দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ৭

সাত

গাড়িতে উঠে সেক্রেটারি বললেন, ‘আপনি বললেন বিকেল থেকে লোক মারফত খাবার পাঠাবেন। সেটা কী করে সম্ভব? দুজন মানুষ খাবে। একজন খুব অসুস্থ। তার পথ্যি আলাদা হবে। আর সুস্থ মানুষ তো সেই পথ্যি খেতে পারে না।’

‘অ্যাঁ?’ ডাক্তারবাবুর খেয়াল হল, ‘তাই তো!’

সেক্রেটারি বললেন, ‘তার চেয়ে সদানন্দবাবুকেই বলি মাস্টারমশাইয়ের পথ্য যদি ওঁর স্ত্রী করে দেন আর ওই পরিমলবাবু যদি হোটেলে খেয়ে আসেন তাহলে আর কোনও সমস্যা থাকে না।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন!’ মাথা নাড়লেন বনবিহারী।

সেক্রেটারি বললেন, ‘রতন, গাড়ি থামাও।’

দ্রুত সদানন্দের বারান্দায় চলে এসেও বৃষ্টিতে সামান্য ভিজলেন ওঁরা। আর তখনই বন্ধ দরজার ওপাশে সদানন্দের গলা শোনা গেল, ‘অত আদিখেদ হচ্ছে কেন?’ বলা নেই কওয়া নেই সাবু বানিয়ে ফেললে! এখন জিজ্ঞাসা করছ ভাতের সঙ্গে কী রান্না করবে? পরপুরুষ দেখলেই শরীর চিড়বিড় করে ওঠে, না?’

সঙ্গে-সঙ্গে নারী কণ্ঠে শোনা গেল, ‘তোমার মুখে পোকা পড়ে না কেন? ছিঃ।’

‘তা তো বলবেই। আমার নাকের ডগায় বসে আমারই পয়সায় যুবক ভাড়াটেকে খাইয়ে রাস্তা তৈরি করছ সেটা আমি বুঝি না?’ সদানন্দ গজগজ করল।

‘তোমার পয়সা মানে? ওঁরা তো বলে গেলেন স্কুল থেকে টাকা দেবেন!’

‘টাকা দেবে? কত টাকা দেবে? হোটেলে যেমন দশ টাকার বাজার করে কুড়ি টাকায় বিক্রি করি, ঘর থেকে তা করতে পারব? এই না হলে মেয়েছেলের বুদ্ধি!’ সদানন্দ বলল, ‘এক রামে রক্ষে নেই তার ওপর সুগ্রীব জুটেছে দোসর হয়ে। শোনো, ভাড়াটের জন্যে ছানা আর আলুসেদ্ধ করে দাও। ওই দাদাটার তো অসুখ হয়নি। সে তার রাস্তা ঠিক খুঁজে নেবে।’

‘বেশ। তুমি তো আজ বাড়ি থেকে নড়ছ না, তুমিই দিয়ে এসো।’

সংলাপগুলো শুনতে শুনতে সেক্রেটারির মুখ লাল হয়ে উঠছিল। তিনি বনবিহারীকে ইশারা করলেন আবার গাড়িতে ফিরে যেতে। গাড়িতে উঠে বললেন, ‘কী লজ্জার কথা! সদানন্দবাবু যে স্ত্রীর সঙ্গে ওই ভাষায় কথা বলেন আমি ভাবতেই পারিনি।’

বনবিহারী বললেন, ‘তরুণী ভার্যা, ফলে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে গেছেন।’

‘রতন, চলো।’

গাড়ি চললে সেক্রেটারি বললেন, ‘আমরা যা চেয়েছিলাম ওরা তো মোটামুটি সেরকম কথাই বলল। যদি অবস্থা আরও খারাপ হয় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও পথ নেই।’

বনবিহারী বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আর একটা রাত অপেক্ষা করা যায়।’

আপত্তি সত্ত্বেও সেক্রেটারি বনবিহারীকে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।

সুজয়ের পথ্য সদানন্দ পৌঁছে দিয়ে পরিমলকে বলেছিল, ‘দেখুন খেতে পারে কিনা! আরে মশাই হাসপাতালে যেরকম চিকিৎসা হয় তা কী করে বাড়িতে হবে? তবু মাতব্বররা যখন বলে গেলেন, চেষ্টা করে দেখুন। ও হ্যাঁ, চৌমাথায় একটা ভাতের হোটেল আছে। ভাত ডাল ভাজা তরকারি মাছের ঝোল খুব ন্যায্য দামে পাওয়া যাবে। আজ রাত্রি বলে মাংস পাবেন না। হোটেলটা বুঝলেন কিনা, আমারই। বেশি দূর নয় এখান থেকে। ঠিক আছে?’

পরিমল বলল, ‘ঠিক আছে। এখন দয়া করে যদি স্নান-পায়খানার জায়গাটা একটু দেখিয়ে দেন। অনেকদূর থেকে তো এসেছি!’

‘অবশ্যই। তবে কিনা, আমি একজনকে ঘর ভাড়া দিয়েছিলাম, দুজনকে নয়। তবে অসুস্থ মানুষ যখন তখন তার দাদাকে তো চলে যেতে বলতে পারি না। আসুন দেখিয়ে দিচ্ছি। ওই যে ভাড়াটের পায়খানা। আর এই কুয়োয় জল আছে, ব্যাটাছেলেরা এখানে কুয়ো থেকে জল তুলে চান করে। দড়িতে বাঁধা বালতি ওখানেই আছে।’

‘অনেক ধন্যবাদ।’

সদানন্দ চলে গেলে পরিমল ভেজা গামছা দিয়ে সুজয়ের শরীর যতটা পারল মুছিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘এই, উঠে বসতে পারবি?’

‘মাথা নাড়ল সুজয়, না।

‘চেষ্টা কর। শুয়ে-শুয়ে খেলে গলায় আটকে যেতে পারে।’

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘জানি। কিন্তু একটু কিছু না খেলে ওষুধ খাবি কী করে? জোর করে খেতে হয় এইসময়। ওঠ।’ সুজয়ের পিঠে হাত রেখে কোনওমতে বসিয়ে দিল পরিমল। তারপর চামচে করে একটু একটু ছানা এবং আলুসেদ্ধ খাওয়াতে লাগল। আলুসেদ্ধ খেয়ে মুখ বিকৃত করল সুজয়। পরিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হল?’

‘নুন দেয়নি!’

‘ভালোই তো। প্রেশার বাড়বে না।’

খানিকটা খাওয়ার পর মাথা নাড়ল সুজয়, ‘আর খাব না।’

জোর করল না পরিমল। তারপর প্রেসক্রিপশনটা দেখে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বলল, ‘জীবনে এই প্রথমবার আমি কোনও রোগীকে খাওয়ালাম।’

সুজয় ফ্যাকাশে হাসি হাসল। তারপর শুয়ে চোখ বন্ধ করল।

পরিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘বাড়িওয়ালার নাম কীরে?’

‘সদা-নন্দ।’

‘মানানসই নাম। শোন, তুই এখন ঘুমিয়ে পড়। আমি স্নান পায়খানা সেরে চৌমাথায় গিয়ে সদানন্দর হোটেল থেকে খেয়ে আসছি। তোর কাছে ছাতি আছে?’

মাথা নেড়ে নিঃশব্দে না বলল সুজয়।

দুপুরের পর বৃষ্টি একটু ধরল। মেঘগুলো দ্রুত সরে যেতে লাগল টিমলিং পাহাড়ের ওপাশে। সাড়ে তিনটে বাজলেই লেবুর পাতায় যত রোদ নামল পৃথিবীতে। একঝাঁক টিয়াপাখি ডানা ঝাপটে চলে গেল পশ্চিমে। আর তখনই নন্দলালবাবুর মেয়ে এসে দাঁড়াল সদানন্দর বাড়ির দরজায়।

দরজা খোলা। সদানন্দ তখন শুয়েছিল। পেট ভরে খেয়ে ছোট্ট একটা ঘুমের পর ভাবছিল তার একবার দোকানে যাওয়া উচিত। সারাদিনের অনুপস্থিতিতে কর্মচারীরা নিশ্চয়ই সাপের পাঁচ পা দেখছে। হিসেবের বাপ-মা থাকবে না। মুশকিল হল, অসুস্থ ভাড়াটে বিছানায় পড়ে আছে দেখে স্বচ্ছন্দে যাওয়া যায়, কিন্তু কোত্থেকে তার এক দাদা এসে জুটেছে এখন। জোয়ান পুরুষকে বাড়ির একপাশে রেখে কী করে যাওয়া যায়?

এই সময় বাইরের বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়ে সদানন্দ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’

নন্দলালবাবুর মেয়ে নরম গলায় জবাব দিল, ‘আমি!’

মেয়েমানুষের গলা শুনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল সদানন্দ। নন্দলালবাবুর মেয়েকে দেখে একটু অবাক হল। এই মেয়ে কারও বাড়িতে যায় বলে সে শোনেনি। স্কুলে পড়াতে যায় গম্ভীর মুখে, রাস্তার দিকে নজর রেখে হাঁটে।

সদানন্দ হাসল, ‘এসো, এসো। বাবা কিছু বলতে পাঠিয়েছেন?’

‘না।’ মাথা নাড়ল নন্দলালবাবুর মেয়ে, ‘এমনি এলাম।’

‘ও। এমনি।’ তারপর গলা তুলল, ‘শুনছ? কে এসেছে দ্যাখো!’

পাশের ঘরের বিছানায় একটু শরীর এলিয়েছিল সদানন্দর স্ত্রী, ডাক শুনে একটু বিরক্ত হয়ে বাইরের ঘরে এলে সদানন্দ বলল, ‘আমাদের নন্দলালবাবুর মেয়ে। আমাদের স্কুলে পড়াত। এই ভাড়াটে নতুন মাস্টার আসার পর—! যাকগে, তোমরা গল্প করো, আমি একটু দোকানটা দেখে আসি।’

পাজামার ওপর শার্ট চাপিয়ে প্রফুল্ল মনে বেরিয়ে গেল সদানন্দ। যাওয়ার আগে চেঁচিয়ে বলল, ‘বেশি দেরি হবে না, আমি না ফেরা পর্যন্ত থেকো কিন্তু।’

মুখ বেঁকিয়ে হাসল সদানন্দর বউ, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম শিবানী, না?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না!’ শিবানী বলল।

‘তুমি যতক্ষণ পারো থাকো। তুমি এখানে আছ জানলে উনি স্বস্তি পাবেন।’

‘সেকী? কেন?’

‘ভাববেন আমার পাহারায় তুমি আছ। আমি চরিত্রহীন হতে পারব না!’

‘এসব কী বলছেন আপনি?’

ঠোঁটে দাঁত চেপে কান্না সামলাতে লাগল সদানন্দর বউ, ‘আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মা-বাবা কবে মরে গেছে। মামা বিয়ে দিয়ে কাঁধ থেকে দায় নামিয়েছে।’

‘কিন্তু আপনি চরিত্রহীন হবেন বলে উনি সন্দেহ করেন?’

‘সব সময়। মাঝে মাঝে মনে হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু বিশ্বাস করো, সাহস পাই না। এভাবে কেউ ঘর করতে পারে? বলো? যাক গে, আমার কথা থাক। বসো।’ একটা মোড়া এগিয়ে দিল সদানন্দর বউ, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এসে পড়লে?’

‘না—না।’ শিবানী মাথা নাড়ল।

‘তোমাকে তো কোথাও দেখি না। অবশ্য আমিও তো বাড়ি থেকে বেরুই না।’

‘কাল রাত্রে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ওঁর মুখে শুনলাম যিনি স্কুলের মাস্টার হয়ে এসেছেন তিনি খুব অসুস্থ। আমি তো ক্যাজুয়াল টিচার ছিলাম। উনি জয়েন করলেই আমার চাকরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু অসুস্থতার জন্যে এখন পড়ানো সম্ভব নয় বলে আরও একমাস কাজটা করতে পারব। তাই আমার মনে হল, ওঁকে একবার দেখে আসা উচিত। বাইরে থেকে এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন!’

চোখ বড় করে শুনছিল সদানন্দর বউ। এবার শব্দ করে শ্বাস ফেলল।

শিবানী জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন উনি কেমন আছেন?’

‘কী জানি! ডাক্তারবাবু বলে গেছেন টাইফয়েড। হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। তবে আজ ওঁর এক দাদা এসেছেন কলকাতা থেকে। তিনিই সেবা করছেন।’ সদানন্দের বউ হাসল, ‘এই দ্যাখো, তোমার ইচ্ছে হল, তুমি এ-বাড়িতে চলে এলে ওঁকে দেখতে। আর আমি একই বাড়িতে থেকেও ওঁকে দেখতে যেতে পারি না।’

‘সেকী! কেন?’ শিবানী অবাক।

‘দেখতে গেলে ওঁর চোখে চরিত্রহীন হয়ে যাব যে!’

‘তাহলে থাক। আপনার কাছে তো শুনলাম। আমি যাই!’ উঠে দাঁড়াল শিবানী।

‘না—না। এসেছ যখন তখন দেখেই যাও।’ সদানন্দর বউ ওর হাত ধরল।

‘কিন্তু—!’

‘কোনও কিন্তু নয়। ওই পাশের টিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলে বাগান দেখতে পাবে। বাগানের শেষ দিকে কুয়োর পাশে যে ঘরটা আছে সেখানেই ওঁরা আছেন।’ সদানন্দর বউ বারান্দা অবধি এগিয়ে দিল।

শিবানী বাগানে ঢুকল। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া গাছগাছালির ওপর শেষ বিকেলের রোদ নেতিয়ে আছে। দু-পায়ে জড়তা নিয়ে সে ছোট্ট ঘরের বারান্দায় উঠে আসতেই পরিমল দরজায় এল, ‘হ্যাঁ বলুন!’

‘উনি কেমন আছেন?’ শিবানী জিজ্ঞাসা করল।

‘একটু ভালো! আপনি কি এই বাড়িতেই থাকেন?’

‘না—না। যে স্কুলে উনি পড়াবেন সেখানে আমি এখন পড়াই।’

‘ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন। আমি পরিমল, সুজয় আমাকে দাদা বলে। আসুন।’ পরিমল সরে গেল। তক্তাপোশ ছাড়া ঘরে একটা কাঠের চেয়ার ছিল। সেটি এগিয়ে দিল।

শিবানী ঘুরে ঢুকে দেখল মানুষটা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় ওর বয়স বেশি নয়।

পরিমল তক্তাপোশের ওপাশে গিয়ে ডাকল, ‘সুজয়! এই সুজয়!’

শিবানী হাত তুলল, ‘থাক না।’

তখনই চোখ খুলে পরিমলকে দেখল সুজয়।

পরিমল বলল, ‘তুই এখানকার যে স্কুলে জয়েন করেছিস তার একজন টিচার এসেছেন তোকে দেখতে। আপনার নামটা—?’

‘শিবানী।’

সুজয় মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। প্রথমে ঝাপসা লাগলেও পরে স্পষ্ট হল। সে হাসার চেষ্টা করল, ‘অনেক ধন্যবাদ।’

শিবানী পরিমলকে বলল, ‘কোনও কিছুর দরকার হলে বলবেন।’

‘তেমন কিছুর তো প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই। তবে টাইফয়েড হলে অনেকদিন বিশ্রাম নিতে হয় বলে শুনেছি। ও যে এভাবে এখানে এসে অসুখে পড়বে তা ভাবতে পারেনি। তাই টাকা-পয়সার সমস্যা হতে পারে।’ পরিমল বলল।

কী বলবে শিবানী বুঝতে পারল না।

পরিমল জিজ্ঞাসা করল, ‘স্কুল থেকে আগাম কিছু পাওয়া যায় না? পরে মাইনের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নেবে।’

শিবানী মাথা নাড়ল, ‘আমি বলব।’

‘খুব ভালো হয়।’ পরিমল খুশি হল, ‘আপনি কী পড়ান?’

‘কোনও বিশেষ সাবজেক্ট পড়াই না। যখন যে ক্লাস নিতে বলে, যাই। আমি তো পার্মানেন্ট স্টাফ নই।’

‘ও।’ গম্ভীর হল পরিমল।

এই সময় বনবিহারীর গলা শোনা গেল, ‘সদানন্দ বাড়িতে নেই? কেমন আছে আমার পেশেন্ট? চেম্বারে ঢুকলে তো সময় পাব না তাই এখনই এলাম।’

দরজায় পৌঁছে বনবিহারী দেখলেন শিবানী একপাশে সরে দাঁড়াল। তিনি বললেন, ‘ও, তুমি এসেছ! পেশেন্ট কেমন আছে?’

উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে এগিয়ে গিয়ে সুজয়ের নাড়ি পরীক্ষা করলেন তিনি। তারপর স্টেথো ব্যবহার করলেন। হেসে বললেন, ‘বেশ ভালো। আর হাসপাতালে যাওয়ার দরকার হবে না। তবে ভাই, পুরোপুরি সুস্থ হতে কয়েক সপ্তাহ লাগবে।’

শুনে মুখ মলিন হল সুজয়ের। বনবিহারী বললেন, ‘দেখি প্রেসক্রিপশনটা—!’

পরিমল কাগজটা এগিয়ে দিলে সেটা দেখে মাথা নাড়লেন বনবিহারী, ‘না। এগুলোই এখন চলুক। পরশু সকালে চেম্বারে এসে আমাকে জানাবেন। তখন দরকার হলে ওষুধ কমিয়ে দেব।’

‘আপনার চেম্বার কোথায়?’ পরিমল জিজ্ঞাসা করল।

শিবানী হেসে বলল, ‘এখানকার সবাই জানে। জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে।’

‘বিকেলে কী খেয়েছে?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘এখনও—, কী খেতে দেব?’

‘সেকী! এখনও কিছু খায়নি? না খেলে শরীর সারবে কেন? ফল কিনে আনুন। মুড়ি খাক। আলু সেদ্ধ করে গোলমরিচ দিয়েও দিতে পারেন। চারঘণ্টা অন্তর অন্তর অল্প অল্প খেতে হবে ওকে। এমনিতেই তো খাওয়ার আগ্রহ থাকার কথা নয়। জোর করে কিছু খাওয়াতে হবে।’ বনবিহারী দরজার দিকে পা বাড়াতেই পরিমল পেছন থেকে ডাকল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ডাক্তারবাবু?’

বনবিহারী তাকালেন। পরিমল জানতে চাইল, ‘হোটেল থেকে সহজে হজম করা যায় এমন খাবার এনে দিতে পারি?’

শিবানী চোখ তুলে তাকাতেই বনবিহারীর সঙ্গে চোখাচোখি হল। বনবিহারী বললেন, ‘সদানন্দর হোটেলে কি সেরকম খাবার পাওয়া যাবে?’

শিবানী বলল, ‘আপনি যদি বাবাকে বলে দেন তাহলে আমি দু-বেলা বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে এনে দিতে পারি!’

‘বেশ তো। তবে তোমার বাবাকে বলার আগে সেক্রেটারি সাহেবকে এই ব্যাপারটা জানানো দরকার। দেখছি।’ তিনি পা বাড়ানো মাত্র শিবানী সুজয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসছি।’

পরিমল কথা বলল, ‘আবার আসবেন।’

বাগানে নেমে দ্রুত বনবিহারীর পাশে এসে হাঁটার সময় সদানন্দর গলা কানে এল, ‘একী! মেয়েটা চলে গেল? বলে গেলাম না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে! কখন গেল সে?’

সদানন্দর বউয়ের গলা শোনা গেল টিনের দরজার কাছে পৌঁছে, ‘আস্তে কথা বলো। ডাক্তারবাবু এসেছেন। ওঁর সঙ্গে ভেতরে গেছে শিবানী।’

‘অ্যাঁ। ডাক্তারবাবু? তাই নাকি? আগে বলবে তো!’ বেশ দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এল সদানন্দ। ততক্ষণে বনবিহারী এবং শিবানী বাড়ির বাইরে চলে এসেছে। সদানন্দ বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখন কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?’

‘হাসপাতালে যাওয়ার আর দরকার হবে না।’ বনবিহারী দাঁড়ালেন।

‘অ।’ মুখটা যেন কালো হয়ে গেল সদানন্দর, ‘আমাকে তো ব্যবসার কাজে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হয়। অসুস্থ লোক বাড়িতে, কখন কী হয়ে যায় এই চিন্তায় মন দিয়ে কাজ করতে পারি না।’

‘না, না, কিছু হবে না। চিন্তা করবেন না। ও হ্যাঁ, বাড়িতে মুড়ি আছে?’

‘কী জানি! দেখতে হবে। হ্যাঁগো, বাড়িতে মুড়ি নেই, না?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল সদানন্দ।

‘আছে।’ ওর স্ত্রীর গলা ভেসে এল।

‘তাহলে খানিকটা বাটিতে করে ওকে দিয়ে আসুন।’

বড় রাস্তায় এসে বনবিহারী বললেন, ‘হয়তো ভুলই করলাম। হাসপাতালে গেলে ঠিকঠাক পথ্য হত। কিন্তু সেখানে তো বাড়ির পরিবেশ পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ওর শরীরের এখনকার অবস্থায় হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনও নেই।’

শিবানী হাঁটতে-হাঁটতে বলল, ‘সদানন্দকাকু বাড়ি ভাড়া দিয়ে এখন অস্বস্তিতে পড়েছেন। কাকিমার সঙ্গে আমার আজকে কথা হয়েছে।’

‘হুঁ!’ একটু চুপচাপ থেকে বনবিহারী বললেন, ‘তুমিও চলো আমার সঙ্গে। সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে আলোচনা করা যাক।’

‘না। না। আমার যাওয়া বোধহয় ঠিক হবে না।’

‘কেন হবে না! তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছ!’

সেক্রেটারির ঘরে নন্দলালবাবু তখন দাবার বোর্ড সাজাচ্ছেন। ফোনে কথা বলছিলেন সেক্রেটারি। ওঁদের দেখে ইশারায় বসতে বলে কথা শেষ করলেন। মেয়েকে ডাক্তারের সঙ্গে দেখে বেশ অবাক হয়ে নন্দলালবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই এখানে?’

‘আমি ওকে ধরে নিয়ে এলাম।’ বনবিহারী জবাবটা দিলেন।

সেক্রেটারি হাসলেন, ‘কী ব্যাপার? চেম্বারে না গিয়ে এই অসময়ে আমার স্কুলের টিচারকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছেন! কিছু হয়েছে?’

‘ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, বললাম, চলো আমার সঙ্গে।’ বনবিহারী কথাটা এড়িয়ে গেলেন, ‘আমি নতুন মাস্টারকে দেখতে গিয়েছিলাম। এখন ওর আর হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। ওর চিকিৎসা শুধু ওষুধ নয়, ঠিকঠাক পথ্যের ওপর নির্ভর করছে। আমার আশঙ্কা ওই বাড়িতে সেটা সম্ভব নয়।’

‘কেন?’ নন্দলালবাবু প্রশ্ন করলেন।

সেক্রেটারি হাত তুললেন তাঁকে থামাতে, ‘আমি আন্দাজ করেছি। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ওকে অন্যত্র সরানো দরকার। মুশকিল হল, আমার বাড়ির মহিলা এবং মেয়ে তো নীচের শহরে থাকে। কাজের লোকের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে কি?’

বনবিহারী বললেন, ‘ওখানকার চেয়ে অনেক ভালো হবে সেটা। তা ছাড়া ওই ছোট ঘরে একটাই তক্তাপোশ। নতুন মাস্টারের দাদার তো শোওয়ার জায়গা নেই।’

সেক্রেটারি বললেন, ‘আমার গেস্টরুমে সেই সমস্যা নেই।’

নন্দলালবাবু বললেন, ‘পেশেন্ট দু-বেলা কী খাবে বা না খাবে তা শিবানী এসে দেখে যাবে। ওকে তো বাড়ির কোনও কাজ করতে হয় না।’

বনবিহারী হাসলেন, ‘বাঃ, তাহলে তো কোনও চিন্তা নেই।’

এই সময় ফোন বাজল। তাতে কথাবার্তা বলে সেক্রেটারি শিবানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী খাওয়াবে বলো?’

‘কেন?’ শিবানী অবাক হল।

‘তোমাকে আরও ছয় মাস এক্সট্রেনশন দেওয়া হয়েছে। সুজয়বাবুর জয়েন করার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।’ সেক্রেটারি দাবার বোর্ডের সামনে বসলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *