দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ৩

তিন

জায়গাটাকে বেশ ভালো লেগে গেল সুজয়ের। সামান্য উঁচু-নীচু রাস্তায় রিকশা চলছিল শ্লথ গতিতে। দুপাশে লম্বা লম্বা গাছ। আকাশে মেঘ জমায় সূর্যের তেজ নেই। একটা চড়াই ভাঙতে রিকশাওয়ালাকে কষ্ট করতে দেখে সে বলল, ‘একটু দাঁড়াও ভাই।’

রিকশাওয়ালা থামলে সে নীচে নেমে বলল, ‘এখান থেকে স্কুল কত দূরে?’

‘দূর আছে।’

‘রাস্তাটা কি এরকম উঁচু-নীচু?’

‘না। আর একটু পরেই সমান রাস্তা পাওয়া যাবে।’

‘তাহলে সেই অবধি আমি হেঁটে যাচ্ছি, তুমি রিকশা নিয়ে চলো।’

‘আরে! আপনি হেঁটে যাবেন কেন?’ রিকশাভাড়া করে কেউ কি হেঁটে যায়?’

‘আমি যাব কারণ তোমাকে অত কষ্ট করা দেখতে চাই না।’

‘আপনি তো আজব লোক।’

‘কথা না বাড়িয়ে চলো।’

‘আপনি উঠে বসুন। এই রাস্তায় রোজ রিকশা চালাই। আমার অভ্যেস আছে।’

‘কেন কথা বাড়াচ্ছ?’ সুজয় হাঁটা শুরু করল।

রিকশাওয়ালা বলল, ‘আপনার মতলবটা খুলে বলুন তো? ভাড়া কম দেবেন বলে কি হেঁটে যাচ্ছেন? তাহলে শুনুন, আমি ভাড়া কম নেব না।’

সুজয় হেসে ফেলল, ‘না, যা ন্যায্য ভাড়া তাই তুমি পাবে।’

রিকশাওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিল, যদিও তার মুখ থেকে সন্দেহের ছাপ যাচ্ছিল না।

সেক্রেটারির বাড়ি স্কুলের কাছে নয়। সেখানে পৌঁছে রিকশা ছেড়ে দিল সুজয়। লোকটা যা ভাড়া চাইল তাই দিল দরাদরি না করে। কাঠের গেট খুলে বাগান পেরিয়ে একতলার যে ঘরের দরজায় সুজয় পৌঁছল সেখানে চারজন মানুষ গল্প করছেন। তাকে দেখে একজন গলা তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাই?’

‘স্কুলের সেক্রেটারি এই বাড়িতে থাকেন?’

‘হ্যাঁ। থাকেন।’

‘তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’

‘বলে ফেলুন!’

‘আপনিই কি—?’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন টাকমাথার ভদ্রলোক।

ব্যাগ থেকে খামটা বের করে এগিয়ে ধরল সুজয়। সেটি নিয়ে ভেতরের কাগজ বের করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেক্রেটারি চাপা গলায় বললেন, ‘তোমার মেয়ের কপাল পুড়ল নন্দলাল।’

‘মানে?’ পাশে বসা নাদুসনুদুস লোকটির কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। আজ যখন এসেছে তখন আজকের মাইনেটাও ওকে দেওয়া হবে।’ বলে সেক্রেটারি সুজয়ের দিকে তাকালেন, ‘এখন কি সরাসরি কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে না। অতদূর থেকে ট্রেনে এলে জামাকাপড়ে তার ছাপ পড়বেই। নোংরা হবেই। আপনি তো সবে পাটভাঙা পরেছেন।’

‘আপনি ঠিক বলেছেন। এখানে নেমে একটি কিশোরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে যখন জানল আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি তখন বলল ওই পোশাক দেখলে আপনি বিরক্ত হবেন। ওদের বাড়িতেই একটু পরিষ্কার হয়ে পোশাক বদলে নিয়েছি।’ সুজয় নরম গলায় বলল।

‘অদ্ভুত তো! প্রথম আলাপেই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে—, ছেলেটির বাবার নাম কী?’

‘ওর বাবার নাম জানি না কিন্তু ওর দাদু ডাক্তার। চৌমাথায় চেম্বার—!’

‘ডাক্তার বনবিহারীর নাতি সে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বুঝলাম। ঠিক আছে, আপনি স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করুন। কবে থেকে জয়েন করতে পারবেন?’

‘যদি বলেন আজ থেকে তাতেও অসুবিধে নেই।’

পকেট থেকে কলম বের করে সুজয়ের দেওয়া চিঠির এককোণে নাম সই করে দিয়ে ওটা ফেরত দিলেন সেক্রেটারি, ‘আমাদের এখানে চেনাজানা কেউ আছে?’

‘আজ্ঞে না।’

‘এই যে হুট করে চলে এলেন, থাকবেন কোথায়?’

‘না এসে উপায় ছিল না। চাকরিটা খুব দরকার। এখানে কি মেস আছে?’

‘আমার অন্তত জানা নেই। দেখুন। যান স্কুলে।’

বাইরে বেরিয়ে আসতে কানে এল, ‘লোকটা জেনুইন কিনা যাচাই করলেন না?’

‘চিঠিটা জাল নয়। লোকটা যদি জাল হয় তাহলে আজ নয় কাল ধরা পড়বেই।’

সুজয় বাইরে এসে দেখল রিকশাওয়ালাটা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সোজা হয়ে বলল, ‘চলুন।’

সুজয় জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি যে রিকশায় যাব তা জানলে কী করে? এখান থেকে স্কুলের পথটুকু আমি হেঁটেই যেতে পারব।’

‘না বাবু, ওই দুটো বোঝা নিয়ে হাঁটবেন কেন? আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না, আমি পৌঁছিয়ে দিচ্ছি।’

‘তুমি বলছ বটে কিন্তু পৌঁছে ভাড়া চাইলে মুশকিলে পড়ব। আমার কাছে বেশি টাকা নেই।’ সুজয় রিকশায় উঠল।

হেডমাস্টারমশাই তার আপাদমস্তক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এর আগে কোথায় পড়িয়েছেন? অভিজ্ঞতা আছে?’

‘আজ্ঞে না। কিন্তু কোনও অসুবিধে হবে না।’

‘অ। আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো তবে বাড়াবাড়িটা ভালো নয়। একটা সাইকেল চালাতে চাইলে প্র্যাকটিস করতে হয়, কয়েকবার আছাড়ও খায় লোকে। ঠিক আছে, কাল সকালে জয়েন করবেন। স্কুল শুরু হয় এগারোটায়, ‘আপনি সাড়ে দশটার মধ্যে আসবেন। কাগজপত্র তৈরি রাখা হবে।’ হেডমাস্টার বললেন।

‘এখানে কোনও মেস নেই?’

‘মেস? নাঃ।’ মাথা নাড়লেন হেডমাস্টারমশাই।

বাইরে বেরিয়ে এসে সুজয় দেখল রিকশাওয়ালাটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যাওয়ামাত্র লোকটা জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাবেন বাবু?’

‘সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। এখানে কোনও মেস নেই যে গিয়ে কথা বলব। আচ্ছা, এখানে নিশ্চয়ই ঘর ভাড়া পাওয়া যায়, ভাড়া কীরকম জানো?’ সুজয় জিজ্ঞাসা করল।

‘বাবুদের বাড়ির ভাড়া হাজার-দু-হাজার, আমাদের ওখানে দেড়-দুশো টাকায় ঘর পাওয়া যায়।’

‘দেড়শো-দুশো?’

প্রশ্ন শুনে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল লোকটা।

‘কীরকম ঘর?’

‘চিনের চাল, বাখারির দেওয়াল, ভালো। আড়াইশো দিলে সিমেন্টের মেঝে পাবেন। কিন্তু কল-পায়খানা একসঙ্গে। আপনি গিয়ে দেখতে পারেন।’

‘চলো।’ সুজয় মালপত্র নিয়ে রিকশায় উঠল। আপাতত মাথা গোঁজার একটা আস্তানা দরকার। লোকটা যে ভাড়ার কথা বলল তাতে ঘরের চেহারা কী হবে ভগবান জানে। ওখানে ক’দিন থাকলে স্কুলের সহকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যাওয়ার পর নিশ্চয়ই একটা ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

রিকশা ক্রমশ বাজার এলাকা ছেড়ে নির্জন পথ ধরল। ক্রমশ ফাঁকা মাঠ আর ছোট ছোট পুকুর পেরিয়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে বাঁক নিতেই বেশ কয়েকটা ঘর দেখতে পেল। চেহারার সঙ্গে কলোনির খুব মিল। একটা বাড়ির সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে লোকটা বলল, ‘একটু বসুন, আমি গিয়ে কথা বলি।’

লোকটা সামনের দরজা দিয়ে না ঢুকে বাড়ির পাশ দিয়ে চোখের আড়ালে গেল। সুজয় দেখল গোটা পাঁচেক শিশু বালক দূরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকে দেখছে। ওদের একজন ছুটে ভেতরে চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুজন মাঝবয়সি মহিলা দৌড়ে এসে একটু আড়ালে থেকে তাকে দেখতে লাগলেন।

রিকশাওয়ালা ফিরে এল, ‘বাবু, আপনার সঙ্গে মা-বউ কেউ থাকবে তো?’

‘মানে?’ হকচকিয়ে গেল সুজয়।

‘বুড়োবুড়ি আইবুড়ো ছেলেকে একা ঘর দেবে না। আমি তাই বলে এলাম আপনি একা থাকবেন না, ওঁরাও থাকবেন। আসুন।’

রিকশাওয়ালা মালপত্র নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে একটা উঠোনমতো জায়গায় তাকে নিয়ে এল, ‘এই যে কাকা, কথা বলুন।’

‘ও কী কথা বলবে? যা বলার আমি বলব। ঘর চাইছেন?’ বুড়ির বয়স অনুমান করা যাচ্ছে না। কথায় নাকিস্বর মেশানো। সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে আপনি বলবেন না। আমি বয়সে অনেক ছোট।’

‘অ। তা নাম কী? পুরো নাম বলো!’

‘সুজয় সেনগুপ্ত।’

‘সেনগুপ্ত? তার মানে বদ্যি বামুন। শুনলাম ইস্কুলে পড়াতে এসেছ?’

‘হ্যাঁ। নতুন চাকরি পেয়ে আজই এখানে এসেছি।’

‘এর আগে চাকরি করতে না?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সে কী! বেকার অবস্থায় বে-থা করেছ?’

‘না, না। আমি, মানে, আমার বিয়ে হয়নি।’

‘তাই বলো। তাহলে তোমার সঙ্গে থাকবে কে? আমরা তো কোনও ব্যাটাছেলেকে একলা থাকলে ভাড়া দেব না!’ ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগলেন বৃদ্ধা।

‘আহা, কাকিমা, উনি একা থাকবেন কেন? ওঁর মা আসবেন।’ রিকশাওয়ালা বলল।

‘তাই বলো। তা ভাড়ার কথাটা ওকে বলেছ?’ বলেই স্বামীর দিকে তাকালেন। ঘরের দাওয়ায় হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে কথাবার্তা শুনছিলেন বৃদ্ধ, মুখ তুললেন।

‘টাকাপয়সার ব্যাপারটা ছেলেদের বলা উচিত।’

‘দুটো ঘর খালি আছে। একটা দুশো, আর একটা আড়াইশো। ইলেকট্রিক নিলে আলো প্রতি দশ টাকা, ফ্যান চালালে কুড়ি টাকা। তো হল গিয়ে দুশো তিরিশ কিংবা দুশো আশি।’ বৃদ্ধ ঘোষণা করলেন।

বৃদ্ধা বললেন, ‘ঘর দেখে নাও। দরজা খোলাই আছে।’

রিকশাওয়ালা তাকে মেঝেতে সিমেন্ট করা ঘরে নিয়ে গেল। বেশ পরিষ্কার ঘর। একটা খাটিয়া আর টেবিল-চেয়ার রয়েছে। চার-চারটে বাখারির জানলা। রিকশাওয়ালা বলল, ‘দুশোরটা এর কাছে আসে না। এটাই নিয়ে নিন।’

‘এখন কত দিতে হবে?’

‘ওই তো, একমাসের অগ্রিম ভাড়া আর একমাসের জমা। তার মানে পাঁচশো। আলো-পাখার জন্যে এখন দিতে হবে না।’

সুজয় ঢোঁক গিলল। আগামীকাল স্কুলে জয়েন করে সামনের মাসের মাইনে থেকে অগ্রিম টাকা চাইলে হেডমাস্টার দেবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। আজ লোকটির কথাবার্তা মোটেই ভালো লাগেনি তার।

সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে বাইরে এসে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, ‘ওই আড়াইশো টাকারটাই নেব। কিন্তু, আজ নয় আমি কাল থেকে এখানে থাকব।’

বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল থেকে কেন?’

‘কাল থেকে স্কুলের চাকরি শুরু হবে। শুরু না করলে তো অ্যাডভান্স পাব না। ঢোকার সময় আপনাদের তো পাঁচশো টাকা দিতে হবে।’

বৃদ্ধ ক্যাটকেটে গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পকেটে কিছু নিয়ে আসোনি?’

‘থাকলে নিয়ে আসতাম। আমি কাল স্কুল ছুটির পর আসব।’ সুজয় তার ব্যাগের দিকে তাকাল, ‘এটা এখানে রেখে যেতে পারি?’

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন, ‘রেখে যেতে হবে না। থেকেই যাও। তবে আজ থেকে নয়, কাল থেকে তোমাকে ভাড়াটে বলে ভাবব।’

মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে রিকশাওয়ালা বলল, ‘বাঁদিক দিয়ে গেলে দশ মিনিট হাঁটলেই চৌমাথায় পৌঁছে যাবেন। সেখানে একটাই ভাতের হোটেল আছে। আপনাকে তো চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজের সঙ্গে একটা জনতা স্টোভ কিনতে হবে। ওই চৌমাথার দোকানেই সব পেয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা হ্যারিকেন নেবেন। আর হ্যাঁ, ওসব জ্বালাতে যে কেরাসিন দরকার হবে তা কাকিমাকে বললে পেয়ে যাবেন।’

‘কী করে?’

‘এই কলোনির একজন কেরাসিন বিক্রি করে, বললেই ঘরে দিয়ে যাবে।’

‘তোমার ভাড়াটা নাও।’ পকেটে হাত ঢোকাল সুজয়।

‘নেব। মাইনে পান, হাতে টাকা আসুক তখন চেয়ে নেব।’ রিকশাওয়ালা চলে গেল।

স্নান কুয়োর জলে, জায়গাটা ঘেরা। পাশেই পায়খানা। সারাদিনে একবারই যেতে হবে। এ নিয়ে মনে অসন্তোষ রাখার কোনও মানে হয় না।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একইভাবে বারান্দায় বসেছিলেন। বৃদ্ধা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সঙ্গে তালা আছে? যদিও এখানে চুরিচামারি হয় না তবু সাবধানের মার নেই।’

‘এখন খোলা থাক। ফেরার সময় নিয়ে আসব।’

‘অ। যাচ্ছ কোথায়?’

‘চৌমাথায়।’

বৃদ্ধ বললেন, ‘খেতে যাচ্ছ বোধহয়। তাড়াতাড়ি যাও। দুটোর সময় ওই ভাতের হোটেল বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের তো এবেলার খাওয়া হয়ে গেছে নইলে তোমাকে দু-মুঠো দেওয়া যেত। যাও।’

বেরিয়ে আসতে আসতে কানে এল, বৃদ্ধা ধমক দিচ্ছেন, ‘বড্ড বাজে কথা বলো তুমি। কতবার বলেছি বেশি কথা বলবে না। বেশি বললেই বাজে কথা বলবে। ঘরে যে এবেলায় খাবার নেই তা ওকে বলার কি দরকার ছিল? অ্যাঁ?’

সুজয় হেসে ফেলল।

সাত টাকায় ডালভাত ভাজা এবং তরকারি হয়ে গেল। এই প্রথম সুজয় কোনও হোটেলওয়ালাকে বলতে শুনল, ‘নিরামিষ খেতে পারলে বসুন, মাছ-মাংস দিতে পারব না।’

‘কেন?’ বেঞ্চিতে বসে জিজ্ঞাসা করল সুজয়।

‘রুইমাছ দুটো পিস পড়ে আছে। ল্যাজা, তাও ভেঙে গেছে। মাংস শেষ। ওই মাছ নিজেরাই খেতে পারব না, খদ্দেরকে কেন দেব?’

রান্না ভালো, বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে নিল সুজয়। এখন দোকানে খদ্দের বলতে শুধু সে। ওদিকে ঝাঁপ বন্ধ হচ্ছে। বোঝাই যায় খুব কম খদ্দের এই দোকানে আসে।

দাম দেওয়ার সময় সে জিজ্ঞাসা করল, ‘একার জন্যে থালা-বাসন, জনতা স্টোভ ইত্যাদি কিনব। দোকানটা কোথায়?’

হোটেলওয়ালা বেশ চর্বিওয়ালা মানুষ। গেঞ্জি ভিজে শরীরের সঙ্গে সেঁটে গেছে। জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে নতুন মনে হচ্ছে!’

‘হ্যাঁ। আজই এসেছি।’

‘কী করা হয়?’

‘এখানে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছি।’

‘অ। উঠেছেন কোথায়?’

‘ওই ওপাশের কলোনিতে ঘর নিয়েছি।’

হোটেলওয়ালার চোখ পিটপিট করল, ‘পুরো নামটা জানতে পারি?’

‘সুজয় সেনগুপ্ত।’

‘এত জায়গা থাকতে ওখানে কেন গেলেন! ওখানে বামুন, কায়েত, বদ্যি একঘরও পাবেন না। যাক গে, নিজে রান্না করে খাওয়ার কী দরকার, এখানে মাসচুক্তিতে খেলে পরিশ্রম বাঁচবে, খরচও বেশি হবে না।’

‘অতদূর থেকে রাতবিরেতে আসা, তারপর শুনেছি এখানে খুব বৃষ্টি হয়!’

‘তা হয়। রাতটা বাদ দিন। স্কুলে যাওয়ার পথে এখানে খেয়ে যেতে পারেন। নিরামিষ খেলে মাসে দুশো দশ হয়, আপনি একশো নব্বুই দেবেন। আমি নিজে বদ্যি বামুন বলে আপনাকে এত কথা বলছি।’ টাকা নিলেন হোটেলওয়ালা।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসল সুজয়। ছেলেবেলা থেকে কথাটা সে শুনে আসছে। বদ্যিকে বদ্যি না দেখিলে দেখিবে কে? যিনি চাকরি দেবেন তিনি যদি দেখেন আবেদনকারীদের মধ্যে বদ্যি আছেন তাহলে তাকে চাকরি দিতে যদি কিছু বেনিয়ম কাজ করতে হয় তাও করবেন। অথচ তার এত দুর্ভাগ্য আজ পর্যন্ত কোনও বদ্যি ব্রাহ্মণের দেখা পায়নি যিনি উপকারের হাত বাড়িয়ে দেবেন। আজ দেখা হল। এক ধাক্কায় কুড়ি টাকা কমে গেল সেই কারণে।

জিনিসপত্র যা দরকার তার সবটা কেনা হওয়ার আগেই পকেটের টাকা প্রায় শেষ হয়ে গেল। কাল যদি স্কুল থেকে অগ্রিম না পাওয়া যায় তাহলে—। নাঃ, কালকের কথা আজ ভাববে না সে।

ঘরে ফিরে এসে খাটিয়ার ওপর বিছানা করে আরাম করে বসল সে। এইসময় বৃদ্ধার গলা শুনতে পেল, ‘এই নাও।’

সে ঝটপট দরজা খুলে দেখল বৃদ্ধা এক হাতে একটা কুঁজো আর অন্য হাতে ছিপি আঁটা বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, ‘কুঁজো কিনে ফেরোনি দেখলাম। এটা পরিষ্কার, বাড়তি। কুয়ো থেকে জল ভরে নাও। গ্লাস কিনেছ?’

মাথা নাড়ল সে, হ্যাঁ। বৃদ্ধা বললেন, ‘বেশ। আর এতে যে কেরাসিন আছে তাতে কাল অবধি চলে যাবে তোমার। যে লোক কেরাসিন বিক্রি করে সে আজ আসতে পারবে না। কাল ওর কাছ থেকে কিনে এই শিশিতে ফেরত দিও।’ বৃদ্ধা বস্তু দুটো বারান্দায় রেখে ফিরে গেলেন।

আধঘণ্টা পরে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ডায়েরি রেখে কলম বের করল সুজয়। ডায়েরির অর্ধেকটা ইতিমধ্যে ভরে গেছে। তারপরে আজকের তারিখ দিয়ে সে লেখা শুরু করল, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয় যেখানে বিপ্লব সম্ভব হয়েছে সেখানকার আবহাওয়া (প্রাকৃতিক নয়) নিশ্চয়ই বিপ্লবের অনুকূলে ছিল। নিষ্পেষিত হতে হতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন সামনের দিকে হাত আপনি উঠে যায়। বাঁচার জন্য মানুষ যখন মরিয়া হয় তখন তার হারাবার ভয়ডর থাকে না। একজন থেকে দশজন, দশ থেকে একশো, হাজার, লক্ষে তখন সেই মরিয়াভাব সংক্রামিত হয়, তখন তাকে কোনও পশুশক্তি দমন করতে পারে না।

এসব তথ্য বই থেকে জানা। কিন্তু আমি জানি না সেইসব দেশের গরিব মানুষরা কীরকম জীবনযাপন করত। আবার ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মানুষ জানে না তারা নিষ্পেষিত কিনা! তারা জানেই না কেউ তাদের শোষণ করছে কিনা! তারা নিজেদের মতো করে বাঁচার ব্যবস্থা করে নেয়। তাতেই ভালো থাকে। যার তেমন কিছু নেই সে আবেগে আক্রান্ত হয়ে তার চেয়ে নিঃস্বকে দান করে অনায়াসে।

হঠাৎ বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এল, ‘আচ্ছা, নতুন মাস্টার কি এখানে থাকেন?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *