দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ৮

আট

খবরটা শুনে খুব খুশি হয়ে তড়িঘড়ি সেক্রেটারির বাড়িতে চলে এল সদানন্দ। ভদ্রলোক তখন টেলিফোনে কথা বলছিলেন। কথা শেষ হওয়া মাত্র সদানন্দ মুখ খুলল, ‘তাহলে ওঁদের এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি?’

সেক্রেটারি প্রথমে বুঝতে পারেননি। তাঁকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সদানন্দ বলল, ‘শুনলাম আপনি নতুন মাস্টারকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন!’

মনে পড়ল সেক্রেটারির, ‘ও, হ্যাঁ। তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু মুশকিলে পড়ে গিয়েছি ভাই। এইমাত্র ফোন এল, আমার স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমাকে এখনই যেতে হবে নীচে। আমি না থাকলে ওকে এখানে নিয়ে আসা ভুল হবে।’

সদানন্দর মুখ শুকিয়ে গেল। মুখে বলল, ‘তা অবশ্য—!’

সেক্রেটারি বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি ওখানে সবারই অসুবিধে হচ্ছে। তখন হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়াই উচিত ছিল। দেখি, কী করা যায়!’

‘আপনি তো এখনই চলে যাবেন!’

‘ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই এতক্ষণে চেম্বারে এসে গিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে কথা বলেই যাব।’

সেক্রেটারি চেম্বারে আসার আগেই সদানন্দ ডাক্তার বনবিহারীকে রাস্তাতেই ধরল, ‘শুনেছেন? সেক্রেটারির স্ত্রী ভয়ংকর অসুস্থ। উনি এখনই নীচে চলে যাচ্ছেন।’

‘আহা! কী হয়েছে?’ বনবিহারী দাঁড়ালেন। সদানন্দ হাত ওলটালো, ‘তা জানি না। তাতে আমার বিপদ বাড়ল।’

‘তার মানে?’

‘শুনেছিলাম নতুন মাস্টারকে সেক্রেটারির বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। উনি না থাকলে, সেটা চলে গেল বিশ বাঁও জলে।’ সদানন্দ হতাশা চেপে রাখল না।

‘খুব অসুবিধে হচ্ছে?’

‘হবে না? একজনের থাকার ব্যবস্থা, সেই জায়গায় দুজন থাকছে। তাও মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু দু-বেলা রুগির পথ্য তৈরি করতে করতে আমার বউয়ের হাড়ে যে দুব্বো গজিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া আর একটা কথা, স্কুলের নতুন মাস্টার অসুস্থ হয়েছেন, ভাড়াটে হিসেবে আছেন, এটা একররকম। তাঁর ওপর আস্থা রাখা যায়। কিন্তু একটা দামড়া লোক নাকের ডগায় বসে আছে চব্বিশ ঘণ্টা, বাড়িতে সোমত্থ মেয়েছেলে, বুঝতেই পারছেন, ব্যবসা ছেড়ে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিতে তো পারি না!’

‘আপনি কি আপনার স্ত্রীর কথা বলছেন?’ বনবিহারী অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করেন।

‘আজ্ঞে।’ মাথা নাড়ল সদানন্দ, ‘বড় চঞ্চলা ওর মতি।’

বনবিহারী গম্ভীর হলেন। আর কথা বাড়ালেন না।

সেক্রেটারি যখন তাঁর চেম্বারে এলেন তখন রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে। তাদের অপেক্ষায় রেখে রাস্তায় নেমে এলেন বনবিহারী। সেক্রেটারি সংক্ষেপে তাঁর সমস্যার কথা বলে বললেন, ‘সদানন্দ যেভাবে আপত্তি করছে তাতে ওর বাড়িতে নতুন মাস্টারকে রেখে দেওয়া উচিত হবে না। এখন যে অবস্থা তা হাসপাতালে ভরতি করার কেস নয়। আমার সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনি কি দয়া করে ওকে আপনার বাড়িতে রাখতে পারবেন? আপনার বাড়িতে তো কোনও মহিলা নেই, কারও অনুমতির প্রয়োজন নেই।’

হাসলেন বনবিহারী, ‘স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। কালীচরণ দেখাশোনা করবে। তা ছাড়া পরিমলবাবুও আছেন।’

নীচে চলে যাওয়ার আগে সেক্রেটারির গাড়ি সদানন্দর বাড়ি থেকে নতুন মাস্টার এবং পরিমলকে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পৌঁছে দিল। সন্তান তখন নিজের ঘরে পড়ছিল। গাড়ির আওয়াজ শুনে ছুটে বাইরে এসে প্রথমে দেখল পরিমলকে। অচেনা মানুষকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে সে অবাক হল। সেক্রেটারির গাড়ির ড্রাইভার সন্তানকে জানাল, ‘স্কুলের নতুন মাস্টারের শরীর খুব খারাপ। তাই ডাক্তারবাবু নিজের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করবেন। উনি ভালো করে হাঁটতে পারছেন না। বাড়ির লোককে বলো বিছানা করে দিতে।’

ততক্ষণে গাড়ির কাছে গিয়ে নতুন মাস্টারকে দেখতে পেয়ে গেছে সন্তান। পেছনের সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে পড়ে আছেন। যে মানুষটাকে সে বাস থেকে নামতে দেখেছিল, এই বাড়িতে এনেছিল, তার সঙ্গে মিল খুব কম। পরিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী?’

‘সন্তান।’

‘আচ্ছা! অদ্ভুত নাম তো। গুড। বাড়িতে আর কে কে আছেন?’

এই সময় কালীচরণ বেরিয়ে এল। সব শুনে নতুন মাস্টারকে দেখে সে চিনতে পারল। একটু দ্বিধা তার ছিল কিন্তু সেক্রেটারির ড্রাইভারের কথা তো অবিশ্বাস করা যায় না। পরিমলের সঙ্গে ধরাধরি করে সে নতুন মাস্টারকে যে ঘরে নিয়ে এল সেটা ইদানীং ব্যবহার করা হয় না। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কালীচরণ জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু কখন আসবেন?’

পরিমল জবাব দিল, ‘আমি জানি না ভাই। হঠাৎ ওই গাড়ির ড্রাইভার গিয়ে বলল, আমাদের এই বাড়িতে আসতে হবে। যেখানে ছিলাম সেই বাড়ির ভদ্রলোকের নিশ্চয়ই অসুবিধে হচ্ছিল। এখানে আর কে কে আছেন?’

সন্তান বলল, ‘আমরা তিনজন। আর কেউ নেই।’

ডাক্তার বনবিহারী আজ তাড়াতাড়ি চেম্বার থেকে ফিরলেন। নতুন মাস্টারকে পরীক্ষা করে তাকে কীরকম খাবার দেওয়া হবে তা কালীচরণকে বুঝিয়ে দিলেন।

পরিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার কি মনে হয় দিন দশেকের মধ্যে ও সুস্থ হবে?’

‘হওয়া উচিত। তবে তারপরে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে স্কুলে যাওয়া উচিত।’

পরিমল বলল, ‘আমি একটু সমস্যায় পড়ে গেছি। ওর কাছে দুদিন থেকে চলে যাব ভেবে এসেছিলাম। ওর অসুখ দেখে যেতেও পারছি না, অথচ যাওয়া দরকার। কাজকর্ম আছে।’

‘আপনি কী কাজ করেন?’ ডাক্তার বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘একটা এনজিওর সঙ্গে আছি। দুমকা অঞ্চলে।’

‘ও। আপনার প্রয়োজন বেশি বোধ করলে চলে যেতে পারেন। আমার এখানে ওর কোনও অসুবিধে হবে না। আমি আছি, কালীচরণও থাকবে।’

সন্তান বলল, ‘আমিও।’

হাসলেন ডাক্তার বনবিহারী, ‘তুমি তো স্কুল খুললেই চলে যাবে।’

পরদিন সকালে ডাক্তার বনবিহারী বেরিয়ে গেলে প্রাতঃরাশ শেষ করে কথা বলল সুজয়। গলার স্বর খুব দুর্বল। রক্তশূন্য মুখে হাসির চেষ্টা করল সে, ‘আবার তোমাদের বাড়িতে এলাম।’

সন্তান পাশের চেয়ারে বসেছিল। পরিমল কিছু কিনতে বেরিয়েছে। সন্তান বলল, ‘এখন আপনার শরীর কেমন লাগছে?’

‘অনেকটা ভালো। মনে হচ্ছে এবার মরব না।’

‘যাঃ। দাদু বলেছেন আপনি দশদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবেন।’

‘তোমার দাদুর জন্যেই আমি বেঁচে গেলাম।’ শ্বাস ফেলল সুজয়।

‘আপনি আর কথা বলবেন না।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। তোমাকে কি বিশ্বাস করতে পারি?’

সন্তান অবাক হয়ে তাকাল। আজ পর্যন্ত এরকম প্রশ্ন কেউ তাকে করেনি। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল নীরবে। তারপর জোর দেওয়ার জন্যে মুখে বলল, ‘পারেন।’

‘পরিমলদা চলে যাবেন। যাওয়ার আগে উনি কয়েকটা বই আমাকে দেবেন। তুমি ওই বইগুলো যত্ন করে রেখে দেবে? আর বইগুলো যেন কেউ না দেখে!’ সুজয় বলল।

‘কী বই? গল্পের বই?’ সন্তান আগ্রহী হল।

ফ্যাকাশে হাসি হাসল সুজয়, ‘না গল্প নয়, জীবনের কথা।’

‘বেশ। রেখে দেব।’ সন্তান মাথা নাড়ল।

‘আর কাউকে দেখিও না।’

‘ঠিক আছে।’

এটুকু কথা বলতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল সুজয়। সে চোখ বন্ধ করলে সন্তান বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

সুজয়ের কথাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। গল্পের বই নয়, জীবনের কথা। জীবনের কথা যে বইতে লেখা থাকে তা কীরকম বই? কেন সেই বই কাউকে দেখাতে নিষেধ করলেন উনি? ক্লাস টিচারের কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছেন, ‘বই মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তোমাদের ইচ্ছে হলে যে-কোনও বই পড়তে পারো। তবে সব বই পড়ে হয়তো তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে না। বোঝার জন্যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশুনার অভিজ্ঞতা থাকা দরকার।’

পরিমলের ব্যস্ততা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। বাজার থেকে ফিরে এসে সুজয়ের সঙ্গে কথা বলে সে ঘোষণা করল চলে যাওয়ার কথা। দুপুরে খেতে এসেছিলেন ডাক্তার বনবিহারী। খাওয়ার টেবিলেই তিনি জানতে পারলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খুব জরুরি কোনও কাজ পড়েছে?’

‘হ্যাঁ। আপনাদের পোস্ট অফিস থেকে ফোন করেছিলাম। জানলাম আমার এখনই যাওয়া দরকার।’ পরিমল খাবার চিবোতে চিবোতে বলল।

‘তাহলে তো যাওয়া উচিত। আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ভাইকে আমরা ঠিকঠাক রেখে দেব।’ ডাক্তার বনবিহারী বললেন।

‘আপনার এই বাড়িতে ফোন নেই, না?’

‘না। দরকার পড়ে না। সবাই জানে আমি সকালে আর সন্ধ্যায় কোথায় থাকি।’

‘তবু, মাঝরাতে যদি কারও দরকার হয়–।’

‘ছোট জায়গা তো। সাইকেলেই চলে আসে। কিন্তু যেতে হলে আপনার আজই যাওয়া উচিত। শুনলাম আজ বিকেল থেকে বৃষ্টি নামবে। একবার নামলে কখন থামবে তা আগাম বলা যায় না। আপনি যেখানে থাকেন সেখানকার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গেলে তেমন কোনও খবর হলে আমি জানিয়ে দিতে পারি।’

‘টেলিফোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। পেলেই জানিয়ে দেব।’

সন্তানের মনে হচ্ছিল পরিমল কথা বলছে বলতে হয় বলে। কোথাও যেন ফাঁক থেকে যাচ্ছে। মন থেকে যে বলছে না তা বোঝাই যাচ্ছে।

দুপুরের খাওয়ার পর ডাক্তার বনবিহারী একটু বালিশে মাথা রাখেন। কালীচরণ তখন রান্নাঘরের পাট চুকোতে ব্যস্ত। কৌতূহলী সন্তান সুজয়ের কাছে যেতেই ওরা কথা বন্ধ করল। তাকে দেখে পরিমল হাসল, ‘এসো। তোমাকে তো সুজয় বইয়ের কথা বলেছে।

‘হ্যাঁ!’ মাথা নাড়ল সন্তান।

‘যত্ন করে এমনভাবে রাখবে যাতে অন্য কেউ দেখতে না পায়। পরে যখন সুজয় ভালো হয়ে যাবে তখন এসে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে।’ পরিমল বলল।

‘আমার স্কুল খুলে গেলে কী হবে?’

‘আহা, তার পরও তো ছুটিতে আসবে। থাক না তোমার কাছে। ডাক্তারবাবুও যেন না দেখে।’ পরিমল তার ঝোলা থেকে একটা বড় প্যাকেট বের করে এগিয়ে ধরল, ‘নাও। বেশি নয়, পাঁচটা বই আছে।’

হাতে নিল সন্তান, বলল, ‘বেশ ভারী।’

‘যে সব বইয়ে গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা থাকে সেগুলোর ওজন ভারী হয়। তা কোথায় রাখবে এই প্যাকেটটাকে, কিছু ভেবেছ? পরিমল সন্তানের কাঁধে হাত রাখল।

‘আমার আলমারিতে।’

‘সেখানে কেউ হাত দেয় না?’

‘না।’ মাথা নাড়ল সন্তান।

বিকেলের আগের বাস ধরে চলে গেল পরিমল। যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কথা বলেছিল সুজয়ের সঙ্গে। ডাক্তার বনবিহারী তখনও বিছানায় ছিলেন। পরিমল সন্তানকে বলেছিল, ‘ওঁকে বিরক্ত করার দরকার নেই, আমি পরে যোগাযোগ করব।’

বাড়ির সামনের হাইওয়ে থেকে বাস ধরেছিল পরিমল। সন্তানের কেবলই মনে হচ্ছিল যে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এ বাড়িতে ঢুকেছিল তার আচরণের সঙ্গে এই চলে যাওয়া মানুষটার কোনও মিল নেই।

দুদিন বাদে, সম্ভবত কালীচরণের পথ্য খেয়ে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠল সুজয়। সন্তানের পড়াশুনার বাইরের সময়টায় সে গল্প করতে চাইত। সুজয়ের কথা শুনতে বেশ ভালো লাগত সন্তানের। যেমন, সুজয় তাকে বোঝাল, ‘প্রকৃতি মানুষ সৃষ্টি করলেন। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বলা হয়েছে আগে পুরুষের জন্ম হয়েছিল। তারপর নারী।’

সঙ্গে-সঙ্গে সন্তান বলেছিল, ‘হ্যাঁ। ঈশ্বর প্রথমে আদমকে সৃষ্টি করেন। তারপর আদম একা বলে ইভকে তৈরি করেন।’

মাথা নেড়েছিল সুজয়, ‘তাই লেখা হয়েছে। কিন্তু প্রথম যখন জলে অ্যামিবার জন্ম হল তখন কি কেউ বলেছিল ঈশ্বর অ্যামিবা সৃষ্টি করেছিলেন! মানুষের ঈশ্বরভাবনা হল একটা বিশ্বাস থেকে যা তাকে শক্তি যোগায়। যখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, সামনে কোনও আশার আলো থাকে না অথবা সে ভাবে তার শক্তি খুব সীমিত তখন সে ঈশ্বরকে তৈরি করে তাঁর ওপর নির্ভর করলে মনে শক্তি পায়। একজন ঈশ্বর সেই অনন্তকাল থেকে এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছেন, কোটি কোটি মানুষের সমস্যা তাঁর কাছে পৌঁছাচ্ছে আর তিনি সমাধান করছেন? এরকম কি হয়? অ্যামিবা থেকে যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে জলচর প্রাণী জন্মেছিল, বিবর্তনের নিয়ম মেনে যেমন বনমানুষ থেকে মানুষের জন্ম হয়েছিল তা তো বৈজ্ঞানিক সত্যি। সেই নিয়মে মানুষ জন্মাল। দুই জাতের মানুষ। একটি জাতের নাম পুরুষ জাত, অন্যটির নাম নারীজাত। এর বাইরে কোনও জাতের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। যদি কেউ অন্য জাতের কথা বলে তাহলে জানবে তা মানুষই তৈরি করেছে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যে।’

‘তাহলে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান—?’ থেমে গেল সন্তান।

‘এগুলো মানুষের তৈরি। আবার দ্যাখো হিন্দুদের মধ্যে কিছু লোককে হরিজন বলে অবহেলা করা হয়েছে। তারা কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ কায়স্থ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ নীচু জাতের বলে চিহ্নিত করে সিডিউল কাস্ট বলা হয়েছে। মানুষের চৈতন্য যেদিন পরিষ্কার হবে সেদিন এসব ধুয়ে মুছে যাবে, তখন তারা স্বীকার করবে তাদের দুটো জাত, পুরুষ এবং স্ত্রী।’

কথাগুলো খুব সত্যি বলে মনে হল সন্তানের।

সুজয় হাসল, ‘এ তো মোদ্দা কথা। মানুষ পৃথিবীতে আসার পর থেকে আর একটা সমস্যা তৈরি হল। তুমি যদি ইতিহাস বই পড়ো তাহলে তোমাকে কাদের কথা পড়তে হবে?’

‘রাজা, বাদশাদের।’

‘অর্থাৎ যাদের হাতে ক্ষমতা ছিল তাদের কাহিনি। এই সব কাহিনিগুলো যাঁরা তখন লিখেছিলেন তাঁরা ক্ষমতা যাদের দখলে ছিল তাদের খুশি করতে লিখেছিলেন। না লিখলে মৃত্যু অবধারিত ছিল। ফলে ওই সব কাহিনিতে অনেক বানানো গল্প ছিল যা ক্ষমতাবানকে খুশি করতে লেখা হয়েছিল। ধরো, তুমি বাবরের ইতিহাস পড়ছ। তিনি কী কী করেছেন তা জানছ। কিন্তু তাঁর প্রজাদের কথা কিছুই জানতে পারছ না। সেইসব প্রজারা পেট ভরে খেতে পেত কিনা, তারা কি সুখী ছিল, না দুঃখী সেসব খবর কাহিনিগুলোতে খুঁজে পাবে না। শাজাহান তাজমহল তৈরি করিয়েছিলেন। বহু বছর ধরে তিল তিল করে ওই আশ্চর্য সুন্দর স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়েছিল যা দেখতে এখনও মানুষ ছুটে যায়। আমরা ইতিহাস পড়ে শাজাহানের রুচির প্রশংসা করি, তাঁর স্ত্রীকে তিনি যে অত্যন্ত ভালোবাসতেন তা জেনে খুশি হই। কিন্তু ওই তাজমহল তৈরি করতে পরিশ্রমে, অভুক্ত হয়ে কত শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল তার খবর আমরা সেই কাহিনিতে পাই না। ওই সব শ্রমিকের চোখের জলের দাগ তাজমহল থেকে মুছে দিয়েছেন কাহিনিকাররা। তাই ইতিহাস হল রাজাবাদশার কাহিনি যেখানে সাধারণ মানুষের কোনও অস্তিত্ব নেই। ফলে দুটো শ্রেণি তৈরি হয়ে গেল। একটা শ্রেণি, যাদের সব আছে; আর একটা শ্রেণি যাদের কিছু নেই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই দুটো শ্রেণিতে মানুষ বেঁচে আছে। এই দুই শ্রেণিতেই মানুষের দুই জাত মিশে গেছে। হ্যাভ এবং হ্যাভ নট। পৃথিবীতে হ্যাভেদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। হ্যাভ নটরাই সংখ্যায় বহুগুণ বেশি। কিন্তু সংখ্যায় নগণ্য হয়েও শুধু অর্থের জোরে ক্ষমতা দখল করে রেখে হ্যাভেরা হ্যাভ নটদের ওপর লাঠি ঘুরিয়ে যাচ্ছে।’ সুজয় একটানা কথাগুলো বলে শ্বাস ফেলল।

মন দিয়ে শুনছিল সন্তান। বলল, ‘যাদের নেই তারা যদি সংখ্যায় খুব বেশি হয় তাহলে তারা প্রতিবাদ করছে না কেন? কেন মুখ বুঁজে মেনে নিচ্ছে?’

‘কেন মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে এটা তোমাকে এখন বোঝালে তুমি পরিষ্কার বুঝতে পারবে না। তোমাকে চোখ-মন খোলা রেখে বুঝতে হবে।’ চোখ বন্ধ করল সুজয়। তাকে এখন বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চুপচাপ সরে এল সন্তান।

বারান্দায় গিয়ে সে আকাশের দিকে তাকাল। সুজয় এতক্ষণ ধরে যেসব কথা বলল তার সবটা সে বুঝতে পারেনি। স্ত্রী এবং পুরুষ জাতের ব্যাপারটা ঠিক আছে, পরের যে শ্রেণির কথা বলল সেটা সে অস্পষ্ট বুঝেছে। তার ওপর ভগবানের ব্যাপারটাও তার কাছে অভিনব। ভগবান, ঈশ্বর, দেবতা অথবা গড কিং বা আল্লা, কত নামে মানুষ তাঁকে ডাকে। কালীচরণ আবার হাতজোড় করে মা কালী মা কালী বলে। তার মুখে ভগবান বা ঈশ্বর শোনা যায় না। ওদিকের সেনগুপ্ত বাড়ির বুড়োদাদু গত বছর যখন মারা গেলেন তখন শ্মশানযাত্রীরা বল হরি, হরি বোল বলতে বলতে নিয়ে গিয়েছিল। কালীচরণ তাকে বুঝিয়েছিল ওরা ভগবান হরিকে ডাকতে ডাকতে নিয়ে যাচ্ছে যাতে তিনি শান্তি দেন। সে মেনে নিয়েছিল, ভগবানের আর এক নাম হরি। কিন্তু হরি বা কালী বলে কেউ ঈশ্বরকে ডাকে না। ওখানে সবাই গড বলে। গড ঈশ্বর এবং তার ছেলের নাম যিশাস। অথচ মা দুর্গা যিনিও নাকি ভগবান, তাঁর দুই ছেলে থাকলেও অন্য কোনও ভগবানের ছেলেমেয়ে আছে কিনা তা সন্তানের জানা নেই। কালীচরণ তাকে বুঝিয়েছে, সব ভগবানই নাকি একজন, মানুষ তাঁকে নানান নামে ডেকে থাকে।

কিন্তু ডাক্তারদাদুর মুখে সে কখনওই ঈশ্বর বা ভগবানের কথা শোনেনি। কালীচরণের ঘরে গেলে দেখা যাবে দেওয়াল জোড়া ক্যালেন্ডারে ছাপা ভগবানের ছবি। কালীচরণ বলে, আমাদের দেশে তেত্রিশ কোটি দেবতা আছে। যে ক’জনের ছবি পেয়েছি, টাঙিয়েছি। অথচ ডাক্তারদাদুর ঘরে একটা দেবতার ছবিও টাঙানো নেই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল সে। তিনি বলেছিলেন, ‘সব জায়গায় যিনি আছেন, তাঁকে দেওয়ালে টাঙাতে যাব কেন?’

কথাটার মানে পরিষ্কার হয়নি সন্তানের কাছে। এই তিনি কি একজন মানুষের চেহারাওয়ালা কেউ যাঁর শক্তি ও ক্ষমতার শেষ নেই? হোন বা না হোন এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের প্রেয়ার শোনার জন্যে যত কান থাকা দরকার তাঁর তো থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবী অন্য নক্ষত্র থেকে ছিটকে আসা একটি অগ্নিপিণ্ড। যা কোটি কোটি বছর ধরে ধীরে ধীরে শীতল হয়েছে। এখানকার যে আবহাওয়া ছিল তাতে পৃথিবীর বুকে জল জমেছে। আর সেই জল থেকে প্রাণের উৎপত্তি। সেইসময় ঈশ্বর কোথায় ছিলেন? তিনিও কি অন্য নক্ষত্র থেকে ছিটকে এখানে এসেছিলেন? কোনও গ্রহ-নক্ষত্রে তো মানুষের অস্তিত্ব নেই, তাই সেই ঈশ্বরও কখনও মানুষ দেখেননি তাহলে মানুষ তৈরির কথা ভাবলেন কী করে? ওসব কথা যদি মানতে হয় তাহলে ঈশ্বর তখন খুব একা ছিলেন।

তারপরেই তার মনে হল ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন তাহলে তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাবান, তাঁর সব আছে। তাঁর শ্রেণিতে কেউ পড়ে না। পৃথিবীর বাকি মানুষেরা, যারা তাঁকে বিপদে-আপদে ডাকাডাকি করে তারা অন্য শ্রেণি। সুজয় স্যার যে কথাটা বলল, যা সে ঠিক বুঝতে পারেনি তা এইভাবেও ভাবা চলে। ঈশ্বর হ্যাভের শ্রেণিতে আর পৃথিবীর সব মানুষ হ্যাভ নটদের শ্রেণিতে রাখাই উচিত হবে।

বিকেলবেলায় স্কুলের দিদিমণিকে তাদের বাড়িতে আসতে দেখল সে। একটু আগে ডাক্তার বনবিহারী বেরিয়ে গেছেন চেম্বারের দিকে। সন্তান এগিয়ে গেল, ‘উনি বাড়িতে নেই।’

‘ও। কোথায় গেছেন?’ শিবানীর কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘আজ বোধহয় একটু তাড়াতাড়ি চেম্বারে গেছেন।’

হেসে ফেলল শিবানী, ‘ওহো! না। আমি ডাক্তারবাবুর কাছে আসিনি। আমাদের স্কুলের নতুন মাস্টারমশাই তো তোমাদের বাড়িতে আছেন, কেমন আছেন এখন?’

‘এখন আগের থেকে ভালো। অনেক কথা বলেছেন।’ সন্তান হাসল।

শিবানী চারপাশে তাকাল। হঠাৎই, ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে সে। এখানে চাকরি করতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষটা আত্মীয়-বন্ধুবান্ধনহীন হয়ে রয়েছেন বলে দেখতে এসেছিল। তা ছাড়া উনি জয়েন করায় তার চাকরি চলে গেছে বলে ওঁর হয়তো খারাপ লাগতে পারে। তাই ওঁকে স্বস্তিতে রাখতে সে জানিয়ে দেবে খবরটা। উনি কাজ শুরু করলেও তাকে ছয়মাস এক্সট্রেনশন দেওয়া হয়েছে।

‘আপনি কি সুজয় স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চান?’ সন্তান জিজ্ঞাসা করল।

‘ঠিক আছে, চলো।’

জানলাগুলো বন্ধ করে ঘরে ধুনো দিচ্ছিল কালীচরণ। সুজয়ের ঘুম ভেঙে যেতে সে উঠে বসল, ‘এর মধ্যেই জানলা বন্ধ করলে ভাই?’

‘না করলে হু-হু করে মশা ঢুকবে। চড়ুইপাখির সাইজ ব্যাটাদের।’ কালীচরণ কথা শেষ করে দেখল দরজায় সন্তান আর এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। সে বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নন্দলালবাবুর মেয়ে না?’

‘আমি শিবানী।’ হাতজোড় করল শিবানী সুজয়ের দিকে তাকিয়ে, ‘কেমন আছেন?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *