দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ৫

পাঁচ

সকালবেলায় চেম্বারে ঢোকার মুখে বনবিহারী দেখলেন হোটেলওয়ালা সদুবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে হাতজোড় করায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার?’

‘আপনাকে একটু কষ্ট করে যেতে হবে ডাক্তারবাবু।’

‘কার কী হয়েছে?’

‘আর বলবেন না, যেচে উপকার করতে গিয়ে, থাক সে কথা। জ্বর তো আসতই, যেখানে ছিল সেখানে থাকলে বেঘোরে মরত। আমার হয়েছে জ্বালা। পদবি সেনগুপ্ত শুনে গৃহিণী আর স্থির থাকতে পারলেন না। আমাকে পাঠিয়ে আনিয়ে নিলেন। অথচ তিনিই ক’দিন আগে বলেছিলেন, অনেক হয়েছে আর ভাড়াটে রাখব না।’ সদানন্দ মাথা নাড়তে লাগলেন আপশোশের ভঙ্গিতে।

‘আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না সদুবাবু।’

ইতিমধ্যে আরও দুজন পেশেন্ট এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। যে ছেলেটা দোকান খোলে, ঝাড়পোঁছ করে সে তাদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসাল।

সদানন্দ ব্যস্ত হলেন, ‘আমাদের স্কুলে একজন নতুন মাস্টারমশাই এসেছেন। উঠেছিলেন কলোনির সস্তার ঘরে। দুপুরে খেতে এসেছিলেন হোটেলে, তখনই জানলাম তিনি বদ্যিবামুন। গৃহিণীকে সেটা বলায় কাল হল। তাঁকে ভাড়াটে করে নিয়ে এলাম কাল বিকেলে। রাত্রে খেতে যাননি শরীর খারাপ বলে। সকালে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ধুম জ্বর। মুখ লাল। ওঁকে দেখতে আপনাকে একটু কষ্ট করে যেতে হবে।’

‘নতুন মাস্টার?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কালই কলকাতা থেকে এসেছেন। আজ স্কুলে জয়েন করার কথা।’

‘ও। বাড়ি গিয়ে ওর মাথা ভালো করে ধুইয়ে দিন। দুপুরে ফেরার সময়ে আমি আপনার বাড়ি ঘুরে যাব।’ বনবিহারী চেম্বারে ঢুকলেন।

পেছন পেছন এসে সদানন্দ বললেন, ‘কিন্তু ওই সময়ে যে আমি হোটেলে থাকব!’

‘তাতে সমস্যা কোথায়?’

‘না, মানে, আপনাকে পেশেন্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে, যা ওষুধ দেবেন তা আনতে হবে। আমি না থাকলে—।’

‘আপনার স্ত্রী তো আছেন। হ্যাঁ, আপনি আসুন। বসুন। কী হয়েছে?’ প্রথম-আসা পেশেন্টকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বনবিহারী।

সদানন্দ প্রথমে ক্ষুণ্ণ হলেন, তারপর খানিকটা হতাশ মুখ করে চলে গেলেন।

বেলা বারোটা নাগাদ নন্দলালবাবু এলেন। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছে সে?’

‘একটু বেটার। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে এলাম।’

‘বলুন।’

নন্দলাল চারপাশে তাকিয়ে নিলেন। এখন কোনও পেশেন্ট নেই বটে কিন্তু দরজায় ডাক্তারবাবুর এখানে কাজকরা ছোকরা দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখছে। অনেকটা গলা নামিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো?’

‘প্রশ্নটা বুঝতে পারছি না।’

‘ওই যে বলে এলেন, এখনই ওর বিয়ে-থা-র কথা না তুলতে। ও কি কারও লভে পড়েছে? আমাদের বংশে এখন পর্যন্ত কোনও লভম্যারেজ দূরের কথা, কেউ লভে পড়েনি।’ নন্দলাল মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন।

হেসে ফেললেন বনবিহারী, ‘যাচ্চলে! হঠাৎ আপনার মাথায় এই ভাবনা এল কেন?’

‘ওর সঙ্গে কথা বলার পর আপনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন।’ নন্দলাল বললেন।

‘ওহো!’ হেসে ফেললেন বনবিহারী, ‘আপনার মেয়েকে আপনি চিনতেই পারেননি। সব মানুষকে এক চোখে দেখা ঠিক নয়। না, কারও প্রেমে পড়েনি সে। কিন্তু বাকি জীবনটা আত্মসম্মান বজায় রেখে বাঁচতে চায়। তার জন্যে একটা চাকরির দরকার।’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘আপনার মেয়ে অবিবাহিতা হয়েই থাকতে চায়। তার জন্যে ও ঠিক করেছে নিজের পায়ে দাঁড়াবেই। অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকলে স্বাধীনতা হারাতে হয়। আপনি চিন্তা করবেন না। আমার যদি এরকম মেয়ে থাকত তাহলে আমি গর্বিত হতাম।’ বনবিহারী বললেন।

গম্ভীর হয়ে গেলেন নন্দলাল। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চাকরি যেন হাতের মোয়া।’

‘চেষ্টা করতে দোষ কি!’

নন্দলাল যেভাবে বেরিয়ে গেলেন তাতে মনে হচ্ছিল বিরাট হার হয়ে গেছে তাঁর।

চেম্বার বন্ধ করে সদানন্দের হোটেলের সামনে পৌঁছে বনবিহারী দেখলেন বেজায় ভিড়। জায়গা না পেয়ে কিছু লোক বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সদানন্দ তাঁকে দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে এলেন, ‘কী অবস্থা! একটা বাস খারাপ হয়েছে ফলে তার যাত্রীরা চলে এসেছে খেতে! সামলাতে হিমসিম খাচ্ছি।’

‘কেমন আছেন তিনি?’

‘কোনও খবর পাইনি। চোখে তো সরষে ফুল দেখছি। দাঁড়ান।’ সদানন্দ ভেতরে গিয়ে একটা ছোকরাকে ধরে আনল, ‘ডাক্তারবাবুকে নিয়ে বাসায় যাবি। মাকে বলবি কোন ঘরে নতুন মাস্টার আছে তা দেখিয়ে দিতে।’ বলে তিনি হাতজোড় করলেন, ‘ওর সঙ্গে যান। আমি সন্ধেবেলায় চেম্বারে গিয়ে ফি দিয়ে আসব।’

সদানন্দর বাড়ি মিনিট আটেক দূরে। বাইরের দরজা বন্ধ। বাঁ-দিকের টিনের দরজা দিয়ে বাগানে ঢোকা যায়। ছেলেটা সেটা খুলে চিৎকার করতে লাগল, ‘মা, ও মা, মা, ডাক্তারবাবুকে বাবু পাঠায় দিছে।’

কয়েক সেকেন্ড বাদে সদানন্দের স্ত্রী কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে বাগানে এসে দাঁড়াল, ‘আসুন, উনি ওইদিকের ঘরে আছেন।’

ভদ্রমহিলাকে আগে কখনও দেখেননি বনবিহারী। মনে হল এর সদানন্দের সঙ্গে বয়সের ভালো পার্থক্য রয়েছে। বাগানের ওপাশে দেড়খানা ঘরের দরজা ভেজানো। সেটা খুলে একপাশে সরে দাঁড়াল সদানন্দর স্ত্রী। বনবিহারী ভেতরে ঢুকে দেখলেন সবক’টা জানলা বন্ধ থাকায় ঘর গুমোট গরম হয়ে রয়েছে। সামনের খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে যে যুবক তার পরনে পাজামা এবং গেঞ্জি।

বনবিহারী বললেন, ‘একী করেছেন? খুলে দিন, সবক’টা জানলা খুলে দিন। ঘরে আলো-বাতাস আসুক।’

সদানন্দর স্ত্রী বলল, ‘খুব জ্বর, শীত করছিল—।’

‘তাতে কী! ভেতরে গরম বাইরেও গরম, জ্বর কমবে কী করে?’

সদানন্দর স্ত্রী জানলাগুলো খুলে দিল। বনবিহারী ডাকলেন, ‘এই যে ভাই, এবার একটু চিত হয়ে শোন।’

সুজয় চোখ খুলল। তারপর ধীরে ধীরে চিত হল। ওর চোখ লাল। বনবিহারী তাকে ভালো করে পরীক্ষা করলেন। তারপর সদানন্দর স্ত্রীকে বললেন, ‘আধ বালতি জল আর একটা গামলা নিয়ে আসুন।’

ওরা বেরিয়ে গেলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী অসুবিধে হচ্ছে ভাই?’

সুজয় তাকাল। তারপর চোখ বন্ধ করল। কথা বলল না।

জ্বর দেখলেন বনবিহারী, একশো তিন। বুকেও সর্দি বসেছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শীত করছে? গায়ে কম্বল দেবেন?’

মাথা নেড়ে না বলল সুজয়। বনবিহারীর মনে হল এই জ্বর ম্যালেরিয়ার নয়। যদিও কলকাতা থেকে যারা আসে তাদের অনেকেই ম্যালেরিয়ায় কাবু হয়। এখনই এর রক্ত পরীক্ষা করানো দরকার। অনেক বলে কয়ে নীচের শহরের একটা প্যাথলজি সেন্টারের কালেকশন কাউন্টার খুলিয়েছেন এখানে। পেশেন্টের রক্ত কালেক্ট করে সেন্টারে পাঠিয়ে দেয়। পরের দিন রিপোর্ট এসে যায়। এতে প্রচণ্ড উপকার হয়েছে। চিকিৎসা করতেও সুবিধে হয়েছে তাঁর।

সদানন্দর বউ গামছা নিয়ে আর ছেলেটি বালতি আনলে বনবিহারী বললেন, ‘ওর গেঞ্জি তুলে বুক-পিঠে গামছা ভিজিয়ে স্পঞ্জ করে দিন। মাথাটাও ধুইয়ে দিতে হবে। শরীরের ভেতরের গরম না কমলে স্বস্তি পাবে না।’

সদানন্দর বউ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। বনবিহারী বললেন, ‘কী হল?’

সদানন্দর বউ বলল, ‘ও এত বাচ্চা, পারবে না। আমি করলে উনি একটুও খুশি হবেন না। খুব অশান্তি করবেন।’

‘সেকী! কোনও অসুস্থ মানুষকে সেবা করলে সদানন্দবাবু রাগ করবেন কেন?’

‘হাজার হোক, ইনি পুরুষমানুষ, চেনা-জানা নেই, মাত্র গতকাল এসেছেন।’

‘উঃ।’ নিজে ঝুঁকে গেঞ্জিটা শরীর থেকে বের করার চেষ্টা করলেন বনবিহারী। শায়িত মানুষের গেঞ্জি খোলা খুব কষ্টকর। বললেন, ‘একটু উঠে বসতে হবে ভাই, অন্তত মাথাটা তুলুন। শুনছেন?’ বনবিহারী হতাশ হয়ে সদানন্দর স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ‘মাথার পেছনটা ধরে একটু ওপরের দিকে তুলে ধরুন তো!’ বলেই খেয়াল হল, ‘ওহো, তাতে তো অচেনা পুরুষকে ছোঁয়া হয়ে যাবে।’

কোনওরকমে গেঞ্জি খুলে সুজয়ের ঊর্ধ্বাঙ্গ স্পঞ্জ করলেন বনবিহারী। তারপর শরীরটাকে টেনে একপাশে নিয়ে গিয়ে মাথা ধুইয়ে মুছিয়ে দিলেন। এসব করতে গিয়ে তাঁর পাঞ্জাবির কিছুটা ভিজে গিয়েছিল। কাগজ বের করে ওষুধের নাম লিখে বললেন, ‘এখনই ওপরের ওষুধটা খাইয়ে দিতে হবে। ওষুধগুলো কাউকে দিয়ে দোকান থেকে আনিয়ে নিন।’ তারপর ব্যাগ খুলে সিরিঞ্জ বের করে হাতের ভেইন খুঁজে বের করে রক্ত টেনে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। যাওয়ার পথে কালেকশন কাউন্টারে জমা দিয়ে বলে যাবেন কাল বিকেলের মধ্যে রিপোর্ট এনে দিতে।

‘সকাল থেকে কিছু খেয়েছে?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘না। কাল রাত থেকেই না খেয়ে আছে।’ সদানন্দর স্ত্রী জানাল।

‘না খেলে অসুখের সঙ্গে লড়াই করবে কী করে? বাড়িতে কী রান্না হয়েছে?’

‘দুপুরে বাড়িতে রান্না হয় না, হোটেল থেকে আসে। ভাত ডাল ভাজা একটা তরকারি আর রুইমাছের ঝোল এসেছে।’

বনবিহারী সুজয়ের গায়ে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খিদে পেয়েছে?’

‘সুজয় মাথা নাড়ল, না।

‘না বললে তো চলবে না। এক কাজ করো। একটা আলু চটপট সেদ্ধ করে নাও। জোর করে খাওয়াতে হবে। ওই ডাল ভাত আর আলু সেদ্ধ। যেটুকু পারে। সদানন্দকে বলো ওকে ফলের রস দিতে হবে। সঙ্গে সন্দেশ। আমি রাত্রে এসে দেখে যাব একবার। তখন দুটো রুটি আর ডাল তরকারি রেখো।’

কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকল সদানন্দর বউ। বনবিহারী ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেলেন সুজয়ের গলা, ‘মা!’

বনবিহারী দাঁড়ালেন, ‘শুধু ওষুধ নয়, এখন ওর দরকার সেবা। হ্যাঁ, ওর নাম কী?’

বিকেলে চেম্বারে বসামাত্র বনবিহারী দেখলেন সদানন্দ আর স্কুলের সেক্রেটারি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলেন। সেক্রেটারি বললেন, ‘তিন মিনিট সময় নেব আপনার।’

‘বসুন বসুন।’

‘সদানন্দবাবুর কাছে জানলাম আমাদের নতুন মাস্টার ওঁর বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আছেন। তাঁর শরীর অসুস্থ বলে আপনি দেখতে গিয়েছিলেন। আমি যেহেতু স্কুলের সেক্রেটারি তাই একটা দায়িত্ব থেকেই যাচ্ছে, বুঝতে পারছেন—?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী হয়েছে ওঁর?’

‘ঠিক বোঝা যাচ্ছে না এখনই। প্রথমে ভেবেছিলাম ম্যালেরিয়া কিন্তু লক্ষণ মিলছে না। রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছি, রিপোর্ট এলে বলতে পারব।’

‘কবে রিপোর্ট আসবে?’

‘আগামীকাল আশা করছি।’

‘কত জ্বর দেখলেন?’

‘একশো তিন ছিল দুপুরে।’

সদানন্দ বললেন, ‘সমস্যা হল, নতুন মাস্টারের পকেটে তেমন কিছু নেই। এই যে ওষুধ কিনলাম তার দাম আমাকেই দিতে হল। উনি স্কুলে জয়েন করলে হয়তো অ্যাডভান্স হিসেবে কিছু টাকা পেতে পারেন। কিন্তু অসুখের জন্যে জয়েন করতে পারেননি। বলেছিলেন, অ্যাডভান্স পেলে বাড়িভাড়ার টাকাও দেবেন। কিন্তু—।’

‘রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এলে তো আবার পেমেন্ট করতে হবে।’ স্কুলের সেক্রেটারি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখুন সদানন্দবাবু। একটি মানুষ সেই কলকাতা থেকে এখানে চাকরি করতে এসে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর কাছে এটা বিদেশবিভুঁই। কোনও পরিচিত মানুষ নেই। আপনি ওঁকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন। ডাক্তারবাবু যদি হাসপাতালে পাঠান তাহলে ঠিক আছে, নইলে ততদিন আপনি দেখাশোনা করবেন বলে সবাই আশা করবে।’

‘আশা করবে! আমি কখন সেটা করব? সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যবসার পেছনে ছুটতে হয়। আমার সময় আছে নাকি!’ সদানন্দ রেগে গেলেন।

‘আহা, আপনার স্ত্রীকে বলুন দেখাশোনা করতে।’

‘অসম্ভব। একটা উটকো লোককে সেবাযত্ন করলে লোকে যা তা বলবে।’

‘কেউ বলবে না। বললে আমার কাছে পাঠাবেন।’ সেক্রেটারি বললেন।

‘না। আপনার স্কুলের টিচার, আপনি ব্যবস্থা করুন।’

‘ঠিক আছে, কাল রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। আমি আমার একটি বৃদ্ধা কাজের মহিলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার বাড়িতে, স্ত্রীকে বলে রাখবেন।’

ওঁরা চলে গেলে বনবিহারীর মনে হল ছেলেটির বাড়িতে খবর পাঠানো দরকার। তারপর ঠিক করলেন ব্লাড রিপোর্ট পাওয়ার পর কাজটা করবেন।

পরদিন বিকেলে রিপোর্ট এল ম্যালেরিয়া নয়, সুজয়ের ম্যালেরিয়া নয়, টাইফয়েড হয়েছে। এখন নিয়ম করে ওষুধ খাওয়া আর পথ্যের ওপর ওর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা নির্ভর করছে। বিকেলেই রিপোর্ট নিয়ে সেক্রেটারি, হেডমাস্টার, সদানন্দ এবং নন্দলালের সঙ্গে বনবিহারী আলোচনা করলেন।

সদানন্দ বললেন, ‘টাইফয়েড? ওরে ব্বাবা, বাঁচবে তো?’

‘ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে আজকাল টাইফয়েডে কেউ মরে না।’ বনবিহারী হাসলেন।

হেডমাস্টারমশাই জানতে চাইলেন, ‘কতদিনে সুস্থ হবেন?’

‘সপ্তাহ তিনেক তো লাগবেই। তার আগেই অসুখ সেরে যাবে কিন্তু দুর্বলতা কাটতে ওই সময়টা লাগবে।’ বনবিহারী বললেন।

সেক্রেটারি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সদানন্দবাবু, আপনার বাড়িতে ওঁকে থাকতে দেবেন?’

‘আমার আপত্তি করার কি আছে বলুন। আমি তো ভাড়া পাব। তবে রোজ ওষুধ, খাবার, ফলের রসটস দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।’

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘উনি তো ভালো হয়ে স্কুলেই পড়াবেন। স্কুল থেকে অগ্রিম দেওয়া সম্ভব নয়?’

হেডমাস্টার বললেন, ‘জয়েন করে ক্লাস না নিলে সেটা বোধহয় দেওয়া যায় না।’

সেক্রেটারি চোখ বন্ধ করলেন, ‘বাইরের লোক, এখানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ঠিক আছে, আমি ওসবের খরচ সদানন্দবাবুকে দিয়ে দেব। উনি মাইনে পাওয়ার পর ধীরে ধীরে না হয় সেটা শোধ করে দেবেন।’

সদানন্দ একগাল হাসলেন, ‘চমৎকার! তাহলে তো সব সমস্যার শেষ। সত্যি, আপনার মতো হৃদয়বান মানুষ খুব কম দেখেছি।’

সেক্রেটারি উঠলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি যদি একবার দেখে যান ওঁকে!’

‘অবশ্যই। যাব। কিন্তু আপনাকে একটা অনুরোধ করব।’

‘বলুন।’ সেক্রেটারি তাকালেন।

‘যে ক’দিন ও জয়েন করতে না পারছে, সেটা তিন সপ্তাহ হলেও ছেলেমেয়েরা পড়া থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবে, তাই নন্দলালবাবুর মেয়ে এতদিন যেভাবে পড়াচ্ছিলেন সেভাবে পড়ানোর অনুমতি দিলে ভালো হয়।’ বনবিহারী হাসলেন।

‘ও। হ্যাঁ। তা দেওয়া যেতেই পারে। হেডমাস্টারমশাই, ও তো ভালোই পড়ায়?’

‘তা পড়ায়।’

‘তাহলে ওকে আবার ক্লাস নিতে বলুন।’ সেক্রেটারি চলে গেলেন।

রাত্রে বাড়ি ফেরার পথে সুজয়কে দেখতে গেলেন বনবিহারী। তখনও সদানন্দ হোটেল থেকে বাড়ি ফেরেননি। তাঁর স্ত্রী দরজা খুলে দিলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছে এখন? ও, আপনি তো দেখেননি!’

‘জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছি। ছটফট করছিল।’

‘আজ ওর মাথা ধোয়ানো নিশ্চয়ই হয়নি?’

‘হয়েছে। ওই বুড়িটাকে বলে আমি ধুইয়ে দিয়েছি। বয়স হয়েছে তো, ঠিক করে পারে না। চলুন।’ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল সদানন্দর স্ত্রী।

ঘরে একটা লণ্ঠন খুব কম আলো নিয়ে জ্বলছে। বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেই মহিলা কোথায়?’

‘বুড়ি তো আটটার সময় ওকে আধখানা রুটি আর ডাল খাইয়ে চলে গেল।’

‘দিনরাত শুয়ে থাকে, বাথরুম পায়খানা করে কখন?’

‘দিনের বেলায় বুড়ি দুবার ধরে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।’

বনবিহারী ভালো করে পরীক্ষা করলেন। জ্বর সামান্য কমেছে। সেক্রেটারি লোক পাঠিয়ে তাঁর প্রেসক্রিপশন নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা দেখিয়ে ওষুধ কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সদানন্দর স্ত্রী সেই প্যাকেটটা এনে দিল।

ওষুধগুলোর দিকে তাকিয়ে বনবিহারী বললেন, ‘সমস্যা। অশিক্ষিত বৃদ্ধার পক্ষে ওষুধ দেখে সময় মেপে ওকে খাওয়ানো সম্ভব নয়। শুনুন, আপনি ওষুধ খাওয়াতে পারবেন?’

মাথা নীচু করল সদানন্দর স্ত্রী। যদিও এখন সে ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে।

বনবিহারী বললেন, ‘লজ্জা-সংকোচ তখনই মূল্যবান যখন সেটা শোভন হবে। কিন্তু যখন কোনও মানুষের জীবন বিপন্ন তখন তাকে বাঁচতে সাহায্য না করে লজ্জার কারণে দূরে সরে থাকলে শুধু অমানবিক কাজ হবে না, অত্যন্ত পাপ করা হবে। আপনি সেটা করতে চান?’

‘না। কিন্তু উনি রাগ করবেন।’ নীচু গলায় বলল সদানন্দর বউ।

‘কেউ যদি অশিক্ষিতের মতো অন্যায় করে তাহলে তাকে সমর্থন করা কি ঠিক? ওঁকে না জানিয়েও তো কাজটা করা যায়। দিনের বেলায় বৃদ্ধাকে ওষুধ দিয়ে বলবেন খাইয়ে দিতে। দেখুন, এই ওষুধগুলো সকালে, খালি পেটে নয়, কিছু খাওয়ার পরে। এই ওষুধগুলো দুপুরবেলায় খাওয়ার পর। আর এগুলো রাত্রে। আমি তিনভাগ করে রাখলাম। আপনি চিনে নিন।’ সদানন্দর স্ত্রী এগিয়ে এসে ওষুধের নামগুলো পড়ে মাথা নাড়ল, ‘ঠিক আছে।’

‘গুড।’ তারপর বনবিহারী ডাকলেন, ‘সুজয়বাবু? শুনতে পাচ্ছেন?’

এবার সুজয় মুখ ফেরাল। চোখ ঘোলাটে।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী অসুবিধে হচ্ছে বলুন? আমি ডাক্তার।’

আবার মুখ ঘুরে গেল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল।

সদানন্দর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘ডাক্তারবাবু, বাঁচবে তো?’

‘নিশ্চয়ই। ওষুধ পেটে পড়ুক, দুদিন পরে জ্বর কমে গেলে পার্থক্য বুঝতে পারবেন।’

গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে সদানন্দর স্ত্রী বলল, ‘ওঁকে কি বলব আপনার ফি কাল সকালে পাঠিয়ে দিতে?’

‘সেটা ওঁর ওপর ছেড়ে দিন। আপনাকে কিছু বলতে হবে না।’

আধা অন্ধকারে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন বনবিহারী। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল এখানে। তাই মানুষের সঙ্গে জানাজানি হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। একজন ডাক্তারের পক্ষে যা সুবিধেজনক, আবার অসুবিধেও। আড়ালে থাকা যায় না।

‘ডাক্তারবাবু।’ মেয়েলি গলা ভেসে এল একটি বাড়ির বারান্দা থেকে। বনবিহারী চিনতে পারলেন, ওটা নন্দলালবাবুর বাড়ি। তাঁর মেয়ে প্রায় দৌড়ে এল কাছে। এসে ঝুঁকে তাঁকে প্রণাম করল। বনবিহারী বললেন, ‘একী! এসব কেন?’

‘আপনার জন্যে আমাকে আবার একমাস কাজ করতে বলা হয়েছে।’ হাসল সে।

‘বাঃ। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ নতুন মাস্টার বেশ অসুস্থ!’

‘হ্যাঁ। আচ্ছা, আমি ওঁকে দেখতে যেতে পারি?’

‘অবশ্যই। যাওয়া তো উচিত। উনি বাইরের মানুষ। বিপদে পড়েছেন।’

বনবিহারী আবার হাঁটতে লাগলেন। মেয়েটির কথা তাঁর খুব ভালো লাগল। বাবা-কাকার থেকে হাজার মাইল এগিয়ে। হঠাৎ মনে হল সুজয়ের অসুস্থতার কথা সন্তানকে জানাবেন কিনা! জানলেই ছুটে যাবে ছেলেটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *