কাণ্ড-কারখানা
০১. বর্তমান
এখন যাঁরা বর্তমানে আছেন মর্ত্যলোকে
– রবীন্দ্রনাথ
পার্ক স্ট্রিটের পাশের একটি গলির মধ্যে অফিস। একটা পুরনো বাড়ির দোতলায়, সিঁড়িটা কাঠের। ঘরের দরজা জানলাগুলো অতিকায় আকারের, নয় ফুট বাই পাঁচ ফুট, ছাদের সিলিং প্রায় চৌদ্দ ফুট উঁচুতে।
এসব বাড়িতে এককালে সাহেবসুবোরা, সিভিলিয়ান বা ব্যারিস্টাররা থাকতেন। তাঁরা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বিদায় নিয়েছেন। তারপরে বেহাত, বেদখল হতে হতে এখন কে যে মালিক সেটা বোঝাই কঠিন।
বাড়ির মেরামত নেই, চুনকাম নেই। তবে সামনের লন-এ পুরনো দিনের দু-চারটে চাঁপা, গন্ধরাজ, কামিনী ফুলের গাছ রয়েছে। সময়ে-অসময়ে সেসব গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধ। একেকদিন অকারণে আচ্ছন্ন করে তোলে পুরনো সাহেবপাড়ার জরাজীর্ণ বাড়ির চারপাশ।
বাড়িটার নীচে-ওপরে ফুটবল খেলার মাঠের মতো লম্বা-চওড়া বড় বড় ঘরগুলোকে নানা কায়দায় পার্টিশন করে ছোট ছোট ঘর বানানো হয়েছে। এই যাকে বলে কিউবিকল।
এইসব কিউবিকলের অধিকাংশই ডাক্তারের চেম্বার। কিছু কিছু ঘরে নতুন যুগের ধোপদুরস্ত জোচ্চোর প্রমোটর, ডেভলপার কোম্পানি বানিয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে কমপিউটার কারবার, হরেকরকম ব্যবসার প্রতিষ্ঠান। এবং একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান, যাদের মডেল সুন্দরীরা এতই জনপ্রিয় যে দিনের বেলায় কখনও আসেন না। তাদের প্রবেশ ঘটে সন্ধে গড়িয়ে রাতে।
এসব কথা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের গল্প এই প্রাচীন বাড়ির দোতলায় সিঁড়ির ডান পাশের একটি ছোট কিউবিকলের ব্যানার নিয়ে। কারণ এর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
নীচে কাঠের সিঁড়ির পাশে একটা ডাকবাক্সে এবং উপরোক্ত ছোট কিউবিকলের গায়ে ইংরেজিতে কোম্পানির নাম লেখা আছে। দুই শব্দের নাম কিন্তু চট করে উচ্চারণ করা বেশ কঠিন। ইংরাজি ভাষায় লেখা হলেও যেকোনও সামান্য ইংরেজি জানা লোক বুঝতে পারে এই কোম্পানির নামের শব্দ দুটো মোটেই ইংরেজি নয়। কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারে, ফরাসি বা ইতালীয় কোম্পানি এটা।
বাগাড়ম্বর না বাড়িয়ে ওই কোম্পানির নামটা আপাতত জানিয়ে রাখছি। তবে সাদা বাংলায় জানালে বিষয়টা বোধগম্য হবে না। তাই লেটার বাক্সে সাইনবোর্ডে যেমন আছে তাই জানাচ্ছি।
KANDA-KARKHANAA
যাঁদের এরপরেও বুঝতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে তাদের সুবিধের জন্যে নামটা সাদা বাংলায় পড়ে দিচ্ছি,
কাণ্ডকারখানা
কারও কারও মনে কৌতূহল জাগতে পারে এরকম অদ্ভুত নামের কোনও কোম্পানি হতে পারে কিনা? না, পারে না, মাত্র এই একটিই আজ পর্যন্ত হয়েছে।
এর পরেই অবশ্য প্রশ্ন উঠবে এই রকম বেগতিক নামের কোম্পানি, কারখানা বা অফিসে কী কাজ হয়, কেন এই কাণ্ডকারখানা?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের ওই ইংরেজিতে নাম লেখা কিউবিকলের মধ্যে, কাণ্ডকারখানার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।
কাণ্ডকারখানার ভেতরটা অবিকল ডাক্তারের চেম্বারের মতো, বোধহয় এককালে তাই ছিল কারণ পার্টিশনের কাঠের দরজার গায়ে একটা পুরনো দিনের গ্ল্যাক্সো বেবির ছবি, তার নীচে একটা। দুই কাঁটাওয়ালা নকল প্লাস্টিকের ঘড়ি, যার কাটা দুটো হাত দিয়ে ঘোরানো যায় এবং যার উপরে লেখা আছে ডাক্তারবাবুর জন্যে ঘড়ির সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
চেম্বারটি দুই অংশে বিভক্ত। ঘরের প্রথম আধাআধি অংশ ভিজিটরস রুম। সেখানে কয়েকটি পুরনো সোফা, বাড়তি দুটো কাঠের চেয়ার, একটা লম্বা নিচু টেবিলে অনেক রকম ইংরেজি বাংলা পত্র-পত্রিকা রয়েছে। সেগুলো প্রায় সবই ময়লা, ছেঁড়া। একটা সিনেমা পত্রিকার প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে, একটি প্রশ্নমূলক প্রবন্ধের অবতারণা। উত্তমকুমার কি বোম্বাই চলে যাচ্ছেন? আর একটি খেলাধুলার পত্রে ছেঁড়া পাতায় বড় বড় অক্ষরে ঘোষণা রয়েছে পতৌদি এবার অবসর নিচ্ছেন। এই আদ্যিযুগের কাগজগুলো বোধহয় সেই ডাক্তারের চেম্বার থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।
ভিজিটরস রুমের পরেই দরজা বন্ধ প্রকৃত চেম্বার। তার মধ্যে টেবিল-চেয়ার। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের এক পাশে একটা গদিমোড়া চেয়ার, সামনে দুটো হাতলওলা সাবেকি কাঠের চেয়ার।
ওই গদিমোড়া চেয়ারটায় বসেন শশাঙ্ক রায়চৌধুরী, এই কাণ্ড-কারখানার প্রাণপুরুষ, উদ্ভাবক ও পরিচালক। সামনের চেয়ার দুটো কাণ্ডকারখানার মক্কেলদের জন্যে। অধিকাংশই গোপন ব্যাপার। অনেকে একা আসেন। অনেকে আবার স্ত্রী কিংবা কোনও অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে আনেন।
কাণ্ডকারখানায় কী ধরনের কাজ হয় সেটা বোঝনোর জন্যে দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
তার আগে একটু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন।
মনে করুন আপনি সারা সন্ধ্যা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, তাস পিটিয়ে হই হই করে কাটিয়েছেন, এখন চোরের মতো বাড়ি ফিরছেন, আপনার স্ত্রী হাতা কিংবা খুন্তি হাতে আপনার জন্য। অধীর প্রতীক্ষা করেছেন। ঘড়িতে এগারোটা বাজে।
এই অবস্থায় আপনি নিশ্চয় আপনার স্ত্রীকে বলবেন না এত রাত পর্যন্ত তাস খেলেছেন, আড্ডা দিয়েছেন। আপনাকে বলতে হবে আপনার অফিসের এক সহকর্মী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে শহরের অপর প্রান্তে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল, কিংবা মানিব্যাগ পকেটমার হওয়ার আপনি অফিস থেকে বাড়ি পর্যন্ত এগারো মাইল পথ হাঁটতে হাঁটতে আসছেন।
বলা বাহুল্য, এই দুটোর কোনওটাই তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং এর ফলে আপনাকে হয়তো আপনার স্ত্রীর হাতে আরও বেশি মার খেতে হবে।
কিন্তু আপনি যদি কাণ্ডকারখানায় এসে মাত্র দশ জেম অর্থাৎ একশো সত্তর টাকা ফি দিয়ে শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন তা হলে এমন হত না।
ঠিক এই রকম একটা কেস কাল বিকেলেই শশাঙ্কবাবুর কাছে এসেছিল। বরানগরের ধনঞ্জয়বাবু বাড়িতে কুটুম এসেছে বলে দমদম বাজারে গিয়েছিলেন ভাল মাছ কিনতে। কিন্তু গলির মোড়েই আটকে গিয়েছিলেন একটা তিন তাসের ঠেকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, বেলা চারটে পর্যন্ত চলল সেই জুয়াখেলা। বাজারের ব্যাগ পড়ে রইল ধনঞ্জয়বাবুর পায়ের কাছে।
বিকেল চারটেয় যখন ক্লান্ত জুয়াড়িরা যে যার মতো পাততাড়ি গোটাল, তখন ধনঞ্জয়বাবুর প্রতি ভাগ্যদেবী শ্রীযুক্ত জুয়া ঠাকুরানি খুবই প্রসন্না। তিনি প্রায় হাজার বারোশো টাকা জিতেছেন।
বাজারের ব্যাগটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঠেক থেকে বেরিয়ে ধনঞ্জয়বাবু ভাদ্র মাসের বিকেলবেলার কড়া রোদে হুশ ফিরে পেলেন। বাড়িতে কুটুম, রীতিমতো বড় কুটুম, স্ত্রীর বড় ভাই, তারই জন্যে ভাল মাছ কিনতে বার হয়ে তারপর এই কাণ্ড।
কিন্তু ধনঞ্জয়বাবু নানাসূত্রে কাণ্ডকারখানার খবর জানতেন। ভাসা ভাসা ভাবে কোথায় কাণ্ডকারখানার অফিসটা সেটারও ধারণা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সাহেব পাড়ায় এসে খুঁজে খুঁজে কাণ্ড কারখানায় পৌঁছে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পরে একশো সত্তর টাকার বিনিময়ে শশাঙ্কবাবুর পরামর্শ পেলেন।
শশাঙ্কবাবু ধনঞ্জয়বাবুর কথা শুনে বললেন, রদ্দি পুরনো বস্তাপচা ব্যাখ্যায় এ যাত্রা পার পাবেন। আপনাকে নতুন কৌশল নিতে হবে।
নতুন কৌশলগুলির অবশ্য রকমফের আছে। এবং তা আগেই লিখে সাইক্লোস্টাইল করে রাখা আছে। শশাঙ্কবাবু তার টেবিলের বাঁ পাশে গাদা করে রাখা ফাঁইলের মধ্য থেকে একটা ফাইল খুঁজে বার করলেন, ফাঁইলের গায়ে লেখা গৃহশান্তি।
গৃহশান্তি শীর্ষক নথিটি খুলে তার মধ্যে থেকে একটি নির্দেশাবলী বার করলেন তিনি, তারপর সেটা ধনঞ্জয়বাবুকে দিলেন।
নির্দেশাবলী অতি দীর্ঘ ও বিস্তৃত, বেশ কয়েক শিট মুদ্রিত পৃষ্ঠা। তার মধ্য থেকে কয়েকটি বাছাই করে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করছি।
(১) আপনার যদি টাকা থাকে ও সাহস থাকে, এখান থেকে সরাসরি বেহালা ফ্লাইং ক্লাবে চলে যান। একটা বিমান ভাড়া করে সেই বিমান থেকে প্যারাসুটে করে নিজের বাড়ির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। শুধু আপনার গৃহিণী কেন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই এত চমৎকৃত হবেন যে দেরি করে আসার প্রশ্নই উঠবে না।
(২) বুকে ব্যথা করছে বলে যেকোনও নার্সিংহোমে ভরতি হয়ে যান, সেখান থেকে বাড়িতে খবর পাঠান।
(৩) যেকোনও ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল বা ছাতা কেড়ে নিন। এক ঘণ্টা পরে থানার হাজত থেকে বাসায় খবর পাঠান।
এইরকম আরও অনেক আছে। পুরো ব্যবস্থাপত্রটি খুঁটিয়ে পড়ার পর ধনঞ্জয়বাবু বলেছিলেন, এর কোনওটাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। তখন টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজের কাটিং লেখা একটি নথি তুলে নিয়ে সেটা খুলে কয়েকটা কাটিং পর্যালোচনা করে শশাঙ্কবাবু বললেন, বাগবাজারের ঘাটে চলে যান। সন্ধ্যার দিকে ইলিশ উঠছে, দুটো বড় দেখে মাছ কিনুন। তারপর সেখান থেকে দৌড়ে বাড়ি চলে যান, ঘামে জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে যাবে, বাসায় প্রবেশ করে ধপ করে বসে পড়ুন, এক গেলাস জল চান। তারপর বলুন, বসনিয়ায় গণহত্যার প্রতিবাদে ঘুঘুডাঙায় পথ অবরোধ চলেছে। এই রোদ্দুরে এতটা পথ হাঁটতে হাঁটতে আসছি। আঃ আরেক গেলাস জল।
সৎ পরামর্শ পেয়ে ধনঞ্জয়বাবু খুশি মনে জোড়া ইলিশ হাতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।
এই তো আজ এখন শশাঙ্কবাবুর সামনে বসে রয়েছে নতুনবাজার থানার বড় দারোগা রমজান খান সাহেব।
খান সাহেব মহা বেকায়দায় পড়েছেন। তিনি বছর দেড়েক আগে নতুনবাজার থানার পোস্টিং নিলামে তিন লাখ টাকায় ডেকে নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে নিলামের ডাকে হেরে গিয়ে তাঁর পুরনো ব্যাচমেট তথা প্রতিদ্বন্দ্বী জগা মাইতি দুর্নীতি প্রতিরোধ দপ্তরে ইনসপেক্টর হয়ে চলে যায়। সেই জগা এখন তার পিছনে লেগেছে।
বালিগঞ্জ লেকে, লেক গার্ডেনে, লেক টাউনে, সল্টলেকে, কলকাতার মধ্যে, আশেপাশে যতরকম লেকের ব্যাপার আছে সব জায়গায় খান সাহেবের বাড়ি বা ফ্ল্যাট আছে। লেকের ওপর খুব ঝোঁক তার। এ ছাড়া বেনামিতে সতেরোটা ট্রাক, বারোটা বাস মিনিবাস, গোটা তিনেক ট্যাকসি, শখানেক রিকশা তার হয়েছে। আর সেই অনুযায়ী ধনসম্পদ বিভিন্ন ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখায় অ্যাকাউন্ট এবং লকার। প্রায় সবই ধরে ফেলেছে জগা।
ঘোর বিপদে পড়ে খান সাহেব কাণ্ড-কারখানায় এসেছেন। তার সমস্ত কথা শুনে শশাঙ্কবাবু সম্পত্তি রক্ষা শীর্ষক একটি নথি খুলে একটা ব্যবস্থাপত্র রমজান খানের হাতে দিলেন। সেটা একবার চোখ বুলিয়ে রমজান খান বললেন, দাদা, সবই ট্রাই করেছি, এই বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুক পেয়েছি, নানান সম্পত্তি, চাচার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে, দান সূত্রে পেয়েছি, লটারিতে টাকা পেয়ে করেছি কিন্তু কিছুই ধোপে টিকছে না। জগা বড় ধূর্ত।
তখন শশাঙ্ক বললেন, আমি আপনাকে নতুন একটা পরামর্শ দিচ্ছি, এটাই লেটেস্ট চলছে। আপনি যেকোনও বড় নেতা, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এমনকী লাটসাহেব বা বিচারপতির নাম বলুন, একটা গ্রহণযোগ্য নাম ভেবেচিন্তে বলবেন, তাঁর সঙ্গে কার্যকারণ কোনও সূত্রে আপনার যোগাযোগ আছে বা কখনও ছিল। তারপর বলুন এসব সম্পত্তি, টাকা পয়সা, সোনাদানা সবই তার, আপনার বেনামে তিনিই এসব করেছেন। নিজের নামে করতে অসুবিধে আছে কিনা তাই। দরকার হলে এফিডেবিট করে বলে দিন।
রমজান খান হাজার হলেও পুলিশের লোক, আদালতকে এখনও ভয় পান। তিনি বললেন, আদালতে এফিডেবিট করে এসব কথা বলা যাবে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, কলকাতায় এফিডেবিট করতে না চান, সুইজারল্যান্ড লন্ডন বা নিদেন পক্ষে ঢাকায় চলে যান। সেখানে নিশ্চয় আপনার আত্মীয়স্বজন আছেন, সেখানে গিয়ে এফিডেবিট করিয়ে ফিরে আসুন।
আশা করি ইতিমধ্যেই পাঠক-পাঠিকা ধরে ফেলেছেন, কাণ্ডকারখানা কোম্পানির কাজকর্ম কী।
এই কোম্পানির একজনই লোক। এই শশাঙ্ক রায়চৌধুরী। তিনি কীভাবে এই কোম্পানির পরিকল্পনা করলেন সেটা অনুধাবনের জন্যে শশাঙ্কবাবুর অতীত ইতিহাস একটু সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
০২. অতীত
হে অতীত তুমি গোপনে গোপনে
–রবীন্দ্রনাথ
শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর অতীত জীবনের মাত্র দুটো ঘটনা বলব।
প্রথমে তার স্কুল জীবনের একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা বলি। তখন তিনি বিদ্যালয়ের মাঝারি ক্লাসে এই সিক্স-সেভেনে পড়েন। একবার পর পর কয়েকদিন জ্বরে ভুগে প্রায় সপ্তাহখানেক কামাই করে প্রথম যেদিন অন্নপথ্য করে স্কুলে ফিরলেন সেদিনই পড়লেন বিপদে।
ভয়ংকর বিপদ। প্রথম পিরিয়ডে ইংরেজির ক্লাস। সব ছাত্র হোম ওয়ার্কের খাতা জমা দিল, শুধু শশাঙ্কবাবু বাদ। তিনি যে স্কুলেই আসতে পারেননি, হোম টাস্ক কী ছিল তাই জানতেন না। এদিকে ইংরেজির মাস্টারমশাই ছিলেন একজন পার্টটাইম গুণ্ডা। জ্বর হয়েছে, তাই আসতে পারিনি এই সব কোনও কথাই তিনি বিশ্বাস করলেন না। সদ্য রোগমুক্ত শশাঙ্ককে তিনি বেধড়ক পেটালেন।
কী করে শশাঙ্ক যেন বুঝে গেলেন সত্যি কথায় কাজ হবে না। বানিয়ে বিশ্বাসযোগ্য বিচিত্র কারণ দেখাতে হবে। মাস দুয়েক মামার বাড়িতে মাসির বিয়েতে দিন দশেক কাটিয়ে স্কুলে ফিরতেই আবার সেই ইংরেজি মাস্টারের হাতে পড়লেন শশাঙ্কবাবু।
কিন্তু এবার ব্যাখ্যা প্রস্তুত ছিল। মামার বাড়ি তিনি গিয়েছিলেন তবে সেটা মাসির বিয়েতে, তা বললেন না। বদলে যা বললেন, সেটা হল তার দাদু মানে মাতামহ আমলকী গাছ থেকে আমলকী পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে ফেলেছেন, সেই সংবাদ পেয়ে তিনি তার মাকে সঙ্গে করে মামার বাড়িতে গিয়েছিলেন, অবস্থা গুরুতর দেখে এ কয়দিন তাকে মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকতে হয়।
ছাত্রের এই কথা শুনে মারকুটে মাস্টার পর্যন্ত উদ্যত চড় থামিয়ে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলেন, দাদু, মানে তোমার মার বাবা?
শশাঙ্ক বলেছিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাস্টারমশায় তখন আবার প্রশ্ন করেন, বয়েস নিশ্চয় অনেক হয়েছে।
শশাঙ্ক জানিয়েছিলেন, বেশি নয়, এই সদ্য বাহাত্তর হয়েছে।
মাস্টারমশায় স্তম্ভিত হয়ে বললেন, বাহাত্তর বছর কম বয়েস নাকি? এই বয়েসে তোমার দাদু গাছে উঠে ফল পাড়েন।
শশাঙ্ক জানিয়েছিলেন, শুধু আমলকী নয়, আম, লিচু এমনকী দাদু তরতর করে নারকেল গাছের মাথায় উঠে গিয়ে ডাব-নারকেল পেড়ে আনেন।
হতবাক মাস্টারমশায় সেদিন শশাঙ্ককে মারেননি। পরে নিয়মিত সেই কল্পিত দাদুর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। মাস তিনেক পরে যখন তিনি জানলেন যে সেই বৃদ্ধ সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং আবার গাছে উঠে ফল পাড়া আরম্ভ করেছেন, তখন তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচলেন।
ছাত্রজীবনের পরে শশাঙ্কবাবুর চাকুরি জীবনের কথা বলতে হয়। বাইশ বছর বয়সে একটা সরকারি অফিসে কেরানির চাকরিতে তিনি প্রবেশ করেন। এ বয়েসটায় চাকরি করতে ভাল লাগে না। শশাঙ্কবাবু রাত জেগে চুটিয়ে আড্ডা দিতেন। ফলে মাঝেমধ্যেই অফিসে কাজের সময় ঘুমিয়ে পড়তেন।
শশাঙ্কবাবু দুর্ভাগ্যক্রমে রমলা পাল নামে এক মহিলা বড়বাবুর অধীনে কাজ করতেন। অবিবাহিতা, মধ্যবয়সিনী কুমারী রমলা পাল ভারি খিটখিটে স্বভাবের ছিলেন। তা ছাড়া খুব খোঁচা দিয়ে কথা বলতেন।
একদিন শশাঙ্কবাবু প্রায় সারারাত আড্ডা দিয়ে সকালে স্নান-খাওয়া করে অফিস যাওয়ার আগে বিছানায় একটু গা এলিয়ে শুয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। ফলে অফিসে আসতে দেরি হয়ে যায়।
বড়বাবু মানে রমলা পালকে তিনি নিজে থেকেই জানান যে বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাই এই বিলম্ব। তার ব্যাখ্যা শুনে রমলা পাল কাষ্ঠহাসি হেসে জানতে চান, সে কী আপনি বাড়িতেও ঘুমোন নাকি?
এর পরে যে মাস ছয়েক চাকরিতে ছিলেন, শশাঙ্কবাবু আর রমলা পালকে একটিও সত্যি কথা বলেননি। একবার বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে পরের দিন বরযাত্রীর সাজে সিল্কের পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরে বেশি দেরি করে কনের বাড়ি ডোমজুড় থেকে অফিসে এসে পৌঁছলেন।
বলা বাহুল্য, একে দেরি, তার ওপরে এই সাজপোশাক দেখে রমলা পাল কটাক্ষ করেছিলেন। তখন শশাঙ্কবাবু বললেন, আমার বড় পিসিমার বিয়ে ছিল ম্যাডাম।
রমলা পাল বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনার বড় পিসিমার বিয়ে?
শশাঙ্কবাবু বললেন, তেমন বয়েস হয়নি। এই আর্লি ফিফটি। আমারই এক বন্ধুকে বিয়ে করলেন।
রমলা পাল বললেন, আপনার বড় পিসিমা আপনার বন্ধুকে বিয়ে করলেন, আর্লি ফিফটিতে?
ইয়েস ম্যাডাম, শশাঙ্কবাবু বললেন, আপনার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড় হবেন।
এরপর থেকে রমলা পাল কেমন সলজ্জ দৃষ্টিতে শশাঙ্কবাবুর দিকে তাকাতেন। তাঁকে দেখলেই শাড়ির আঁচলটা দিয়ে গলা ঢাকা দিতেন কিংবা অন্যমনস্কভাবে হাতের আঙুলে জড়াতেন।
ইতিমধ্যে শশাঙ্কবাবু বুঝে গেছেন যদি ঠিকমত মিথ্যার বেসাতি করা যায় তাহলে তার থেকে লাভজনক আর কিছু নেই।
স্ত্রীকে, বাবাকে, অফিসের ওপরওলাকে, বাড়িওলাকে, প্রেমিকাকে–পাড়ার মাস্তানকে, সবাইকে কত কারণে কতরকম ব্যাখ্যা দিতে হয়। সেই ব্যাখ্যা যদি চমকপ্রদ অথচ বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবেই কাজ চলে, না হলে বিপদ অনিবার্য।
প্রথম প্রথম শৌখিনভাবে একে-ওকে চেনা-জানাদের পরামর্শ দিতেন শশাঙ্ক রায়চৌধুরী। এখন ক্রমশ তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, না ছেড়ে উপায়ও ছিল না। শেষের। দিকে রমলা পাল বড়ইব্রীড়াপরায়ণা হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে দেখলেই কেমন ডগমগ হয়ে উঠতেন।
চাকরি ছেড়ে অবশ্য শশাঙ্ক রায়চৌধুরীর কোনও ক্ষতি হয়নি। কাণ্ড-কারখানার এখন রমরমা চলছে। প্রতি সন্ধ্যায় হাজার খানেক টাকা আয় হয়।
বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করেও যাওয়া যায়। পুজোসংখ্যার জন্যে যে লেখা ১ জুন দেয়ার কথা ছিল সেটা এই যে আমি এই ভাদ্রশেষেও লিখছি তা সম্ভব হয়েছে শশাঙ্কবাবুর কৃপায়। তারই পরামর্শে হাতের বুড়ো আঙুলে একটা মিথ্যে ব্যান্ডেজ বেঁধে সম্পাদকদের দেখিয়েছি, ঘুমের মধ্যে টিকটিকিতে কামড়িয়ে দিয়েছে বলে। তারা যে আমার কথা অবিশ্বাস করেননি, আমার জন্যে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, এই লেখা ছাপা হওয়াই তার প্রমাণ।