পৃথিবীতে এই হয়—নিঃশব্দে তা মেনে নেওয়াই ভাল।
অভিভুতের মত বসে বসে দেখতে লাগল বিপিন। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে গেল মালার মৃদু কান্না শুনতে শুনতে বুকের ভেতর কোথায় যেন হাড়গোড় চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ চমক ভাঙল তার, সে লাফিয়ে উঠল।
‘বাবা–ও বাবা-মাণিক আমার’—মালা চিৎকার করে উঠল।
ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল বিপিন, ফিসফিস করে, ‘কি হল? মরে গেল নাকি? অ্যাঁ?’
মালা তার কথা শুনতেই পেল না, একই ভাবে সে চিৎকার করে কেঁদে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলি বাবা?—বাবারে—‘
সে কান্না ভয়াবহ। পাঁচ বছরের মরা ছেলে কোলে করে মা কাঁদছে। মরে ছেলেটার মুখ গম্ভীর ও ভারিক্কী হয়ে গেছে। আর মালাকে যেন চেনাই যায় না। ও যেন মানুষ নয়, পুঞ্জীভূত বেদনার একটা স্কুপা যে অসহায় বেদনা, অন্যায় আর বঞ্চনাতে জাগে বিপ্লব—ও যেন সেই বেদনার একটা বহু-যুগ-সঞ্চিত পাহাড়। বিপিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর কোথা থেকে কি যেন সব হয়ে গেল। ছেলেটাকে পোড়ান হল, রাতটা কাটল, তারও পরের দিন কাটল। একসঙ্গে এতগুলো দুর্ঘটনা, এতগুলো আঘাত সব সহ্য করে চুপ করে বসেছিল বিপিন কিন্তু মালা চুপ ছিল না। বিনিয়ে বিনিয়ে, ক্লান্তকণ্ঠে কাঁদছিল সো জীবন্ত মানুষের কান্না নয় তো। পাতালের ভেতরকার অন্ধকার কোন প্রকোষ্ঠে বসে যেন সে কাঁদছে— ছেলেটা যেন তার কাঁদবার শক্তি খানিকটা চুরি করে মারা গেছে, তাই সে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে না।
বিপিন চুপ করে বসেছিল। বসে বসে মালার এই কান্না শুনছিল। বুড়ীটা শেয়াল কুকুরের মত মারা গেল, চাকরি গেল, ছেলেটা মারা গেল। এবার ঘরের মধ্যে যেন একটা অশুভ ছায়া ঘনিয়ে উঠছে। আর এই কান্না অসহ্য এই কান্না শুনলে মন হয় যেন সে ভারী অসহায়, যেন সে একটা অদৃশ্য মানুষের হাতের পুতুল। তার মাথাটা গরম হয়ে উঠল, সব চিন্তা তালগোল পাকিয়ে গেল। বুকের ভেতর আশার যে স্ফটিকের প্রাসাদটা ছিল তা যেন হঠাৎ রেণু রেণু হয়ে উড়ে গেল আর সৃষ্টি করল একটা দিকচিহ্নহীন মরুভূমিকে। চোখের সামনে আকাশের গায়ে যত সোনার রেখা ছিল, সব যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দাঁতে দাঁত চেপে সে উঠে দাঁড়াল, মালার কাছে গেল, বলল, ‘থামো’—
মালা থামল না।
‘থামো মালা—কেঁদো না—ছিঃ—’
তবু মালা থামল না।
‘কেঁদোনা—শুনছ’—ধমকে উঠল বিপিন।
আরো জোরে কেঁদে উঠল মালা, ‘ওরে বাবা, বাবা রে, না খেয়ে অচিকিচ্ছেয় যে তুই মারা গেলি রে বাবা–’
গর্জন করে উঠল বিপিন, ‘মালা–থামো—’
মালা এবার তাকাল, তার জলভরা চোখে বিদ্যুতের শিখা, তার ক্রন্দনাকুল মুখে চোখে মণিহারা সাপের ক্রুরতা।
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘না, থামব না—‘
বিপিনের সমস্ত রক্ত যেন মস্তিষ্কের কোটরে গিয়ে জমা হল, কানের কাছে এসে সশব্দে তা যেন আছড়ে পড়তে লাগল। তার চোখ লালচে হয়ে উঠল, কপালের শিরাগুলো মোটা হয়ে উঠল না, মালার কান্নাকে থামাতেই হবে সে অসহায় নয়, সে হার মানবে না, তার পেশীর মধ্যে যে শক্তি লুকানো আছে তাই দিয়ে আবার সব কিছু সে জয় করবো
‘থামবি না মালা!’
‘না’—মালা গর্জে উঠল, কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, ‘কেন থামব? তুমি থামতে বলার কে? তুমিই তো আমার দশার জন্য দায়ী—‘
‘মানে? তার মানে?’
‘আমার বুড়ী মাকে—আর কোলের ছেলেটাকে তো তুমিই খুন করেছ’—
‘আমি!’
‘হ্যাঁ–’
‘চুপ কর হারামজাদী—‘
সশব্দে, কান্না অজস্রতায় ভেঙে পড়ল মালা–মাথা নেড়ে বলল, ‘না, চুপ করব না—কি করবে তুমি? কি করবে আমার—‘
মালা আর কথা বলতে পারেনি, আর কাঁদতে পারেনি। তার কান্নায় বিকৃত, বীভৎস মুখটার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল বিপিন, লোহা-পিটানো শক্ত দুটো হাত দিয়ে হঠাৎ সে মালার গলাটা টিপে ধরেছিল। মালার মাথা খারাপ হয়েছে, এমনি ভাবে ঘা না মারলে ও থামবে না। মালার নরম গলার ওপর তার আঙুলগুলো বসে গেল। মালা বাধা দিল, মুক্ত হতে চাইলা মাঝে মাঝে দু একটা উল্কট চিকারের টুকরো ছিটকে বেরোল তার গলা থেকে বাধ্য হয়ে বিপিন তার গলাটা একটু জোরে টিপল। এখনো থামবে না মালা? বটে! বটে!
ঢং ঢং ঢং–। চমক ভাঙল বিপিনের, কান পাতল সে। জেলখানার বাইরে প্রহর ঘোষণা হল। ঢং ঢং—পাঁচটা বাজল পাঁচটা সময় শেষ। হঠাৎ কাদের পায়ের শব্দ পাওয়া গেল।
খট খট–খট খট। তিন চার জোড়া বুটের শব্দ।
ঝনন ঝনন—লোহার গেটটা সশব্দে খুলে গেল। ভেতরে এসে দাঁড়ালেন জেলার সাহেব, পেছনে বন্দুকধারী দুজন সেপাই ও একজন হাবিলদার।
‘বিপিন দাস’—
‘আজ্ঞে’—
উঠে দাঁড়াল বিপিন। হঠাৎ তার মাথাটা পরিষ্কার ও হালকা মনে হচ্ছে। পাঁচটা বেজেছে। বাইরে পৃথিবী এখনো শান্ত। কিন্তু কোথায় যেন কে এখনো কাঁদছে? একটানা কান্না। অনেকটা মালার কান্নার মত, ছেলেটার কান্নার মত, তাঁর শাশুড়ীর কান্নার মত।
‘জেলার সাহেব, কে যেন কাঁদছে, তাই না?’
জেলার সাহেব কান পাতলেন, মৃদু হেসে বললেন, ‘কৈ না তো’ একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ‘বিপিন—এবার তোমাকে যেতে হবে।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ—চলুন—‘
‘তোমার কিছু বলবার আছে বিপিন?’
‘বলবার?’ বিপিন একটু ভেবে মাথা নাড়ল, ‘আছে হুজুর’
‘কি?’
‘ওদের বলবেন যে আমি ভুল করেছি, আমার মাথার ঠিক ছিল না। গলা টিপে তো কান্না থামান যায় না।’—
‘কি বলছ তুমি বিপিন?’
‘ঠিকই বলছি হুজুর’—কেশে, গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বিপিন বলল, ‘ওদের বলবেন যেন আমার মত ওরা ভুল না করে, ওরা যেন না থামে’—
‘কাদের বলব এ কথা?’
‘ওদের হুজুর—ওদের—যারা ছেলেবৌয়ের কান্না থামাবার জন্য এখনো লড়াই করছে—‘
বুটের শব্দ তুলে করিডোর দিয়ে বেরোল ওরা। আগে জেলার সাহেব। পেছনে বিপিন, তার দু পাশে দুই বন্দুকধারী সেপাই। আর সবার পেছন হাবিলদার কোন শব্দ নেই কারো মুখে শুধু তিন জোড়া বুটের ছন্দোময় শব্দ উঠতে লাগল—খট খট–খট খট–লেফট রাইট লেফট—। তিন জোড়া পা যেন কথা বলছে, সদর্পে আত্ম-ঘোষণা করছে। আর তাদের মাঝে একজোড়া পা একেবারে নগ্ন, নিঃশব্দ। মৃত্যুর মত।
আকাশের আলোক-তোরণটা তখন একটু একটু করে খুলবার উপক্রম করেছে, জেল কম্পাউন্ডের বড় বড় আম গাছের ডালে তখন পাখীরা প্রভাতী গান গাইছে, অন্ধকার তরল হয়ে এসেছে। আলো আঁধারে মেশানো বিস্তৃত উঠোনে হঠাৎ ফাঁসির মঞ্চটাকে দেখা গেল।
জেলার সাহেব বললেন, ‘হলট—থামো।’